#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter
৬.
পরদিন ভোরবেলা আমার নানুর ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম ঘুম চোখে নানুর দিকে তাকিয়ে আছি এটা জানার জন্য যে, কেন এত ভোরবেলা ডাকছে?
নানু জায়নামাজ ভাজ করতে করতে বললেন,
— তোর বড়ো জেঠুর পোলাডা আছে না শাদাদ একটু আগে তোরে ডাইকা গেছে। ট্রেনিং নাকি যাইব গা। যাহ্ গিয়া দেহা কইরা আয়। এরপর, সারাবেলা বিড়ালের লাহান পইরা ঘুমাইয়া থাকিস।
বিরক্তি এসে শরীরে ভর করেছে। তবুও, কষ্ট করে হলেও চোখের ঘুম একপাশে রেখে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে টাওয়াল দিয়ে মুছে ফেললাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুলে হাত খোঁপা করে ঘর থেকে বের হয়ে শাদাদ ভাই যে ঘরে থাকেন সেই ঘরের দিকে যাচ্ছি। দরজার কাছে যেতেই দেখলাম শাদাদ ভাই রেডি হয়ে বস আছেন। হলুদ টিশার্ট, কালো জিন্স ক্লিন শেভড পুরো টিপটপ সেজে বসে আছেন। হুট করে মনটা খারাপ হয়ে আসছে। চলে যাবেন শাদাদ ভাই। আবার কবে না কবে ফিরে আসবেন উনি? বাড়িতে এলে হাজারবার বিরক্ত করুক তবুও উনার উপস্থিতি বড্ড ভালো লাগে আমার। উনি মানুষটাই এমন দূরে গেলেও যন্ত্রণা, কাছে থাকলে আরও বেশি যন্ত্রণার।
— কি রে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছিস ক্যান? আয় আমার সঙ্গে গেট অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসবি।
ধ্যান-ভগ্ন হলো শাদাদ ভাইয়ের কথায়। দেখলাম হাতে ব্যাগ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি পা চালিয়ে শাদাদ ভাইয়ের পিছু পিছু হাঁটছি। বাড়ির সদর দরজা পের হতেই শাদাদ ভাই হুট করে দাঁড়িয়ে পরলো এরপর আমাকে বললো,
— ভালো থাকিস। আর শোন ওই তেহজিব না তেজপাতা ওই ব্যাটার সঙ্গে বিয়ের আলাপ এলে বারণ করে দিবি। ব্যাটার চরিত্র ভালো না। কলিগের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে। অথচ, মা যখন বললো, বাবা বিয়ে করবি আমাদের পছন্দের পাত্রীকে। ব্যস, তিনি এখন ওই মেয়েকে ছেড়ে তোর পেছনে পরেছে।
এইসব লুচ্চা ক্যাটাগরির পোলারা যেখানে মেয়ে দেখে ওখানে জিহ্বা বের করে হা করে থাকে।
আয় তোর সঙ্গে একটা সেলফি তুলি। কবে না কবে দেখা হয় তোর সঙ্গে। তুই আবার আমার সঙ্গে ছবি তুলে রানী এলিজাবেথ বনে যাস না। তোর ছবি সঙ্গে রেখেছি যেন, ঘুম বেশি এলে তোর পেত্নিমার্কা চেহারা দেখে নিজের চোখের ঘুমকে তাড়াতে পারি।নয়তো, তোর ছবির যোগ্যতা আছে আমার আইফোনে থাকার!
মোবাইল বের করে ক্লিক করে দু’চারটা সেলফি তুলে ফেললেন শাদাদ ভাই। রাগে দুঃখে মনটায় চাচ্ছে শাদাদ ভাইয়ের মাথার চুলগুলো টেনে ছিড়ে ফেলি। আর উনি টাক হয়ে যাক। ব্যস, কাহিনী খাতাম।
— তেহজিবের গার্লফ্রেন্ড আমার বন্ধুর বড়ো বোন। গতকাল রাতে সুমনের সাথে তোর ব্যাপারটা আলোচনা করছিলাম। কথায় কথায় চেনা-জানা হলো। তখন সুমন বললো যে, ওর বোনের সঙ্গে আজ চার বছরের প্রেম। কিন্তু, ওর বাবা-মায়ের কথায় নাকি এখন সে সুমনের বোনকে বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছে।
লতার তো ইচ্ছে করছে তেহজিব শয়তানকে সামনে পেলে মরিচ ডলে লাগিয়ে দিতো ওর চোখে। কত্ত বড়ো শয়তান লোক! এত বছর প্রেম করে এখন বাবা-মায়ের পছন্দের দোহাই দিয়ে একটা মেয়ের এত বছরের স্বপ্নকে পায়ে পিষে ফেলেছে।
কিন্তু, মনে একটাই প্রশ্ন শাদাদ ভাই এতকিছু কার কাছ থেকে জেনেছেন?
লতার রাগান্বিত মুখটা দেখে শাদাদ লতার গালে হাত রেখে বললো,
— থাক রাগ বাড়িয়ে নিজের বিপি হাই করিস না। নিজের খেয়াল রাখিস। আমার কিন্তু একটা কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে?
— কি কথা শাদাদ ভাই?
লতা গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে শাদাদের দিকে উত্তরের আশায়।
— তোর বিয়ের স্বপ্নটা পূরণ হলো না।
কথাটি বলে শাদাদ ভাই রিকশায় চড়ে বসলেন। আর আমি রাগে-দুঃখে পারছি না নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলি। মানে একটা মানুষ নিজের কথা দিয়ে একটা মানুষকে কতটা বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে!
রিকশা চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। লতা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার কিনারায়। অপেক্ষা কখন শাদাদ ভাইয়ের রিকশাটা চোখের সামনে থেকে আড়াল হবে।
রিকশা চোখের আড়াল হলেই লতা বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। একটিবার যদি পেছনে ফিরে তাকাতো তবে দেখতে পেতো, তৃষ্ণার্ত একজোড়া আঁখি অনিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে লতার দিকে। দুচোখে তার লতাকে হারানোর ভয়।
——————-
পুরোদমে লতার পড়ালেখা চলছে। একসপ্তাহ পর থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। রুপা আপা এবং বড়ো জেঠু সর্বাত্নক সাহায্য করছে লতাকে পড়াশোনার ব্যাপারে। তেহজিব সাহেবের পরিবারকে লতার বাবা বিয়ের জন্য বারণ করে দিয়েছে। উনার একটাই কথা ওমন মেরুদণ্ডহীন ছেলের কাছে উনার সোনার মতো মেয়েকে বিয়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তৃনা লতার বাবার ওপরে গিয়ে আর কিছু বলেনি। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায় কি করতে যাচ্ছিলেন তিনি? যদি শাদাদ সত্য ঘটনাটি না জানত। তখন তো ঠিকই লতাকে ধরে বেঁধে তেহজিবের সঙ্গে বিয়ে দিতেন তিনি।
প্রথম পরীক্ষার দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ার টেবিলে বসে বই খুলে পড়ায় মনোনিবেশ করে লতা। এক অধ্যায় পড়ে অন্য অধ্যায় পড়তে গিয়ে লতার মনে হলো সে জানালা দিয়ে শাদাদ ভাইকে দেখেছে। তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে নীচে যেতেই দেখতে পেলো সত্যি সত্যি শাদাদ ভাই এসেছেন।
কাঁধের ব্যাগটা সবে ড্রইংরুমের সোফায় রেখেছে। এমনসময় লতার উপস্থিতি টের পায় শাদাদ। লতার দিকে বললো,
— কি রে সকাল সকাল হাফপ্যান্ট পরে বাড়িতে ভূতের মতো ঘুরছিস ব্যাপার কি? লজ্জা শরম বেচে কি হাওয়াই মিঠাই খেয়েছিস ?
শাদাদ ভাইয়ের কথায় লতা নিজের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে দিলো এক দৌঁড়। গতকাল রাতে অতিরিক্ত গরম লাগছিল বিধায় সে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর ফতুয়া পরে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু, সকাল সকাল শাদাদ ভাইয়ের আগমন ঘটেছে দেখেই তো লতা নিজের দিকে খেয়াল করেনি।
ঘরে এসে দরজায় খিল এটে ইংরেজি বইটা হাতে নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিতে চাচ্ছে। কিন্তু, কোনোভাবেই পারছে না। অসভ্য শাদাদ ভাইয়ের কথা মনে পরছে আর লতার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। এবার পরীক্ষার খাতায় কি লিখবে লতা?
সাড়ে আটটা বাজার আগে লতা গোসল সেড়ে ফেললো। কিছু সময় পর লতার মা এসে লতাকে রুটি খাইয়ে দিয়ে গেলেন। আরেকবার বইটা নিয়ে রিভিশন দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে পরীক্ষার যাবতীয় কাগজপত্র, কলম, স্কেল নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই একগাদা ফুল এসে লতার গায়ের ওপর বর্ষন হচ্ছে। লতা চোখ খুলে তাকাতেই দেখতে পেলো, ওর পরিবার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে ফুলের ছিটা দিচ্ছে। রুপা আপা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুভকামনা জানালো। এরপর, একে একে বাবা, জেঠু এবং মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিলেন।
আমার দুচোখ তখন অন্য একটা মানুষকে খুঁজছে। সেই মানুষটাকে খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে শাদাদ ভাই। মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে? মনটা হুট করে খারাপ হয়ে গেলো। সবাই আমাকে শুভকামনা জানালো কিন্তু শাদাদ ভাই জানালো না কেন? বিষন্ন মনে বাবাকে বললাম,
— বাবা নিয়ে যাবে না আমাকে?
— আজ তো আমি যাব না। শাদাদ নিয়ে যাবে তোকে।
— ব্যস আজ আর পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখতে হবে না। শাদাদ ভাইয়ের সঙ্গে এক রিকশায় যেতে সব ভুলে যাব আমি, বাবা।
মনে মনে কথাগুলো বলতে বলতে লতা নুইয়ে পরছিল৷ না পারছে কাউকে বারণ করতে আর না পারছে শাদাদ ভাইয়ের সঙ্গে যাওয়াটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে।
এক রিকশায় পাশাপাশি বসে পরীক্ষার হলের উদ্দেশ্য রওনা হলো লতা আর শাদাদ ভাই। দুজনই চুপ। রাস্তার পাশে অসংখ্য গাড়ি ছুটে চলেছে নিজেদের গন্তব্যস্থলে। হুট করে একটা গান এসে শাদাদের কানে পৌঁছায়।
“এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো”
শাদাদ জানে আজ মনটা কতটা শান্তি পাচ্ছে। এতদিন তো বেশ অশান্তিতে কাটছিলো তার। হুট করে আজ সকালে মাধবীলতা নামক জীবন্ত এক ফুলকে দেখে শাদাদের দিনটা আজ বরকতময় আর প্রশান্তিময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু, মধু এভাবে চুপ করে আছে কেন? কোনো কিছু নিয়ে আবার দুশ্চিন্তা করছে না তো আবার?
— এভাবে টেংরা মাছের মতো ব্যাঁকা হয়ে আছিস কেন? সোজা হয়ে বস। দেখে মনে হচ্ছে উনাকে কেই রিকশায় জায়গা দিচ্ছে না।
শাদাদের কথায় লতা সোজা হয় বসলো ঠিকই তবে শাদাদের থেকে ডিস্টেন্স রেখেই। ভুল করেও যেন শাদাদের পায়ের সঙ্গে লতার পা যেন না লাগে। শাদাদ মনে মনে হাসছে লতার কান্ড দেখে। কিন্তু, মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে।
— নিরা ফ্রেন্ড হয় তোর?
শাদাদ ভাইয়ের কথায় চমকে উঠে লতা। নিরা কথা উনি কি করে জানলেন?
— এই সবই করিস স্কুলে এসে! টিপাটিপি শিখবা ওদের প্রেম দেখে। নাক টিপলে দুধ বের হবে এমন মেয়ে স্কুলে এসে বান্ধবীদের প্রেমের সময় পাহাড়া দাও। আজকের পর যদি শুনি নিরা না ফিরা নামের মেয়েদের সাথে চলতে। তবে তোকে মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে চিড়িয়াখানার সামনে থালা দিয়ে বসিয়ে রাখব। তখন ভিক্ষা করে খেতে হবে। সবাই তখন তোকে এক নামে লতা ফকিন্নি বললে চিনবে।
শাদাদ ভাইয়ের কথায় লতা যতটা অবাক হয়েছে, তারচেয়ে বেশি চিন্তা করছে এই ভেবে যে ওকে লতা ফকিন্নি বেশে কেমন দেখাবে? নিজেকে নিয়ে এমন কল্পনা করতে গিয়েও অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল লতার। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো আজকের পর থেকে নিরার সঙ্গে আর কখনো দেখাও করবে না কথা তো দূরের থাক।
#চলবে