বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-২৭+২৮

0
371

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৭.
সুবর্ণার বিয়ে। এই নিয়ে যেন আরিন্তার আনন্দের শেষ নেই। শুনে হতে সে এটা-ওটা পরিকল্পনা করছে। মনে করে-করে প্রয়োজনীয় সব জিনিসে লাগেজ গোছাচ্ছে। চোখের সামনে যে মেয়েটাকে বড়ো হতে দেখেছে, একটু-একটু করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে দেখেছে, সবসময় যাকে পাশে পেয়েছে; দুদিন পর সেই মেয়েটার বিয়ে। ভাবতেই আরিন্তার ভীষণ ভালো লাগছে। আরিন্তার বিবাহিত জীবনের পাঁচটা বছর কেটে গে’ছে। এই পাঁচ বছরে এমন কোনো মুহুর্ত নেই, যখন এই মেয়েটা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আপনজনদের রূপ আরিন্তা দেখেছে। সে ভেঙেছে, গড়েছে, জীবনকে নতুন করে সাজিয়েছে। যে জীবনের অনুপ্রেরণাদায়ক মানুষদের মাঝে এই মেয়েটি গুরুত্বপূর্ণ একজন। সুবর্ণার ধৈর্যের প্রশংসা আরিন্তা সবসময় করে। এই পাঁচ বছরে সে নিজের সেই ছোট্ট পার্লারটাকেও ভালো জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। তার পরিচিতিও বেড়েছে। আয়েশার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়া। সংসার জীবনের যে সুখ তিনি ধরে রাখতে পারেননি, সে সুখ তিনি মেয়ের কপালে দেখতে চেয়েছিলেন। তার সেই ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। মায়েরা বোধ হয় এমনই। নিজেদের যত না পাওয়ার দুঃখ তারা মেয়েদের দিয়ে ঘোচাতে চায়। নিজেদের না পাওয়া সুখ তারা মেয়েদের সুখে মিটিয়ে নেয়।

নিয়াজকে আরিন্তা আগে থেকেই বলে রেখেছিল সুবর্ণার বিয়ের দুদিন আগেই তারা গ্রামে যাবে। নিয়াজ যেন কাজের বাহানা না ধরে, সে কারণেই তার এই ঘোষণা। নিয়াজও তা ভোলেনি। ভুলবে কী করে? সে জানে সচরাচর আরিন্তা খুব আয়োজন করে এমন বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে আগ্রহী না। সে শান্তিপ্রিয় মানুষ। নিরিবিলি পরিবেশে থাকতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সুবর্ণার বিয়ে নিয়ে তার এত আগ্রহ দেখতে নিয়াজের ভালো লাগছে। তাই তো আরিন্তার ইচ্ছায় বিয়ের ঠিক দুদিন আগেই সে আরিন্তাকে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছে। সঙ্গে তাদের দুই বছরের মেয়ে নোভা। গ্রামে পৌঁছে তারা নিজেদের বাড়িতে না গিয়ে একবারে খালার বাড়ি উঠেছে। সুবর্ণা বারবার করে বলে দিয়েছিল আরিন্তা যেন আগে-আগে চলে যায়। তার কথা ফেলতে চায়নি আরিন্তা। বাড়ি পৌঁছে খালা-খালুর সাথে দেখা করেই আরিন্তা মেয়েকে খালুর কোলে দিয়ে সুবর্ণার সঙ্গে গল্প করতে বসে পড়েছে। আয়েশা টেবিলে হালকা নাশতা দিয়েছে। নিয়াজ বসে খাচ্ছে আর আরিন্তার গল্প শুনছে। আরিন্তা অনেক কথা বলে ফেললেও সুবর্ণা সবসময়ের মতো বকবক করছে না খেয়াল করে আরিন্তা জিজ্ঞেস করল,
“তোর মন খারাপ কেন?”
সুবর্ণা মাথা দুলিয়ে বলল,
“মন খারাপ না।”
“তাহলে মুখ এমন লাগছে কেন?”
“এমনি।”
“এমনি? সত্যি কথা বল।”

নিয়াজ বলে উঠল,
“আহা! দুদিন পর মেয়েটার বিয়ে। তোমাকে দেখে ওর খারাপ লাগতে পারে। বোঝো না?”
আরিন্তা সুবর্ণার কাঁধে হাতের ভর দিয়ে বসে হেসে বলল বলল,
“আরে ওসব কিছু না। আমরা তো রোজ ফোনে বকবক করি। সুবর্ণা, একটা জিনিস ভাব। তোর বিয়েতে কিন্তু আমাদের ক্ষতি নেই। এতদিন তুই একা বলে যখন ইচ্ছা আমার কাছে যেতে পারিসনি। বিয়ের পর বরের ঘাড় ধরে নিয়ে চলে যাবি।”

নিয়াজ ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ে হওয়ার আগেই তুমি ওকে এসব শিখাচ্ছ? দু-একটা উপকারী কথা বলো, যা ওর কাজে লাগবে।”
আরিন্তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি চুপ করে খাও তো। আমাদের কথার মাঝে ঢুকছ কেন?”
“তো আমাকে এনেছ কেন?”
“এনেছি ভালো করেছি। এখন গিয়ে তোমার আদরের শালাবাবুর খোঁজ করো যাও।”
“পরে যাব।”
“কেন? আসার সময় তো আগে শশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলে।”

নিয়াজ সুবর্ণাকে বলল,
“দেখেছ? যেভাবে বলছে, মনে হচ্ছে ওটা আমার বাবার বাড়ি।”
আরিন্তা বলল,
“তোমারই তো। আমার মা বাদে।”
“অ্যাহ্! মা কেন বাদ যাবে? বাবার বাড়ি আমার হলে, মা-ও আমার।”
“চুপ করো। আজকাল তুমি ঝগড়া শিখে গেছ।”
“সঙ্গদোষ, বোঝো না?”

সুবর্ণা দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমরা ঝগড়া করো কবে থেকে? বাড়িতেও এমন ঝগড়া করো?”
নিয়াজ বলল,
“আরে ধুর! না, না। আমাকে তুমি ঝগড়া করতে দেখেছ কোনোদিন?”
“মাত্রই তো দেখলাম।”
নিয়াজ একটু হোঁচট খেয়ে বলল,
“ওই… তোমার বোন মাঝে-মাঝে তর্ক বাঁধিয়ে বসে।”

আরিন্তা প্রতিবাদ করে বলে উঠল,
“আসছে সাধু! এখন সব দোষ আমার, না?”
নিয়াজ বলল,
“তোমার বোন কি তোমাকে চেনে না?”
আরিন্তা সুবর্ণাকে চেপে ধরল,
“এই সুবর্ণা বল। আমি কি কোনোদিন তোর সাথে ঝগড়া করেছি? জীবনেও করিনি। শুনিয়ে দে তো একটু মশাইকে।”

ভেতরের ঘর থেকে সেই মুহুর্তে সুবর্ণার ডাক পড়ল,
“সুবর্ণা, আমার ফোন কোথায়?”
সুবর্ণা গলা বাড়িয়ে উত্তর দিলো,
“আমার কাছে।”

এদিকে ডাক শোনার সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তা হতভম্ব হয়ে বসা থেকে সটান দাঁড়িয়ে পড়েছে। সুবর্ণার মুখের দিকে অবাক প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
“মিশু ভাই?”
সুবর্ণা থমথমে মুখে মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,
“কাল রাতে এসেছে। আসার কথা আগে থেকে কাউকে জানায়নি। কাল রাতে হঠাৎ বাড়ি এসে উপস্থিত হওয়ার পর আমরাও সবাই অবাক হয়েছি।”

ভেতরের ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেয়েই আরিন্তা এক ছুটে গিয়ে সুবর্ণার ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো। মিশকাত দরজা খুলে বেরিয়েই এমনভাবে সুবর্ণার ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে চমকে উঠল। অথচ এগিয়ে গিয়ে দেখল সুবর্ণা বসার ঘরে বসে আছে। তবে তাকে প্রশ্ন করতে হলো না। প্রশ্নের উত্তর সে সুবর্ণার বিপরীতে বসা পুরুষকে দেখেই পেয়েই গেল। সে একবার নিয়াজের দিকে, আরেকবার সুবর্ণার ঘরের বন্ধ দরজায় তাকাল। নিয়াজ নিজেই জায়গা ছেড়ে উঠে মিশকাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। হাসিমুখে বলল,
“কী খবর মিশকাত? বহু বছর পর দেখা।”
নিয়াজ হাত মিলিয়ে বলল,
“এই তো ভাই ভালো। আপনার কী খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ্ ভালো রেখেছে ভাই।”
“কখন এলেন?”
“কিছুক্ষণ আগেই। তুমি এসেছ জানতাম না।”
“হুট করেই আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কাউকে জানিয়ে আসিনি।”
“যাক, সুবর্ণার জন্য দারুণ সারপ্রাইজ। এসো, বসো। হ্যান্ডসাম হয়ে গেছো আগে থেকে আরও।”

মিশকাত মুচকি হাসল। নিয়াজের সঙ্গে বসতেই নিয়াজ নানান গল্প জুড়ে দিলো। মিশকাতের প্রবাস জীবন, কাজকর্মের ব্যাপারে জানতে চাইল। সুবর্ণা মিশকাতের ফোন ফেরত দিয়ে উঠে পড়ল। মিশকাত তাকে প্রশ্ন করল,
“মা কই রে?”
সুবর্ণা বলল,
“বাইরে।”

নিয়াজ সুবর্ণাকে বলল,
“বসো, ওঠো কেন?”
“আপনাদের কাজের কথা কী শুনব? কথা বলুন। আমার কাজ আছে।”

সুবর্ণা নিজের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো। আরিন্তা নিজের লাগেজ থেকে জিনিসপত্র বের করছিল। দরজা খুলে সুবর্ণাকে দেখে আবার গিয়ে কাজে হাত লাগিয়ে বলল,
“সুবর্ণা, বাবুকে নিয়ে খালু কোথায় গেল রে?”

সুবর্ণা দরজা ভেজিয়ে গিয়ে বিছানায় এক পা তুলে বসে বলল,
“কোথায় আর গিয়েছে? বাইরেই আশেপাশে কোথাও গেছে হয়তো।”
“ওকে কিছু খাওয়াতে হবে। বাসে বমি করেছিল মেয়েটা। পেট খালি, তবু মুখে খাবার দিতে পারিনি। একটু দেখ তো কোথায় গিয়েছে। নইলে এই মেয়েকে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ালেও তার ক্ষুধা পাবে না। কী যে মুশকিল একে নিয়ে!”

আরিন্তার ব্যস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সুবর্ণা শুধাল,
“পালালে কেন আপু?”
আরিন্তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আরে ধুর! কিসের পালিয়েছি? পাঁচ বছর ধরে অন্যের সংসার করছি, মেয়ের মা হয়েছি। দুদিন পর বুড়ি হয়ে যাব। পালানোর আর বয়স আছে না কি?”
“সামনে তো পড়তেই হবে একসময়।”
“যখনকারটা না হয় তখনই দেখা যাবে। তুই যা তো, বাবুকে নিয়ে আয়। আর একটু কিছু খাবার নিয়ে আসিস তো ওর জন্য।”
“আচ্ছা যাচ্ছি।”

সুবর্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল নিয়াজ আর মিশকাত হাসিমুখে গল্প করেই চলেছে। তাকে বাইরে যেতে দেখে নিয়াজ বলল,
“সুবর্ণা, নোভাকে একটু নিয়ে এসো তো বোন। ওকে কিছু খাওয়াতে হবে।”
“ওকে আনতেই যাচ্ছি।”

আয়েশা নিয়াজ-আরিন্তাকে পায়েস খেতে দিয়েছিলেন। গল্পের তালে পড়ে আরিন্তা খায়নি। নিয়াজ ভাবল এটাই নোভাকে খাওয়ানো যাবে। তাই সে মিশকাতকে বলল,
“একটু বসো তো। এটা একটু দিয়ে আসি। মেয়েকে খাওয়াতে পারবে।”

মিশকাত মাথা দোলাল। তাকে বসিয়ে রেখে নিয়াজ গেল আরিন্তাকে পায়েসের বাটি দিয়ে আসতে। ঘরে গিয়ে আরিন্তাকে বলল,
“নাও, বাবুকে এই পায়েসটুকু খাইয়ে দিয়ো।”
“টেবিলে রাখো।”

নিয়াজ টেবিলের ওপর বাটিটা রেখে আরিন্তার ব্যস্ত মুখটা লক্ষ্য করে বলল,
“মিশকাতের সঙ্গে কথা বললাম।”
আরিন্তা কাজে মনোযোগ দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“ভালো।”
“কাজের ভালোই উন্নতি হয়েছে।”
“উন্নতিই তো ভালো।”

নিয়াজ কিছু মুহূর্ত চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। এরপরও আরিন্তা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে দেখে সে কাছে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে আলতো করে আরিন্তার গলা জড়িয়ে ধরল। আরিন্তা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হেসে শুধাল,
“কী?”
“কিছু না।”
“একটা ঘুম দিতে পারতে। ক্লান্ত লাগছে না?”
“উঁহু। একটু বেরুব। বাবুকে খাইয়ে তুমি একটু ঘুমিয়ে নিয়ো।”
“আচ্ছা, যাও। তাড়াতাড়ি ফিরো। জামাটা পালটে যাও।”
নিয়াজ আরিন্তার কপালের কিনারায় চুমু খেয়ে সরে গেল। আরিন্তা ভাঁজ করে রাখা জামাকাপড় থেকে তাকে একটা শার্ট বের করে দিলো।

সুবর্ণা গিয়ে বাবার কাছ থেকে নোভাকে নিয়ে এসেছে। মিশকাত মাত্রই বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছে। সুবর্ণাকে মিষ্টি একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে সে তাকিয়ে রইল। বাচ্চাটা একদম ওর মায়ের মতো দেখতে হয়েছে। সুবর্ণা যখন তাকে ছবি পাঠিয়েছিল, তখনই সে বুঝে গিয়েছিল এ কার প্রতিচ্ছবি হতে চলেছে। তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুবর্ণা সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আরি আপুর মেয়ে।”
মিশকাত বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“মা শা আল্লাহ্।”
বাচ্চাটা কেমন গোল-গোল চোখে মিশকাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত মুখ তাকে আদর করছে বলেই হয়তো। সুবর্ণা বলল,
“কোলে নিবে? এমনিতে ও খুব চঞ্চল মেয়ে। তবে সবার কোলে চড়তে পছন্দ করে।”
মিশকাত বলল,
“কার মেয়ে দেখতে হবে না!”
“নাও।”
সুবর্ণা নোভাকে কোলে দিতে চাইলে মিশকাত বলল,
“ওকে না খাওয়ানোর জন্য এনেছিস? যা, খাওয়াতে দিয়ে আয়।”
“ও হ্যাঁ, যাই।”

সুবর্ণা নোভাকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যেতে-যেতে বাচ্চাটার সাথে বিড়বিড় করে বলল,
“মামাটা পচা, না? নোভা সোনাকে কোলে নেয়নি। চলো মায়ের কাছে যাই।”

মিশকাত আপন মনে হাসল। সে হাসিতে ঠিক কার প্রতি তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল, বুঝা গেল না। সে তো এখন নিজেকেই তাচ্ছিল্যের তালিকার শীর্ষে ঝুলিয়ে রেখেছে। সুবর্ণার ঘর থেকে অতি পরিচিত কন্ঠটা ভেসে আসছে। তার সঙ্গে নিয়াজ আর সুবর্ণার-ও। বুঝা যাচ্ছে মেয়েকে খাওয়ানোর মিশনে নেমেছে তিনজন। একটু বাদেই শোনা গেল আরিন্তার রাগত কন্ঠস্বর। রেগেমেগে সে বলছে,
“এই তুমি সরবে সামনে থেকে? জোর না করলে তোমার মেয়ে কোন বেলা খাবার গিলে শুনি? পারলে নিজে খাওয়াও, নইলে নিজের কাজে যাও।”

নিশ্চিতভাবে নিয়াজ মেয়েকে জোর করতে বারণ করার ফলেই ঝাড়িটা খেয়েছে। বেচারা! একসঙ্গে বাইরে যাবে বলে মিশকাত নিয়াজের জন্য অপেক্ষা করছিল। এরপর আর সে বসল না। চুপচাপ উঠে বাইরে চলে গেল।

অন্ধকার রাস্তায় ফোনের আলো ফেলে পথ চলছে মিশকাত আর নিয়াজ। নানান কথার মাঝেই মিশকাত বলে বসল,
“ভাই, অনেক ধন্যবাদ।”
“কেন?”
“তাকে ভালো রাখার জন্য।”
“এটা আমার দায়িত্ব। আমি কিন্তু সবটাই করেছি নিজের জন্য। তাই আমাকে ধন্যবাদ জানানোটা যৌক্তিক মনে করছি না।”
“আপনার কাছে অযৌক্তিক মনে হলেও, আমার কাছে যৌক্তিক। আমি জানতাম সে ভালো থাকবে। কিন্তু এতটা ভালো থাকবে, বুঝিনি।”

নিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“সে নিজেকে ভালো রাখতে শুরু করেছিল আমার জন্য, কিন্তু বাঁচিয়ে তো রেখেছিল অন্যের জন্য।”
মিশকাত বলল,
“সবই এখন পুরোনো রূপকথা। সময় আর পরিস্থিতি সব পালটে দেয়। মানুষের বাঁচার কারণ পালটানোও অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
“সত্যিই কি তাই?”
“সবটা পেয়ে যাওয়ার পরও আপনার সন্দেহ আছে?”
“সবটা?”
নিয়াজ মাথা দুলিয়ে হেসে পুনরায় বলল,
“মিশকাত, এই একটা জায়গায় এসেই আমি নিজের কাছে হেরে যাই, বুঝলে? এজন্য কখনো নিজেকে প্রশ্ন করি না এতকিছু পেয়ে যাওয়াকে ‘সবটা’ বলে কি না। একটা সিক্রেট কী জানো? আমার পরিচিত সব মানুষ আমাকে খুবই হিংসামুক্ত পুরুষ হিসাবে চেনে। কিন্তু কেবলমাত্র আমি জানি আমি ঠিক কতটা হিংসুটে। কেন জানো? কারণ এই গোটা পৃথিবীতে আমি শুধু একজন ব্যক্তিকেই হিংসা করি, এবং সেই একমাত্র ব্যক্তিটি তুমি।”

মিশকাত প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধাল,
“কারণ?”
“কারণ সবকিছু পেয়ে যাওয়ার পরও আমার নিজের কাছে মনে হয় তুমি যা পেয়েছ, তা পাওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। যে আরিন্তাকে তুমি পেয়েছিলে, তাকে আমি কোনোদিনই পাব না। আমি যে আরিন্তাকে পেয়েছি, সে সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। এককথায় ভেঙেচুরে অবশিষ্ট যে অংশটুকু থাকে, সেটুকুই আমি পেয়েছি।”
“মানুষ পেয়ে হারায়, আর আপনি পেয়েও সন্তুষ্ট নন?”
“অবশ্যই সন্তুষ্ট। আমার জীবনে এটা অনেক বড়ো একটা পাওয়া। শুধু আমার আজন্মের আফসোস একটাই, তোমার বর্ণনার আরিন্তাকে আমি আবিষ্কার করতে পারিনি।”

আরিন্তার কাছে নিয়াজ খোলা ডায়রি হলেও, তার অগোচরে একটা কাজই সে করছে। নিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। গত পাঁচ বছর ধরেই তার নিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, যা আরিন্তা কখনও টের পায়নি। মিশকাতের বুঝে আসত না এই লোক কী ভেবে নিয়মিত তার খোঁজখবর নেয়। স্ত্রীর প্রাক্তনকে ঘৃণা না করে এত কদর করতে দেখে সে সত্যিই অবাক হত। তবে সে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যায়নি। নিয়াজ বয়সে তার চেয়ে বড়ো হলেও, খুবই বন্ধুসুলভ। যোগাযোগের এক পর্যায়ে তার সাথে মিশকাতের আলাদাই একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যার সবটাই বন্ধুত্বের। নিয়াজ চাইলেই পারত পুরোনো কথা তুলে তাকে আরও ভেঙে দিতে। কিন্তু সে তা ভুলেও করেনি। মিশকাতের মনে হয় নিয়াজ মানুষটাই এমন যে মানুষকে ভাঙতে নয়, নতুন করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সে খুব সুন্দর এক অনুপ্রেরণা।

নিয়াজ হেসে বলল,
“ভাই, আপনি না আমাকে হিংসা করেন? তাহলে এত কদর করার কারণ কী? আপনার তো আমাকে ঘৃণা করা উচিত।”
“জানি না কেন তোমার প্রতি আমার ঘৃণা আসে না। আমার সবসময় মনে হয়েছে তোমার পাশে থাকা দরকার, আমি সেটাই করার চেষ্টা করেছি। তাতেও বা তোমাকে বুঝাতে পারলাম কই? হাজারবার বললাম জীবনকে একটা শেষ সুযোগ দাও। শুনলে তো না-ই।”

মিশকাত মাথা নেড়ে বলল,
“এটা আমার জীবনের সবচেয়ে অসম্ভব কাজ ভাই। মানুষ আমাকে গর্দভ বলতে পারে, দেবদাস বলতে পারে, বলুক। আমি যে কী পেয়েছিলাম, কী হারিয়েছি আর কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছি; তা শুধুই আমি জানি। দুনিয়ার কেউ আমার বেঁচে থাকার গল্প জানে না। কেউ জানে না গত পাঁচ বছরে আমার একেকটা দিন ঠিক কীভাবে কে’টেছে। পাঁচ বছর আগে যে মিশকাত বেঁচে ছিল, তার চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল, বেঁচে থাকার আক্ষেপ ছিল। আজ আপনি যে মিশকাতকে দেখছেন সে বেঁচে থাকার তাগাদায় বেঁচে আছে। তার ভেতরে প্রাণ, হৃদয় বা অনুভূতি বলতে কিছু আছে কি না সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে একটা পরিবার তার ওপর বেঁচে আছে। বাঁচা, ম’রার আক্ষেপ আর আমার নেই ভাই। আক্ষেপ ছিল শেষবার কাছের মানুষদের একবার যেন দেখতে পারি, এটুকুই। আপনি আবার একজন ভেবে রাগ করবেন না।”

নিয়াজ ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“রাগ করা আমার সাজে না। তুমি কিংবা আরিন্তা, কারোর ওপরেই আমার রাগ নেই। রাগ করার কারণটাই তো অযৌক্তিক, যেখানে তোমাদের কোনো হাতই ছিল না। অন্তত আমার মতো পরিস্থিতি আর যন্ত্রণা বোঝা মানুষদের কাছে অযৌক্তিক হওয়া উচিত। তোমার মতে তুমি বাঁচা থেকে ম’রেছ, আমার মতে আমি ম’রা থেকে বেঁচেছি। এই এক বাক্যেই তো আমার সব বোঝা উচিত। মানুষ আমাকে কী বলবে, তাতে আমারও কিছু আসে-যায় না। আমি জানি আমি যথেষ্ট বুঝদার, এবং আমি যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই যা উচিত মনে হয় তা-ই করি। ভবিষ্যতে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে আমি জানি না। কিন্তু আমি তোমাদের সামনে অন্তত মুখোশ পরে থাকতে চাই না। কারণ তুমি হারিয়েছিলে বলেই আমি পেয়েছিলাম, তুমি ভেঙেছিলে বলেই আমি গড়ে উঠেছিলাম।”

“আমার জীবনে আমি আপনার মতো মানুষ দ্বিতীয়টি দেখিনি। আপনার মতো মানসিকতার মানুষ খুব কম পাওয়া যায়। আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।”
“আরে ধুর! লজ্জা দিয়ো না তো। যা হওয়ার ছিল হয়ে গেছে। তুমি খুব শক্ত মানুষ। যা-ই বলো, আমি তোমার জীবনের নতুন অধ্যায় দেখার অপেক্ষায় আছি।”

মিশকাত পরিস্থিতি সামলে নিয়ে ফাজলামি করে বলল,
“ভাই, বউ নামক এক্সট্রা প্যারা আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন, বয়ে বেড়ান, শুভকামনা। আমাকে এরমধ্যে টানবেন না।”

তারা দুজন বাজারে গিয়ে একসঙ্গে চা, নাশতা খেল। গল্প করে অনেকটা সময় কা’টিয়ে দিলো। ফেরার আগে মিশকাত বাড়ির সবার জন্য গরম চটপটি নিয়েছে। তা দেখে নিয়াজ হেসে বলল,
“পেলবের কাছে শুনেছিলাম এখানকার চটপটি আমার বউয়ের খুব পছন্দ। প্রতিবারই সে এলে পেলব তার জন্য কিনে নিয়ে যায়, কিন্তু সে খায় না। তার ওপর আজকাল আবার গ্যাস্ট্রিক বাঁধিয়ে বসেছে। বাইরের খাবার খায় না।”
মিশকাত চটপটির প্যাকেটটা নিয়াজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“অন্যেরটা খাবে কেন? দায়িত্ব তো এখন আপনার।”

বসার ঘরে টিভি চলছিল। আরিন্তা, সুবর্ণা আর তার চাচাতো বোনরা বসে টিভি দেখছিল আর গল্প করছিল। আরিন্তার কোল জুড়ে নোভা ঘুমিয়ে আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে নিয়াজ, মিশকাত এসে উপস্থিত হলো। বেখেয়ালে আরিন্তা ফিরে তাকাতেই অতি পরিচিত দুটি চোখে আটকে গেল। ক্ষণিকের জন্য দুজনের যেন গোটা জীবনটা এসে থমকে গেল এই একটি মুহুর্তে। বুকের ভেতর ঘাপটি মে’রে বসে থাকা যন্ত্রণারা ফোড়ন কা’টতেই মিশকাত চোখ সরিয়ে নিল। পরমুহূর্তেই আরিন্তা উঠে দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“কেমন আছো মিশু ভাই?”
মিশকাত বোধ হয় হাসিটাকে জোরপূর্বক দখলে রেখে কথার কথা বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
“ভালো। আমার মেয়েকে দেখেছ?”
মিশকাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, তোর মতো হয়েছে। দোআ রইল।”
“আমার মেয়েকে তুমি কোলে নিবে না?”

মিশকাত আরিন্তার কোলে ঘুমন্ত নোভার দিকে তাকাল। এ যেন চাঁদের কোলে আরেকটি চাঁদ। মেয়েটাকে দেখলেই তার কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হয়। তাই এখনও কোলে নেয়নি। এবারে যেন সে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না। হাত বাড়িয়ে দিলো। আরিন্তা হাসিমুখে নোভাকে তার কোলে তুলে দিলো। মেয়েটাকে বুকে নিয়ে মিশকাত তার কপালে চুমু খেল। হাত বুলিয়ে আদর করে মৃদু হেসে বলল,
“তোর মেয়েটাকে আমায় দিয়ে দে তো আরি। শুনলাম তুই আর আগের মতো বাঁদর নেই, ভদ্র মেয়েটি হয়ে গেছিস। ওকে আমার কাছে রেখে চঞ্চল বানিয়ে ফেলব।”
আরিন্তা যেন সোজাসাপ্টা বলে দিলো,
“রেখে দাও।”

নিয়াজ চটপটির প্যাকেট আরিন্তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“তার চেয়ে চলো আমরা মিশকাতের জন্য একটা সুন্দরী বউ খুঁজে আনি। মেয়ে এমনিতেই পেয়ে যাবে। কী বলো?”
আরিন্তা কেবল হাসল। চটপটির পরিমাণ দেখে বলল,
“এত চটপটি এনেছ কী করতে?”
“সবাইকে ভাগ করে দাও, আর তুমিও খাও।”
“আমি খাব না। আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয় জানো না? সুবর্ণা, সবাইকে একটু ভাগ করে দে তো।”

আরিন্তা চটপটির প্যাকেটটা সুবর্ণার হাতে দিয়ে দিলো। নিয়াজ বলল,
“আজ একটু খাও। কিছু হবে না। মিশকাত আরও সবার জন্য এতগুলো নিয়ে এল।”
আরিন্তা হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“আমি আসলে স্বাস্থ্যের তাগাদায় পুরোনো অভ্যাসগুলো ছেড়ে দিয়েছি। সরি মিশু ভাই।”
মিশকাত-ও হাসির ছলে উত্তর দিলো,
“যাক ভালো। তোর বরের টাকা বেঁচে গেছে। ভাগ্যিস ভাই সেই খাদকের কবলে পড়েনি!”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৮.
গায়ে হলুদের দিন সকালেই মেরিনা চলে এসেছেন। আরিন্তা, মিশকাতের আসার খবর পেলব পেয়েছে। কিন্তু কাজের বাহানায় সে ও-বাড়ি যায়নি। কিন্তু না গিয়েও তার উপায় রয়নি। সে বিয়ে করেছে গতবছর। দুদিন আগেই তার বউ বাবার বাড়ি গিয়েছিল। সে বলে দিয়েছে সন্ধ্যার আগে তাকে সুবর্ণার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে। বউকে নিয়ে পেলব অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগমুহূর্তেই উপস্থিত হয়েছে। সুবর্ণাকে তখন স্টেজে বসানো হয়েছে। সবাই সেখানেই ছিল। পেলব এসেই সবার আগে আরিন্তার খোঁজখবর নিল। নিয়াজের সাথে কুশল বিনিময় করল। বিপরীতে দাঁড়ানো মিশকাতের সঙ্গে চোখাচোখিও হলো তখনই। জীবনে প্রথমবারের মতো মিশকাতের সামনে সে ভীষণ রকম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। অস্বস্তি অনুভব করল। অথচ তাকে চমকে দিয়ে মিশকাত দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে তার সাথে কোলাকুলি করতে-করতে বলল,
“আরে ভাই, আমার উপকারী বন্ধু যে। কী খবর?”

স্পষ্ট খোঁচা অনুভব করে পেলব ‘ভালো, তুই?’ ছাড়া কথাই বাড়াতে যায়নি। তার পাশের শাড়ি পরিহিতা পরিচিত মুখ দেখে মিশকাতই আবার হেসে বলল,
“ভাবি না? কেমন আছেন?”
পেলবের স্ত্রী একগাল হেসে বলল,
“এই তো ভাইয়া ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। তা কী খবর আপনাদের? প্রেম-ট্রেম করে বিয়েও করে ফেললেন! এমন ভাগ্য কজনের হয়? মানাতে গিয়েই তো দাঁত ভেঙে যায়। আপনাদের রাজকপাল বটে!”
“কী যে বলেন ভাইয়া!”

পেলব আরিন্তার কোল থেকে নোভাকে নেওয়ার অজুহাতে সেখান থেকে সরে গেল। পেলবের স্ত্রী ছাড়া কারোরই তা ধরতে অসুবিধা হলো না। মিশকাত তাচ্ছিল্য হাসল। পেলবের বিয়ের গল্প সে সুবর্ণার কাছে সবটাই শুনেছিল। নিজের কলেজেরই এক মেয়ের সঙ্গে পেলব টানা দুই বছর প্রেম করেছিল। গতবছর মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়াতে পেলব বাধ্য হয়ে বাবা-মাকে জানিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। ভালো পরিবার পেয়ে দুই পক্ষের কারোরই আপত্তি ছিল না। একমাত্র ছেলের বিয়েতেও পুলক তালুকদার ত্রুটি রাখেননি। বড়ো আয়োজন করেছিলেন। আরিন্তা বিয়েতে উপস্থিত ছিল নিমন্ত্রিত অতিথির মতো। একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে তার না ছিল আগ্রহ, না ছিল আনন্দ। পেলব আশাই করে নিয়েছিল এ বেলায়ও বোনের কাছে তাকে কড়া কথা শুনতে হবে। কিন্তু আরিন্তা তাকে কেবল একটা কথাই বলেছিল, ‘নিজের বেলায় ষোলো আনা সবাই বোঝে, অন্যের বেলায় এক আনাও না।’
পেলব সেদিন উত্তর দিতে পারেনি। আরিন্তার মুখে এ ধরনের কথা শুনতে-শুনতে তার বোঝা হয়ে গেছে কথাগুলো তার প্রাপ্য। শুধু স্বীকার করতেই যত আপত্তি, এই যা!

বিয়ের দিন সকালে মিশকাতকে একা ডেকে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া, খালু এসেছে। দেখা করেছ?”
“হ্যাঁ, দেখা হলো।”
“কী বলল?”
“কী বলবে? এমনি খোঁজখবর নিল ওখানকার।”
“ও।”

সুবর্ণা হঠাৎ মিশকাতের একহাত মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
“ভাইয়া, একটা কথা বললে রাখবে?”
“বল।”
“তুমি আর যেয়ো না। এখানেই থেকে যাও প্লিজ।”
“তুই কি চাস না আমি একটু যন্ত্রণামুক্ত থাকি বোন?”
“চাই ভাইয়া। আমি বুঝি তোমাকে। কিন্তু আমি চলে যাওয়ার পর বাবা-মা তো একদম একা হয়ে পড়বে। মানলাম বাবা এখন সুস্থ। তবু তাদের একা করে আমরা দুজনই দূরে থাকব, এটা আমি মানতে পারছি না।”
“চিন্তা করিস না। আজীবন কি আর ওখানে থাকব? একসময় তো আসতেই হবে।”

সুবর্ণার চোখে জল। সে অসহায় মুখে অনুরোধের সুরে বলল,
“অনেক তো হলো, এবার নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে আনো না।”
“সরিয়ে তো নিয়েছি সেই কবেই। সরিয়ে নিয়েছিলাম বলেই তো সবাই ভালো আছে। আর কীভাবে সরতে বলছিস সুবর্ণা?”
“নিজের ভালো থাকার দিকে কি তুমি তাকাবে না? এভাবে তো আর গোটা জীবন কা’টানো যায় না।”

মিশকাত সন্দিহান মুখে বলল,
“হঠাৎ আবার এসব তুললি কেন? তোর কোনো ননদ ঠিক করেছিস না কি আমার জন্য?”
“ফাজলামি কোরো না তো। আমার কি চিন্তা হয় না তোমার জন্য? তোমার এই ছন্নছাড়া জীবন দেখতে কি আমার ভালো লাগে? সবাই ভালো আছে দেখেও, তুমি কেন ভালো থাকবে না?”
“কে বলল আমি ভালো নেই? ভালো না থাকলে এমন বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে সবার সাথে কথা বলতে পারতাম?”
“ভাইয়া প্লিজ। পুরোনো সব বাদ দাও। ভাগ্যের ওপর কারোর হাত নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে। কারো জন্য কারোর জীবন থেমে থাকে না, এটা কি তুমি বুঝতে পারছ না? চোখের সামনেই তো দেখছ তার প্রমাণ। তুমি চাইলেই পারো নতুন করে শুরু করতে।”
“সব হবে, সব হবে। আমি ভালোই থাকব। অযথা ভাবিস না তো। তুই এখন আমাকে রেখে শুধু নিজের কথা ভাব।”

সুবর্ণার কান্নার গতি বেড়ে গেল। মিশকাতের বুকে পড়ে সে কাঁদতে-কাঁদতে বলল,
“তুমি বোঝো না কেন ভাইয়া? তোমার জন্য আমার কত কষ্ট হয়। আজকাল আমার এত কষ্ট বাবা-মায়ের জন্যও হয় না, জানো? আমরা সবাই থাকতেও তুমি কেন একা? সবাইকে ভালো রেখে তুমি কেন ভালো থাকতে পারো না? তোমার কী হবে ভাইয়া? তোমার এমন পাথরের মতো রূপ দেখতে আমার ভালো লাগে না, মানতে পারি না আমি। আমার ভাই এমন ছিল না।”

মিশকাত ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“শান্ত হ বোন। আমি ভালো থাকব দেখিস তুই। কাঁদিস না। সবাই তাকিয়ে আছে।”

মেরিনা কাছেই ছিল। একজনকে ডেকে তিনি সুবর্ণাকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। সুবর্ণাকে মিশকাতের থেকে সরিয়ে ঘরে নিয়ে গেলে মেরিনা এগিয়ে এলেন। তার দুচোখ ভর্তি টলমলে জলধারা। মিশকাত বলল,
“খালা, তুমিও এখন শুরু কোরো না। অনেক কাজ আছে।”
মেরিনা আঁচলের কোণে চোখের জল মুছে বললেন,
“তুই আমাকে মাফ করবি না বাবা?”
“কিসের মাফ? কী বলছ তুমি খালা? তুমি আমার সাথে কোনোদিন কোনো অন্যায় করেছ? আমি তোমাকে চিনি না? আমার মায়ের থেকে বেশি আহ্লাদ আমি তোমার থেকে পেয়েছি। আমি তোমার আদর ভুলিনি।”
“তোর পরিবর্তন দেখলে আর মনকে মানাতে পারি না রে বাপ। এমন হবে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি আমি।”

মিশকাত খালাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
“খালা, তোমার মিশু ভালো আছে। কেঁদো না। তুমি শুধু দোআ করো আমার জন্য। তোমাদের দোয়া-ই আমাকে ভালো রাখবে।”

সারাদিন ধরে মিশকাতের ব্যস্ততার শেষ নেই। বোনের বিয়েতে কোনো আয়োজনের কমতি রাখেনি সে। বিয়ের কথা ওঠার পর থেকেই সুবর্ণা রোজ তার আসার কথা জিজ্ঞেস করত। কত যে অনুনয়-বিনয় করত মেয়েটা! বিয়েতে একমাত্র ভাই অনুপস্থিত থাকবে, এ ব্যাপারটা নিয়ে সে খুবই মন খারাপ করে ছিল। মিশকাত আসার কথা ভাবেওনি। পরিচিত কয়েকটা মুখ দেখার জন্য বুকের ভেতর ছটফট করলেও সে আসার সাহস করেনি। কারণ সে জানত তার আগমন মোটেই সহজ হবে না। পরিস্থিতি আজন্ম তার প্রতিকূলেই থাকবে। সে চায়নি এত বছর পর তার আগমন কারো জীবনে কোনোরকম প্রভাব ফেলুক। সে চায়নি জিইয়ে রাখা ক্ষত জাগিয়ে তুলে নিজেকে নতুন করে র’ক্তাক্ত করতে। তবু বোনটার কান্নার শব্দ পাথরের মতো এড়িয়ে যেতে পারেনি সে। তাই তো কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে এসে উপস্থিত হয়েছিল বোনের সামনে। সেই মুহূর্তে বাবা-মা-বোনের চমকিত মুখের হাসি আর আনন্দাশ্রু দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। সে চাইলেই পারত আরও আগে এই মানুষগুলোকে দেখে যেতে। কিন্তু সে কখনো ওই সাহসটাই করতে পারেনি।

খুব বেশিদিন থাকার ইচ্ছা তার নেই। যেটুকু ইচ্ছা ছিল, তা-ও আছ শূন্যের কোঠায় নেমে গেল আজকের দিনের সবচেয়ে জঘন্য মুহূর্তটির মুখোমুখি হয়ে। আরিন্তা শাড়ি পরেছে, সেজেছে। সে দেখেছে, দগ্ধ হয়েও চোখ সরিয়ে নিয়েছে। দুচোখ ভরে দেখার অধিকার যে তার আর নেই। খুব সূক্ষ্মভাবে নিজেকে সামলে নিতে জানে সে। এসে হতেই তার প্রমাণ সে দিয়েছে। কিন্তু আজ এত করে ফিরিয়ে রাখা চোখ দুটির সামনেই যখন তার আকাঙ্ক্ষিত নারীটিকে অন্য পুরুষ বুকে জড়িয়ে মুখ জুড়ে আদুরে চুম্বন এঁকে দিলো; সেই অলুক্ষুণে মুহুর্তে তার মনে হয়েছিল সে নিজের সমস্ত ধৈর্য কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। মনে হয়েছিল এই আগমন তার জীবনের জঘন্যতম একটি ভুল। দুর্ঘটনাবশত মুখোমুখি হওয়া ঘটনা থেকে মুখ ফিরিয়ে সে যে গোটা দিন কীভাবে নিজেকে ব্যস্ততায় ডুবিয়ে রেখেছে, তা কেবল সে-ই জানে। এরমধ্যে তার মন সিদ্ধান্ত-ও নিয়ে ফেলেছে, ছুটি থাকলেও সে থাকবে না। বিয়ের ঝামেলা মিটলেই ফিরে যাবে। জোকারের মতো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে এই নরকযন্ত্রণার মধ্যে থেকে নিজের অবশিষ্ট অস্তিত্বটুকু-ও এভাবে শেষ করার কোনো মানেই হয় না।

বোনের বিদায়ে ভাইয়ের এমন বুকফাটা আর্তনাদ ইতিপূর্বে গোটা এলাকায় দেখা যায়নি। যেমনি চিৎকার করছে সুবর্ণা, তেমনি মিশকাত। মানুষজন অবাক হয়ে মিশকাতের কান্না দেখছে আর আফসোস করছে, বোনটাকে খুব ভালোবাসত ছেলেটা। ভাইয়ের কান্না দেখে সুবর্ণা আরও ভেঙে পড়েছে। সে জানে তার ভাইয়ের এ কান্না কেবল তাকে আরেক পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার কষ্টেই নয়, এ কান্নার আরও এক রং আছে। ঘনকালো রং, যা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এ আর্তনাদ বহু বছরের চাপা দেওয়া ব্যথাদের মুক্তি দেওয়ার গোপন কৌশল। কেউ তা জানে না, কেউ জানবেও না। মিশকাতকে আর চাচাতো ভাই আর নিয়াজ শান্ত করার চেষ্টা করছে। আরিন্তা অদূরে দাঁড়িয়ে কেবল চেয়ে-চেয়ে দেখছে। তার পা দুটো এক কদমও সামনে এগোতে পারছে না। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিষাদময় অশ্রুরা। সুবর্ণার বিদায় হয়ে যাচ্ছে, অথচ সে তার কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। কে বলতে পারে? অমন আর্তনাদ তাকেও পেয়ে বসে কি না! সুবর্ণা নিজেই এসে তাকে জাপটে ধরে হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল। ধরা গলায় নিচু স্বরে বলল,
“আপু গো… আমার ভাইটা শেষ হয়ে গেল। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না।”
আরিন্তা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড় করিয়ে রাখল। হাত তুলে কেবল সুবর্ণাকে একবার জড়িয়ে ধরে বলল,
“কাঁদিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তোকে দেখতে যাব।”

সুবর্ণাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরও কান্নার আওয়াজ কমেনি। সবার চোখে জল। মিশকাতের সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁদছে তার বাবা, মা, খালা। মেরিনা তাদের কাছ থেকে সরে এসে মেয়ের কাছে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিলেন। আরিন্তার কান্নায় নেই এতটুকু শব্দ। বোধ হয় শব্দেরা সব ফুরিয়ে গেছে পাঁচ বছর আগেই। সে এখন আর্তনাদ করে কাঁদতে ভুলে গেছে। মিশকাতের কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“এই মানুষটা কত দিনের জমানো কান্না নিয়ে বসেছে মা? থামছে না কেন?”
মেরিনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন,
“ভেতরে চলে যা আরি।”
“ভয় পেয়ো না মা। ওভাবে কাঁদার সাহস আর আমার নেই। একজনের মেয়ের মা হয়ে অন্যের জন্য কাঁদতে নেই, আমি জানি।”

মিশকাত রাতের খাবার খায়নি। তার চাচি তার জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে যাওয়া ধরেছিল। তার থেকে গ্লাস চেয়ে নিয়ে আরিন্তা মিশকাতের ঘরের সামনে উপস্থিত হয়েছে। মিশকাত দরজা খুলেই বসেছিল। আরিন্তা দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
“আসব?”
মুখ তুলে তাকিয়ে আরিন্তাকে দেখে মিশকাত হেসে বলল,
“আয়। অনুমতি নেওয়া-ও শিখেছিস দেখছি! নিয়াজ ভাই শিক্ষা দিতে পেরেছে তাহলে।”

আরিন্তা ভেতরে এসে দুধের গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরে বলল,
“চাচি দিয়েছে, খেয়ে নাও।”
মিশকাত গ্লাসটা হাতে নিল। আরিন্তা তবু দাঁড়িয়ে রইল। মিশকাত কেমন অতিথিদের মতো বলল,
“বসবি? বোস।”
আরিন্তা মাথা নেড়ে বলল,
“বসব না। তুমি আছো কতদিন?”
“কয়েকটা দিন হয়তো। শিওর না।”
“তুমিও চলে যাওয়ার পর খালা-খালু একদম একা হয়ে যাবে।”
“জানি। কিছু করার নেই।”

আরিন্তা আমতা-আমতা করে শুধাল,
“নিজেকে নিয়ে কী ভাবলে?”
মিশকাত খুব সহজভাবে উত্তর দিলো,
“নতুন করে আর কী ভাবব? জীবন তো কোথাও থেমে নেই।”
“যেভাবে চলছে একে কি থেমে থাকা বলে না?”

মিশকাত মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, বলে না। কিছু থেমে নেই বলেই তুই আজ অভিজ্ঞ গৃহিণী হতে পেরেছিস, আর আমি অভিজ্ঞ প্রেমিক।”
“ঠিকই বলেছ। আমাকে অভিজ্ঞ গৃহিণী বানানোর জন্য আর নিজেকে অভিজ্ঞ প্রেমিক বানানোর জন্যই এত বছরে ভুল করেও একবার খবর নাওনি। তাই না?”
“সবই তো বুঝিস। নতুন করে বলার আর কী দরকার?”
“কারণ তোমার এমন জীবনের জন্য নিজের কাছে আজন্ম আমিই দায়ী হয়ে থাকব।”
“কেন? আমি তো তোকে দায় দিইনি। বরং মুক্ত জীবন দিয়েছি।”

আরিন্তা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“হ্যাঁ, মুক্ত জীবন দিয়েছিলে বলেই তো সেদিনের সেই আবেগী, ভেঙে পড়া আমি তোমার মতোই শক্ত পাথরে পরিণত হতে পেরেছিলাম। ওই যে লোহা যেমন আগুনে পুড়ে শক্ত হয়, অনেকটা সেরকমই।”
“আরি, মিশু চাইলে অনেককিছুই করতে পারত, করতে পারে। সে পা’গল, কিন্তু অমানুষ না। আমি পুড়ে কয়লা হয়েছি। আমার ভেতরের কয়লা পুড়তে-পুড়তে ছাই হয়ে যাক, তার বিনিময়ে হলেও তুই ভালো থাক।”
“ভালো আছি মিশু ভাই। আমরা সবাই খুব ভালো আছি। তুমিও ভালো থেকো।”

আরিন্তা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ মিশকাত বলে উঠল,
“শেষ একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি? সেসব ভালোবাসার এক বিন্দুও কি অবশিষ্ট নেই?”
আরিন্তা জবাব দিলো,
“সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। থাকলেও দিতে নেই। সংসার নামক শিকলে আর বাস্তবতার বেড়াজালে বন্দী সেসব উত্তর।”
“নিয়াজ ভাই তার বউকে খুব ভালোবাসে। তাকে ভালোবেসে ভালো রাখিস।”
আরিন্তা মাথা দুলিয়ে বলল,
“রাখব।”

আরিন্তা চলে গেল। মিশকাত ফিরে তাকাল না। কেবল টের পেল একটা সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা বুকের বাঁ পাশ বেয়ে গোটা হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মিশকাত পাত্তা দিলো না, হেসে উড়িয়ে দিলো।

দখিন দুয়ার খুলে
পাখিদের কলতানের বদলে,
তুমি শুনছ তোমার বদ্ধ দুয়ারে বন্দী
নিজের গুনগুন কান্নার সুর।
কেউ শোনে না!
তোমার ফুলেভরা উচ্ছসিত হৃদয়ে
লেপ্টে আছে কালচে লাল রক্তের ছোপ,
কেউ দেখে না!
তোমার রঙিন বসন্ত বিষাদের গাঢ় স্পর্শে
কালো হয়ে আছে,
কেউ জানে না!
আদতে কেউ জানতে পারে না।

আরিন্তা ঘরে গিয়ে দেখল খাটের মাঝখান জুড়ে নোভা শুয়ে আছে। পাশে বসে নিয়াজ মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। আরিন্তা এগিয়ে গিয়ে নিয়াজকে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়েছে তো। শুয়ে পড়ো তুমি।”

আরিন্তা নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে ঘুমন্ত নোভার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলো। এই মেয়েটা যবে থেকে তার জীবনে এসেছে, তবে থেকেই তার জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা আরও একগুণ বেড়ে গেছে। নিয়াজ শুধাল,
“কোথায় ছিলে?”
“মিশু ভাইয়ের সাথে কথা বললাম একটু।”

সহজ স্বীকারোক্তি করে আরিন্তা সরে যাওয়া ধরতেই নিয়াজ আচমকা তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। আরিন্তা খানিক চমকাল। অথচ তাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে রইল নিয়াজ। ক্ষণকাল চুপ থেকে আরিন্তা মাথা হেলিয়ে তাকিয়ে নিয়াজের গালে হাত রেখে শুধাল,
“কী হয়েছে?”
নিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাথা নেড়ে বলল,
“কিছু না। তোমাকে প্রয়োজন।”
“আমি আছি তো।”

আরিন্তা নিয়াজের হাত সরাতে চাইল। নিয়াজ সরাতে দিলো না। কেমন অনুরোধের সুরে বলল,
“একটু থাকো না।”

আরিন্তা বুঝল নিয়াজের মনে কী চলছে। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে সে নিয়াজের চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি না আমার শক্তি হয়ে আমাকে ভরসা দিয়ে শক্ত করে তুলেছ? নিজে কেন মনোবল হারাচ্ছ? এত বছরেও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারলাম না?”
“তুমি ছাড়া কাকে বিশ্বাস করব আমি?”
“তাহলে এসব কী?”

নিয়াজ নীরব রইল। খানিক বাদে মৃদু শব্দে বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি আমার নোভার আম্মু।”
আরিন্তা মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
“নোভার আব্বুকেও নোভার আম্মু ভালোবাসে।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে