#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
৩.
আরিন্তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। প্রস্তাব এসেছে সেদিন অটোতে সাক্ষাত হওয়া সেই বৃদ্ধ দম্পতির মাধ্যমে। পাত্র তাদেরই আত্মীয়। নতুন শিক্ষকতা করছে, তা-ও সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। আরিন্তা তখন বাড়িতে ছিল। তাদের দেখে সে সালাম জানালেও, মনে-মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। মেরিনাকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে দেখে আরিন্তা কটমট করে বলল,
“মা, এত খাবার বুড়া-বুড়িকে না খাইয়ে আমাকে খাওয়াও, কাজে আসবে।”
মেরিনা বললেন,
“তোকে খেতে না বলে কে? ঘরে কি খাবারের অভাব?”
“অভাব নেই বলেই তো ট্রে ভর্তি খাবার অচেনা মানুষকে খাওয়াতে নিচ্ছ।”
মেরিনা রাগত স্বরে বললেন,
“এসব কোন ধরনের কথা? ঘরে মেহমান এলে আপ্যায়ন করব না? মেহমান কি সবসময় চেনা মানুষ-ই হয়? তুই তোর আব্বাকে একটা ফোন কর তো।”
“মা, তুমি কি আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাও? আব্বার কানে এসব কথা তুললেই সে বিয়ের পেছনে লাগবে।”
“বিয়ে দেওয়া, না দেওয়া পরের ব্যাপার। ঘরে মেয়ে থাকলে বিয়ের সম্বন্ধ আসবেই। কথাবার্তা না বলে কি মানুষজনকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়? এতে মানুষ খারাপ ভাবে। ওনারা তোর আব্বার সাথে কথা বলতে চাইছেন, বলুক। তারপর দেখা যাবে।”
আরিন্তা বিরক্ত মুখে বলল,
“তারপর আর কী দেখা যাবে? আমার আব্বা ছুটবে পাত্রের খোঁজ-খবর নিতে। ওসব আমার জানা আছে। তুমিই আব্বাকে ফোন করো। আমি ভাইয়াকে ফোন করছি।”
“আচ্ছা যা, আমিই করছি। তুই এই ট্রেটা দিয়ে আয়।”
আরিন্তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাবারের ট্রে নিয়ে গেল বৃদ্ধ দম্পতির কাছে। টেবিলে ট্রে রেখে সৌজন্যতা দেখিয়ে বলল,
“খান আপনারা। মা আসছে।”
আরিন্তা চলে আসার উদ্যোগ করতেই বৃদ্ধ বলে উঠল,
“বহো বইন, তোমার লগে কতা কই কয়ডা।”
আরিন্তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। তবু সে বসল না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
“জি বলুন।”
“তোমার নামডা কী জানি?”
“আরিন্তা।”
“আরিতা?”
“না, আরিন্তা।”
“কঠিন নাম-”
আরিন্তা বলে উঠল,
“কঠিন না। আপনার উচ্চারণ করতে সমস্যা হচ্ছে।”
“হ, হ। বুড়া মানুষ তো। তা তোমার বয়স কত হইল?”
“মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই দাদু।”
“ক্যান?”
“এটা নিয়ম।”
“এইডা আবার ক্যামন নিয়ম? বিয়ার সময় তো বয়স জানার দরকার আছে।”
আরিন্তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। আশেপাশে আর কেউ নেই। সে কন্ঠস্বর নিচু করে বলল,
“এবার ছাব্বিশে পা দিয়েছি দাদু। কাউকে বলবেন না যেন।”
বৃদ্ধ দম্পতির চোখ বড়ো হয়ে গেল। বৃদ্ধা অবাক হয়ে বললেন,
“তোমারে দেইখা তো বুঝা যায় না তোমার এত বয়স। মাইয়ারা আবার হাতে-পায়ে তাড়াতাড়ি বড়ো হইয়া যায়। ঘরের কাজকাম জানো কেমন গো?”
আরিন্তা বলল,
“কাজ? আমি তো কোনো কাজকর্ম জানি না দাদি। কখনো করিও না। আমার কাজ শুধু সারাদিন খাওয়া আর ঘুম।”
বৃদ্ধা অসন্তুষ্টির সাথে বললেন,
“মাইয়া মাইনষের ঘরের কাজকাম জানার দরকার আছে। বিয়ার পর নিজের সংসার সামাল দিতে হইব না? এহন থিকা তোমার মার কাছে কাজকাম শিখো।”
“কেন গো দাদি? আমার শ্বশুরবাড়িতে কাজ করার জন্য আর কোনো মানুষ থাকবে না? না কি কাজ করার মানুষ নেই বলে আমাকে নিবে?”
“এমন কইরা কতা কও ক্যা গো বইন? মাইয়া মানুষ বিয়ার পর নিজের সংসার নিজে সামলাইব, এইডাই তো নিয়ম।”
“এই নিয়মটা কে বানাল দাদি?”
“কে জানে? এইয়াই দেইখা আইছি ছোডোকাল থিকা।”
“দাদি, আমরা বর্তমান যুগের মেয়ে। আগেকার উদ্ভট নিয়ম-কানুন আঁকড়ে ধরে রাখার সময় এখন নেই আমাদের।”
বৃদ্ধা পান খাওয়া লাল দাঁতে জিব কে’টে বললেন,
“এইসব কতা আর মাইনষের সামনে কইয়ো না। মাইনষে খারাপ ভাবব।”
আরিন্তা হেসে বলল,
“সত্য কথা মানুষ খারাপ-ই ভাবে দাদি। এটাই নিয়ম। আপনারা খান, আমি আসছি।”
আরিন্তা উঠে ওপরে চলে গেল। রুমে গিয়ে পেলবকে ফোন করে এদিকের কাণ্ডের কথা বলল। পেলব শুনে রেগেমেগে একাকার। সে জানাল দশ মিনিটের মধ্যে সে বাড়ি আসছে।
বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে কথা বলার পর পুলক তালুকদার পাত্র দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন সময় করে তিনি পেলবকে নিয়ে যাবেন পাত্র দেখতে আর খোঁজ-খবর নিতে। কিন্তু পেলব নারাজ। সে এত তাড়াতাড়ি ছোটো বোনকে বিয়ে দিবে না। বড়ো বোন আশাকেও তার বাবা এমন হুট করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। ফলস্বরূপ তার বোনটার বর পছন্দ হয়নি। জীবনের কথা ভেবে সংসারজীবনে নিজেকে মানিয়ে নিলেও, এখনো পর্যন্ত সে তার বরকে মন থেকে পছন্দ করতে পারেনি। পেলব চায় না আরিন্তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটুক। তাছাড়া আরিন্তা এ বাড়ির ছোটো মেয়ে। তার পরে বাড়িতে আর কোনো মেয়ে নেই। সে চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে। পেলবের ইচ্ছা আরিন্তা অনার্স শেষ করার পর তার বিয়ে নিয়ে ভাববে। এই নিয়ে বাবা-ছেলের মাঝে বেঁধে গেল তর্ক। পুলক তালুকদার কিছুতেই ছেলেকে রাজি করাতে পারেননি। আরিন্তা মনে-মনে ভাইকে হাজারটা ধন্যবাদ জানিয়ে বসে আছে। কারণ বিয়ের কথা শোনার পর থেকে তার বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা চলেছে।
ওদিকে গত চারদিন ধরে মিশকাতের দেখা নেই। না ফোন ধরছে, না এ বাড়িতে আসছে, না কলেজের রাস্তায় দাঁড়াচ্ছে। বিয়ের কথা উঠেছে হতে আরিন্তা শ’খানেক ফোন করেছে মিশকাতকে। প্রতিবার রিং হয়ে কেটে গেছে। অথচ তার কোনো পাত্তা-ই নেই। ভাইয়ের অসম্মতিতে বাবা বিয়ের কথা ভোলার পর সে নিশ্চিন্ত হলেও, মিশকাতের প্রতি জমা হয়েছে অভিমান। সেই অভিমান কিছুটা রাগেও পরিণত হয়েছে।
আজ কলেজ ফেরার পথে হঠাৎ করেই আরিন্তার কী হলো কে জানে? ফিরছিল বাড়িতে, কিন্তু পথে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল খালার বাড়িতে। হঠাৎ ভাগনির আগমনে আয়েশা খাতুন খুশি হলেন। ছোটো মেয়ে সুবর্ণাকে ডেকে বললেন আরিন্তাকে তার একটা নতুন জামা বের করে দিতে। আরিন্তা বলল,
“খালা, আমি থাকব না। বাড়ি চলে যাব।”
আয়েশা খাতুন বললেন,
“যাবি কেন? এবার কতদিন পর এসেছিস! আজকে রাতটা থাকবি।”
“না, আমি এমনিতেই এসেছি তোমাদের দেখতে। বাড়িতে বলিওনি এখানে আসব।”
“তাতে কী হয়েছে? আমি ফোন করে বলছি তোর মায়ের কাছে। তুই যা, জামা পালটে, হাত-মুখ ধুয়ে আয়। আমি ভাত বাড়ছি।”
আরিন্তা আর জোর দিয়ে ‘না’ বলেনি। খালাকে সে যে অজুহাতই দেখাক না কেন, তার মন জানে সে এ বাড়িতে কেন এসেছে। বাড়িতে ঢুকে মিশকাতের কোনো সাড়াশব্দ পায়নি। বাড়ি আছে কি না তা-ও জানে না। এখনই চলে গেলে দেখা হবে কী করে? সুবর্ণার থেকে জামাকাপড় নিয়ে আরিন্তা কলেজ ড্রেস বদলে নতুন জামা পরল। সুবর্ণা তার তিন বছরের ছোটো হলেও, স্বাস্থ্যের দিকে দুজন একই রকম। তাই আরিন্তা মাঝে-মাঝে এ বাড়িতে এলে সুবর্ণার জামাকাপড়-ই পরে থাকে। খেতে বসেও আরিন্তার খাওয়ার রুচি চলে গেল। ঠিকমতো খেতে পারল না। কথায়-কথায় সুবর্ণাকে জিজ্ঞেস করল,
“মিশু ভাই কোথায় রে? কয়েকদিন ধরে আমাদের বাড়িও যাচ্ছে না।”
সুবর্ণা বলল,
“বাড়িতেই তো আছে, ঘুমাচ্ছে মনে হয়। কদিন ধরে তোমার আব্বার সাথে গোরুর হাটে দৌড়াদৌড়ি করছে কুরবানির গোরু কেনার জন্য। পছন্দমতো গোরু না কি পাচ্ছেই না। সেজন্যই মনে হয় তোমাদের বাড়ি যায়নি।”
আরিন্তা জানে এ কথা সত্য হলেও, পুরোপুরি সত্য নয়। মনের জেদ-ই আসল কারণ। আরিন্তা মুখে কেবল উচ্চারণ করল,
“ওহ্!”
আরিন্তার খালার বাড়িটা একতলা। তিনটা শোবার ঘর আর ডাইনিং, ড্রয়িংরুম। ছোটোখাটো একটা কিচেনও আছে। তবে দিনবেলায় তাদের রান্নাবান্না হয় বাইরের আলাদা রান্নাঘরে, জ্বালানি পু’ড়িয়ে। মিশকাতের বাবা শমসের খাঁন এককালে এই গ্রামের পয়সাওয়ালা ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। তখন মিশকাত ছিল খুব ছোটো। আয়েশা খাতুনের সঙ্গে তার বিয়েটা হয়েছিল পুলক তালুকদারের সাহায্যে। পুলক তালুকদার নিজের একমাত্র শ্যালিকাকে দেখেশুনে ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পার্শবর্তী গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে শমসের খাঁনের সাথে তার একটু-আধটু পরিচিতি ছিল। আয়েশা খাতুন যখন বোনের শ্বশুরবাড়ি আসা-যাওয়া করতেন, তখনই তিনি শমসের খাঁনের ফুপুর চোখে পড়েন। তারপর শমসের খাঁনের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে পুলক তালুকদারের কাছেই। পুলক তালুকদার দেখেশুনে নিজ দায়িত্বে শমসের খাঁনের হাতে আয়েশা খাতুনকে তুলে দিয়েছিলেন। প্রথমদিকে তাদের সংসারটা যথেষ্ট বিলাসবহুল ছিল। বলা চলে শমসের খাঁন তখন দুহাতে টাকা রোজগার করতেন। কথায় আছে যার টাকা বেশি, তার বন্ধুর অভাব হয় না। শমসের খাঁনের বেলায়ও কথাটা শতভাগ সত্যি ছিল। তার বন্ধু নামক কাল সাপের অভাব ছিল না। সেসব বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই কবে, কখন তিনি জুয়ার আসরের মধ্যমনি হয়ে ওঠেন, কেউ টেরও পায়নি। সেখান থেকেই শুরু হয় তার অধঃপতন। দুহাতে টাকা রোজগার করে দিনের পর দিন তা ঢালতে থাকেন জুয়ার আসরে। ফলস্বরূপ সংসারে শুরু হতে থাকে টানাপোড়েন। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপই থাকে না। আয়েশা খাতুন জানতে পেরে নিজের সংসারের চিন্তায় ছুটে গিয়েছিলেন পুলক তালুকদারের কাছে। পুলক তালুকদার অনেকদিন, অনেকভাবে শমসের খাঁনকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। বরং শমসের খাঁন জুয়ার আসরে টাকা ঢেলে-ঢেলে নিজের সমস্তটা হারিয়ে পথের ফকির বনে যান। আয়েশা খাতুনের সঙ্গেও তখন সম্পর্ক ভাঙার পথে। আয়েশা খাতুন সংসারের এমন টানাপোড়েন মানিয়ে নিতে গিয়ে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। দিনের পর দিন চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছিলেন। কিন্তু শমসের খাঁন সব হারালেও আয়েশা খাতুনকে ছাড়তে নারাজ ছিলেন। মিশকাত আর সুবর্ণা তখন ছোটো। মিশকাত যেটুকু বুঝতে শিখেছিল, সুবর্ণা তা-ও বুঝত না। দুটো সন্তান সাথে নিয়ে বা তাদের ছেড়ে সংসার থেকে বিদায় নেওয়া আয়েশা খাতুনের জন্য-ও সহজ ছিল না। তাই অতিষ্ট হয়েও তিনি সহ্য করে নিয়েছিলেন। পুলক তালুকদার আর মেরিনা অনেকদিন তাকে বলেছিলেন সে যদি ওই সংসারে আর মানিয়ে নিতে না পারে, তাহলে যেন ফিরে আসে। কিন্তু আয়েশা খাতুন দাঁত কামড়ে সমস্ত বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে অভাবের সংসারে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই করেছিলেন। তিনি সফলও হয়েছিলেন। তার সেই সফলতা শমসের খাঁনের মনে অনুতাপ এনে দিলেও, তিনি নিজের পুরোনো কোনোকিছুই আর ফেরত আনতে পারেননি। ব্যর্থ হাতে পুলক তালুকদারের সাহায্যে নতুন করে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলেন। আজ তাদের সংসারে সুখ আছে। সবসময় বিলাসিতায় ভাসতে না পারলেও, তারা অভাবে পড়ে নেই। শমসের খাঁনের জীবনের সেই কাল সাপ রূপধারী বন্ধুরা এখন তাকে চেনেও না। প্রয়োজন ফুরালে কে কার খবর রাখে? স্বার্থের বন্ধুত্ব কি আর অভাবে বজায় থাকে? শমসের খাঁনের জীবন পুরোপুরি পরিবর্তন হয়েছে নিজের ভুলের জন্য। আজ আর তার দুহাত ভর্তি টাকা নেই। আছে একটা সংসার চালানোর আর দুটো সন্তানকে মানুষ করার মতো সীমিত সাধ্য। শমসের খাঁন এটুকুর জন্যই পুলক তালুকদারের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই অভাবের দিনগুলোতে শ্যালিকার সংসার আর ভাগনে-ভাগনির জীবনের কথা ভেবে পুলক তালুকদার তার পাশে না দাঁড়ালে, অভাবের স্রোতেই হয়তো ভেসে যেত তার স্ত্রী, সন্তান, সংসার। পুলক তালুকদার আগাগোড়া-ই অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী মানুষ। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কোনো ভুল কাজ পছন্দ করেন না। নিজের কর্ম, সংসার দুটোই সামলান খুব যত্ন সহকারে। আর্থিক সচ্ছলতার দিকে তার কোনোকালেই কমতি ছিল না। তিনি নিজে যেমন সুখী জীবন পছন্দ করেন, তেমনি নিজের কাছের মানুষদেরও সুখী দেখতে পছন্দ করেন। পৃথিবীতে বোধ হয় খুব কম মানুষই আছে, যে নিজের সুখের পাশাপাশি অন্যের সুখ দেখতেও পছন্দ করে।
•
আরিন্তাকে পেলে সুবর্ণার মাথায় যত ভূ’ত চাপে। সুবর্ণার বাবা যখন বাড়ি থাকে না, তখন দুজন মিলে বাড়ি মাথায় তোলে। আরিন্তার খাওয়া শেষে সুবর্ণা তাকে নিয়ে বসল টিভি দেখতে। ভলিউম বাড়িয়ে হিন্দি গান ছেড়ে দুজন সোফায় পা তুলে বসেছে। গানের সাথে-সাথে দুজন গলা মিলাচ্ছে, আবার মাঝে-মাঝে নাচের তাল-ও উঠছে। বসে-বসেই তারা নাচছে, গাইছে। প্রায় দশ মিনিটের মাথায় নিজের ঘর থেকে মিশকাত চেঁচিয়ে উঠল,
“সুবর্ণার বাচ্চা, টিভি বন্ধ কর বলছি। আমি এলে কিন্তু আছড়ে মা’রব।”
সুবর্ণা দাঁতে জিব কে’টে দ্রুত রিমোট হাতে নিল ভলিউম কমানোর জন্য। আরিন্তা ঝট করে তার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে ভলিউম আরও বাড়িয়ে দিলো। একদম ফুল ভলিউম। সুবর্ণা মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“আল্লাহ্! আপু, কী করছো? ভাইয়া চলে আসবে, সাউন্ড কমাও তাড়াতাড়ি।”
আরিন্তা হেসে বলল,
“চুপ করে বোস।”
“ভাইয়া এসে পরে আমাকেই মা’রবে।”
“কিছু হবে না। মাঝে-মাঝে একটু সাহস নিয়ে ভাইদের বিরক্ত করতে হয়। চুপ থাক তুই।”
সুবর্ণা মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আমি কিছু জানি না। সব তোমার দোষ।”
“আচ্ছা, আমারই দোষ। দেখব নে তোর ভাই কী করে আমাকে।”
এরমধ্যেই মিশকাত সুবর্ণার ওপর চেঁচাতে-চেঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ড্রয়িংরুমে পা রেখেই সে কিছু সময়ের জন্য দুটো অতি প্রিয় চোখে থমকে গেল। পরক্ষণেই তেড়ে এসে সুবর্ণার পিঠে ধুমধাম কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো। সুবর্ণা অসহায়ের মতো চেঁচিয়ে উঠল,
“আমি কী করেছি? দেখছো না রিমোট আপুর হাতে?”
মিশকাত আবার এক পলক আরিন্তার দিকে তাকাল। তবু ত্যাড়া কন্ঠে বলে উঠল,
“আমি ঘর থেকে ডাক দিয়েছি, তুই শুনিসনি? তারপর আবার সাউন্ড বাড়ে কীভাবে? অতিরিক্ত সাহস হয়ে গেছে? চা’পড়ে গাল লাল করে ফেলব, বেয়াদব।”
নিরপরাধ সুবর্ণা রেগেমেগে সোফা থেকে উঠে পড়ল। ধুপধাপ করে পা ফেলে ঘরে চলে যেতে-যেতে রাগত স্বরে বলল,
“সবসময় হাত চলে বেশি। অযথা মা’রতে থাকে। বড়ো হয়েছে বলে বেশি বাড়াবাড়ি করে। আজকে যদি আব্বা এর বিচার না করছে-”
আরিন্তা সুবর্ণার চলে যাওয়া পথে তাকিয়ে ছিল। মিশকাত তার হাত থেকে রিমোট ছোঁ মে’রে নিয়ে সোফায় আছড়ে ফেলে দিলো। আরিন্তা মৃদু চমকে চোখ তুলে তাকাতেই শক্ত গলায় বলল,
“কী সমস্যা?”
আরিন্তা প্রত্যুত্তর করল না। নীরব চোখে তাকিয়েই রইল। মিশকাত পরবর্তী প্রশ্ন করল,
“কেন এসেছিস?”
এবারে আরিন্তা ধীর কন্ঠে জবাব দিলো,
“দেখতে এসেছি নিখোঁজ ব্যক্তি ম’রেছে, না বেঁচে আছে।”
“মরলে সুবিধা হত, না? রাস্তাঘাটে মানুষ রূপ দেখে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসত, আর বিনা বাঁধায় নাচতে-নাচতে বিয়ে করে অন্যের সঙ্গে সংসার পাতা যেত। খুব তো শখ।”
“হুম, অনেক শখ। আজই গিয়ে বলব ওই লোকদের ‘হ্যাঁ’ বলে দিতে।”
মিশকাত শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে নিয়েছে। মেয়েটা যেভাবে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, কড়া ভাবটা বজায় রাখা মুশকিল। মিশকাত পা দিয়ে মেঝেতে আঘাত করল। তারপর ধুপ করে সোফায় বসে পড়ল। আরিন্তা একটু সরে বসতে গিয়ে খেয়াল করল মিশকাতের ডান হাতের কবজি ফুলে লাল হয়ে আছে। হাতের দিকে নজর পড়তেই সে হাত বাড়িয়ে মিশকাতের হাতের কবজি ছুঁলো। জানতে চাইল,
“কী হয়েছে?”
মিশকাত মৃদু স্বরে উত্তর দিলো,
“গতকাল গোরুর হাটে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।”
“সাবধান হতে পারলে না?”
“আমি কি হাত পেতে গোরুকে বলেছিলাম ব্যথা দিতে?”
সুযোগ বুঝে আরিন্তাও সঙ্গে-সঙ্গে বলে বসল,
“তাহলে আমি কি যেচে ওই খারাপ লোকটাকে বলেছিলাম আমাকে ছুঁয়ে দিতে?”
মিশকাতের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল। আরিন্তা তার কবজিতে আঙুল বুলিয়ে দিতে-দিতে নরম গলায় বলল,
“জেনে-বুঝে এমন পা’গলামি কেন করো মিশু ভাই? তোমার থেকে কেউ আমাকে কেড়ে তো নিচ্ছে না।”
মিশকাত কিছু মুহূর্ত একইভাবে চুপ মে’রে বসে রইল। তারপর ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরিন্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোকে অন্য কোনো পুরুষ অনিচ্ছাকৃত ছুঁলেও আমার সহ্য হয় না। তুই বুঝিস না? ইচ্ছা করে তার হাত কে’টে ফেলে দিই।”
আরিন্তা মৃদু হেসে বলল,
“এখন যে আমি তোমাকে ছুঁয়েছি, সে বেলায় কী ইচ্ছা করছে?”
“আজীবন ছুঁয়ে থাক।”
“ইশ্! নিজের বেলায় ষোলো আনা?”
“হুঁ, আমার ষোলো আনা অধিকার আছে।”
“কিসের অধিকার দাবি করছো?”
“ভালোবাসার অধিকার। যা দ্বিতীয় কোনো পুরুষের নেই।”
“গত চারদিন সেই অধিকার কোথায় ছিল? খুব তো গাল ফুলিয়ে থাকা হয়েছে। আমি কতবার করে ফোন করেছি, তা-ও গায়ে লাগেনি। আগামী চারদিন আমিও দেখব কেউ আমাকে ফোন করে কি না। ফোন ছোঁব-ও না।”
“ঠিক আছে, দেখা যাবে কে আমার ফোন ইগনোর করে। তুলে এনে বিয়ে করে নেব একদম।”
“সাহস কত! আমার বাপ আর ভাই তোমায় আস্ত রাখবে না।”
মিশকাত তোয়াক্কা না করে বলল,
“কী করবে তোর বাপ-ভাই? মে’রে ফেলবে? অকালে বিধবা তো তাদের মেয়ে-ই হবে।”
আরিন্তা মিশকাতের বাহুতে চিমটি কে’টে বলল,
“চুপ, ফালতু কথা কম বলবে। আমার বেলাতেই জ্ঞান-বুদ্ধি চাঙ্গে উঠে যায়? পোল্ট্রি কোথাকার।”
মিশকাত চোখ পাকিয়ে তাকাল। আরিন্তা ভয় না পেয়ে উলটা মুখ বাঁকাতেই সে খপ করে আরিন্তার চুলের মুঠি চেপে ধরল। আরিন্তা ব্যথাতুর শব্দ করলেও ছাড়ল না। রাগত মুখে বলল,
“পোল্ট্রি, পোল্ট্রি করতে নিষেধ করেছি না বারবার?”
“তুমি পোল্ট্রি না তো কী? সাদা চামড়াওয়ালা, মোটাসোটা শরীরের পোল্ট্রির মতো দেখতে।”
কথাটা বলেই আরিন্তা গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“খালা…দেখে যাও তোমার ছেলে আমাকে আর সুবর্ণাকে মে’রে ফেলছে। খালা… তাড়াতাড়ি এসো। তোমার জল্লাদ ছেলেকে বারণ করো।”
আয়েশা খাতুন হাতের কাজ ফেলে রেখে তেড়ে এলেন। সুবর্ণা রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। মিশকাত আরিন্তার চুল ছেড়ে দিলো। আয়েশা বিরক্ত মুখে বললেন,
“মিশকাত, তোকে না বলছিলাম ওদের খ্যাপাবি না?”
মিশকাত বলল,
“মা, তোমার ভাগনিকে বলতে পারো না আমাকে পোল্ট্রি না বলতে? ওর বেয়াদবি চোখে পড়ে না তোমার?”
“তুই খ্যাপাস বলেই তো ও ওগুলো বলে। সাধে বলে?”
“হ্যাঁ, এভাবেই নিজের ছেলের বিপক্ষে দাঁড়াবে। তোমার মেয়েগুলো দুধে ধোয়া তুলসী পাতা।”
সুবর্ণা এগিয়ে এসে অভিযোগ তুলল,
“মা, তোমার ছেলে একটু আগেও আমাকে মে’রেছে।”
মিশকাত কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“অ্যাহ্! এসেছে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে। সর সামনে থেকে, বেয়াদবের দল।”
আয়েশা শাসনের সুরে বললেন,
“তোকে যেন আর ওদের পেছনে লাগতে না দেখি।”
মিশকাত কথাটা গায়েই মাখেনি। নিজের মতো চলে যেতে-যেতে বলল,
“আগে বেয়াদবগুলোকে আদব শেখাও মা।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।