#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২৯.
ভোর পৌনে পাঁচটা। নামাজের সময়। শমসের খান অভ্যাসবশত আজান শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই জেগে উঠেছেন। স্ত্রীকেও ডেকেছেন। আয়েশা খাতুন উঠে বসতেই শমসের খান দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,
“ভোরবেলা মেইন দরজা খোলা কেন?”
আয়েশা খাতুন লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে বলে উঠলেন,
“কী বলেন! দরজা খোলা থাকবে কীভাবে?”
“কেউ কি বাইরে গেছে না কি?”
“ভোরবেলা বাইরে যাবে কে? কেউ তো ওঠেইনি। দেখেন আবার চোর পড়ছে না কি। ও আল্লাহ্! দেখি সরুন।”
আতঙ্কিত হয়ে আয়েশা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন সত্যিই মেইন দরজা খোলা। শমসের খাঁন বললেন,
“কাল রাতে দরজা বন্ধ করতেই ভুলে গিয়েছিল না কি কেউ?”
“আরে না, আমিই তো দরজা আটকেছিলাম। তাড়াতাড়ি দেখেন তো সবাই ঘরে আছে কি না। আমার তো ভয় লাগছে।”
শমসের খাঁন সব ঘরের দরজায় চোখ বুলাতে গিয়ে দেখলেন ছেলের ঘরের-ই দরজা খোলা। ভেতরে লাইটও জ্বলছে। স্ত্রীকে ডাকতে-ডাকতে তিনি ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখলেন বিছানা ফাঁকা। শুধু তাই নয়, বিছানাসহ পুরো ঘরের লণ্ডভণ্ড অবস্থা। মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে ঝড় বয়ে গেছে। তার চেয়েও অবাক করা কাণ্ড হচ্ছে আলমারির তালা ভেঙে জিনিসপত্র সব জিনিস মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা। শমসের খাঁন দৌড়ে গিয়ে আলমারির দরজা খুলতেই তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। টাকার ড্রয়ার সম্পূর্ণ ফাঁকা। আয়েশা এসব দেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। তার চিৎকারে বাড়িসুদ্ধ সবাই চমকে উঠেছে। আতঙ্কিত হয়ে ঘুম জড়ানো চোখে ছুটে এসেছে। মিশকাতের ঘরের এমন অকল্পনীয় অবস্থা দেখে সবার মাথায় হাত। কিছু যে একটা ঘটেছে তা সবার কাছে স্পষ্ট। কিন্তু এই মুহূর্তে মিশকাতের খোঁজ করা আগে প্রয়োজন ভেবে তাকে ফোন করা হলো। তিন-চার জন মিলে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। ফোন বন্ধ বলছে। সবার চোখে-মুখে ভীতি। আরিন্তার মন কেন জানি বলছে মিশকাত নিজেই কিছু একটা ঘটিয়েছে। আচ্ছা, সে এখান থেকে বাঁচতে সরে যায়নি তো? গেলেও এভাবে যাওয়ার তো মানে নেই। আয়েশা, মেরিনা রীতিমতো কান্নাকাটি জুড়ে বসেছেন। সবাই মিলে বাড়ির বাইরে চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও মিশকাতকে পেল না। শেষে নিয়াজ দুজন ছেলে সাথে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল খোঁজ নিতে। যদি কেউ দেখে থাকে! সেই যে সকালে তারা বেরুল, গোটা সকালে আর বাড়ি ফিরল না। এলাকা চষে বেড়াল। থানায়ও জানানো হয়ে গেছে। ওদিকে বাড়িতে শোকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে নোভা-ও প্রচণ্ড চিৎকার করছে। বড়োদের অবস্থা দেখে মেয়েটা ভয় পেয়েছে। আরিন্তা কাকে সামলাবে কূল পাচ্ছে না। আপন মনের অবস্থা না হয় চাপা-ই পড়ে থাকল।
গোটা দিন কে’টে গেল। মিশকাতের কোনো খবর পাওয়া গেল না। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে নিয়াজ ফোন করে জানাল মিশকাতকে পাওয়া গেছে। তারা বাড়ি ফিরছে। সবার সারাটা দিনের অশান্ত মন যেন শান্ত হলো এবার। সন্ধ্যার পর গাড়ির শব্দে সবার বুকের ভেতর কামড় দিয়ে উঠল। আরিন্তা তখন ঘরে বসে নোভাকে দুধ পান করাচ্ছিল। হঠাৎ গাড়ির শব্দের সঙ্গে আয়েশার গগনবিদারী চিৎকার কানে আসতেই সে নোভাকে কোলে চেপে ছুট লাগাল। তার আতঙ্কিত পা দুটো দরজাতেই থমকে গেল। উঠানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দানবের মতো অ্যাম্বুলেন্সটা গলা তুলে বিপজ্জনক হাঁক ছাড়ছে। তার আওয়াজে বুক কেঁপে ওঠে। নিয়াজ, পেলব আর দুজন ছেলে মিলে তার ভেতর থেকে বের করল সাদা কাপড় মোড়ানো লম্বাচওড়া এক দেহ। দেহটা উঠানে রাখতেই আয়েশা, মেরিনা আর্তনাদ তুলে লুটিয়ে পড়লেন তার ওপর। হতভম্ব আরিন্তার মস্তিষ্ক হঠাৎ খনিকের জন্য সজাগ হয়ে ঘটনা অনুধাবন করল। পরক্ষণেই তার মনে হলো মাথাসহ শরীরটা ভীষণ ভার হয়ে আসছে। দুচোখে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসতেই সে বাড়ি কাঁপিয়ে ‘ও আল্লাহ্!’ বলে এক চিৎকার দিয়েই শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। তার শরীরটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে দেখেই নিয়াজ ছুটে এল। নিয়াজের আগে মিশকাতের চাচি আরিন্তাসহ নোভাকে আঁকড়ে ধরে ফেলেছে। চারদিকের অস্বাভাবিক পরিবেশ বুঝতে না পেরে অবুঝ নোভা হঠাৎ ভয়ে কেঁদে উঠল। নোভাকে পেলবের কাছে দিয়ে নিয়াজ দ্রুত আরিন্তাকে বুকে আগলে ধরে কাউকে পানি আনতে বলল। এক মেয়ে পানি এনে দিলো। নিয়াজ আরিন্তার মাথার তালুতে, চোখে-মুখে পানির ছিটা দিতে লাগল।
ইতোমধ্যেই উঠানে ভীড় জমে গেছে। চারদিকের মানুষজন ছুটে এসেছে। উঠানের মরদেহের পাশে আয়েশা, মেরিনাসহ তার জায়েরা সমানে আর্তনাদ করে চলেছেন। আয়েশা, মেরিনা একটু পরপর জ্ঞান হারাচ্ছেন। মানুষজন আরও হৃদয়বিদারক কান্না দেখলেন শমসের খাঁনের। উঠানে লুটিয়ে পড়ে মাটি আছড়ে, বুক আছড়ে অসহায়ের মতো কাঁদছেন মানুষটা। তার বুক যেন কিছুতেই এই কষ্ট বহন করতে পারছে না।
আরিন্তার জ্ঞান ফিরতেই সে নিয়াজের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠেপড়ে দৌড় লাগাল। এক দৌড়ে গিয়ে মরদেহের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। সাদা কাপড়ের ফাঁকে বেরিয়ে আছে কেবল নিষ্পাপ মুখটা। সারা মুখে শুকিয়ে থাকা রক্তের দাগ। কপালে আঘাতের চিহ্ন। তবু যেন ওই মুখে নেই বিষাদের ছায়া। গোটা পাঁচ বছর পর যেন আরিন্তা সেই সহজ, স্বাভাবিক মুখে দেখতে পেল তার মিশু ভাইকে। মিশকাতের প্রাণহীন দেহের ওপর আছড়ে পড়ে আরিন্তা করুণ সুরে আর্তনাদ তুলল,
“ও আল্লাহ্, এ কী করলে! আমার মিশু ভাই… কী করলে খোদা!”
মিশকাতের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে সে বাচ্চাদের মতো ডাকল,
“ও মিশু ভাই, মিশু ভাই, ওঠো। এমন কোরো না, আমি মানতে পারব না মিশু ভাই। ওঠো না তুমি। তোমাকে আর কষ্ট দিবো না মিশু ভাই। আমায় মাফ করো। এত বড়ো শাস্তি তুমি আমায় দিয়ো না। তোমার পায়ে পড়ি মিশু ভাই, একবার ওঠো।”
আরিন্তা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মিশকাতের পা জড়িয়ে ধরল অনুনয়-বিনয় করল। কিন্তু তার এই করুণ ডাক আজ আর মিশকাতের কান অবধি পৌঁছাল না। মিশকাত একবার চেয়ে দেখল না তার প্রাণভোমরা তার জন্য গলাকা’টা মুরগির মতো ছটফট করে কাঁদছে। মহিলারা আরিন্তাকে সামলাতে পারল না। তারা ধরতে এলেই আরিন্তার শরীরে যেন দ্বিগুণ শক্তি ভর করে। মেরিনাকে আঁকড়ে ধরে আরিন্তা অনুরোধ করল,
“ও মা গো, তোমার আদরের ভাগনেকে উঠতে বলো। আমি বেঁচে আছি কেন মা? আল্লাহ্ আমাকে কেন আগে নিল না? আমি সহ্য করতে পারছি না মা। আমার মিশু ভাইকে উঠতে বলো।”
মেরিনা মেয়েকে কী সান্ত্বনা দিবেন? তাকেই সামলাচ্ছে আরেকজন। নিয়াজ অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। বাড়িতে পা রাখা এমন কোনো মানুষ নেই, এ বাড়ির মানুষগুলোর কান্না দেখে যার চোখে এক ফোঁটা জল না বেরিয়েছে। আজ পেলবের চোখ-ও শুকিয়ে নেই। চারপাশের মানুষজন যখন মিশকাতের মৃ’ত্যুর ঘটনা নিয়ে বলাবলি করছিল, তখন আরিন্তার কানে যায় এ সাধারণ মৃ’ত্যু নয়, খুন। এ কথা শুনতেই আরিন্তার মাথায় কী এক চিন্তাধারা খেলে গেল! পেলব সামনে আসতেই সে আচমকা হিংস্র বাঘের মতো ভাইয়ের ওপর আক্রমণ করে বসল। দুহাতে পেলবের গলা চেপে ধরে হুঙ্কার ছাড়ল,
“তুই এই সর্বনাশ করেছিস না? তুই আমার মিশু ভাইকে শেষ করে দিয়েছিস। তুই ছাড়া আর কেউ এই জা’নোয়ারের মতো কাজ করতে পারে না। আমার মিশু ভাইকে তুই-ই শেষ করে দিয়েছিস। তোকে আমি আর ছাড়ব না পাষণ্ডের বাচ্চা।”
পেলব গলা থেকে আরিন্তার হাত সরিয়ে দুহাতে আটকে বুঝাতে চাইছে,
“শান্ত হ বোন। কী বলছিস? এসব আমি করব কেন? তোর মাথা ঠিক নেই। শান্ত হ।”
“তুই করবি কেন? এই তুই জানিস না তুই কী করতে পারিস? তোর কারণে সব হইছে। তুই আমাকে মরার মতো বাঁচিয়ে রেখেছিস। এই তুই, তুই আমার মিশু ভাইয়ের সম্পূর্ণ জীবন নষ্ট করেছিস। তাতেও তোর শান্তি হয়নি? শেষমেষ পশুর মতো জানটা কেড়ে নিলি? এই জা’নোয়ার, তোর কি ম’রার ভয় নেই?”
নিয়াজ আরিন্তাকে জোর করে পেলবের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তা-ও আরিন্তা সরতে চাইল না। নিয়াজকে বলল,
“ছাড়ো আমাকে। তুমি ওকে চেনো না। আমার চেয়ে ভালো ওকে কেউ চেনে না। ওর মাঝে হৃদয় বলতে কিছু নেই। ও নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। তুমি ওকে ধরো। ও আমার মিশু ভাইকে খু’ন করছে। আমার মিশু ভাই-”
আরিন্তা আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। নিয়াজ অনবরত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বলল,
“শান্ত হও প্লিজ। পা’গলামি কোরো না।”
“আমার মন মানছে না গো। আমি তো সব মেনে নিয়েছিলাম। ওই মানুষটা নিজের সবটা ত্যাগ করেছিল আমার ভালোর জন্য। তার সাথেই কেন এমন অবিচার হলো। তার সাথে বারবার কেন এমন অবিচার হয় বলতে পারো? সে তো জীবনে কোনো অন্যায় করেনি।”
“শান্ত হও, শান্ত হও আরিন্তা, একটু শান্ত হও। মেয়েটা ভয় পেয়েছে তোমার কান্না দেখে। আল্লাহ্ কখন কাকে নিয়ে যান, বলা যায় না।”
“আল্লাহ্ আমায় কেন নিল না? এইদিন দেখানোর জন্যই তোমরা আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিলে? আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমি তোমায় বুঝাতে পারব না। আমি সব সহ্য করে নিয়েছিলাম। এই আঘাত আমি সইব কী করে? আমার দমবন্ধ লাগছে। ও নোভার আব্বু, ওই মানুষটাকে একবার উঠতে বলো না। বলো না পোনি তাকে ডাকছে, বলো না।”
আরিন্তা পুনরায় ছুটে গেল মিশকাতের নিশ্চল, ঘুমন্ত দেহের পাশে। অসহায়ের মতো আহাজারি করল,
“ও মিশু ভাই, ওঠো না মিশু ভাই। তুমি আমায় বকবে না? তোমার পোনি আর তোমার সাথে ঝগড়া করবে না, বিশ্বাস করো। আর তোমায় কষ্ট দিবে না। ওঠো না…।”
খানিক বাদে আবারও আরিন্তা জ্ঞান হারাল। আরিন্তার বিলাপ চারপাশের মনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক করছে বুঝতে পেরে নিয়াজ মেয়েদের দিয়ে অজ্ঞান আরিন্তাকে ঘরে পাঠিয়ে দিলো। আয়েশা, মেরিনার একই অবস্থা। শমসের আলী চিৎকার থামিয়ে এখন অনুভূতিশূন্য, ভাবলেশহীন সিক্ত চোখ মেলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মানুষের বাবা হারালে না কি পরিবারের প্রাণ হারিয়ে যায়? তার তো ছেলে হারিয়ে পরিবারের প্রাণ হারানোর অনুভূতি হচ্ছে। এই ছেলেটাই তো তার পরিবারের প্রাণ ছিল। গোটা পরিবারকে দায়িত্ব নিয়ে নিজের কাঁধে তুলে রেখে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। এই প্রাণ ছাড়া তার পরিবার কীভাবে টিকে থাকবে? পাঁচ বছর বাদে ছেলেকে এক পলক দেখেও তারা শান্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু কোনোদিন না দেখার যন্ত্রণা কীভাবে সহ্য করবেন? কীভাবে মেনে নিবেন পরিবার জুড়ে ছেলের অভাব? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে যে ছেলে পরিবারকে বাঁচাতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল, সে ছেলের বিদায় মেনে নেওয়া কি এত সহজ? মিশকাতের বাবা-মায়ের তো মনে হচ্ছে তাদের শরীর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটাই হুট করে খসে পড়েছে।
আত্মীয়-স্বজনরা বোনের বিয়েতে এসে সাক্ষী হলেন ভাইয়ের করুণ মৃ’ত্যুর। সুবর্ণাকে কিচ্ছু জানানো হয়নি। জানানো হয়েছে তার শ্বশুর-শাশুড়ি আর স্বামীকে। তার বিয়ের মাত্র দ্বিতীয় দিন। সে আশায় ছিল পরদিন বউভাতে আপনজনদের দেখার। তার শ্বশুরবাড়িতে বউভাতের জন্য আজ থেকেই নানান প্রস্তুতি চলছে। এরমধ্যে তার বর হঠাৎ তাকে নিয়ে কোথাও যাবে শুনে অবাকই হয়েছিল। তবু সারপ্রাইজ ভেবে যেতে রাজি হয়েছিল। বাড়ি যাওয়ার পথ তার জানা নেই। তার ওপর রাতের অন্ধকার। তাই গাড়িতে বসে বুঝতে পারছিল না কোথায় যাচ্ছে। পথ শেষ হচ্ছে না দেখে সে অধৈর্য হয়ে পড়ায় তার বর বলেছে একটু দেরী হবে। তার বর তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। বিয়ের ব্যস্ততার মাঝে ঠিকঠাক ঘুমাতে না পারাতে মেয়েটা গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে পড়েছিল। তার ঘুম ভাঙল বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে। মাঝরাতেও জানালা দিয়ে নিজের এলাকা চিনতে তার ভুল হলো না। সে অত্যাশ্চর্য মুখোভাব নিয়ে বরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এ তো আমাদের এলাকা! আপনি আমায় আমাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন? কেন?”
“এসেই তো পড়েছি। আরেকটু একটু ধৈর্য ধরো।”
সুবর্ণার হঠাৎ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো। কোনোকিছু স্বাভাবিক মনে হলো না। সে সন্দিহান কন্ঠে শুধাল,
“কী ব্যাপার বলুন তো? বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“সমস্যা হবে কেন? চুপ করে বসো।”
“না, না, আমার ভালো লাগছে না কিছু। এতরাতে আপনি আমায় কিছু না বলে আমাদের বাড়ি আনবেন কেন? কালই তো বউভাত। আমার বাবা ঠিক আছে তো? বলুন না।”
“তোমার বাবা একদম ঠিক আছে। প্যানিক হয়ো না তুমি।”
সুবর্ণা নিজের কোলের ওপর চোখ বুলিয়ে বলল,
“আমার ফোন কোথায়? দেখি, ফোন দিন। নিশ্চয়ই কিছু খারাপ হয়েছে। ফোনটা দিন।”
“ফোন দিয়ে কী করবে এখন?”
“ভাইয়ার সাথে কথা বলব।”
“এখন আর কথা বলতে হবে না। এসে পড়েছি। তুমি নিজেকে শান্ত করো প্লিজ। এমন টেনশন করলে শরীর খারাপ হবে।”
গাড়ি বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই সুবর্ণার কানে ভেসে এল এক পরিচিত কন্ঠের আহাজারি। তার মায়ের কন্ঠ। সঙ্গে-সঙ্গে সে কান খাঁড়া করে আতঙ্কিত মুখে বলে উঠল,
“মা কাঁদছে।”
“কোথায়?”
“আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আমার বাবা কী হয়েছে? আল্লাহ্!”
সুবর্ণা প্রায় কেঁদেই ফেলল। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে থামাল বাড়ির ভেতরে। রাত তখন আড়াইটা। গাড়ির দরজা খুলে তাড়াহুড়া করে নেমে দাঁড়াতেই সুবর্ণা দেখল উঠানেই চেয়ার পেতে বসে আছে তার বাবা। এলাকার কয়েকজন মানুষও দেখা যাচ্ছে। গোটা বাড়িটা কেমন ঝিম মে’রে আছে। কেমন থমথমে পরিবেশ! সুবর্ণা এগিয়ে গিয়ে বাবাকে ডাকল। শমসের খাঁন সাড়া দিলেন না। পাথরের ন্যায় বসে রইলেন। সুবর্ণা গায়ে হাত দিয়ে ডাকার পর কেবল চোখ তুলে তাকালেন। মেয়ের মুখটা দেখেই তার দুচোখ বেয়ে নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সুবর্ণা ভেজা চোখে জানতে চাইছে,
“কী হয়েছে বাবা? ও বাবা, বলো না।”
শমসের খাঁন উত্তর দিতে পারছেন না। তার ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে। ছোটো চাচার ঘর থেকে পুনরায় মায়ের আহাজারি ভেসে আসতেই সুবর্ণা সোজা হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে ছুট লাগাল চাচার ঘরের দিকে। তার চাচার ঘরটা টিনের তৈরি। দরজা ভেজানো ছিল। সুবর্ণা এক ছুটে বারান্দায় উঠে এসে দেখল খাটিয়ার পাশে বসে তার কান্নারত মা। খালা, চাচিদের হাতে তাসবি। কেউবা কোরআন পাঠ করছে। সবার চোখে জল। তার মন বলল চাচা নেই। কিন্তু মায়ের পাশে আরিন্তাকেও দেখতে পেল। কেমন পাথুরে মূর্তির মতো বসে আছে! মনে হচ্ছে এতটুকু জ্ঞান নেই। সুবর্ণা রুদ্ধশ্বাসে মায়ের কাছে গিয়ে বসতেই আয়েশা খাতুন তাকে দেখে এক চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
“সুবর্ণা রে, তোর ভাই শেষ রে সুবর্ণা। আমার বুক খালি করে দিছে রে মা।”
সুবর্ণা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। অবিশ্বাস্য চোখে খাটিয়ায় শায়িত দেহের দিকে তাকালে ওপাশ থেকে তার চাচি মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে দিলো। নিমেষেই সুবর্ণা ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল,
“ও আল্লাহ্ গো…আমার ভাই! ও মা আমার ভাইয়ের কী হয়েছে? ও ভাই, ও ভাই তোমার কী হলো? ও আপু, আমার ভাই এখানে শুয়ে আছে কেন? ও ভাই গো…।”
সুবর্ণার ছটফটানিতে আরেক দফা কান্নার রোল পড়ে গেল। এই তো গতকালই তার ভাই তার বিদায়ে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদল। সেই ভাই আজ তাকেই কাঁদিয়ে আজীবনের জন্য বিদায় নিল, এ যেন তার কল্পনার বাইরে। সারাদিন সে ভাইয়ের ফোনে অনেকবার ফোন করেছিল। বন্ধ পেয়ে যখন বাবাকে ফোন করেছিল, বাবা বলেছিল ভাই ব্যস্ত। ফোনটা হয়তো চার্জ দিতে ভুলে গেছে। সুবর্ণা জানে তার ভাই আজকাল দরকারের বাইরে খুব সহজে ফোনের খবর রাখে না। তাই সে বাবার কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিল। এখন টের পাচ্ছে তার বাবার মিথ্যা বলার কারণ, তার বর কেন মিথ্যা বলে তাকে এই অবধি নিয়ে এসেছে।
আরিন্তা দুর্বল হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে পড়া সুবর্ণাকে ধরতে চাইল। কিন্তু তার নিজের শরীরেই এক ফোঁটা শক্তি নেই। চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। তার কন্ঠ বসে গেছে, গলা দিয়ে কথা বেরোতে চাইছে না। সুবর্ণার গায়ে হাত দিয়ে সে মৃদু স্বরে বলল,
“তোর ভাই আজীবনের শান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে আছে রে সুবর্ণা। তোর ভাইয়ের আর কোনো দুঃখ নেই। সব কষ্ট ভুলে ঘুমিয়ে পড়েছে।”
সারাটা রাত রাতজাগা পাখির মতো মানুষগুলো জেগে রইল। কাঁদল, আহাজারি করল, জ্ঞান হারাল, কখনোবা থম মে’রে রইল। এভাবেই পেরিয়ে গেল ভয়ঙ্কর এক রাত। সকালের আলো ফুটতে দেখেই নতুন করে যেন সবার বুকে ব্যথা জেগে উঠল, ভয় হলো। সময় ফুরিয়ে আসছে। এরপর এই প্রাণহীন দেহটাও তাদের কাছে থাকবে না। চিরদিনের জন্য মিশে যাবে আপন ঘরে। কেউ আর কোনোদিন তাকে দেখতে পাবে না, ছুঁতে পারবে না। এলাকায় মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সকাল আটটায় জানাজা। মুরব্বিরা জানাজার আগে আর কোনো নারীদের মুখ দেখাবে না বলে দিলো। দেখলেন কেবল আয়েশা খাতুন। মিশকাতের মৃ’তদেহ জানাজার জন্য মসজিদে নিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও আরিন্তা আর সুবর্ণা শেষ এক নজর দেখার জন্য খুব অনুনয়-বিনয় করল। তাদের জোরাজুরিতে শেষে অল্প সময়ের জন্য মুখ দেখাল। দুই বোন মিলে আবারও পরিবেশ ভারী করে তুলল। আরিন্তা মিনমিনে স্বরে বিলাপ করল,
“তুমি মুক্ত মিশু ভাই, সব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত। অনেক ভালো থেকো। তোমার বুকে জমে থাকা যন্ত্রণাগুলো না হয় আমিই বহন করে রাখব। তবু তুমি এখন থেকে ভালো থেকো। পারলে তোমার পোনিকে মাফ করে দিয়ো।”
মুরব্বিরা সরে যেতে বললে আরিন্তা-সুবর্ণা খাটিয়া আঁকড়ে ধরে বসে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করে উঠল। সম্ভব হলে যেন তারা এই মানুষটাকে এভাবেই নিজেদের কাছে রেখে দিত। কিন্তু তা যে অসম্ভব। পাঁচ বছর পর বাড়িতে পা রাখা ছেলেটাকে চার দিনের মাথায় শমসের খাঁন কাঁধে তুলে চিরকালের জন্য বাড়ি থেকে বিদায় দিলেন। তাদের বড়ো শখের প্রথম সন্তান। ছোট্টবেলা থেকে যে গোটা বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছিল। যে ছিল সবার প্রাণ। বুকে পাথর চেপে আজ সেই সন্তানের জানাজা পড়ে রেখে এলেন মাটির গভীরে, সম্পূর্ণ একা। পারলে শমসের খাঁন নিজের বুকটা চিরে ব্যথাদের থেকে বাঁচতে চাইতেন। মিশকাত আজ সত্যিই মুক্তি পেয়েছে। তার বুকে জমে থাকা দীর্ঘদিনের অসহ্য যন্ত্রণাদের ফেলে রেখে গেছে নিজের পরিবার, পরিজন, একমাত্র ভালোবাসার মানুষটির হৃদয়ে।
বাড়ি জুড়ে এক মিশকাত খাঁন হারানোর শোক ছড়িয়ে আছে। কেউ যেন ঘোর থেকেই বেরোতে পারছে না। এখনও সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয়। তবু নিয়াজ থেমে নেই। পুলিশদের সঙ্গে সে সবসময় যোগাযোগ করে চলেছে। পুলিশ তাদের মতো তদন্ত চালাচ্ছে। নিয়াজ বেশিদিন এখানে থাকতে পারেনি। তাকে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু আরিন্তাকে সে কোনোভাবেই সাথে নিতে পারেনি। পুলক তালুকদার নিজেই তারপর বলেছিলেন কটা দিন রেখে যেতে। আরিন্তাকে রেখে যাওয়ার সাহস তার হচ্ছিল না। শেষে আরিন্তার জেদে রেখে যেতে হয়েছে। যাওয়ার আগে সে সুবর্ণাকে বারবার করে অনুরোধ করে বলে গিয়েছে কষ্ট হলেও সে যেন আরিন্তার দিকে একটু খেয়াল রাখে। তাছাড়া আরিন্তা এখনও শোকের ছায়া থেকে বেরোতে পারেনি। তাই ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়েও তার চিন্তা হয়।
জোরালো তদন্তে অপরাধী সামনে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। মাত্র দশ দিনের মাথায় খু’নী ধরা পড়েছে। তাতেই বেরিয়ে এসেছে এই হ’ত্যাকাণ্ডের মূল কাহিনি। হ’ত্যাকারী তিনজন যুবক। দুজন মিশকাতের নিজের এলাকার, একজন পাশের এলাকার। নিজের এলাকার দুজন ছেলেই একসময় তার বন্ধু ছিল। তারা ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে খেলাধুলা করেছে। তাদের জবানবন্দিতে জানা গিয়েছে এই হত্যাকাণ্ড তাদের পরিকল্পিত। মিশকাত আসার পরপরই তারা পরিকল্পনা করে রেখেছিল। পরিকল্পনামাফিক ঘটনার রাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন, তখন তারা মিশকাতকে ফোন করে। মিশকাত তখনও জেগে ছিল। মিশকাত ফোন রিসিভ করলে তারা তাকে বাইরে ডেকে এনেছিল দরকারি কথা আছে বলে। তারা বলেছিল তাদের একজন খুব বিপদে পড়েছে, তাই মিশকাতের সাহায্য দরকার। মিশকাত বাইরে এলে তবেই তাকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সবটা বলবে। বন্ধুরা বিপদে পড়ে সাহায্য চাইতে বাড়ির সামনে চলে এসেছে ভেবেই মিশকাত গায়ে টি-শার্ট আর হাতে ফোনটা নিয়েই বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল। রাস্তায় গিয়ে বন্ধুদের সাথে তার দেখা হয়েছিল। সেখান থেকেই তারা এটা-ওটা বুঝিয়ে তাকে নিয়ে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলের কাছে এসেই তারা মিশকাতকে আটকে ফেলেছিল। তার থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে জানতে চেয়েছিল সে কী পরিমাণ অর্থ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। জেদি মিশকাত তাদের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি। তার জেদের কারণেই তার গায়ে হাত তোলা হয়েছিল। একের পর এক আঘাতের পরও যখন সে মুখ খোলেনি তখনই ছেলেগুলোর মাথায় র’ক্ত চড়ে উঠেছিল। জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা লাঠি রেখে তারা রামদা দিয়ে কো’পানোর ভয় দেখাচ্ছিল। শেষমেষ মিশকাতের মুখ বেঁধে সেই রামদাতেই মিশকাতের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে লা’শে পরিণত করা হয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা দেহ থেকে প্রাণটুকু বেরোনোর অপেক্ষা না করেই তার দেহটা বস্তাবন্দি করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল জঙ্গলের ওপাশের পরিত্যক্ত পুকুরে। তারপরেই তারা বাড়ি এসে দরজা খোলা পেয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়েছিল মিশকাতের ঘরে। নিঃশব্দে সারা ঘর তন্নতন্ন করে আলমারির চাবি খুঁজেছিল তারা। চাবি না পেয়ে শেষমেষ কৌশলে তালা ভেঙে পেয়ে গিয়েছিল নিজেদের কাঙ্ক্ষিত সম্পদ। তারপর সেসব বন্টন করে নিয়েছিল তিনজন।
সম্পূর্ণ ঘটনার নিশ্চয়তায় তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মাধ্যমে এই মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। সাথে তাদের চুরি করা অর্থ-ও মিশকাতের পরিবারের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
আগামীকাল আরিন্তাকে নিতে আসবে নিয়াজ। এতদিন সে এ বাড়িতেই ছিল। প্রতিদিন গিয়ে দূর থেকে দেখে এসেছে মিশকাতের কবরটা। আজ সে অনেকবার করে মিশকাতের কাছে গিয়েছে। আজ আবারও তার চোখ দুটো বারংবার বাঁধ ভাঙছে। আগামীকাল চলে গেলে আবার কবে সে মিশু ভাইয়ের কাছে আসতে পারবে নিশ্চয়তা নেই যে। এরমধ্যে সুবর্ণা একবার শশুরবাড়ি গিয়ে এসেছে। শত হলেও সে নতুন বউ। ভাইয়ের মৃ’ত্যুশোকের কারণে তাদের বউভাতের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছিল। সুবর্ণার বর বলেছে এসব শোক কা’টিয়ে ওঠার পর সে নিজেই একদিন আয়োজন করে সবাইকে দাওয়াত করবে। ওসব পরেও করা যাবে। সুবর্ণার সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তা ছিল বাবা-মাকে নিয়ে। তার বর তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে এসব নিয়ে যেন সে দুশ্চিন্তা না করে। শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব সে নিজেই নিতে পারবে। ছেলে হারানো বাবা-মায়ের আরেক ছেলে হয়ে উঠতে তার কোনোরকম আপত্তি নেই। সুবর্ণা যেন কপাল করে এই লোকটাকে নিজের জীবনে পেয়েছে।
মিশকাতের আলমারিতে একটা লাগেজ পাওয়া গিয়েছিল। বাড়ি এসে সবকিছু সুবর্ণার হাতে আনপ্যাক করালেও ওই লাগেজটা সে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। সুবর্ণাকে বলেছিল সে চলে যাওয়ার পর এটা আরিন্তাকে দিতে। লাগেজের তালাও ভাঙা ছিল। কিন্তু সুবর্ণা সেটা কারোর হাতে দেয়নি। নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। আজ আরিন্তাকে একা ডেকে সে লাগেজটা তার হাতে তুলে দিলো। তদন্তের সময় আরিন্তা এই লাগেজের কথা শুনেছিল। কিন্তু তখন সুবর্ণা সবাইকে বলেছিল এই লাগেজে জামাকাপড় আছে। সুবর্ণা যখন বলল এটা আসলে তার, আরিন্তা ভেতরের জিনিসটা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। লাগেজ খুলে ভেতরে পেল লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি। সঙ্গে কিছু সাজগোজের সরঞ্জাম। হতবাক হয়ে আরিন্তা সেগুলো হাতে নিয়ে বসে রইল। সুবর্ণা বলল,
“এগুলো হয়তো ভাইয়া ওখানে যাওয়ার পরপরই কিনেছিল তোমার জন্য। কী পাগল ছিল আমার ভাইটা! ভাগ্যে কী লেখা আছে না জেনেই-”
বেনারসিটা দুহাতে জড়িয়ে আরিন্তা কেঁদে ফেলল। এই বেনারসি গায়ে জড়িয়ে তার মিশকাত খাঁনের বউ হওয়ার কথা ছিল। আর আজ বেনারসি আছে, মিশকাত খাঁন নেই। সে-ও আজ অন্যের ঘরের বউ। একসময় সুবর্ণা বলে উঠল,
“জানো আপু? কেন জানি মাঝে-মাঝে আমার মনে হয় এই হ’ত্যাটা আমার ভাই ইচ্ছা করে বরণ করে নিয়েছিল। ওর বুকের ভেতর অনেক যন্ত্রণা আটকে ছিল। হয়তো সেসব থেকে মুক্তি পাওয়ার লোভেই ও চুপ ছিল। শেষমেষ মুক্তি পেল, বলো? আমার সবচেয়ে বড়ো দুঃখ কী জানো? আমার ফুলের মতো ভাইটার এই করুণ পরিণতি প্রাপ্য ছিল না।”
পরদিন খুব ভোরবেলা আরিন্তা সেই বেনারসি গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো। বাড়ির সবাই তখন ঘুমে। শমসের খাঁন মসজিদে গিয়েছেন। আয়েশা নামাজে বসেছেন। নোভার পাশে সুবর্ণা ঘুমিয়ে আছে। এই সুযোগে বেনারসি পরে সে চুপিচুপি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সোজা বাড়ির সামনে চলে গেল। মিশকাতের কাছে। দূর থেকে সে চেয়ে রইল মিশকাতের পানে। এখানে এলেই তার মনে হয় মিশু ভাই তার দিকে চেয়ে আছে। আরিন্তা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। খালু ফিরবে কথাটা মনে হতেই সে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। যাওয়ার আগে সে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আপনমনে বলে গেল,
“মিশু ভাই, দেখো, তোমার কেনা বেনারসি পরেছি। তোমার পোনিকে ভালো লাগছে? আজ চলে যাচ্ছি অন্যের সংসারে। তুমি তো চাও আমি ওখানে ভালো থাকি, তাই না? চিন্তা কোরো না। আমি তোমার এই চাওয়াটুকু পূরণ করে রাখব। তোমার পোনি সবসময় ভালো থাকবে। তুমি জানতে চেয়েছিলে না ভালোবাসার এতটুকু অংশ অবশিষ্ট আছে কি না? আজ শুনবে? শোনো, তোমায় যতটুকু ভালোবেসেছি, গোটা জীবন ফুরিয়ে গেলেও আমি বোধ হয় এত ভালো কাউকে বাসতে পারব না। হ্যাঁ, আমার স্বামী আছে। তাকে আমি নিরাশ করি না, কোনোদিন করব না। কেউ কোনোদিন জানবে না এই সংসারী সুখী মেয়েটার বুকের ভেতর ঠিক কী পরিমাণ ব্যথা জমে আছে। লোকে আমায় মন্দ বলুক, নিন্দা করুক। তবু আমি এক জীবন ভালোবাসার মানে তোমাকেই বুঝব। তুমি বরং অনুভূতিতে বেঁচে থেকো এক জনম। আমি শেষ অবধি সেই অনুভূতি বয়ে বেড়াব। আসি, ভালো থেকো মিশু ভাই।”
মিশকাতের ভালোবাসায় মোড়ানো চাঁদটা বাড়ির ভেতরে চলে যাচ্ছে। মিশকাত তাকে পিছু ডাকছে না। তার এক জীবনের চাঁদাসক্তি যে বিরহবিধুর হয়েই ফুরিয়ে গেল।
~সমাপ্ত~