#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
৫.
আরিন্তা শরবত নিয়ে মিশকাতের রুমে এসে দেখল মিশকাত বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ফোনে ভিডিয়ো দেখছে। পরনের জামা-কাপড়ও এখনো পালটায়নি। আরিন্তা দরজার সামনে থেকে ডাকল,
“মিশু ভাই, তোমার শরবত এনেছি।”
মিশকাত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ফোন বন্ধ করে হাতের তালুতে মাথা ভর দিয়ে বলল,
“ভেতরে আসতে জানিস না? না কি কোলে তুলে ভেতরে আনতে হবে?”
আরিন্তা ভেতরে গিয়ে মিশকাতকে শরবতের গ্লাস দিলো। মিশকাত শোয়া থেকে উঠে আরাম করে বসে গ্লাসে চুমুক দিয়ে গভীর আফসোসের সুরে বলল,
“আহ্! রোজ বাইরে থেকে ফিরে যদি এমন সুন্দরী বউয়ের হাতের ভালোবাসায় টলমলে শরবত পেতাম!”
আরিন্তা বলল,
“ঢং বন্ধ করো। তখন ওভাবে ইশারা করেছিলে কেন?”
“কেন আবার? আমার চাওয়া পূরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলাম না? ভুলে গেলি?”
“ভুলিনি। কী চাও তুমি?”
মিশকাত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলল,
“উলটা-পালটা কিছু চাইব?”
আরিন্তা চোখ পাকিয়ে বলল,
“ভালোয়-ভালোয় বলবে, না চলে যাব?”
“বলছি, এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন?”
“আমি তোমার বিয়ে করা বউ না যে, তোমার ঘরে এসে লাগাতার বসে থাকলেও কারো চোখে লাগবে না।”
“একদিন তো হবি।”
“তখন আর এখন আলাদা সময়। তুমি দ্রুত বলো কী চাও।”
মিশকাত বলে উঠল,
“বউ সাজে দেখতে চাই।”
আরিন্তা ভ্রুকুটি করে শুধাল,
“মানে? কে বউ সাজবে?”
“আমার ভবিষ্যত বউ।”
আরিন্তা চোখ বড়ো করে বলল,
“ফাজলামি করো? আমি কীভাবে বউ সাজব?”
“কেন? এমনিতে তো সুবর্ণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কম অকাজ করিস না। একটু বুদ্ধি খাটালে কাজের কাজও করতে পারবি।”
“বউ সাজতে শাড়ি, গয়না কোথায় পাব?”
“মায়ের বিয়ের শাড়ি, গয়না আছে তো। আপাতত না হয় শাশুড়িরটা দিয়েই টেম্পোরারি বউ সাজ। পরে বরের দেওয়া শাড়ি, গয়নায় পার্মানেন্ট বউ সাজবি।”
আরিন্তা চিন্তিত মুখে বলল,
“এমন ঝামেলায় না ফেললেও পারো। হুট করে আমি গিয়ে খালার বিয়ের শাড়ি, গয়না কীভাবে চাইব? আমি বউ সাজব শুনলে খালা না জানি মনে-মনে কী ভাববে!”
“কিছুই ভাববে না। সুবর্ণার হেল্প নে। এমনিতে তো ছবি-টবি তোলার জন্য-ও কত সময় সাজগোজ করিস।”
আরিন্তা ঠোঁট উলটে নাকি সুরে বলল,
“এটা পালটে দাও না প্লিজ। আমার ওসব চাইতে লজ্জা লাগে।”
“তার মানে তুই আমাকে কথা দিয়ে কথা রাখবি না?”
“তা নয়। আমি তো চাওয়া পালটে দিতে বলেছি।”
“চাওয়া কীভাবে পালটাব পোনি? এটা তো আমার বহুদিনের ইচ্ছা, তোকে বউ সাজে দেখব। আজ যখন সুযোগ পেয়েছি, তখন তুই আমাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছিস?”
আরিন্তা গাল ফুলিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মিশকাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে বহুদিনের চাওয়া পূরণের কোমল আবেদন। আরিন্তা মিনমিনে গলায় বলল,
“সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভালোই জানো। খালা আর সুবর্ণা যদি আমাকে লজ্জা দেয়, তাহলে তোমার খবর আছে।”
মিশকাত শুধু হাসিমুখে ঘাড় কাত করল। যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে সে প্রস্তুত। আরিন্তা গাল ফুলিয়ে মিশকাতের রুম থেকে বেরিয়ে এল।
আরিন্তা যখন সুবর্ণাকে বলল, ‘চল, আমরা সাজি।’ সুবর্ণার মুখে গাঢ় অনীহা ফুটে উঠল। আজ তার সাজগোজ করতে একদমই ইচ্ছা করছে না। সে বলল,
“এখন সাজতে ইচ্ছা করছে না আপু। চলো আমরা অন্যকিছু করি।”
“কেন ইচ্ছা করছে না? এমনিতে তো নিজের যখন ইচ্ছা করে, তখন আমাকে চেপে ধরে সাজিয়ে ছাড়িস। এখন আমার ইচ্ছা করছে, সেই বেলায় তোর ইচ্ছা চলে গেছে?”
সুবর্ণা ঘ্যানঘ্যান করে বলল,
“আমার একদম ভালো লাগছে না আপু।”
“আমার ভালো লাগছে। আয়, তুই না সাজলে আমাকে সাজিয়ে দে।”
“তুমি একা সেজে কী করবে?”
“ছবি তুলব।”
“আচ্ছা চলো তোমাকে সাজাই।”
সুবর্ণা তার সাজগোজের সমস্ত সরঞ্জাম বের করল। আরিন্তা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“শাড়ি পরব।”
সুবর্ণা শুধাল,
“আমার তো মাত্র দুইটা শাড়ি। কোনটা পরবে?”
“তোরটা পরব না। খালার শাড়ি পরব।”
“তাহলে তুমি গিয়ে মায়ের থেকে চেয়ে নিয়ে এসো।”
আরিন্তা ড্রয়িংরুমের কাছে গিয়ে চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। আয়েশা খাতুন এখনো সিরিয়াল দেখছেন। একটু আগে ভালোভাবেই বসে ছিলেন, এখন টান হয়ে সোফায় শুয়ে পড়েছেন। আরিন্তা শাড়ি চাইলে তিনি ‘না’ করবেন না। কিন্তু বিয়ের শাড়ি চাইবে কীভাবে? আরিন্তার ইচ্ছা করল গিয়ে মিশকাতকে বলতে, ‘এত যখন শখ তখন যাও, তোমার মায়ের কাছ থেকে শাড়ি, গয়না চেয়ে এনে দাও।’
কিছুক্ষণ ঠোঁট উলটে মনে-মনে এটা-সেটা ভেবে আরিন্তা ধীর পায়ে আয়েশা খাতুনের কাছে এগিয়ে গেল। তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল,
“খালা?”
আয়েশা টিভির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আরিন্তার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলবি?”
“তোমার একটা শাড়ি বের করে দিবে? আমি সাজব।”
“এখন?”
“হ্যাঁ, আমি আর সুবর্ণা ছবি তুলব।”
“এই রাতে পরবি শাড়ি?”
“হুম।”
“তোদের যে কখন কী শখ জাগে! আচ্ছা চল, দিচ্ছি।”
আয়েশা খাতুন সোফা ছেড়ে উঠলেন। আরিন্তা তার পেছন-পেছন রুমে চলল। আলমারি খুলে আয়েশা খাতুন প্রশ্ন করলেন,
“কোনটা পরবি?”
অনেকগুলো ভাঁজ করা শাড়ির মাঝে আরিন্তা চোখ বুলিয়ে চলল। হ্যাঁ, একটা লাল বেনারসি দেখা যাচ্ছে। এটাই বোধ হয় খালার বিয়ের শাড়ি। আয়েশা একটা নীল রংয়ের শাড়ি বের করলেন। বললেন,
“এটায় তোকে মানাবে।”
আরিন্তা শাড়িটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর লাল শাড়িটা দেখিয়ে শুধাল,
“এটা কি তোমার বিয়ের শাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
“দেখাও না একটু।”
আয়েশা তার বিয়ের শাড়িটা বের করলেন। লাল টুকটুকে জামদানির ওপর সোনালি সুতার কাজ। শাড়িটা আরিন্তা হাতে নিয়ে বলল,
“সুন্দর তো! এটা কার পছন্দ ছিল?”
“তোর খালুর।”
“তোমার বিয়ের ছবি দেখেছিলাম, তোমাকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছিল বউয়ের সাজে।”
আয়েশা হেসে বললেন,
“তোর মা সাজিয়েছিল।”
আরিন্তা লজ্জা ভেঙে বলে ফেলল,
“খালা, এটা আমি পরি?”
আয়েশা খাতুন অবাক হলেন। হাসতে-হাসতে জিজ্ঞেস করলেন,
“বিয়ের শাড়ি পরবি?”
“হ্যাঁ, দেখব আমাকে কেমন লাগে। পরি?”
“আচ্ছা, তোর ভালো লাগলে পর। ওড়না নিবি?”
“দাও।”
আয়েশা শাড়ির সাথে ওড়না-ও বের করে দিলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন,
“আর কিছু লাগবে, না আটকে দিবো?”
আরিন্তা একটু মিনমিনে কন্ঠে বলল,
“তোমার গয়নাগুলো দিবে?”
আয়েশা খাতুন সূক্ষ্ম চোখে আরিন্তার দিকে তাকালেন। মুচকি হেসে বললেন,
“তোর হঠাৎ বউ সাজার শখ জাগল কেন রে? বর খুঁজব?”
“ধুর! না। এমনি তোমার বিয়ের সাজ সুন্দর হয়েছিল দেখে আমারো সাজতে ইচ্ছা করছে।”
“তোরা পারিসও!”
আয়েশা তার বিয়ের গয়নাগুলো-ও বের করে দিলেন। শমসের খাঁন যখন জুয়াড়ির তালিকায় নাম লেখিয়েছিলেন, তখন আয়েশা বুদ্ধি করে তার সমস্ত গয়না মেরিনার কাছে আমানত রেখে এসেছিলেন। শমসের খাঁন অনেকদিন সেই গয়না চেয়েছিলেন, আলমারিতে খোঁজ-ও করেছিলেন। না পেয়ে শুধু নিজের দেওয়া গয়নাটুকু চেয়েছিলেন। আয়েশা খাতুনের গয়নাগুলো কিছু তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া আর কিছু শমসের খাঁনের থেকে। শমসের খাঁন যখন নিজের দেওয়া গয়না চেয়ে বসেছিলেন, আয়েশা খাতুন তখন বলেছিলেন তার বড়ো বোনের কাছ থেকে চেয়ে আনতে। শমসের খাঁনের সেই সাহস ছিল না যে, নিজে গিয়ে বড়ো শ্যালিকার কাছ থেকে গয়না চেয়ে আনবে। তিনি আয়েশা খাতুনের কাছেই বারবার চেয়েছিলেন। মাঝে-মাঝে ধমকাধমকি-ও করেছিলেন। কিন্তু আয়েশা কিছুতেই তার হাতে গয়না তুলে দিতে রাজি হননি। নিজের বিয়ের স্মৃতি কোন মেয়ে হারাতে দিতে চায়? আয়েশা খাতুন-ও চাননি। ভাগ্যিস তখন বুদ্ধি করে বড়ো বোনের কাছে রেখে এসেছিলেন। নইলে তার কোনো গয়নাই এত বছর অবধি টিকে থাকত না।
শাড়ি, গয়না নিয়ে আরিন্তা নাচতে-নাচতে রুমে আসার সময় মিশকাত ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছিল। আরিন্তার হাতে শাড়ি, গয়না দেখে সে হাসিমুখে কনিষ্ঠাঙ্গুলি দেখিয়ে শব্দহীন মুখ নাড়িয়ে বলল,
“ওয়েল ডান।”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে, মুখ বাঁকিয়ে সুবর্ণার রুমে ফিরে এল। তার হাতে নিজের মায়ের বিয়ের শাড়ি, গয়না দেখে সুবর্ণা চোখ দুটো ছানাবড়া করে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“একি! তুমি মায়ের বিয়ের শাড়ি, গয়না এনেছ কী করতে?”
আরিন্তা প্রশস্ত হেসে দুলতে-দুলতে বলল,
“তোর মায়ের মতো বউ সাজব।”
“মা দিয়ে দিলো?”
“দিবে না কেন? খালা কি আবার বউ সাজবে?”
“তুমি হঠাৎ বউ সাজবে কেন?”
“খালার শাড়িটা দেখে পরতে ইচ্ছা করল। খালার বিয়ের ছবিতে তাকে কী সুন্দর লাগে না?”
সুবর্ণা ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। আরিন্তা হেসে বলল,
“আমি-ও দেখব আমাকে কেমন লাগে?”
সুবর্ণা মুচকি হেসে বলল,
“তোমার নিশ্চয়ই বিয়ের সাধ জেগেছে। এবার যে বিয়ের প্রস্তাব এল, তাতে না করলে কেন? রাজি হলেই তো সত্যিকারের বউ সাজতে পারতে।”
আরিন্তা বিরক্ত মুখে বলল,
“তোর এত শখ থাকলে তুই বল, আমি তোর সত্যিকারের বউ সাজার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
“আমি তো আর বউ সাজতে চাইছি না। তুমি চাইছ, শখ তো তোমারই আছে।”
“আমার শখ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। নে, আমাকে হেল্প কর।”
আরিন্তা সুবর্ণার সাহায্যে আস্তে-ধীরে শাড়ি পরতে লাগল। আয়েশা খাতুনের ব্লাউজ আরিন্তার গায়ে অনেকটা ঢোলা। সুবর্ণা সেফটিপিন দিয়ে ব্লাউজটা যতটুকু পেরেছে চাপিয়ে দিয়েছে। সুবর্ণা খুব যত্ন করে গুছিয়ে শাড়ির কুঁচি-ও দিয়ে দিয়েছে। আরিন্তার পরনে শাড়িটা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে নতুন বউকেই সাজানো হচ্ছে। শাড়িটা তার জন্যই আনা। সুবর্ণা প্রশ্ন করল,
“তুমি নিজে সাজবে, না আমি সাজিয়ে দিবো?”
“তুই চুল বেঁধে দে, আমি সাজছি।”
“আচ্ছা।”
তারা দুজন সাজগোজের সরঞ্জাম নিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসেছে। আরিন্তা ছোটো আয়নাটা বিছানায় ফেলে একটু উপুড় হয়ে বসে নিজে-নিজে মেকআপ শুরু করেছে। সুবর্ণা তার পেছনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। দক্ষ হাতে চুল বাঁধতে তার বেশি সময় লাগেনি। চুল বাঁধা শেষ করে সে আরিন্তার সামনে গিয়ে বসল। আরিন্তা তখন মুখে ফাউন্ডেশন মাখছে। সুবর্ণা বলল,
“আপু, হালকা মেকআপ করো। ভারী মেকআপের চেয়ে হালকা মেকআপে তোমায় বেশি সুন্দর লাগে।”
“হালকা মেকআপ-ই করব। তোর তো চুল বাঁধা শেষ, এই নে, তুই-ই চোখ সাজিয়ে দে। আমার করতে দেরী হবে।”
সুবর্ণা এগিয়ে বসল। মেকআপ বক্স টেনে নিয়ে আরিন্তার চোখ সাজাতে লাগল।
এসব সাজ-গোজের ব্যাপারে সুবর্ণা অল্প বয়স থেকেই বেশ দক্ষ। ছোটো থেকেই সে খুব সাজতে পছন্দ করত। সেই থেকেই নিজে-নিজে সাজার চেষ্টা করত। মন খারাপেও সে সাজতে বসে। তার ধারণা সাজতে বসলে সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তখন তার সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকে সাজটা সুন্দর করে তোলার দিকে। গ্রামের মেয়েদের বিয়েতে মানুষজন তাকেই ডেকে নেয় বউ সাজানোর জন্য। আশেপাশের বাচ্চাদের-ও সে যখন ইচ্ছা ডেকে এনে সাজাতে বসে। বাচ্চারাও তার কাছে সাজতে পছন্দ করে। কখনো কারো সাজার দরকার পড়লে বা ইচ্ছা জাগলেই ছুটে আসে সুবর্ণার কাছে। সুবর্ণা এই কাজটা মন থেকেই খুব উপভোগ করে। এভাবেই সাজগোজে তার দক্ষতা অর্জন। সুবর্ণার মনের গোপন ইচ্ছা ছোটোখাটো একটা পার্লার দিবে। যদিও এই ইচ্ছার কথা সে ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি জানে না। তার চিন্তা হয় বাবাকে নিয়ে। শমসের খাঁন নিশ্চয়ই এই কাজটা পছন্দ করবেন না। শুনলেই রেগে যাবেন। সুবর্ণা সবে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। পার্লার দেওয়ার মতো পুঁজি তার নেই। এই ইচ্ছা পূরণ করতে হলে কারোর আর্থিক সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। এসব কথা চিন্তা করেই তার গোপন ইচ্ছাটা অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। সে নিজেও জানে না কোনোদিন তার এই ইচ্ছাটা পূরণ হবে কি না। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়েদের কাছে নিজেদের ছোটোখাটো ইচ্ছা পূরণ-ও এলাহি ব্যাপার।
আরিন্তাকে বউ সাজে দারুণ লাগছে। মনেই হচ্ছে না সে এমনি-এমনি বউ সেজেছে। যেন বধূবেশে নতুন বউ বরের আগমনের অপেক্ষায় আছে। সুবর্ণা হাসিমুখে বলল,
“আপু, তোমাকে যে কী দারুণ লাগছে! একদম সত্যিকারের নতুন বউ।”
আরিন্তা ঘুরেঘুরে নিজেকে আয়নায় দেখছিল। সুবর্ণার কথায় সে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
“খালার মতো সুন্দর লাগছে?”
“অবশ্যই। আজ যদি সত্যি-সত্যি তোমার বিয়ে হত, তাহলে তোমার বর বিয়ের চিন্তা ভুলে তোমার দিকেই হা করে তাকিয়ে থাকত।”
”বেশি-বেশি বলছিস।”
“বেশি-বেশি না, সত্যি বলছি। বিশ্বাস না হলে মাকে জিজ্ঞেস করবে, চলো। দেখি মা তোমাকে দেখে কী মন্তব্য করে।”
সুবর্ণা টেনেহিঁচড়ে আরিন্তাকে নিয়ে চলল মায়ের সামনে। আরিন্তা বলল,
“আরে, টানিস না, পড়ে যাব। যাচ্ছি তো আমি।”
আয়েশা খাতুন আরিন্তাকে দেখেই খুশি হয়ে গেলেন। আরিন্তার মাঝে যেন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন। সেই দিনটিকে স্মরণ করলেন, বহুবছর আগে যেদিন তিনি বউ সেজে শমসের খাঁনের জীবনে এসেছিলেন। সুবর্ণা বলল,
“মা, তুমিই বলো, আপুকে তোমার মতো সুন্দর লাগছে না?”
আয়েশা খাতুন হেসে বললেন,
“আমার চেয়েও দ্বিগুণ সুন্দর লাগছে। একদম সুন্দরী নতুন বউ। ছবি তুলে রাখ, আপাকে দেখাবি পরে। আপা দেখবে না তার মেয়েকে বউ সাজে কেমন পরীর মতো লাগে?”
আরিন্তা খুব খুশি হলো। মায়ের পছন্দ হয়েছে মানে ছেলেরও পছন্দ হতে বাধ্য। সুবর্ণার হাতে আয়েশা খাতুনের ফোন ছিল। সে ক্যামেরা অন করে ঠোঁট উলটে বলল,
“মায়ের ফোনের তো ক্যামেরা কোয়ালিটি ভালো না আপু। এত কষ্ট করে সেজে পচা ছবি তুলে লাভ কী?”
আরিন্তা বলল,
“মিশু ভাইয়ের ফোনটা চেয়ে আন, যা।”
“ভাইয়া ওর ফোন দিবে আমাকে? তাহলেই হয়েছে! চলো, তুমি নিজেই চাও।”
সুবর্ণা আরিন্তাকে নিয়ে গেল মিশকাতের ঘরে। মিশকাতকে ঘরে না দেখে দুজনে ভেতরে ঢুকে বুঝল মিশকাত ওয়াশরুমে আছে। তার ফোনটা বিছানায় পড়ে ছিল। সুবর্ণা গিয়ে ফোন হাতে তুলে বলল,
“এই তো ফোন। পাসওয়ার্ড জানলে ভালো হত। না বলেই নিয়ে পালাতাম।”
এই ফোনের পাসওয়ার্ড আরিন্তার অজানা নয়। প্রেমের সূচনা থেকেই এই ফোন জুড়ে রয়েছে সে নিজেই। তবু আরিন্তা বলল,
“দাঁড়া, মিশু ভাই আসুক।”
“আমি চেষ্টা করে দেখি খুলতে পারি কি না। পাসওয়ার্ড কী হতে পারে?”
সুবর্ণা আন্দাজে একটার পর একটা ভুল পাসওয়ার্ড প্রয়োগ করে চলল। কিন্তু কিছুতেই লক খুলতে পারল না। তবু সে হাল ছাড়ল না। একবার ব্যর্থ হয়ে নতুন উদ্যমে আবার চেষ্টা করেই চলল। আরিন্তা চুপচাপ দাঁড়িয়ে সুবর্ণার আপ্রাণ চেষ্টা দেখছে। বেচারির চেষ্টা যে কোনোভাবেই সফল হবে না তা সে ভালোভাবেই জানে। এরমধ্যে মিশকাত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। সুবর্ণা নিজের প্রচেষ্টায় এতটাই মগ্ন ছিল যে, ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ-ও তার কানে পৌঁছায়নি। আরিন্তা-ও প্রথমে ঠিক খেয়াল করেনি। মিশকাত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রথমেই সুবর্ণার হাতে তার ফোন দেখে তেড়ে যাওয়ার উদ্যোগ করছিল। পরক্ষণেই লাল টুকটুকে বউটার ওপর দৃষ্টি পড়তেই সে থমকে দাঁড়াল। এক চুল-ও নড়ল না, না টু শব্দটি করল। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল বধূরূপী আরিন্তার দিকে। এ যেন তার মায়েরই প্রতিচ্ছবি। ঊনত্রিশ বছর আগে তার মা এভাবেই বউ সেজে এসেছিল এ বাড়িতে। আজ ঊনত্রিশ বছর পর মনে হচ্ছে মায়েরই আরেক প্রতিচ্ছবি এ বাড়িতে বউ সেজে এসেছে। আরিন্তার দৃষ্টি মিশকাতের দৃষ্টিতে আটকাল দুই মিনিটের মাথায়। মিশকাতের অমন মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টি আরিন্তার অনেক বেশি প্রিয়। কিন্তু আজ যেন অনুভূতিটা অন্যসব দিনের চেয়ে একদম আলাদা। মিশকাতের চাহনিতে এত বেশি লজ্জা তো আরিন্তা এর আগে কখনো পায়নি। আজ মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ মিশকাতের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেই তার হাত-পা অবশ হয়ে যাবে। তার সামনে দীর্ঘ সময় থাকলে জ্ঞান-ও হারিয়ে ফেলতে হারাবে। আরিন্তা নিজেকে এই কঠিন লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতেই মৃদু কন্ঠে ডেকে উঠল,
“মিশু ভাই।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।