#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১০.
ভার্সিটি ছুটি হয়েছে। এদিকে বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। অথচ আজ আকাশে মেঘের বালাই ছিল না বলে আরিন্তা ছাতা নিয়ে আসেনি। গতকাল আকাশে মেঘ দেখে ছাতা এনেছিল, কিন্তু বৃষ্টি হয়নি। তাই আজ আর আনতে ইচ্ছা করেনি। প্রকৃতির মতিগতি বোঝা দায়। করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আরিন্তার বিরক্তি ধরে গেছে। শিক্ষার্থীরা যারা ছাতা এনেছে তারা আগেভাগেই চলে গেছে। যারা আনেনি তারা দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি থামার লক্ষণ দেখতে না পেয়ে যে যার মতো ভিজে-ভিজেই রাস্তায় নেমে পড়েছে গাড়ির খোঁজে। রাস্তায় আর ফাঁকা গাড়িও চোখে পড়ছে না। পুরো ভার্সিটি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আরিন্তার আর একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগল না। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সে রাস্তায় নেমে পড়ল। কিন্তু গাড়ি পেল না। যা-ও একটা পেল, তা-ও সে একা বলে যেতে চাইল না। উপায় না পেয়ে আরিন্তা ভিজে-ভিজেই হাঁটা ধরল। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় তেমন কোনো মানুষও চোখে পড়ছে না। একটু ভয়-ভয়ও লাগছে তার। এসব রাস্তায় পা’গল লোকদের চলাচল আছে। তাদের আরিন্তা প্রচণ্ড ভয় পায়। যতটা সম্ভব দ্রুত পা চালাচ্ছে সে। বাড়ির রাস্তা অবধি পৌঁছাতে পারলেই নিশ্চিন্ত। কিন্তু মাঝপথে গিয়ে আরিন্তার মনে হলো তিন রাস্তার মোড় থেকে কেউ তার পিছু নিয়েছে। তাড়াহুড়ায় স্পষ্ট চোখে না তাকালেও ঘাড় ঘুরিয়ে অস্পষ্ট চোখে এক পলক দেখে বুঝল একটা ছেলে ছাতা মাথায় দিয়ে তার পেছনে আসছে। হতে পারে সে এই রাস্তা ধরেই যাবে। আরিন্তা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত পা চালাল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার পা থামতে বাধ্য হলো। পেছনে আসা ছেলেটা চোখের পলকে ছুটে এসে তার ডান পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতে আগলে ধরে তাকে ছাতার নিচে টেনে নিল। আরিন্তা ভীষণভাবে চমকে উঠল। ভয়ে না, পরিচিত স্পর্শ আর পারফিউমের গন্ধে। পা থামিয়ে মুখ তুলে তাকাতেই মিশকাত শাসনের সুরে বলে উঠল,
“এমন বৃষ্টির মধ্যে কাকভেজা হয়ে ফেরার কী হয়েছে? বৃষ্টি থামা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে পারলি না?”
“বাড়াবাড়ি কোনোকিছুর জন্য আমি অপেক্ষা করি না। নিজের মতো এগিয়ে যাই।”
গম্ভীর মুখে কথাটা বলেই আরিন্তা মিশকাতের হাত সরিয়ে ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে আবার সামনে হাঁটা ধরল। এবার যেন তার প্রতিটা পদচারণায় রাস্তার স্বল্প পানিতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হলো। মিশকাত আবারো ছুটে গিয়ে আরিন্তাকে ছাতার নিচে টেনে নিল। এবার সে আরিন্তার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখল, যাতে চাইলেই ছাড়িয়ে চলে যেতে না পারে। ধমকের সুরে বলল,
“থাম, একদম ছুটাছুটি করবি না।”
আরিন্তা চাইলেও অবশ্য ছুটাছুটি করতে পারল না। তবে অভিমানে থমথমে মুখে ফুলানো গালে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। সেদিনের পর আজ তিনদিন হয়ে গেল সে মিশকাতের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে। কই? একদিনও তো মিশকাত তার খবর নিতে যায়নি। রিমাও ভার্সিটিতে আসছে না। মিশকাতের কি একবার জানতেও ইচ্ছা হয়নি আরিন্তা কেন তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে? রাগ, অভিমান করেছে কি না তার-ও খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি? এই তার আরিন্তার জন্য ভালোবাসার পা’গলামি? হাতে মিশকাতের ঝাঁকুনি খেয়ে-ও আরিন্তা মিশকাতের দিকে তাকাল না। মিশকাত ডাকল,
“এই পোনি, অভিমানের পাহাড় এত বেশি উঁচু হয়ে গেছে?”
আরিন্তা অভিমানী স্বরে বলল,
“আমার কোনো রাগ, অভিমান নেই।”
“আমার ওপর রেগে থাকতে পারা মেয়ে না তুই। যতটুকু পারিস, অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখতে। কিন্তু অভিমান করার আগে তো কারণটা অন্তত ঠিকঠাক বুঝে নিতে হয়।”
“আমি তো গাধা। মানুষ ভুলভাল বুঝালে তা-ই বুঝি। ঠিক বুঝার আর দরকার নেই আমার।”
মিশকাত ক্ষণকাল চুপ করে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে বলল,
“আমি জানি তুই ওইদিন আমার ফোনে রিমার ম্যাসেজটা দেখেছিস। আমি মিথ্যা বলায় ভুল বুঝে বসে আছিস।”
“আমি কারোর কোনো কৈফিয়ত চাই না।”
আরিন্তার কথায় কান না দিয়ে মিশকাত বলে চলল,
“সেদিন হঠাৎ বাজারে রিমার সাথে দেখা। রিমা আমাকে জানায় সে একটা বিপদে পড়ে গেছে। আমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে কথা বলতে চায়। আমি বলি খুব প্রয়োজনীয় কথা হলে আমাকে ম্যাসেজ করে পরে জানিয়ে দিতে। তারপর ও বলল আমি ওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করিনি। সেদিন আমি ওর রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করি। তারপর ও আমাকে ম্যাসেজ করে জানায় একটা ছেলে কদিন ধরে ওকে উত্তক্ত করছে। আজকাল আবার হু’মকিও দিচ্ছে ও প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে ওর ক্ষতি করবে। পরে জানতে পারি ছেলেটা আমাদের এলাকার। রিমা ওর বাবাকে বলার সাহস পাচ্ছিল না, নিজের ভাই-ও নেই, তাই আমাকে জানিয়েছে। ওইদিন যে আমাকে কলেজের সামনে যেতে বলেছিল, তা ওই ছেলের সাথে কথা বলানোর জন্যই। আমি আগেভাগেই ব্যাপারটা পাঁচকান হতে দিতে চাইনি, তাই কাউকে জানাইনি। তোকে তখন জানাইনি তোর এই ভুলভাল বুঝের কারণে। অথচ কে জানত তুই আগে থেকেই ভুল বুঝে বসে আছিস? পরে যখন ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছিলি না, ফোন-ও ধরছিলি না, তখন আমার এই ব্যাপারটা সন্দেহ হয়। দুদিন একটু ব্যস্ত ছিলাম। রিমার ব্যাপারটা নিয়েও ঝামেলায় ছিলাম। তোদের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না বলে কথাও বলতে পারছিলাম না। আজ ভার্সিটি ছুটির পর আসব ঠিক করেছি, রওনা দিতে, না দিতেই শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টির দিনে তো তোর কাছে জীবনেও ছাতা থাকে না, তাই ছাতা নিয়ে চলে এসেছি। আন্দাজ করেছিলাম মাঝরাস্তায় কাকভেজা অবস্থায় পাব।”
আরিন্তা সব কথা শোনার পরও চুপ করে আছে। সে ভাবছে এখানে ভুলটা কার। সে-ও আসল কারণটা জানত না, মিশকাত-ও ইচ্ছা করে তার থেকে দূরে থাকেনি। পুরো ব্যাপারটা ভুলের ওপরেই কে’টে গেছে। মিশকাত নিজেই আবার শুধাল,
“কিছু বলবি না?”
আরিন্তা এবার বলল,
“কী বলব?”
“কিছু খাবি?”
“এখানকার দোকান বন্ধ।”
“সামনের দোকান থেকে কিনে দিবো।”
আরিন্তা হ্যাঁ, না কিছু বলল না। আবারো চুপ হয়ে গেল। মিনিট দুয়েক পর রাস্তার মাঝখান বরাবর একটা বাইক ছুটে গেল। বাইকে দুজন তরুণ, পেছনেরজন একহাতে ছাতা ধরে রেখেছে, আরেক হাতে সিগারেট। মুহুর্তের জন্য পাশ দিয়ে গেলেও সিগারেটের গন্ধ এসে লাগল আরিন্তার নাকে। সিগারেটের গন্ধ তার কাছে সবসময় খুব বাজে লাগে। মিশকাতের দিকে তাকিয়ে দেখল মিশকাতের তেমন কোনো হেলদোল নেই। এসব গন্ধ যেন তার সয়ে গেছে। আরিন্তা কী ভেবে এবার নিজে থেকে ডাকল,
“শোনো?”
মিশকাত সাড়া দিলো,
“হুম, বল।”
“তোমার কি এখন মাঝে-মাঝে কখনো সিগারেট খাওয়া হয়?”
মিশকাত হেসে ফেলল। বলল,
“ওই ছেলেটাকে দেখে এই প্রশ্ন মাথায় এল? তুই কি জানিস না?”
“আগে তো খেতে না, এখন খাও কি না জিজ্ঞেস করিনি তো কখনো।”
মিশকাত দুষ্টুমি করার জন্য বলল,
“যদি বলি খাই?”
আরিন্তা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি মিথ্যা কথা বলছো।”
“তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
“ওসব খাবে না কখনো।”
“সেটা তোর ওপর নির্ভর করছে।”
আরিন্তা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমার ওপর?”
সামনেই একটা দোকান। দোকানে কয়েকজন ছেলেপেলে-ও বসে আছে। আরিন্তার শরীর ভেজা বলে মিশকাত সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। আরিন্তার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“পোনির স্থায়িত্ব যতদিন, পোল্ট্রির ভালো থাকার মেয়াদ ঠিক ততদিন।”
চোখের পলকে মিশকাত ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে এক ছুটে সামনের দোকানে ঢুকে পড়ল। আরিন্তা চুপ মে’রে সেদিকে তাকিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। জীবনে এমন কোনো মুহূর্ত কি সত্যিই আসবে, যখন সে মিশকাতের কাছ থেকে ছিটকে পড়বে শত মাইল দূরে? মিশকাত ফিরল কিছুক্ষণের মধ্যেই। হাতে গরম সিঙ্গাড়া, সমুচার প্যাকেট আর একটা কোক। দোকান পেরোনোর সময় সে আরিন্তাকে একটু আড়াল করে রাখার চেষ্টা করল। দোকান পেরিয়ে গিয়ে প্যাকেট খুলে একহাতে ধরে, আরেক হাতে ছাতাটা নিয়ে সে আরিন্তাকে খেতে বলল। আরিন্তার বাঁ হাতে কোক। ডান হাতে মিশকাতের হাত থেকে সিঙাড়া নিয়ে খাচ্ছে আর হাঁটছে আরিন্তা। মাঝে-মাঝে মিশকাতের মুখেও তুলে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আরিন্তা নরম গলায় ডাকল,
“মিশু ভাই?”
“হুম।”
“আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব বলে মনে হয় তোমার?”
মিশকাত কেমন অদ্ভুতভাবে বলল,
“মানুষ সব পারে রে পোনি।”
“তবে তুমি আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না কেন?”
“বেঁচে থাকলেই কি মানুষ ভালো থাকে? মানুষ ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকে, ভালো থাকা সবার কপালে থাকে না। মানুষ মানুষের ভালো থাকা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।”
আরিন্তা বলল,
“আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।”
“ছাড়তে দিলে তো ছাড়বি।”
সিঙাড়ার চিটচিটে তেল মাখা হাতেই আরিন্তা মিশকাতের হাতের কবজি চেপে ধরল। করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আর এসব ছেড়ে যাওয়ার কথা বোলো না আমায়। আমার ভালো লাগে না এসব শুনতে।”
মিশকাত মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা, বলব না।”
“রিমার সমস্যার কোনো সমাধান হয়েছে?”
“ছেলের অভিভাবকদের জানানো হয়েছে। বখাটে ছেলে তো, অভিভাবক মানে না। তাই রিমার বাবা আর চেয়ারম্যানকে জানিয়ে এসেছি। আজ ডাকার কথা।”
“ওহ্ আচ্ছা।তুমি আমাকে আগে জানালেই পারতে। আমি কি কাউকে বলতে যেতাম?”
“মহিলা মানুষের পেটে এসব কথা থাকে না।”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে অমন ভাবো?”
“না, তুই তো একটা গা’ধী।”
“তুমি বুঝি ভালো মানুষ?”
“নিঃসন্দেহে।”
“অ্যাহ্! পোল্ট্রির ভাব কত!”
“পোনির চেয়ে পোল্ট্রির কদর বেশি।”
“তোমার মাথা।”
তখন মিশকাতের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। হঠাৎ করেই শমসের খাঁন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার শরীরের ডানদিক প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। ওই মুহূর্তে শমসের খাঁনকে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। মিশকাতের পরীক্ষার মধ্যে এই বিপদ তার মাথায় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ভাগ্যিস এবারেও দুঃসময়ের বন্ধু হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান পুলক তালুকদার। আয়েশা খাতুন আর সুবর্ণা সবসময় শমসের খাঁনের কাছে থাকেন। মিশকাত সেখানে সবসময় থাকতে পারে না। পরীক্ষার জন্য তাকে বাড়ি আসতে হয়। মিশকাত চলে এলে আবার পেলব যায়। আয়েশা খাতুন আর সুবর্ণা একা তো আর সবদিক সামলাতে পারবে না। পুলক তালুকদার আর মেরিনা সুযোগ পেলেই গিয়ে দেখে আসেন। শমসের খাঁনের অবস্থা দিন-দিন খারাপ হয়। পুলক তালুকদার ছাড়া তার এই লাগাতার চিকিৎসার খরচ জোগানো সম্ভব ছিল না। মিশকাত পরীক্ষার জন্য বাড়িতে এসে যে কটা দিন থাকে, সে কদিন তার সবকিছু এলোমেলো লাগে। চিন্তায় পড়াশোনাটাও ঠিকমতো করতে ইচ্ছা করে না। বাড়ি ফাঁকা বলে মেরিনার কথায় সে ওই বাড়িতেই থাকে। পেলবের রুমে থেকে পড়াশোনা করে। মেরিনা সবসময় তার খাবার-দাবারের দিকে বিশেষ নজর রাখার চেষ্টা করেন। আরিন্তা-ও সুযোগ পেলেই মিশকাতের সাথে গল্প করতে বসে পড়ে। কখনো মিশকাতকে তার দাদির ঘরে টেনে নিয়ে যায়। মিশকাতের মন খারাপ তার সহ্য হয় না। সে সবসময় চায় মিশকাতকে চিন্তামুক্ত রাখতে।
আজ সন্ধ্যায় মিশকাত পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিল। আগামীকাল তার পরীক্ষা আছে। মেরিনা সন্ধ্যার নাশতায় হালিম রান্না করেছেন। আরিন্তাকে বললেন মিশকাতকে ডেকে আনতে। আরিন্তা বলল,
“মিশু ভাই আজ একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। মনোযোগ নষ্ট করার দরকার নেই। তুমি তার বাটি দাও, আমি দিয়ে আসছি।”
মেরিনা মিশকাতের জন্য রাখা হালিমের বাটিটা আরিন্তার হাতে দিলো। তা নিয়ে আরিন্তা পেলবের রুমে গিয়ে দেখল মিশকাত চেয়ারে বসে টেবিলে মেলে রাখা বইয়ের ওপর মাথা ঠেকিয়ে পড়ে আছে। আরিন্তা কাছে যেতেই মিশকাত মাথা তুলে তাকাল। আরিন্তা হাতের বাটিটা টেবিলে রেখে বলল,
“মা হালিম বানিয়েছে। গরম-গরম খেয়ে নাও। তোমার কি মাথা ব্যথা করছে?”
মিশকাত হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাল। আরিন্তা মিশকাতের কপালে হাত রেখে বলল,
“মাথা ব্যথার ঔষধ আছে। নিয়ে আসব?”
“নিয়ে আয়।”
আরিন্তা ছুটল মা-বাবার ঘরে। মেরিনার মাথা ব্যথার মলমটা নিয়ে আবার মিশকাতের কাছে ফিরে এল। মিশকাত হালিমের বাটি থেকে কয়েক চামচ মুখে দিয়েছে। আরিন্তা পাশে দাঁড়িয়ে মলম খুলে নিজেই আঙুলে নিয়ে মিশকাতের কপালে লাগিয়ে ঘষে দিতে লাগল। মিশকাতের ভালো লাগছে। সে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে। কিছু মুহূর্ত পর আস্তে-আস্তে বলল,
“দোকানটা ঠিকমতো খুলছি না। কী যে অবস্থা হবে!”
আরিন্তা বলল,
“দোকানের কথা এখন চিন্তা করতে হবে না। পরীক্ষা শেষ হলে ঠিকমতো খুলে বোসো।”
মিশকাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কয়েকটা দিনে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। আল্লাহ্ বাবাকে সুস্থ করে তুললেও এরপর হয়তো সংসার টানাপোড়েনে পড়বে। ভাবছি পরীক্ষা শেষে কী করব।”
“কোনোকিছু আটকে থাকবে না। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাবা আছে না? তুমি এত চাপ কেন নাও?”
“আছে তো। দিন-দিন শুধু তার কাছে ঋণ বাড়ছেই।”
“কিসের ঋণ? তোমরা কি পর কেউ? চুপ করো তো তুমি। বাজে চিন্তা কোরো না। আল্লাহ্ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে একসময়।”
তারপর আবার শুধাল,
“পরীক্ষা দিয়ে কি কালই কি তুমি ঢাকা যাবে?”
“হুম। পেলবের-ও তো পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। ও আর কতদিন থাকবে?”
“এবার আমাকে সাথে নিবে?”
“তোর না ক্লাস আছে?”
“কয়েকটা দিনে কিছু হবে না।”
“খালু যেতে দিবে?”
“মা বললেই যেতে দিবে। তুমি একবার মাকে বলো না। আমার যেতে ইচ্ছা করছে। খালা আর সুবর্ণা কত কান্নাকাটি করে ফোনে। ভালো লাগে না আমার।”
“আচ্ছা বলব।”
“হালিমটুকু খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“তুই খেয়েছিস?”
“না, গিয়ে খাব।”
“এখান থেকে খা।”
“না, আমারটা রাখা আছে। তুমি খাও তো। তোমার চুল টেনে দিবো?”
“লাগবে না, তুই গিয়ে খেয়ে নে আগে।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১১.
পেলবের এক চাচাতো ভাই দশ বছর যাবত আমেরিকা প্রবাসী। কথা ছিল পেলবের মাস্টার্স শেষ হলে তাকে-ও আমেরিকা নিয়ে যাবে। ভিসা, পাসপোর্ট সবকিছু গোছানো-ও শুরু করেছিল। সেই মুহূর্তে পুলক তালুকদার হঠাৎ বলে দিলেন পেলবের এখন আমেরিকা যাওয়া হবে না। তার বদলে ওই ভিসায় মিশকাত যাবে। পাসপোর্ট-ও মিশকাতের নামে করা হবে। হঠাৎ পুলক তালুকদারের এমন সিদ্ধান্তে সবাই অবাক হয়। আয়েশা খাতুন শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই না করে দেন। বাড়িতে তার স্বামী বিছানায় পড়ে আছে। একটু-আধটু হাঁটাচলা করতে পারলেও তার জন্য স্ক্র্যাচের ওপর নির্ভর করতে হয়। সুবর্ণা এখনও ছোটো। এমন পরিস্থিতিতে মিশকাত চলে গেলে সংসারটাই না এলোমেলো হয়ে যায়। পুলক তালুকদার শ্যালিকাকে বুঝান, এই মুহূর্তে মিশকাতের আর্থিক সচ্ছলতা খুব দরকার। শমসের খাঁন কবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার দোকানে বসতে পারবেন, তা অনিশ্চিত। মিশকাত দোকান চালাতে গেলে দোকানে অনেক পাওনা পড়ে যায়। বাকিতে এত পণ্য দিলে মানুষ সেই পাওনা সহজে মিটায় না। এদিকে আছে সুবর্ণার পড়াশোনার খরচ, হাত খরচ, সংসারের খরচ, শমসের খাঁনের ঔষধের খরচ। এতসব কীভাবে চলবে? সুবর্ণা বড়ো হচ্ছে। তাকে-ও তো বিয়ে-টিয়ে দিতে হবে। বিপদের সময় না হয় পুলক তালুকদার আপন ভেবে চিকিৎসার খরচ দিয়েছেন। তাই বলে সারা বছর তো আরেকটা সংসার চালানোর দায় তার নেই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য হিসাবে এই দায়িত্ব এখন অবশ্যই মিশকাতকে নিতে হবে। তাছাড়া তার পড়াশোনা-ও শেষ। এখন এমনিতেও তার কাজ খুঁজতে নামতে হত। মেরিনা আর পেলব-ও এই সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়েছে। তারা-ও আয়েশা খাতুন আর মিশকাতকে বুঝিয়েছে। খালুর সব কথাই মিশকাতের যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এই মুহূর্তে এছাড়া আর কোনো উপায় সে চোখে দেখছে না। পেলব নিজের ইচ্ছা ত্যাগ করে তাকে এমন সুযোগ করে দিয়েছে, পুলক তালুকদার নিজ দায়িত্বে তাকে আমেরিকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিবেন। তার জন্য এত ভালো সুযোগ আর কেউ করে দিবে না। অন্তত পরিবারের কথা চিন্তা করে তার রাজি হওয়া উচিত। আয়েশা খাতুনের চোখে পানি জমলেও শেষমেষ তাকে-ও রাজি হতে হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত জানার পর থেকে আরিন্তার সাথে এ বিষয়ে মিশকাতের কোনো কথা হয়নি। আরিন্তা-ও চুপচাপ আছে। ফোন করলে রোজকার মতোই স্বাভাবিক কথা হলেও ওসব প্রসঙ্গ কেউ টানে না।
একদিন সময় করে মিশকাত ভার্সিটি ছুটির সময় এল। আরিন্তা রিমার সাথে ছিল। দুজন গাড়ি ঠিক করতে গিয়ে মিশকাতকে লক্ষ্য করল। মিশকাত একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। হাত নাড়তেই আরিন্তা তাকে চিনতে পারল। রিমা বলল,
“মিশু ভাই তোকে ডাকছে মনে হয়।”
“হুঁ। তুই বরং চলে যা, আমি মিশু ভাইয়ের সাথে যাব।”
“আগে গিয়ে শুনে আয় কী বলে। এখন গেলে তো আমাদের সঙ্গেই যেতে পারে। এক পথেই তো যাব, আলাদা গাড়ি নেওয়ার কী দরকার?”
আরিন্তা বিরক্ত হলো। মিশকাত তাকে জানিয়ে এল না কেন? এই রিমা এখন পিছু নিলে তারা মনখুলে কথা বলবে কীভাবে? আরিন্তা যাওয়ার আগেই মিশকাত তাদের কাছে চলে এল। সে আসতেই রিমা হাসিমুখে শুধাল,
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
মিশকাত রিমার সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার পর থেকেই রিমা মিশকাতের প্রতি যেন আরও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মাঝে-মাঝে ম্যাসেজ-ও করে। প্রথমদিকে মিশকাত দু-একটা উত্তর দিলেও, এখন আর দেয় না। রিমাকে প্রশ্ন করার আর সুযোগ না দিয়ে মিশকাত বলল,
“ভালো আছি। তুমি চলে যাও। আমার একটা কাজ আছে, কাজ সেরে আরিকে নিয়ে যাব।”
“কতক্ষণ লাগবে কাজ সারতে? বেশিক্ষণ না লাগলে তো একসঙ্গেই যাওয়া যায়।”
“না থাক, আমার একটু সময় লাগবে। তুমি চলে যাও।”
রিমা বিষণ্ণ মনে বলল,
“আচ্ছা। শুনলাম আপনি না কি আমেরিকা চলে যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কবে?”
“পাসপোর্ট করা হয়নি এখনও। একটু সময় লাগবে।”
“ওহ্! আপনি চলে গেলে আপনাকে মিস করব ভাইয়া।”
মিশকাত কথা এড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা, সাবধানে যেয়ো, হ্যাঁ? আসছি। আরি, চল।”
রিমা গাড়িতে ওঠার আগেই মিশকাত উলটো পথে হাঁটা ধরল। আরিন্তা-ও হাত নেড়ে রিমাকে বিদায় জানিয়ে মিশকাতের পিছু নিল। রিমা কয়েক মুহূর্ত মন খারাপ করে মিশকাতের চলে যাওয়া পথে তাকিয়ে থেকে গাড়িতে উঠে পড়ল। আরিন্তা মিশকাতের পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“তোমার রিমা সুন্দরী তোমাকে কত মিস করবে বলল। উত্তরে একটু সান্ত্বনা তো দিতে পারতে।”
মিশকাত আরিন্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহা! এ কথা আগে মনে করিয়ে দিবি না? বেচারি ভাঙা মন নিয়ে চলে গেল।”
“আহারে! খুব কষ্ট লাগছে তোমার? ডেকে দিবো?”
“থাক, আপনার আর বেশি উপকার করার দরকার নেই। রা’ক্ষুসে পেটের কী অবস্থা? বেচারার ক্ষুধা পায়নি?”
“অপমান করছো, না? খাব না তোমার খাবার।”
“ঠিক আছে, তাহলে তো আমারই ভালো। পকেটের কিছু টাকা বেঁচে যাবে।”
“বাঁচাও টাকা। তারপর সেই টাকায় রিমা সুন্দরীকে উপহার কিনে দিয়ো, খুশিতে নাচবে।”
“বাহ্! তাহলে তো রিমা সুন্দরীর নাচ দেখতে পারব।”
আরিন্তা মুখ বাঁকাল। মিশকাত হেসে আরিন্তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“দাঁড়া এখানে।”
আরিন্তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মিশকাত পাশের দোকানে গেল। দোকান থেকে কিনে আনল দুটো চিপস, কিছু চকোলেট আর ঠান্ডা কোক। সেগুলো আরিন্তাকে সাধলে সে বলল,
“খাব না।”
“তুই আবার খাবারের ওপর রাগ করা শিখেছিস কবে থেকে?”
“আবারো অপমান করছো?”
মিশকাত ঠোঁট টিপে হাসল। খাবারগুলো আরিন্তার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আর কিছু বলছি না। নে খা। বলা তো যায় না এভাবে আর কটা দিন খাওয়াতে পারব।”
শেষের কথাটায় আরিন্তা চুপ হয়ে গেল। আর তর্ক না বাড়িয়ে চুপচাপ চিপসের প্যাকেট খুলে খেতে আরম্ভ করল। মিশকাত নিজেও একটা প্যাকেট খুলে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ডাকল,
“আরি?”
“বলো।”
“আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে তো কিছু বললি না এখনো।”
আরিন্তা স্বাভাবিকভাবেই উলটো প্রশ্ন করল,
“কী বলব?”
“কিছু বলার নেই?”
“কী শুনতে চাও তুমি?”
“তোর কষ্ট হবে না?”
“এখনো তো কাছেই আছো, ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“লুকাচ্ছিস?”
“লুকাব কেন? তুমি বুঝি আজীবনের জন্য যাচ্ছ?”
“গেলে ফেরার কথা তো বলা যায় না। আবার কবে ফিরতে পারব, কবে আমরা মুখোমুখি হব নিশ্চয়তা নেই।”
“যেদিনই ফিরো, ফিরে দেখবে আমি বউ সেজে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
মিশকাত হাসল। বলল,
“পারবি অপেক্ষা করতে?”
“সন্দেহ কেন আছে তোমার মনে?”
মিশকাত ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না রে। এতগুলো বছর কীভাবে কা’টাব? কাউকে দেখতে পারব না, ছুঁতে পারব না।”
আরিন্তা বলল,
“বাচ্চাদের মতো কথা বোলো না তো। দেখতে পারবে না কেন? প্রতিদিন নিয়ম করে সবার সাথে ভিডিয়ো কলে কথা বলবে। আমাকে তোমার কল করতে হবে না, আমি নিজেই করতে পারব। সময় কত দ্রুত কে’টে যায়! প্রয়োজনে তুমি সুযোগ বুঝে দেশে আসার চেষ্টা করবে। অন্যদের মতো তোমার বছরের পর বছর প্রবাসী হয়ে কা’টাতে হবে না। নিজেকে একটু ঠিকঠাকমতো গুছিয়ে নিয়ে তারপর এসে দেশেই কিছু করবে। বিয়ের পর কিন্তু আমি তোমাকে দূরে যেতে দিবো না।”
মিশকাত চুপ করে রইল। তারপর আস্তে করে বলল,
“সময়টা দীর্ঘ, এতদিনে হয়তো তোর জন্য অনেক ভালো পাত্র আসবে-যাবে।”
“আসুক, এলেই কি আমি নাচতে-নাচতে বিয়ে করে নেব?”
“কিন্তু খালু?”
“তুমি কি আমাকে ভরসা করতে পারছো না?”
“তোকে ভরসা করতে আমার ভয় নেই। ভয়টা খালুকে নিয়ে। ভালো পাত্র পেলে সে অবশ্যই বিয়ের পেছনে পড়বে।”
আরিন্তা গায়ে না মেখে বলল,
“পড়ুক।”
“তখন কী করবি?”
“প্রয়োজনে বলে দিবো তোমার কথা।”
মিশকাত চমকে উঠে বলল,
“সাহস হবে তোর? অন্য কোনো ছেলে হলে তেমন ঝামেলা ছিল না, কিন্তু আমি-”
আরিন্তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তোমার মাথায় কী ঢুকেছে মিশু ভাই? সবসময় তো তুমিই জোর গলায় বলো আমাকে হারাতে দিবে না। এখন নিজেই ভয় পাচ্ছ?”
মিশকাত ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছু মুহূর্ত নীরব রইল। আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে সত্যিই তার মন কেমন যেন হয়ে গেছে। পূর্বের মনের জোর এখন ভীতিতে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে এতগুলো বছরে সে আরিন্তাকে হারিয়ে ফেলবে। মিশকাত দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বলল,
“আমি নিজেকে গোছাতে তোর থেকে হাজার মাইল দূরে সরে যাচ্ছি আরি। এই দূরত্ব যদি তোকে গ্রা’স করে নেয়, তাহলে আমি গোছালোর বদলে আরও অগোছালো হয়ে যাব। একদম শেষ হয়ে যাব।”
মিশকাতের অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে আরিন্তার ভীষণ মায়া লাগছে। অসহায় মিশকাতকে সে এর আগে শুধু দেখেছে তার খালু যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। সেদিন মিশকাতের চোখে ছিল বাবা হারানোর ভয়। আজ তার চোখে ভালোবাসা হারানোর ভয়। আরিন্তার ভীষণ ইচ্ছা করছে মিশকাতের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে। কিন্তু আশেপাশের মানুষের বাঁকা চাহনির জন্য সেই সাহসটা হচ্ছে না। তবু আরিন্তা মিশকাতের হাতের ওপর আলতো করে নিজের হাতটা ক্ষণিকের জন্য ছুঁয়ে দিয়ে কন্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,
“তুমি এখন এসব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো তো। আমাকে নিয়ে তোমাকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমার ব্যাপার আমি সামলে নিতে পারব। তুমি শুধু সবসময় আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে, তাতেই হবে। বিয়ে আমি পোল্ট্রিকেই করছি, সে এক বছর পর হোক বা দশ বছর পর। পোল্ট্রি ছাড়া পোনিকে সহ্য করার মতো দ্বিতীয় কোনো মাথা আছে না কি জগতে?”
মিশকাত বলল,
“তবে থেকে যাস পোল্ট্রির হয়ে। আমি ফিরে যেন তোকে ঠিক এমনই দেখতে পাই।”
আরিন্তা একটু ভাবুক ভান ধরে বলল,
“ঠিক এমনই? না, একটু পরিবর্তন হতে পারে।”
“কী?”
“হতে পারে ততদিনে আমি আরও একটু বড়ো হব, একটু মোটা হব। তুমি এসে আমাকে দেখে আকাশ থেকে পড়ে বলবে, একি কাণ্ড! রেখে গেলাম পোনি, ফিরে পেলাম হাতি!”
কথাটা বলে আরিন্তা নিজেই ফিক করে হেসে উঠল। মিশকাত-ও না হেসে পারল না। তারপর শ্লেষের সুরে বলল,
“এত বছরে খেয়ে-খেয়ে যে হাতি হবি, তা নিয়ে সন্দেহের কিছু নেই। তাই আমার অবাক হওয়ার-ও কারণ নেই।”
“সে যা-ই বলো, আমার জন্য চকোলেট পাঠাতে ভুল করলে তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ।”
“শিয়ালের মুখে মুরগি তুলে দেওয়ার মতো ভুল আমি করি না।”
আরিন্তা চোখ ছোটো করে বলল,
“তার মানে কী? তুমি আমার জন্য চকোলেট পাঠাবে না?”
“সন্দেহ আছে?”
“প্রচুর সন্দেহ আছে। তোমার মনে শ’য়তানি বুদ্ধির অভাব নেই।”
“তাহলে আমার কাছে আগেভাগেই চাস কেন চকোলেট?”
“আর চাইব না। তুমি তোমার রিমা সুন্দরীর জন্য পাঠিয়ো বস্তা-বস্তা চকোলেট। ফিরে এসে দেখবে তোমার জন্য সাজানো বরণ ডালা হাতে নিয়ে বধূবেশে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে।”
মিশকাত বলে উঠল,
“আহা, কী দারুণ দৃশ্য!”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে মিশকাতের আস্তিন চেপে ধরে রাগত স্বরে বলল,
“আহাহাহাহা…খুব সুন্দর দৃশ্য, না? খুব শখ দেখার?”
মিশকাত আরিন্তার হাত সরিয়ে মাথায় মৃদু টোকা মে’রে বলল,
“হাত সামলা। রাস্তার মানুষজন গু’ন্ডা ভাববে।”
“ভাবুক।”
“আমার মতো একটা নিরিহ ছেলের সাথে এমন গু’ন্ডা মেয়ে দেখলে মানুষ আমাকে বলদ ভাববে।”
“অ্যাহ্! আসছে বলদ! তুমি বলদ হলে, বলদকে মানুষ কী বলবে?”
পরক্ষণেই আরিন্তার চোখ গেল রাস্তার পাশের ঝালমুড়ির ভ্যানগাড়ির ওপর। সঙ্গে-সঙ্গে সে বলে উঠল,
“মিশু ভাই, ঝালমুড়ি খাবে?”
মিশকাত উত্তর দিলো,
“ওটা খাবে হবে না, খাব হবে। খাদক মাইয়া।”
আরিন্তা ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলল,
“এক হলেই হলো। আমি খেলে তো তুমিও খাবে। চলো।”
“মাত্র না চিপস খেলি? চকোলেটগুলো-ও বাকি আছে এখনও?”
“আরে এসব পরেও খাওয়া যাবে। এসো তো।”
আরিন্তা আগে-আগে হাঁটা ধরল ভ্যানগাড়ির দিকে। মিশকাত মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বলল,
“কীভাবে পারিস এত গিলতে? মুখটার-ও তো একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।