বিলাসীর জীবন (গল্প )
মাকসুদা খাতুন দোলন
বড় আপা, তোমার বাসায় এসে শান্তি নেই!বাচ্চাদের চিৎকার,কান্নাকাটি! একটা হাসে তো আর একটা কাঁদে! এত বাচ্চা কারো থাকে? তিনটে মেয়ে, দুটো ছেলে। সবগুলো পিঠাপিঠি। আমি কিন্তু তোমার মতো সেকেলের নই! দুটো বাচ্চার উপর নিবই না। একটা ছেলে একটা মেয়ে ব্যাস! আর বাড়বে না!
কথা না বলে, টুসিকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে একটু ঘুম বাড়িয়ে দে! ঘুমের জন্য আমার পিছন পিছন ঘুরছে।তোর দুলাভাই গোসল করে এসেই ভাত চাইবে। দেরি তার সহ্য হয় না।
-সরি, বড় আপা! টুসির নাক দিয়ে ঠাণ্ডা ঝরছে। গায়ের জামা ময়লা। আমি ওকে কোলে নিতে পারবো না। দুলাভাই যত তাড়াতাড়ি করবে তুমি ততই দেরি করবে তাহলে শিক্ষে হবে। জানে না, ঘরে এতগুলো বাচ্চা? আর বাচ্চাগুলি তো তার জন্যই হয়েছে।
-তোর এত কথা বলতে হবে না বিলাসী! তুই এখন যা আমার বাসা থেকে,যা ভাগ! আর আসবি না আমার এখানে।
বিলাসী যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। গুনগুনিয়ে গান ধরে,”প্রেম এসেছিল একবার নীরবে”
-আ রে শ্যালিকা! কোথায় যাও? আসো, আসো কতদিন তোমার গান শুনি না। একসাথে ভাত খাই। খাওয়ার পর একটা সুন্দর গান শুনাবা।
-না,দুলাভাই। আপার মাথা এখন হট আছে। গান শুনলে আমার মাথায় বাড়ি বসাবে। তার চেয়ে বরং আমি এখন যাই। দুলাভাই একটা কথা, আপনাকে দাড়ি রাখতে বলছে কে? আর বাসায় লুঙ্গি পরেন ক্যান? টিভিতে নাটকে দেখেন না ছেলে মানুষ গেঞ্জির সাথে ট্রাউজার পরে। আপনিও সেগুলো পরবেন। অনেক স্মার্ট লাগবে।
-তুমিই আমায় বুঝলে যে আমি কত সুন্দর! তোমার আপার পাল্লায় পড়ে আমার জীবন শেষ। ডানে,বামে শিথানে,পৈথানে শুধু পোলাপান। সকালের ব্রেকফাস্ট দেয় লাঞ্চের সময়। আর লাঞ্চেরটা চলে যায় ডিনারে।
জাহান রাগে চোখ লাল করে বড় বড় করে তাকাতেই বিলাসী বললো, বড় আপা, আমি যাই। বাই টা টা।
জাহান স্বামীর চাকরির সূত্রধরে বাবার বাড়ির কাছাকাছি বাসা নিয়ে থাকে। সাত ভাই-বোনের মধ্যে বিলাসী চতুর্থ। বোনদের মধ্যে দ্বিতীয়, জাহানের ছোট। কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। কবিতা, গান নিয়ে থাকে। ঘর সংসারের কাজ ভালো লাগে না। শিখতেও চায় না। মা কোনো কাজের কথা বললে,”আমাকে কাজ করতে বলবা না। আমি অনেক লেখাপড়া করবো। চাকরি করবো। কাজের লোক কাজ করবে। দু’তিনটে কাজের মানুষ থাকবে। বাচ্চাদেরও পেলেপুলে বড় করবে কাজের মানুষ।”
বাবা হজ্জ করে আসার পর বিলাসীর বিয়ের চিন্তা শুরু করেন। বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। দেখতে সুন্দরী, কথাবার্তায় আধুনিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বিলাসী বিয়ের নামই শুনতে পারে না। মা’কে বলে,
– মা, আমি কি খারাপ ছাত্রী? মেট্রিকে ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছি দুইটি লেটার সহ। খারাপ ছাত্রীরা লেটার পায় না। বড় আপার মতো আমাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিবা না। জানি,তুমি কিছু করতে পারবে না। কারণ, আব্বার কথার উপর তুমি টু শব্দটি করতে পারো না।
-তোর আব্বা হজ্জ করে আসছেন। তাবলীগ জামায়াত করেন। কোরআন হাদিস আমার চেয়ে অনেক জানেন। তোর আব্বার কথার উপর কোনো বিষয়ে আজ পর্যন্ত কথা বলিনি। তোর এত পড়ার শখ,জামাই বাড়ি গিয়ে পড়িস।
পাশের গ্রামের সরকার বাড়ি থেকে বিলাসীর বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র বাবার একমাত্র ছেলে,তিন বোনের একমাত্র ভাই। গ্রামের মধ্যে আর্থিক দিক দিয়ে সবার উপরে। পাত্র বি কমে পড়ে, নূরানি চেহারা। ফর্সা,লম্বা মুখে খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ি এককথায় সুদর্শন। মফিজ সরকার বউয়ের অসুস্থতার জন্য একমাত্র ছেলের বিয়ে করিয়ে নতুন বৌ ঘরে তুলবেন। বিলাসীর বাবা এবং ভাইদের খুব পছন্দ হয় বিয়ের সমন্ধ। কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়।
এক শুক্রবার বিলাসীকে দেখতে আসেন বরপক্ষের লোকজন। পাত্রী তাদের পছন্দ হয়। হাতে আংটি পরিয়ে দেন বিলাসীর শ্বশুর। ঐদিনই বিয়ের কাবিন হয়। পাত্র কনে দেখতে আসেনি। মা-বাবার খুব ভক্ত। মা’কে জানিয়ে দিয়েছে,”তোমাদের পছন্দ মতো মেয়েকে বৌ করে ঘরে আনো। আমার আপত্তি নেই”
বিলাসীর বাবা কৃপণ স্বভাবের মানুষ। মফস্বলে বিশাল সম্পদের মালিক। কিন্তু নগদ টাকা খরচ করতে কলিজা কাঁপে। বড় ভাইয়েরা সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বিয়ে করে সবাই আলাদা। টাকা খরচ করে বোনের বিয়ে জাঁকজমক ভাবে করার জন্য এগিয়ে আসেনি। বাবাকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় নি। অল্প পরিসরে কাছের কিছু মানুষকে দাওয়াত করে বিলাসীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিলাসী স্বামীর বাড়ি যাওয়ার আগে মা’কে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,”কপালে কি আছে জানি না।বিয়ে প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ। তোমরা আমার সুখ-শান্তির জন্য বড় ঘরে বিয়ে দিলে। সবকিছু যেন ভালো হয়।”
বড়বোনকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলে,”বড় আপা, তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি! পারলে ক্ষমা করে দিও।”
বিলাসীর জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু। বউ হয়ে সরকার বাড়িতে এসেছে। বাড়ির বড় উঠোনে হাতল ওয়ালা কাঠের চেয়ারে গা ভর্তি গয়না পরে বসে আছে দু’ঘন্টা ধরে। পায়ে ঝি ঝি ধরে গেছে। লাইন বেঁধে মহিলা ছোট বাচ্চারা আসছে মফিজ সরকারের একমাত্র ছেলের বউকে দেখার জন্য। গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মুরুব্বি
বিলাসীকে দেখে বলেন,
” দেখতে তো তুমি পাহা আমডার লাহান! ধান-বনের কাজ কাম জানো তো? হুনলাম, তোমারে নাকি শহরের বড় ঘর থেইক্কা আনছে।”
বিলাসী কোনো উত্তর দিল না।শুধু তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মনে মনে বিড়বিড় করছে, চিড়িয়াখানার জীব আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কী জ্বালায় পড়লাম? কখন আপদগুলো বিদায় হবে? খানিকক্ষণ পর ফর্সা করে সুঠাম দেহের একজন মহিলা সবাইকে ঠেলে বিলাসীর কাছে আসলো।
“দাদি,নানি,চাচি আন্ডাবাচ্চা তোমরা সবাই এখন যাও। নতুন বৌ বিশ্রাম করবো!”
সবাই চলে যাওয়ার পর বিলাসীকে নিয়ে ময়না ঘরে আসে। লাল রংয়ের সুতি শাড়ি বের করে বলল,
-ভাবী এইডা পরেন! আমি বাইরে দাঁড়াই! আফনেরে কলপাড়ে নিয়া যাই। হাত-মুখে পানি দিবেন।
বিলাসী লাল শাড়ি হাতে নিয়ে বলল,
-আপনি আমার শ্বশুর মফিজ সরকারের সম্পর্কে কী হন?
-আমার নাম ময়না।আফনি আমারে তুমি কইরা ডাকবেন। সরকার বাড়িতে আছি পাঁচ বছর। এই দুইকূলে আমার কেউ নেই! বিয়ের এক বছরের মাথায় প্রথম স্বামীডা মইরা গেল! এরপর বাপজান আবারও বিয়া দিল। বিয়ার প্রথম বছরেই দুইডা জমজ মাইয়া হইলো। মাইয়াদের বয়স যখন ছয় নিউমোনিয়ায় মইরা গেল। কামের কথা কইয়া এই যে গেল শহরে! স্বামী আর ফিরলো না!
বাড়ি ভর্তি লোকজন। রাতে ননদরা বিলাসীকে নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে শাশুড়ির ঘরে নিয়ে যায়। অসুস্থ শাশুড়ি নতুন বৌকে দেখে প্রাণ ফিরে পান। বিলাসী পা ছুঁয়ে সালাম করে। কাছে টেনে বৌ’কে আদর করে বলেন,”লক্ষী ঘরে এসেছে! আমি শরীরে শক্তি ফিরে পেয়েছি!কাল থেকেই হাঁটতে পারবো। ফটোতে যে রকম দেখেছি। বৌ মা তার চেয়ে অনেক সুন্দর !!কী বলিস তোরা?
বিলাসীর এক ননদ বলল,শহরের শিক্ষিত মেয়ে। তোমাদের যত্নের ত্রুটি করবে না।
রাত বাড়ছে। সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। বিলাসী টিনের ঘরে জরি দিয়ে সাজানো খাটে বসে ভাবছে, নতুন বাড়ি,অচেনা মানুষ, অচেনা পরিবেশ। সবাই কেমন মনের মানুষ হবে জানি না। যার সাথে বিয়ে
হয়েছে, তার সাথেই ভালো করে কথা বলা হলো না। আজ বাসর রাত,এত রাত পর্যন্ত বাইরে কি কাজ থাকতে পারে? নানা ভাবনায় স্বামী আসার অপেক্ষার
প্রহর গুনছে। হঠাৎ ঘরের পিছন দিক থেকে ফিসফিস শব্দ শুনে ভয় পেয়ে যায়। কিছু সময় চুপ থেকে শোনার চেষ্টা করে। ধীর পায়ে এগিয়ে শুনতে পেলো,”ঘরে নতুন বৌ আইছে, যদি আমারে ভুইল্লা যাও, তাহলে আমি এই বাড়িতেই গলায় ফাঁস দিমু!”
বিলাসী কারেন্ট শকড খাওয়ার মতো ছিটকে পড়ে খাঁটে। প্রচন্ড ধাক্কায় তার সব স্বপ্ন কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার। ভিতরে ঘামতে থাকে। হাত পা অবশ হয়ে আসে। শক্তি হারিয়ে ফেলে। চোখ দুটোতে পানি জমে ঝাপসা হয়ে আসে সবকিছু। দরজায় শব্দ হতেই চোখ মুছে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলার আগে জানতে চাইলো, -কে?
-বিলাসী, দরজা খুলো! আমি পরান।
বিলাসী দরজা খুলে আগের জায়গায় গিয়ে বসে। কোনো কথা বলল না। পরান জামা কাপড় ছেড়ে খাঁটে আসে।
-এতরাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে? আজ বাসর রাত ভুলে গেছো?
-আর বলো না! আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে। তাদের সাথে আড্ডা দেই। আর বিয়ের রাতেই কেন এত
কৈফয়ত চাইছো?
-কৈফয়ত না। স্ত্রীর অধিকার নিয়ে জানতে চাই। আজ থেকে দুজনে একসাথে পথ চলা শুরু।
-এত জ্ঞান দিতে এসো না। আমার মন মতো চলবো। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমাও এখন।
বিলাসীর সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার । মনের কোনো কথা,জীবনের শখ,আহ্লাদ,ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিছুই স্বামীর সাথে শেয়ার করতে পারেনি। জানাতে পারেনি মনে লুকিয়ে থাকা আশা,আকাঙ্ক্ষার কথা। পরান স্বামীর অধিকারে শুধু বিলাসীর দেহটাকে ভোগ করতে থাকে দিনের পর দিন হিংস্র পশুর মতো।
দীর্ঘদিন সরকার বাড়িতে কাজ করে সুন্দরী ময়না সবার মন জুগাতে ব্যস্ত। খুব চালাক,ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করে। সংসারের অনেক কিছুই ময়নার হাতে। বিয়ের পর বিলাসী অনেক চেষ্টা করে সবার আগে ঘুম থেকে উঠার। প্রায়ই দেরি হয়ে যায়। শাশুড়ি ডেকে বলেন,
“বেলা করে ঘুম থেকে উঠা চলবে না। শহরের ভাবসাব ছাড়ো।যদি সকালে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠতে না পারো। বাপের বাড়ি গিয়ে পড়ে থাকো।”
শাশুড়ির মুখে এই কথা শোনার পর বিলাসী কোনো জবাব দেই নি। মনে মনে ভাবে,থাক দেরি করেছি বলেই
দু’চারটা কথা শুনিয়েছেন মেনে নিলাম। কিন্তু কথায় কথায় মা,ছেলে বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে কেন?
এরপর বললে সত্যিই চলে যাবো।
প্রায়ই দেখে ময়না সবার আগে ঘুম থেকে উঠে, রান্না করে নিজেকে পরিপাটি সাজে সবাইকে খাওয়াচ্ছে। বিলাসীর ইচ্ছে হলো স্বামীর সাথে এক সাথে বসে ভাত খাবে। ময়না জোর করে আগেই ভাত বেড়ে বিলাসীকে খেতে বসিয়ে দে। কাউকে বিলাসীর সাথে বসে খেতে দেয় না। সবাইকে বুঝায়, বিলাসী শহর থেকে আসছে
তাই তাকে আদর যত্ন বেশি করে। প্লেটে অল্প ভাত দিয়ে ময়না বলল,
শহরের মানুষ ভাত কম খায়। তয় টাইম মতো খায়।
পরান ভাইয়ের জন্য বইসা থাইক্কা লাভ নাই তো! হে ব্যস্ত মানুষ! কোন সময় না কোন সময় আসে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। তার খাওন বাইড়া দেই আমি।
বিলাসী খেতে খেতে বলল,
ময়না বুজি, এখন থেকে তোমার ভাত বেড়ে খাওয়াতে হবে না। আমার স্বামীকে আমি ভাত বেড়ে খাওয়াবো। মা,অসুস্থ থাকতেন তাই হয়তো তুমি সবাইকে বেড়ে দিতে। এখন তো আমি আসছি,ঐ কাজ তোমাকে করতে হবে না।
ময়না রাগে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। চোখ লাল করে
বলল,
“পরান ভাইজান আফনার হাতে খাইলে তো! আমি ভাত বাইড়া না দিলে খাইবোই না”
ময়না নানাভাবে বিলাসীর সাথে কথায় টেক্কা দিয়ে চলতে থাকে। কৌশলে কীভাবে পরানের এবং বিলাসীর শ্বশুর শাশুড়ির কাছে থাকা যায় সেই কাজগুলো করে। ভারী কাজ বিলাসীকে দিয়ে করায়। ধান কাটার মৌসুমে ধান সিদ্ধ, শুকানোর কাজে বাড়তি কিছু লোক থাকে বাড়িতে। বিলাসী কোনোদিন এইসব কাজে অভ্যস্ত ছিল না। স্বামী, বাড়ির লোকদের মন জয় করার জন্য সব কাজে হাত বাড়ায়। উঠোনে ধান নেড়েচেড়ে দেওয়ার সময় চোখ গেল রান্নাঘরের দিকে। স্বামী নিজ হাতে ময়নার মুখে ভাতের ধলা তুলে দিচ্ছে। দেখেই বিলাসী
মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে। সবাই বলাবলি করে শহরের মেয়ে ধান বনের কাজ করে অভ্যাস নেই তাই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
রাতে বিলাসী স্বামীকে ময়নার কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করলে বলে,তুমি ভুল দেখছো,ভুল শুনছো। যদি সত্যিই
মনে করো,তবে সত্যি। এটা মেনে নিয়ে থাকতে হবে।
বিলাসী বাবার বাড়ি চলে আসলো। মা,বাবা ভাইদের
সব কথা জানালো। তাদের পরিস্কার কথা বিয়ে একবারই। বংশে কারো দ্বিতীয় বিয়ে নেই। তাকেই স্বামীর পরকীয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বামীর
ঘরে ফিরে যেতে হবে।ইতিমধ্যে বিলাসী অন্তঃসত্ত্বা।শরীর ভারী হতে থাকে। মা’কে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসলো। মেয়ের সুখ-শান্তির জন্য মা অনেক কাজ করে দেন। শ্বশুর-শাশুড়িকে বুঝিয়ে মেয়েকে তাদের কাছে রেখে চলে আসেন।
স্বামীকে আপন করে নিতে না পারলেও, সব কথা শেয়ার করতে না পারলেও বংশ রক্ষার্থে একে একে দুই মেয়ের জন্ম হলো। শ্বশুর শাশুড়ি রাগ বিলাসীর উপর। কেন ছেলে হলো না? ছেলে না হওয়ার পিছনে বিলাসীই দায়ী। কথায় কথায় নানা অজুহাতে বিলাসীকে খোঁটা দেয়, “এই মেয়ের পেটে ছেলে ধরবে না কোনোদিন। পরানের বংশের বাতি দিব কে?”
বিলাসী সব সহ্য করে। কার কাছে বলবে? স্বামীটা যে
তার না। বাবার বাড়ি কেউ শুনে গুরুত্বই দিল না।
রাতে স্বামী ঘুমাতে আসলো। মেয়ে দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে স্বামীর কাছে একবুক আশা নিয়ে গেল,
-এত রাতে বাড়ি আসো কেন? অনেক জরুরি কথা ছিল
বলার। তোমাকে কাছেই পাই না।
-এত ভয় লাগলে বাপের বাড়ি চলে যাও। এখানে থাকতে বলছে কে? কি জরুরি কথা? আদর ভালোবাসা দেই না? না হলে দুই মেয়ে হলো কি করে?
ঐরাতে আর কোনো কথাই বলতে পারিনি বিলাসী।
বিলাসীর চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হতে থাকে স্বামীকে আপন করে নেবার। মুখ বুঝে সব সহ্য করে সংসার কর্ম করতে
থাকে। একদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই,
রান্না-বান্না করে শ্বশুর শাশুড়ির জন্য ভাত বেড়ে ডেকে আনেন। শাশুড়ি ভাত মুখে দিতেই ঝালে ফোঁপাতে থাকে । পরপর দুই গ্লাস পানি গিলে। অগ্নিমূর্তির ন্যায় বলল,
-বাপের বাড়ি থেকে কিছু শিখে আসছো? কোনোদিন রান্নাবান্না করছো? যেই কাজ পারো না সেটা করতে যাও কেন? পটের বিবি হয়েই থাকো।
দূর থেকে ময়না ঠোঁট টিপে হাসছে। কাছে এসে বললো,
হায়! হায়! চাচী আফনার চোখ থেইক্কা পানি পড়তাছে। তরকারি খুব ঝাল হইছে ? খাড়ান আমি ডিম ভাইজা আনি।
শাশুড়ি রাগে বিলাসীর মুখ হা করে দুই চামচ তরকারির ঝোল ঢেলে দিল। গরম, ঝাল তরকারির ঝোলে গলা,জিহবা জ্বলতে থাকে। বিলাসী জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। শ্বশুর বিলাসীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আহা! পরানের মা এইটা তুমি কী করলা? বৌ মার মুখে ঝোল দিলা কেন?”
-আপনি চুপ থাকেন! ওরে বাড়ি নিয়ে দিয়ে আসেন আজই!”
বিলাসীর আর বুঝতে বাকি রইলো না তরকারিতে কে মরিচের গুঁড়া মিশিয়েছে। বাড়ির লোকদের কীভাবে প্রমান দিবে এটা ময়নার কাজ।তার কাছে কোনো প্রমাণ
নেই। তাছাড়া বাড়ির সব লোক ময়নার অন্ধভক্ত। কেউ
তার কথা বিশ্বাস করবে না। শ্বশুরের সাথে বাপের বাড়ি রওনা দিল। গাড়িতে বসে অতীতে ফিরে নীরবে চোখের জলে কাপড় ভিজছে তার খেয়াল নেই। কোথায় আমার লেখাপড়া? কোথায় গান,কবিতা? কোথায় আমার শেষ ঠিকানা?
বিলাসীর বাবার শরীর ভালো নেই। সব সম্পত্তি সাত ছেলেমেয়েকে ভাগ করে দিলেন। তার মনে অজানা ভয় কোনদিন কী হয়ে যায়! মরার পর যাতে মেয়েরা বাপের অংশ থেকে বঞ্চিত না হয় তার জন্য রেজিস্ট্রি করে জমি ভাগ করে দেন। বিলাসী শহরেএবং গ্রামে ধানি জমি পেল। বিলাসীর মা,বাবা মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসলেন। শ্বশুরের হাত ধরে কেঁদে বললেন,
“ভাইসাব,আমার মেয়েটা ছোট বেলা থেকেই খুব শৌখিন ছিল। তার শখ ছিল লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। আমার ইচ্ছায় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। কাজ করতে গেলে ছোট ছোট ভুল হয়ে থাকে। মেয়ে হিসাবে ক্ষমা করে দিবেন। আপনার হাতে মেয়েকে আবার দিয়ে গেলাম”
বিলাসীর কাজ করতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝেই মাথা ব্যথা করে। কাউকে বলে না। একদিন খবর আসলো বাবা মারা গেছে। মৃত্যুর সংবাদ শুনে এক কাপড়ে ছুটে বাবার কাছে। কিছুদিন মায়ের পাশে থেকে আবার শ্বশুর বাড়িতে আসে। সবকিছুই তার এলোমেলো। মেয়েদের দেখাশুনো ময়নার হাতে। এর মধ্যে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বিলাসীর অনেক কিছুই
স্মৃতিতে থাকে না। কোথায় কোন জিনিস আছে বলতে পারেনা। এভাবে সময় চলতে থাকে। ঘর আলো করে ফুটফুটে ছেলে সন্তান জন্ম নিল। সরকার বাড়িতে সুখের সীমা নেই। দুই গরু জবাই করে আকিকার অনুষ্ঠান করে লোক খাওয়ালো মফিজ সরকার। নাতির নাম রাখলেন”মেসকাতুল আরাফাত সরকার রাজ”
মায়ের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে ময়না বাচ্চাদের মায়ের আদর দিয়ে লালন-পালন করে।বিলাসী ছেলেকে কাছে টানলে বলে,”ময়না খালা খুব ভালো। আমি রাতে ময়না খালার কাছে ঘুমাবো।” বিলাসীর এলোমেলো কাজে শ্বশুর শাশুড়ি খুব বিরক্ত। বিলাসী যতটুকু সুস্থ ছিল বাড়ির লোকদের আচরণ,স্বামীর তাচ্ছিল্যের কারণে আরও অসুস্থ হয়ে যায়। একদিন বাড়িতে না জানিয়ে একাই বাবার বাড়ি চলে যায়। ভাইয়েরা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে,” বিয়ে দিয়েছি, স্বামী,সংসার, বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকবি। এত ঘনঘন এখানে মায়ের কাছে আসবি না।”
ফিরে এল শ্বশুরবাড়ি।বিলাসীকে দেখেই ময়না বলল,
“সরকার বাড়ির সম্মান আর রইলো না। বাড়ির বউ
বাজারের মাইয়্যাদের মতো ঘুইরা বেড়ায়।”
শাশুড়ি দেখেই খুব বকা ঝকা করলেন,সবার সামনে
পরান গালে শক্ত হাতে বিলাসীর গালে চড় বসিয়ে দিল।
মাথার যন্ত্রণা, শ্বশুর বাড়ির লোকদের নির্যাতন, তিরস্কার, স্বামীর অবহেলা সয়ে গেলো কয়েকবছর। হঠাৎ খবর আসলো মায়ের মৃত্যুর সংবাদ। শ্বশুরকে নিয়ে গেল মায়ের দাফন-কাফনে। বিলাসী বড় বোন
জাহানকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ছোট বোনের করুণ
দশা দেখে বিলাসীর শ্বশুরকে জাহান বললেন,
-আমার বোনটাকে এভাবে তিলে তিলে মারবেন না। যা প্রত্যাশা করেছিল তার কিছুই পায়নি জীবনে। আপনারা
অমানুষ। ওকে পুরোপরি সুস্থ করে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। ওর ভবিষ্যত নিয়ে আমি চিন্তাভাবনা করবো।
বিলাসীর শ্বশুর কথাগুলো শুনে বিলাসীকে নিয়ে চলে
আসলো।
বছরের শেষে আর এক মেয়ে হলো। স্বামীর প্রেম,ভালোবাসা, মায়া,সহযোগিতা না পেলেও স্বামীর অধিকার নিয়ে শারীরিক চাহিদা মেটাতে কখনো পিছপা ছিল না পরান। বিলাসীর শরীরে নানা অসুখ বাসা বাঁধে। একমাত্র আদরের ছেলে সারাবাড়ি খেলে দৌড়ে বেড়ায় । বাড়ির বাইরে বল খেলতে গিয়ে বল পানিতে পড়ে যায় । বলের পিছনে পিছনে যেতে যেতে এক সময় রাজ পুকুরে তলিয়ে যায় । বিলাসীর চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে যায়। সরকার বাড়িতে শোকের বন্যা। তখনও শাশুড়ি নাতি মরার দোষ বিলাসীর উপর চাপিয়ে দেয়। বিলাপ করে বলে,”কী অলক্ষী বউ ঘরে আইলো? একে একে নিজের বাপ মাকে খাইলো! শেষে আমার বংশের বাত্তিটাকে খেলোধ। আমার সংসার ধ্বংস কইরা দিব এই বউ!”
ছেলে মরার পর বিলাসী মানসিকভাবে বড় ধরনের
আঘাত পায়। সকাল হয়ে দুপুর, বিকেল গিয়ে রাত হয় কিছুই বলতে পারে না বিলাসী। কখনো শরীরের কাপড়ও ঠিক থাকে না। কোলের মেয়েটাকে ময়না লালন-পালন করে। বড় মেয়ে দুটো মা’কে মুখে খাবার তুলে দিলে যত্ন করলে শাশুড়ি সহ্য করে না। নাতনিদের বকাঝকা করে। দাদীর ভয়ে মায়ের কাছে আসে না মেয়েরা। খবর শুনে বড় বোন জাহান ছুটে আসলো। বোনকে নিয়ে গেলো নিজের কাছে। ভাইদের সাথে পরামর্শ করলো বিলাসীর টিট্রমেন্টের ব্যাপারে। ভাইরা আন্তরিকতা দেখালো না।কেউ এগিয়ে আসলো না চিকিৎসা করাতে। বিলাসীর স্মৃতি শক্তি একেবারে লোপ পেতে থাকে। কাছের মানুষগুলো তার চোখে অচেনা। সারাদিন আবল-তাবল বকে। মাঝে মাঝে নিজের ছেলের নাম রাজ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। কখনও খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। বিলাসীকে দেখে বড় বোন শুধু চোখের পানি ফেলে।
শ্বশুর বাড়িতে বিলাসীর ফিরে যাওয়ার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। অসুস্থ বউকে গ্রহণ করবে না। কিছুদিন পর ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দেয়। জাহান তার হাজব্যান্ডের সাথে পরামর্শ করলো আগে বোনের সুস্থ জীবন ফিরে আনতে হবে তারপর থানা পুলিশ করবে।
জাহান হাজব্যান্ডকে নিয়ে শহরের নামকরা বিশেষজ্ঞদের কাছে পরামর্শ করেন। উনারা জানালেন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সুস্থ জীবন ফিরে পেতে হলে দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা করাতে হবে। আবার এটাও জানালেন, পুরোপুরি সুস্থ নাও হতে পারে। ব্যয় বহুল চিকিৎসা অনেক টাকা খরচ করতে হবে।
জাহান ডাক্তারের কথাগুলো ভাইদের জানালো।
ভাইয়েরা সিদ্ধান্ত করলো বাবার কাছ থেকে ওয়ারিশ হিসাবে যে সম্পত্তি পেয়েছে সেটা বিক্রি করে চিকিৎসা করাবে। বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি দুইভাই ভাগ
করে নিল। বিলাসীর ভরণপোষণ,চিকাৎসা করাবে। চিকিৎসা চললো কচ্ছপ গতিতে। চিকিৎসার কোনো উন্নতি নেই। বিলাসীর অবস্থা আগের মতোই। বরং দিনে
দিনে আরও অবনতি হলো। বাড়ির সদর দরজা খোলা থাকলে কোথায় চলে যায় কেউ টের পায় না। কে খুঁজবে? কতবার খুঁজে আনবে? অবশেষে পায়ে পরানো হলো লোহার শিকল।
সবাই ব্যস্ত সবার কাজে। সবার সংসার চলছে সুখ-শান্তিতে। বিলাসীর সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকা অনিশ্চিত। তার সংসার,স্বামী,সন্তান, সুখ, স্বপ্ন, শখ,কবিতা,গান সবই সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে। তার সঙ্গী লোহার শিকল,ঘুমহীন আঁধার রাত,ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে
থাকা হাজারো প্রশ্ন। সুস্থ হয়ে ফিরে সে প্রশ্নের উত্তর পাবে কিনা সে জানে না।
খবর আসলো বিলাসীর বড় মেয়ের বিয়ে। বিয়ের পর জামাই নিয়ে আসে মায়ের পায়ের কাছে। পা ছুঁয়ে সালাম করে জামাই মেয়ে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। চিনতে পারে না গর্ভের মেয়েকে! জামাই শাশুড়ির জন্য শাড়ি নিয়ে আসে। শাড়ি চিনে না,শাড়ি পরা ভুলে গেছে। হায়রে নিয়তি! মায়ের করুণ অবস্থা দেখে মেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যে ভাই দুটো চিকিৎসার ভার নিয়েছিলেন,একভাই বিলাসীর ভাগের
সম্পত্তি বিক্রি করে পরবর্তীতে কানাডায় চলে যান ছেলের কাছে। বিলাসীর সম্পত্তিতে এক পুলিশ কর্মকর্তা পাঁচতলা বাড়ি করে থাকেন। পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে,শরীরে নানা রকম ব্যাধি নিয়ে বিলাসী এখন হেমায়েতপুরে চার দেয়ালে বন্দী অনিশ্চিত জীবনকে সঙ্গী করে মৃত্যুর প্রহর গুনছে…….
(সমাপ্ত)