বিরহ ভালোবাসা পর্ব-০৮

0
825

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

৮.

শাদাদ ভাই পরদিন চলে গেলেন কাউকে কিছু না বলেই। বিষন্ন মনে তার কথা ভাবছিলাম। ইদানীং বিশেষ একটা সমস্যা আমার মাঝে বেড়ে ওঠছে। তা হলো কোনো কারণ ছাড়া যে কোনো জায়গায় আমি শাদাদ ভাইয়ের অস্তিত্বকে খুঁজে বেড়াই। অথচ, তিনি ট্রেনিংয়ে আছেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে। এটি চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী ভাটিয়ারী নামক স্থানে।। হুট করে রাস্তায় কারো মাথায় হ্যাট দেখলেই মনে হলো শাদাদ ভাই। কিন্তু, চোখের সামনে এলে বুঝতে পারি মানুষটা অন্য কেউ। এই যে আমার তাকে কারণে অকারণে দেখার অসুখ হলো আমি কাকে গিয়ে বলব? যার জন্য আমার এই রোগ তাকে বললে কি ফলাফল পাব? আর সে আমার রোগে আক্রান্ত কিনা সেটাও তো জানি না। কিন্তু, সে যদি আমাকে পছন্দ না করে তখন আমার কি করণীয় থাকবে? হুট করেই সে আমার পছন্দের মানুষ বনে গেছে। কিন্তু, চাইলেই কি আর হুট করে তাকে আমার মন-মস্তিষ্ক থেকে বের করা যাবে?

এত প্রশ্ন অথচ উত্তর নেই। সবকটা প্রশ্নের সমীকরণ সমাধান করতে চাই। কিন্তু, ঘুরে ফিরে সেই শূন্যস্থানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি আমি।

পরীক্ষা শেষ করে একটা দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীন হয়ে ঘুরছি। পড়ালেখার চাপ নেই। মায়ের শাসন নেই। বাবা প্রত্যেক শুক্রবারে বাবার বাইকের পেছনে বসিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছেন। আসার সময় মায়ের জন্য একটা করে গোলাপ আনতে বাবা ভুল করছেন না। বাবার এই দিকটা কেন যেন ভীষণ ভালো লাগে আমার! বাবার হাজার ব্যস্ততার মাঝেও মায়ের জন্য গোলাপফুল আনতে ভুলেন না। এতবছরের সংসার ; মাঝে মাঝে তাদের মাঝে ছোট বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় কিন্তু দিনশেষে তারাই একে অপরের পরিপূরক।

তেহজীব সাহেবের সঙ্গে একদিন সকালে দেখা হলো পাবলিক লাইব্রেরীর ভেতরে। আমি সবে ভেতরে ঢুকছিলাম আর তিনি বের হচ্ছিলেন। আমাকে দেখা মাত্র অনুরোধ করছিলেন পাশের এক রেষ্টুরেন্টে বসতে। উনার নাকি কথা আছে আমার সাথে। এতবার অনুরোধ করলো যে বারণ করতে পারিনি।

রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। দুটো কোল্ড কফির অর্ডার দিলেন তেহজিব সাহেব। কফি এলে উনি আমার দিকে কফি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

— আমি অনেক অনেক দুঃখিত মাধবীলতা। আসলে সেদিন আপনাকে হুট করে দেখে ভালো লেগে যায় আমার। তাই মায়ের কথায় রাজি হয়ে যাই। কিন্তু, আপনার কাজিন কি যেন নাম সৈকত চৌধুরী যিনি ট্রেনিংয়ে আছেন। উনার কথায় আমি ভীষণ হার্ট হয়েছি। একজন মানুষের ভালো লাগা , মন্দ লাগা থাকতেই পারে। আমার আপনাকে ভালো লেগেছে এতে দোষের কিছু তো নেই। কিন্তু, উনি আমার বাসায় এসে গালমন্দ করে এসেছেন।

অনেকক্ষণ ধরেই তেহজিব সাহেবের কথা শুনছিলাম। কিন্তু, শাদাদ ভাইয়ের বিপক্ষে কথা শুনে আর ভালো লাগছিল না। তাই এবার মুখ খুলে কিছু শক্ত জবাব দিলাম।

—- আপনি একজনের সঙ্গে কমিটমেন্টে আছেন। অথচ, আমাকে দেখেই আপনার ভালো লেগে গেল? ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারছেন? মানে হলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সমস্যা আছে। আর রইলো শাদাদ ভাইয়ের কথা উনি ঠিক কাজই করেছেন। সেদিন যদি সঠিক সময়ে উনি খবরটা না জানতেন। তবে আমার পরিবার আপনার মতো একটা নীচু লোকের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেলতেন। যেই লোক একজনকে ভালোবাসার কথা বলে অন্য একজনকে পছন্দ করতে পারে। সে আর যাই হোক ভদ্রলোক হতে পারে না।

কথাগুলো বলে আর দেরি না করে সেদিন আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসি।

——————————

হুট করে একদিন বিকেলে আমার নামে একটা চিঠি এলো পোস্ট অফিস থেকে। মা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমার হৃদপিন্ড যেন বুকের পাঁজর ভেঙে বের হয়ে আসবে। কোন হতচ্ছাড়া আমাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেললো কে জানে?

চিঠির খামটা নিয়ে প্রায় আধঘন্টা ধরে বসে আছি। সাহসের অভাবে খাম খুলে চিঠি বের করে পড়ার সাহস পাচ্ছি না। কিন্তু, মনটা আকুপাকু করছে কার চিঠি হতে পারে ভেবে? অবশেষে দোয়া-দরুদ পড়ে খামটা হাতে নিয়ে চিঠি বের করলাম। হলুদ খামে লেখা চিঠি।

তোকে প্রিয় বলতে বাঁধে
মধ,

খুব তো চিল মুডে আছিস দেখছি। অথচ ট্রেনিংয়ে এসে আমি রোদে-পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছি। মাঝেমাঝে দুএকটা চিঠি লিখলেও তো পারিস। জিজ্ঞেস তো করতে পারিস শাদাদ ভাই কেমন আছেন? কিন্তু, না আপনার তো বলতে বাঁধে। জানিস না আমি কতটা মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছি। কিন্তু, বাবার আমাকে নিয়ে স্বপ্নের কথা মনে হলে এসব কষ্ট তুচ্ছ মনে হয়। বিএমএর ট্রেনিংয়ে থাকা মানে মরণ কষ্টে থাকা। ছুটি পাচ্ছি না। ট্রেনিংটা শেষ হলো সাই করে সেকেন্ড ল্যাফটেন্টেট। তারপরই শুরু হবে বেসিক কোর্স।

অনেক তো হলো কাজের কথা। এবার আসল কথায় আসি।

ইদানীং আমার স্বপ্নে একটা মেয়ে আসে। সে আমার পরিচিত। ডাগরডাগর চোখদুটো দিয়ে আমার দিকে অনেক অভিমান নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় যেন কিছু বলতে চায়। আমারও জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগে সকাল হয়ে যায় আর স্বপ্ন গায়েব।

মেয়েটাকে এখন আমি বাস্তবে দেখতে পাই। মনে হয় কালো কাতান শাড়ি আর বড়ো খোঁপায় বেলীফুল গুঁজে আমার কাছে হাত বাড়িয়ে দেয় একটুখানি ভালোবাসা পাবার আশায়। ইসস্ কথাগুলো বলতে বলতে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে রে মধু।

মধু, তুই একটু আশেপাশে খোঁজ খবর নিয়ে দেখিস তো বড়ো চোখের, টিয়াপাখির মতো লাল ঠোঁট ওয়ালা, কাজল চোখের মেয়ে আছে কিনা?

ইতি,
শাদাদ ভাই

চিঠিটা শেষ অব্দি পড়ার পর লতার মনে একটাই অভিযোগ কেন সে এই চিঠিটা খুলে পড়েছে? না পড়লে বরং ভালো হতো। তার প্রেমিকার বর্ণনা শুনে লতার কানা তালা লেগে গেছে মন হচ্ছে।

—- স্বপ্নে মেয়ে দেখে না! ঢং দেখলে বাঁচি না। বাস্তবে কোন মেয়েকে দেখে তার ভালো লেগে গেছে আর এখন স্বপ্নের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে।

লতা রাগ করে চিঠিটা দুমড়েমুচড়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও ফেললো না। চিঠিটা নিয়ে রিডিংটেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রাখল।

এরপর, থেকে লতার একটা দিনও ভালো কাটে না। এত সুন্দর মূহুর্তগুলো যেন বিষাদময় ক্ষণে পরিণত হয়েছে। নাহ্ আর কতদিন এভাবে কাটাবে? তাই লতা সিদ্ধান্ত নেয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য এখনই কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন। বাবাকে বলে কাছের এক কোচিংয়ে ভর্তি হলো। পড়াশোনার মাঝে ডুব দিয়ে আশেপাশের ঘটনা থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে লাগল লতা। ভাবসাব দেখলে মনে হবে মেয়েটার জীবনের একটাই লক্ষ্য আর তা হলো পড়াশোনা। কিন্তু, দিনশেষে যখন রাত হয়। তখন লতার বালিশ গুলো জানে লতার মনে কেউ একজন আছে। নয়তো তার জন্য রোজ নিয়ম করে কেঁদে কেটে বালিশ ভেজানোর মানে কি?

পনেরোদিন পরের কথা…

লতা এইচএসসি পরীক্ষায় A পেলো। ওর মা তো পারছে না ওকে ধরে ইচ্ছামতো কেলানী দিতে। কিন্তু, লতার বড়ো জেঠু আর বাবার জন্য পারছে না। উনাদের কথা লতা ভালো করার চেষ্টা করেছে এটাই অনেক। সামনের দিকে আরও ভালো রেজাল্ট করবে।

লতা মনে মনে তখন শাদাদ ভাইকে বকছিল। কারণ,উনার জন্যই তো লতার রেজাল্ট খারাপ হলো। পরীক্ষার খাতায় লিখতে গেলে উনার চেহারা খাতার মাঝে ভেসে ওঠতো। এই শাদাদ ভাইয়ের জন্য ওর মনটা তো ভেঙেছে সেই সঙ্গে রেজাল্টও খারাপ হলো।

শাদাদ ভাইয়ের ওপর ভীষণ রাগ করে চিঠি লিখলো লতা।

অপ্রিয়
শাদাদ ভাই।

নিশ্চয়ই অনেক অনেক ভালো আছেন। ভালো থাকারই কথা। আপনি তো সবসময় চেয়েছেন আমার যাতে কোনদিকেই ভালো না হয়। হলোও তাই আপনার কারণে আমার এইচএসসির রেজাল্ট খারাপ হলো। এখন এলাকার মানুষ জানবে লতার মাথায় গোবরে ভরা। নয়তো, এত সহজ পরীক্ষায় শুধু A পেয়েছে।

দোয়া করি আপনার সেই পছন্দের মানুষের যেন মাথার চুল পরে টাক বেরিয়ে আসে। তার ডাগরডাগর চোখদুটো যেন চুলের চিন্তা দেবে যায়। তখন আপনিও কি করে তার চিন্তায় ডুবে থাকেন আমিও দেখব।

ইতি
মাধবীলতা।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে