#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২৫.
নিয়াজ প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিন্তা একটু ভেবে বলল,
“আন্টির কাছে আজ আপনার ব্যাপারে অনেক কথা শুনলাম। কিন্তু তার সত্যতা নিয়ে আমি কনফিউজড।”
“সে মিথ্যা বলার মানুষ না।”
“কীভাবে বুঝলেন? আপনি তো শুনলেনই না কী কথা বলেছে।”
“তাকে আমি ছোটোবেলা থেকে চিনি, বুঝা কঠিন কিছু নয়। তারপর বলো কী কথা বলেছে?”
আরিন্তা হোসনে আরার বলা কথাগুলোই একে-এক পুনরাবৃত্তি করল। নিয়াজ চুপচাপ শুধু শুনছে দেখে সে আবার শুধাল,
“কথা বলছেন না কেন? এসব কি সত্যি? আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনি চাপা স্বভাবের মানুষ।”
নিয়াজ হতাশ মুখে বলল,
“আন্টি এসব কথা বলেছে তোমাকে?”
“বলল তো। আপনি কি সত্যিই এমন?”
“যদি হয়ে থাকি?”
আরিন্তা ভাবুক হয়ে বলল,
“হলে কি আমি এতদিনে বুঝতাম না?”
“কখনও বুঝতে চেয়েছিলে?”
আরিন্তার মুখ আটকে গেল। পরক্ষণেই বলল,
“আমি আপনাকে প্রশ্ন করেছি। আমাকে প্রশ্ন করতে বলিনি।”
নিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“সব হাসিখুশি মুখের আড়ালে স্বাভাবিক জীবন থাকে না। কিছু হাসিমুখের আড়ালের জীবন অস্বাভাবিক রকমেরও হয়। তোমাকে তেমনই এক জীবনের গল্প বলব, শুনবে?”
আরিন্তা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“গল্প?”
নিয়াজ মাথা নেড়ে বলল,
“হুঁ, একটা ছোট্ট ছেলের বড়ো হওয়ার গল্প।”
“শুনব।”
“আমি গল্প বলতে অভ্যস্ত নই। তুমি কিন্তু বিরক্ত হলে বোলো।”
“বিরক্ত হব না, বলুন।”
নিয়াজ নড়েচড়ে বসে গল্প বলতে শুরু করল,
“গল্পটা যে ছেলেকে নিয়ে, তার ছোটোবেলাটা ছিল খুবই চমৎকার। একদম স্বপ্নের মতো সুন্দর। তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে এমনভাবে আদর করত, যেন সে রাজপুত্র। বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের ছেলেকে অবশ্য রাজপুত্র ভাবারই কথা। সে ছিল মায়ের খুবই বাধ্য ছেলে। বাবা-মাকে নিয়ে পরিবার হওয়ায় মা-ই ছিল তার সকাল থেকে রাতের একমাত্র সঙ্গী। বাবা কর্মব্যস্ত মানুষ ছিলেন। ছেলেকে দেওয়ার জন্য সময় পেতেন খুব কম। ছেলেটার মা তাকে এত বেশি ভালোবাসত যে সে একটু ব্যথা পেলেও মায়ের চোখেই আগে পানি এসে যেত। স্কুলে ছেলেটার অনেক বন্ধু ছিল। কিন্তু মায়ের সান্নিধ্যই তার সবচেয়ে পছন্দের ছিল। আত্মীয়-স্বজন যারা তাকে খুব আদর করত, তাদের সাথেও সে মিশতে পছন্দ করত। মা প্রতিদিন নিজ হাতে তার পছন্দমতো খাবার বানিয়ে দিত, স্কুলে যাওয়ার আগে যত্ন করে রেডি করিয়ে দিত। এমনকি হাতের কাজ রেখে প্রতিদিন ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসত, আবার ছুটির পর নিয়েও আসত। ছেলেটা তখন ঠিক বুঝত না পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি সে। বুঝল কখন জানো?”
আরিন্তার ভালো লাগছিল এক সুখী বাচ্চার গল্প শুনতে। সে কৌতুহল নিয়ে শুধাল,
“কখন?”
“যখন তার মা তাকে লোকে লোকারণ্য পৃথিবীর মাঝে একা ছেড়ে দিয়ে আজীবনের জন্য দূরে চলে গেল, তখন।”
আরিন্তার মুখটা আচমকা কালো মেঘে ছেয়ে গেল। নিয়াজ একটু থেমে পুনরায় বলতে শুরু করল,
“ছেলেটাকে তার বাবা, আত্মীয়-স্বজন সবাই খুব বুঝানোর চেষ্টা করেছিল, তার মা কিছুদিনের জন্য দূরে গেছে। কিন্তু ছেলেটা বুঝত মা আর তার কাছে ফিরবে না। সকাল থেকে রাতের একমাত্র সঙ্গী হারানোর দুঃখ তার ছোট্ট হৃদয়ে হাতুড়ি পেটার মতো আঘাত করেছিল। সময়-অসময় সে মায়ের জন্য কাঁদত। মানুষ বলত সময়ের সঙ্গে আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। সময় গেল, ছেলেটার কান্নাও থামল, কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। বরং ছেলেটা আরও বেশি এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। বাবা তাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারে না বলে খালার কাছে পাঠাতে চেয়েছিল। সবাই রাজি ছিল, একমাত্র ছেলেটা ছাড়া। নিজের ঘর, মায়ের স্মৃতি ছেড়ে কোথাও শান্তি খুঁজে পাবে না বুঝেই সে কোথাও যেতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে বেতন-ভাতা দিয়ে লোক ঠিক করে বাবা তার হাতে ছেলের দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল। বাবা তাকে সময় দেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করত। কিন্তু ছেলেটার জন্য সে সময়টুকু বড্ড কম ছিল। কিন্তু বাবারও কিছু করার ছিল না। ওই মানুষটাকে তার ভাই-বোনরা দ্বিতীয় বিয়ে করার তাগাদা দিয়েছিল বহুবার। কিন্তু সে কোনোভাবেই রাজি হয়নি। কারণ সে ছেলের জন্য চিন্তিত ছিল, ছেলের মাকেও সে অনেক বেশি ভালোবাসত। এসব নিয়ে বাক-বিতণ্ডা চলতে-চলতে এক পর্যায়ে এসে ভাই-বোনের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়। কেউই তার পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।”
আরিন্তা অসন্তুষ্ট মুখে বলল,
“এ কেমন ভাই-বোন! তারপর?”
“তারপর বছরের পর বছর কা’টল। ছেলেটার জীবনের সবকিছুই স্বাভাবিক চলছিল। পড়াশোনা নিয়েই তার সময় কে’টে যেত। কিন্তু পড়াশোনা ছাড়া তার জীবনে সে আর কিছুই পায়নি। মায়ের অভাব তাকে কুড়ে-কুড়ে খেয়েছে, কিন্তু সে তা কাউকে বলেনি। স্কুল আর বাসার মধ্যে থাকতে-থাকতে সপ্তাহে একদিন আর বাবার সাথে তার বাইরে বেরোতে ইচ্ছা করত না। তবু মাঝে-মাঝে বাবা জোর করে ঘুরতে নিয়ে যেত। বাবা যখন বুঝতে পেরেছিল ছেলেটা অল্প বয়সে একা হয়ে পড়েছে, তখন সে খুব বুঝাতে চাইত সে ছেলের পাশে আছে। কিন্তু ততদিনে ‘একাকিত্ব’ নামক ভয়ানক রোগ ছেলেটাকে পেয়ে বসেছিল। একা থাকতে-থাকতে সে বন্ধু-বান্ধবও হারিয়ে ফেলেছিল। নতুন বন্ধুত্ব গড়তে তার মন টানত না। স্কুল, কলেজে সহপাঠীরা তার সাথে ভাব জমাতে চাইত। কিন্তু সে চুপচাপ থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। তারপর একদিন সে নিজের লক্ষ্য পূরণ করে কিঞ্চিৎ আনন্দিত হলো। ততদিনে তার বাবা শয্যাশায়ী। ছেলেটা তখন বাবার মতো কর্মব্যস্ত হলো। আর বাবা পেল তার একাকিত্ব জীবন। নিজের একাকিত্বের অভিজ্ঞতা থেকে বাবার একাকিত্ব তার ভালো লাগত না। ছেলেটা নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন ছিল। সেজন্য বাবা-ই তার জীবনের কথা চিন্তা করে রীতিমতো বিয়ের তাগাদা দিতে শুরু করেছিল। ছেলেটা তখন বাবার চিন্তা ছাড়াও অনুভব করেছিল, সত্যিই এবার তার নিজের একজন মানুষ প্রয়োজন। নিজের মানুষের প্রয়োজনবোধ করার পর থেকেই না অনেক অদ্ভুত সব জল্পনা-কল্পনা তাকে জাপটে ধরেছিল। সবসময় তার মনে হত নিজের একটা মানুষ হলেই তার একাকিত্ব ঘুঁচবে। নিজের জীবনের যত একাকিত্বের গল্প সে নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে রেখেছে, যত কথা সে সবার থেকে লুকিয়েছে, সেসব কথা সে ওই মানুষটাকে বলবে। নিজেকে মুক্ত করে দিবে তার কাছে। যেসব সময়গুলো তার অযথা কেটে গেছে, সেসব সময়গুলো সে ওই মানুষটাকে নিয়ে সাজিয়ে তুলবে। ওই মানুষটার সঙ্গে সম্পূর্ণ এক নতুন, অন্যরকম জীবন গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা তাকে লোভী করে তুলেছিল। সত্যিই ছেলেটা লোভ করতে শিখেছিল, ভালোবাসা পাওয়ার লোভ। সে খুব করে চেয়েছিল তার নিজের একটা মানুষ হবে যে তাকে খুব ভালোবাসবে, যত্ন করবে, তাকে এত সময় দিবে যে ছেলেটা একসময় নিজের জীবনের যত অভাব, একাকিত্ব ভুলে যাবে। সব দুঃখ, না পাওয়া ভুলে তার জীবন একজন মানুষে আটকে পড়বে। জানো? ছেলেটা ঠিকই নিজের একজন মানুষ পেয়েছে। কিন্তু সময়, যত্ন, ভালোবাসা দূর, তাকে নিজের মানুষ দাবি করতেও তার দুবার ভাবতে হয়। ছেলেটার জন্য আমার খুব বেশি করুণা হয়, জানো তো? আমি চাই ছেলেটার নিজের মানুষটারও তার ওপর একটু করুণা হোক। আচ্ছা আরিন্তা, এক জীবনে ভালোবাসা না পাওয়ার দুঃখ কি করুণায় মিটে? না মিটুক, মনটা অন্তত একটু সান্ত্বনা তো পাবেই। তাই না? হতভাগা ছেলেটার জীবনে এর বেশি আর কীইবা পাওয়ার আছে?”
আরিন্তা শান্ত চোখে নিয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গল্পের শুরুর দিকে নিয়াজের মুখোভাব খুবই সিরিয়াস ছিল। কিন্তু শেষ করতে-করতে সেই মুখে কিছু চাপা বিষাদের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। গলার স্বরও পালটে গেছে। এই মুহূর্তে আরিন্তার কাছে তাকে ঠিক হোসনে আরার বর্ণনার নিয়াজ মনে হচ্ছে। নিয়াজ চুপ হয়ে যাওয়ায় আরিন্তা শুধাল,
“আপনার গল্প শেষ হয়েছে?”
নিয়াজ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আরিন্তা পুনরায় শুধাল,
“আর কিছু বলার নেই?”
“তুমি আরও শুনতে চাও?”
“না। তবে একটা প্রশ্নের উত্তর চাই। গল্পের ছেলেটার নাম কি ডক্টর নিয়াজ মাহমুদ?”
নিয়াজ মেকি হাসল। সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“খালা তোমাকে যা বলেছে, মিথ্যা কিছু বলেনি। আমার জন্য তার খারাপ লাগে। সেই খারাপ লাগা থেকেই তোমাকে ওসব কথা বলেছে। কিছু মনে কোরো না।”
নিয়াজ উঠে টেবিলে ফিরে গেল। ল্যাপটপটা হাতে তুলে বলল,
“ধন্যবাদ।”
আরিন্তা জানতে চাইল,
“কেন?”
“কেন জানি ভেতরটা হালকা লাগছে।”
নিয়াজ আবিরের ল্যাপটপ ফেরত দিতে যাচ্ছিল। আরিন্তা পেছন থেকে বলে উঠল,
“আপনার মতো একজন মানুষের ভালোবাসার জায়গায় করুণা চাইতে কি আত্মসম্মানে লাগে না?”
নিয়াজ ক্ষণিকের জন্য পা থামিয়ে উত্তর দিয়ে গেল,
“বাইরের মানুষের করুণা তো চাইনি। যারটা চেয়েছি সে আমার ঘরের মানুষ। আমার মতো মানুষের জন্য ঘরের মানুষের ভালোবাসার অভাবের কাছে আত্মসম্মান কেন, গোটা জীবনটাই ব্যর্থ। আমার জায়গায় থাকলে হয়তো বুঝতে ‘না পাওয়া’ ঠিক কাকে বলে।”
এতদিন পর আরিন্তাকে অনলাইনে পেয়ে সুবর্ণা ফোন করেছে। সে জানাল নিয়াজ-আরিন্তার কাপল পিক দেখেছে। প্রশংসা করে বলল,
“তোমাদের খুব সুন্দর লাগছিল আপু।”
আরিন্তা তাকে থামিয়ে দিয়ে শুধাল,
“মিশু ভাই ফেসবুকে নেই?”
“আছে। কিন্তু আগের মতো রেগুলার না। মাঝে-মাঝে এলেও বুঝা যায় না। অ্যাক্টিভ স্ট্যাটাস অফ করে রেখেছে।”
তারপর সুবর্ণা মিনমিনিয়ে বলল,
“তোমাদের ছবি দেখেছে।”
আরিন্তার বুকের ভেতর কামড় দিয়ে উঠল। প্রশ্ন করল,
“কী বলল?”
“তেমন কিছু না। শুধু বলল তোমাদের একসঙ্গে মানিয়েছে।”
“সত্যিই কি মানিয়েছে? মন থেকে বলা কথা এটা?”
“জানি না। প্রয়োজনের বাইরে তো কোনো কথা বলে না আমাদের সাথে। তার কথা বাদ দাও।”
“সে কি বাদ দেওয়ার মতো বিষয় সুবর্ণা?”
“না হলেও দিতে হবে আপু। তোমার বর্তমান, ভবিষ্যতের সঙ্গে যার জীবন জড়িয়ে আছে, তার কথা ভাবো। সে ছাড়া বাকি সব তোমার কাছে বাদ দেওয়ার মতোই বিষয়।”
“আমি মাঝনদীতে পড়ে আছি রে বোন। এই অনুভূতি তুই বুঝবি না।”
“তোমার সামনে বাঁচার পথ আছে আপু, তা আঁকড়ে ধরো। মাঝনদীতে না ডুবে নতুনভাবে বাঁচো। কে বলতে পারে? হয়তো সুখের এক নতুন পথ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেদিকে পা বাড়াও আপু। যত কষ্ট হোক, নিজেকে একটু সুযোগ দাও।”
আরিন্তা চোখ বন্ধ করে বড়ো করে দম নিল। ঢোক গিলে মৃদু স্বরে ডাকল,
“সুবর্ণা?”
“বলো আপু।”
“মিশু ভাইকে জিজ্ঞেস করিস তো, এক আকাশে স্থায়ীভাবে বাস করা এক চাঁদ কখনও অন্য আকাশে জায়গা বদল করতে পারে কি না। উত্তরটা আমাকে জানাতে হবে না।”
নিয়াজের ভাই-বোনরা সবাই তার পেছনে লেগেছে বাইরে যাওয়ার জন্য। আজকের ডিনার তারা বাইরে করতে চায়। আবির সবাইকে আরও উসকে দিচ্ছে। এমনিতেই আরিন্তা এখানে আর থাকতে চাইছে না। তার ওপর এই রাতে আবার তাকে টানাহেঁচড়া করলে অসন্তুষ্ট হয় কি না ভেবে নিয়াজ রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আরিন্তা নিজেই বলে বসল,
“সবাই যখন এত করে বলছে চলুন। এখানে তো আপনার কোনো কাজও নেই। রাজি না হওয়ার কী আছে?”
ব্যস, এটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল নিয়াজকে রাজি করাতে। সবাই মিলে হৈ-হৈ করে বেরিয়ে পড়ল রাতের শহরে। এদিক-ওদিক না ঘুরে সোজা ঢুকে পড়ল পছন্দের রেস্টুরেন্টে। ভুঁড়ি ভোজের সঙ্গে চলল জমিয়ে আড্ডা। তাদের হা-হা, হি-হির শব্দে পাশের টেবিলের মানুষজন রীতিমতো অতিষ্ট। নিয়াজ অনেকবার থামাতে চেয়েও এদের মুখ বন্ধ করতে পারেনি। অন্যদের থামাবে কী? তার নিজের বউয়ের মুখটাই তো আজ থামছে না। সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে-ও আজ কোমর বেঁধে গল্প করতে লেগে পড়েছে। এই ব্যাপারটা অবশ্য তার মন্দ লাগছে না। মেয়েটাকে এমন স্বাভাবিক, হাসিখুশি দেখা তার কাছে সৌভাগ্য মনে হয়। সবসময় তার এমন সৌভাগ্যের মুহূর্ত যে আসে না!
ফেরার সময় ফুটপাত থেকে আবির তার বউকে ফুল কিনে দিলো। মালা কিনে হাতেও জড়িয়ে দিলো। হাসিমুখে ভালোবাসা নিবেদন করল। তার বউ ভীষণ খুশি হলো। নিয়াজকেও সে টেনেটুনে সাথে নিয়ে ফুল কিনিয়েছে। কিন্তু নিয়াজ তার মতো করে আরিন্তাকে ভালোবাসা নিবেদন করতে পারেনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ফুলের গোছা আরিন্তার হাতে তুলে দিয়েছে। আরিন্তার মুখেও কেবল ‘ধন্যবাদ’ ছাড়া তেমন পৃথিবীর সকল সুখ পেয়ে যাওয়ার মতো আনন্দের দেখা মিলেনি। আবির হতাশ মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“ইয়া মাবুদ! এসব দিন দেখাতেই বেছে-বেছে এই নিরামিষ দুটোকে জুটি মিলিয়ে দিয়েছিলে?”
এর আগেও নিয়াজ একবার আরিন্তার জন্য অনেকগুলো ফুল কিনে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। আরিন্তা সেগুলো ছুঁয়েও দেখেনি। টেবিলের ওপর অবহেলায় পড়ে থেকে যখন ফুলগুলোর পাপড়ি ঝরে গিয়েছিল, তখন নিয়াজ নিজেই আবার সেগুলো নিয়ে ফেলে দিয়েছিল। ভেবেছিল এবারে আরিন্তা নিজেই ফুলগুলো ফেলে দিবে। কিন্তু তার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে বাড়ি ফিরে আরিন্তা ফুলগুলো টেবিলের ওপরের ফুলদানিতে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। যারপরনাই অবাক-ই হয়েছে নিয়াজ। এমনকি আরিন্তা ঘুমাতে গিয়েও বলেছে আজ বাইরে থেকে ঘুরে এসে তার ভালো লাগছে। সবসময় ঘরবন্দী থাকতে-থাকতে তার দমবন্ধ লাগছিল। আরিন্তা যখন চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন নিয়াজ হঠাৎ তাকে ডাকল,
“আরিন্তা?”
আরিন্তা চোখ বন্ধ রেখেই সাড়া দিলো,
“হুঁ?”
“সব কথাই তো শুনলে। শুধু একটা কথা বলা হয়নি তোমায়। শুনবে?”
“বলুন।”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। স্ত্রী বলে কথার কথা বলছি না। সত্যিই ভালোবাসি।”
আরিন্তার চোখ জোড়া ঝট করে খুলে গেল। সহসা সে কোনো উত্তর দিতে পারল না। নিয়াজ ব্যাকুল হয়ে পুনরায় ডেকে উঠল,
“আরিন্তা? কিছু বলবে না?”
“কী বলব?”
“তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে রাগ করবে না?”
“কেন ভালোবাসেন?”
“কেন বাসব না? বউ তো একটাই। একমাত্র বউ ভালোবাসার মতো মানুষ হলে আমি ভালো না বেসে যাব কোথায়?”
“আপনাকে কে বলেছে আমি ভালোবাসার মতো মানুষ?”
“কেউ বলেনি। এতদিনেও কি উপলব্ধি করতে পারব না?”
“উপলব্ধি কীভাবে করলেন? আমি তো কখনও আপনাকে ভালোবাসিনি।”
“কিন্তু আমি তো বেসেছি। তুমি ভালোবাসোনি কারণ তোমার ভালোবাসার মানুষ ছিল, আছে। আমি ভালোবেসেছি কারণ অনেক অপেক্ষার পর আমার ভালোবাসার মতো একটা মানুষ হয়েছে।”
“তাতে কী লাভ, সে-ই যদি আপনাকে ভালো না বাসে?”
“জানি না। তুমি আমায় ভালো না বাসলেও আমার ভালোবাসার অধিকারটুকু অন্তত তুলে নিয়ো না আরিন্তা। তোমার ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট থেকেও আমায় বেশি পোড়াবে তোমাকে ভালোবাসতে না পারার কষ্ট। তুমি কি এরপরও রাগ করবে আরিন্তা?”
আরিন্তা মৃদু কন্ঠে উত্তর দিলো,
“করব না।”
“তোমাকে ভালোবাসি জেনেও তুমি রাগ করবে না?”
“না।”
নিয়াজ লাফিয়ে উঠে বসল। আচমকা তার কাণ্ডে আরিন্তা ফিরে তাকাল। নিয়াজ তার দিকে এগিয়ে বসে আনন্দিত মুখে শুধাল,
“তুমি সত্যিই রাগবে না?”
আরিন্তা পালটা প্রশ্ন করল,
“না রাগলে আপনি খুশি হবেন?”
“অনেক খুশি হব।”
“ঠিক আছে। আর রাগ করব না।”
নিয়াজ হাসিমুখে বলল,
“দেখেছ? আমি বলেছি না তুমি ভালোবাসার মতোই মানুষ? আচ্ছা? তুমি কি জানো আমি তোমাকে এত ভালোবেসে ফেলেছি কীভাবে?”
“না।”
“রোজ রাতে তুমি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকো, তখন আমি চুপচাপ বসে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।”
আরিন্তা অবাক হয়ে বলল,
“সত্যি?”
নিয়াজ মাথা দুলিয়ে বলল,
“সত্যি। ঘুমের মধ্যে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। একদম নিষ্পাপ, কোমল ফুলের মতো লাগে। আমার চোখ ফেরাতে কষ্ট হয়। তখন আমার কী ইচ্ছা করে জানো?”
আরিন্তা দুপাশে মাথা নাড়ল। নিয়াজ বলল,
“তোমার কপালে চুমু খেতে ইচ্ছা করে। ভীষণ ইচ্ছা করে। কিন্তু তুমি কাঁদবে বলে আমি নিজেকে আটকে রাখি। ভালোবাসার মানুষের থেকে নিজেকে আটকে রাখা খুব বেশি কঠিন, জানো? তবু আমি তোমায় কাঁদাতে চাই না। আচ্ছা আরিন্তা, আমি যদি তোমার কপালে চুমু খাওয়ার অনুমতি চাই, তুমি অনুমতি দিবে?”
নিয়াজের চোখে-মুখে-কন্ঠে আকুল আবেদন। যেন কতশত বছর পর সে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে। আরিন্তার চোখ ভরে জল চলে এল। প্রিয় মানুষটির দুচোখে টলমল জল দেখে নিয়াজ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল,
“তোমাকে আমি জোর করছি না। কাঁদবে না প্লিজ। তোমার কান্নার শব্দ আমার বুকে খুব বিঁধে। তুমি জানো না রোজ সেই শব্দ সহ্য করতে আমার কী কষ্ট হয়! প্লিজ আরিন্তা। আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম। তোমাকে কোনো অনুমতি দিতে হবে না।”
আরিন্তা তাকে স্তব্ধ করে দিয়ে বলে উঠল,
“অনুমতি দিলাম।”
নিয়াজ পুরোদস্তুর অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আরিন্তা পুনরায় ধরা গলায় বলল,
“কী? শুনছেন না? আপনাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
“সত্যি?”
এরপর আরিন্তা মুখে উত্তর না দিয়ে হাত তুলে নিজের কপালের ওপরে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিলো। নিয়াজ রোবটের মতো ঝুঁকে পড়ে আরিন্তার কপালের ঠিক মাঝ বরাবর চুমু খেল। ক্ষণিকের নয়, দীর্ঘ চুমু। সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তার চোখের টলমলে জল সব কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। নিয়াজ তার কপাল থেকে ঠোঁট জোড়া সরিয়ে নিয়ে তার ভেজা চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমি কী করলে তোমার এই চোখের পানি চিরতরে বন্ধ করতে পারব আরিন্তা? ভালোবাসা কি শুধু কাঁদাতেই পারে? কান্না ভুলিয়ে দিতে পারে না?”
উত্তরে আরিন্তা হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল। নিয়াজ বিচলিত হয়ে উঠল,
“আরিন্তা? সরি আরিন্তা, কেঁদো না প্লিজ। আমি আর তোমার কাছে এমন আবদার করব না। প্লিজ, শান্ত হও।”
আরিন্তা থামল না। নিয়াজ তার চোখের পানি মুছে দিলো, সে কিছু বললও না। নিয়াজ কেমন বিপাকে পড়ে গেল। না পারল সরে যেতে, না পারল মেয়েটাকে থামাতে। শেষমেষ সে সব ভাবনা-চিন্তা, সংকোচ, দূরত্ব ভেদ করে আকাশ-পাতাল না ভেবে আরিন্তাকে বুকে জড়িয়ে নিল। সে ধরেই নিল আরিন্তা তার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মেয়েটা নড়লও না। সে যেভাবে বুকে তুলে নিয়েছে, সেভাবেই তার বুকে পড়ে অশ্রু বিসর্জন দিলো। কেবল তার হাত দুটো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রইল বিছানার চাদর। নিয়াজের বুকের ভেতর এক মিশ্র অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। একদিকে মেয়েটার কান্নার শব্দ তার বুকে আঘাত করল। আরেকদিকে এই প্রথমবার মেয়েটাকে নিজের বুকে পেয়ে তার কেমন ‘না পাওয়া’ কিছু আকস্মিকভাবে পেয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ অনুভব হলো। সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তার মনে। নিয়াজ এক হাত তুলে পরম আদরে আরিন্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কোমল কন্ঠে বলল,
“ছিঁচকাদুনে মেয়ে, স্বামীহারা মেয়েদের মতো কেঁদো না। তোমার স্বামী এখনও বেঁচে আছে। তুমি রাখলে সে মৃত্যুর আগ অবধি তোমার পাশে থাকবে। হৃদয়ের কাছাকাছি গিয়েও কি তুমি তার কথা শুনতে পারছো না? ওই হৃদস্পন্দন বলছে সে তোমাকে ভীষণ রকম ভালোবাসে।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২৬.
খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন পুলক তালুকদার। খেতে মন টানছে না। আজ বাড়িতে বড়ো কাতলা মাছ রান্না হয়েছে। ছোটোবেলা থেকে আরিন্তার পাতে তিনি নিজ হাতে কাতলা মাছের মাথাটা তুলে দিতেন। মেয়েটা খুব পছন্দ করে খেতে। আজ প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল মেয়েটা তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খায় না। বাড়ি আসতেই তাকে রাজি করানো কঠিন। প্রতিবার নিয়াজকে দিয়ে বলেকয়ে রাজি করিয়ে তাকে বাড়ি আনা হয়। তা-ও সে খুব বেশিদিন থাকে না। নিয়াজের সঙ্গে আসে, আবার তার সঙ্গেই চলে যায়। নিয়াজের ব্যস্ততার মাঝে পেলব কতবার বোনকে আনতে গিয়েছিল। কোনোবারই মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেনি। পুলক তালুকদার ফোন করে বারবার আসার অনুরোধ করেন। সে দোনামোনা করে এড়িয়ে যায়। যে দুয়েকটা দিন সে বাড়ি এসে থাকে, ততদিন প্রয়োজনের বাইরে বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে না। এমনকি এক টেবিলে খেতেও বসে না। অথচ পুলক তালুকদার বাজার থেকে মেয়ের জন্য তার পছন্দের মাছ, মাংস, সবজি বেছে-বেছে নিয়ে আসেন। পেলব প্রতি বেলায় বাইরে গেলেই বোনের পছন্দের খাবার ছাড়া খালি হাতে বাড়ি ফিরে না। অথচ আরিন্তা যেন নির্লিপ্ত। কিছুতেই তার নেই পূর্বের মতো আনন্দ। এখন আর সে পছন্দের খাবার পেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। প্রতি ঘন্টায় তার রাক্ষুসে ক্ষুধা পায় না। সময়-অসময়ে খাওয়ার রুচি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ফলস্বরূপ তার স্বাস্থ্যেরও যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। তার মুখের দিকে তাকালে বাবা-মায়ের বুকের ভেতর হুঁ-হুঁ করে ওঠে। পেলব বারবার করে নিয়াজকে বলে দেয় বোনের খাবারের দিকে বিশেষ নজর রাখতে। নিয়াজ যথেষ্ট চেষ্টাও করে, কিন্তু একরোখা মেয়েটার অভ্যাসগুলো সে কিছুতেই পরিবর্তন করতে পারে না।
এবার প্রায় এক মাস হতে চলল আরিন্তা বাড়ি আসে না। মেয়ের মুখটা দেখার জন্য পুলক তালুকদারের মন বড়ো উদগ্রীব হয়ে আছে। আজও ফোন করে কত করে বললেন আসার জন্য। তার এক কথা, নিয়াজের ছুটি নেই। পুলক তালুকদার নিজে আনতে যাওয়ার কথা বললেন, তাতেও যে তার মত নেই তা কথার সুরেই স্পষ্ট। পেলব খেতে এসে দেখল বাবা খাবার না খেয়ে ব্যথিত মুখে বসে আছে। প্রশ্নভরা চোখে সে মায়ের দিকে তাকাল। মেরিনা স্বামীর ওপর রাগ ঝাড়তে না পেরে রাগত স্বরে ছেলেকে বললেন,
“শখ করে বোনের গলায় পাড়া দিয়ে বিয়ে দিয়েছিলি না? বোনকে সুখী করে নিজেরাও নিশ্চিন্ত থাকার জন্য? তাহলে আর এত ঢং কিসের তোদের? দেখ সুখ, দেখ কত সুখের সাগরে ভাসছে তোর বোন। এখন আর তোদের অত চিন্তা কিসের? যেমন আনন্দে থাকতে চেয়েছিলি, থাক। রোজ-রোজ আমার যেন কোনো নাটক দেখতে না হয়। এসব নাটক দেখার শখ আমার চিরতরে ঘুচে গেছে। আর দেখার ধৈর্য নেই।”
পেলব বলল,
“মা, তুমি আবার শুরু করলে?”
“না বাপ, আমার আর শুরু করারও কিছু নেই, শেষ করারও কিছু নেই। আমার কী হারিয়েছে, আমি কেমন আছি তাতে তো তোদের কিছু যায়-আসে না। আমার বোন যখন ইচ্ছা আমার কাছে আসে না, সুবর্ণা আসে না, আমি গেলে আমার বোনের মুখে ওর ছেলের খবর শুনে অস্বস্তিতে পড়তে হয়, আমার মিশু আমার সাথে আর আগের মতো মনখুলে কথা বলে না, আমার জন্মের মেয়েটা পর্যন্ত আমার কাছে আসে না, তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে-শুনতে আমার বুক ভার হয়ে যায়; এসবে কার কী আসে-যায়? এসব আমারই কপালের দোষ। আর সবাই নির্দোষ।”
মেরিনা কাঁদতে-কাঁদতে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত পায়ে টেবিলের কাছ থেকে সরে গেলেন। পেলব, পুলক তালুকদার কেউই কিছু বলতে পারল না। কিছু সময় দুজনেই মুখবন্ধ করে বসে রইল। বাবা খাবারে হাত দিচ্ছে না বলে পেলবের-ও খাবার নেওয়া হচ্ছে না। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর পুলক তালুকদার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“খেয়ে নে।”
পেলব প্লেটে খাবার নিল। পুলক তালুকদার ভাত চিবোতে-চিবোতে কিছু একটা চিন্তা করে বললেন,
“কাল বরং ঢাকা যা।”
হঠাৎ ঢাকা যাওয়ার আদেশে পেলব খাওয়া থামিয়ে বলল,
“কেন?”
“আরিকে আনতে।”
“লাভ কী? আসবে না তো।”
“গিয়ে দেখ। এবার তো অনেকদিন হয়ে গেল।”
“কতবারই তো গেলাম।”
“এবারও যা। তুই যেতে না পারলে আমিই যাব।”
পেলব ছোটো একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কাল আমার কাজ আছে, পরশু যাব।”
“নিয়াজকে ফোন করে জানিয়ে দিস।”
পুলক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
কোমরে ওড়না গুঁজে আরিন্তা রাতের খাবার রান্না করছে। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আজ রান্না বসাতে দেরী হয়ে গেছে। মায়ের মন খুব খারাপ ছিল। কারণটাও তার অজানা নয়। তাই সে আজ একটু বেশি সময় কথা বলেছে। তার রান্না যখন শেষের দিকে তখন নিয়াজ বাড়ি এসেছে। রান্নাঘরের আলো জ্বালানো দেখেই সে বুঝতে পেরেছে আজ রান্না করতে দেরী হয়েছে। হাত খালি করে সে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। আরিন্তা তখন তরকারি নাড়ছে। নিয়াজ নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে তার কোমর জড়িয়ে কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়াল। আরিন্তা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে মৃদু হাসল। এক হাত তুলে নিয়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধাল,
“ক্লান্ত?”
নিয়াজ হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলাল।
“চা করে দিবো?”
“উঁহু। তোমার রান্না শেষ হয়েছে?”
“এই তো শেষ। তরকারিটা নামিয়ে বাসন ধুবো শুধু।”
নিয়াজ আরিন্তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তাহলে এটুকু আমি করছি। তুমি গিয়ে রেডি হও, বাইরে যাব।”
আরিন্তা ভ্রুকুটি করে বলল,
“এখন কিসের বাইরে যাব? রান্নাবান্না হয়ে গেছে। খেয়ে ঘুমানো লাগবে না?”
“না, লাগবে না। কতদিন হয়ে গেছে বাইরে যাওয়া হচ্ছে না তোমাকে নিয়ে।”
“তা কি অন্য এক সময় যাওয়া যাবে না? আমার এখন যেতে ইচ্ছা করছে না।”
“আমার ইচ্ছা করছে। যাও গিয়ে রেডি হও।”
আরিন্তা চোখে-মুখে অনিচ্ছা নিয়ে বলল,
“কাল যাই? আপনারও তো বিশ্রাম দরকার।”
নিয়াজ ত্যাড়া কন্ঠে বলল,
“ঘুরতে গেলেই আমার বিশ্রাম হয়ে যাবে। যাও।”
“তরকারিটা নামিয়ে যাই।”
“এটুকু আমিই করতে পারব। তুমি যাও তাড়াতাড়ি।”
“আপনি ফ্রেশ হবেন না?”
“ফ্রেশ হওয়া যাবে।”
আরিন্তাকে ঠেলেঠুলে নিয়াজ রান্নাঘর থেকে বের করে দিলো। তারপর নিজেই বাকি কাজে হাত লাগাল।
আলস্যতা নিয়েই আরিন্তা রেডি হয়েছে। কোনোমতে পোশাকটা পালটে সে চুল আঁচড়ে নিয়েছে। এরমধ্যেই নিয়াজ হাতের কাজ শেষ করে বাবাকে খাবার দিয়ে এসেছে। নিয়াজ যখন রেডি হচ্ছিল তখন আরিন্তা গেল আতাউর রহমানকে তাদের বাইরে যাওয়ার কথা জানাতে। আতাউর রহমান খাচ্ছিলেন। সে যখন বলল, ‘বাবা, আপনার ছেলে এই রাত-দুপুরে আবার বাইরে যেতে চাইছে।’
আতাউর রহমান হাসলেন। একসময় এদের সম্পর্ক নিয়ে তার যত দুশ্চিন্তা ছিল। তারপর হঠাৎ-ই সবকিছু পালটে গেল। এখন তাদের একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখে তার আনন্দের অন্ত নেই। আতাউর রহমান হাসিমুখে বললেন,
“নিয়াজ বলেছে আমাকে। যাও মা, সমস্যা নেই।”
“একটু পর তো আপনার ঔষধ আছে।”
“আমি মনে করে খেতে পারব। চিন্তা কোরো না। যাও, ঘুরে এসো। কত আর বাসায় বসে থাকবে? ঘুরে এলে ভালো লাগবে।”
“আপনার আর কিছু লাগবে?”
“না মা। আমি খাওয়া শেষ করে রুমে চলে যাচ্ছি। যাও তুমি।”
নিয়াজ-আরিন্তা একসঙ্গে রেস্ট্রন্টে ডিনার করেছে। একসঙ্গে রাতের শহর ঘুরেছে। আরিন্তা ফেরার নাম নিচ্ছে না বলে নিয়াজও তাড়া দেয়নি। অথচ কাল সকালে তার অফিস আছে। শেষমেষ রাত বাড়ছে দেখে সে বলল,
“ফিরবে না?”
আরিন্তা বলল,
“বাইরে ভালো লাগছে।”
“আসতে তো চাওনি।”
আরিন্তা মুচকি হাসল। তারপর বলল,
“আর একটু থাকি?”
“আচ্ছা থাকো।”
নিয়াজের পকেটে ফোন ভাইব্রেট করে উঠল। তার না, আরিন্তার ফোন। মেয়েটা যতবার বেরোয় হাতে ব্যাগ নেয় না। তার না কি খালি হাতে ঘুরতেই ভালো লাগে। বাড়তি জিনিস বোঝা মনে হয়। ফোনটাও সে হাতে রাখতে চায় না। তাই নিয়াজের কাছে জমা দিয়ে রাখে। পকেট থেকে ফোন বের করে সে আরিন্তাকে দিলো। আরিন্তা ফোন হাতে নিয়ে শুধাল,
“কে?”
“নাম নেই। বাহিরের দেশের নাম্বার।”
স্পষ্ট দৃষ্টিতে নাম্বার চেক করতে গিয়ে কান্ট্রি কোড দেখেই আরিন্তার বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। এত দিন, এত মাস পর হঠাৎ তার কল! সবকিছু ঠিক আছে তো? সে একবার নিয়াজের মুখে চাইল। নিয়াজ মৃদু স্বরে বলল,
“রিসিভ করো।”
আরিন্তা ফোন রিসিভ করে কানে ধরল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। মন বলল ওপাশ থেকে এক্ষুনি সেই কন্ঠটা ডেকে উঠবে, ‘এই পোনি।’
কিন্তু অতি নরম এক কন্ঠস্বর ডাকল,
“আরি?”
আরিন্তা অস্বাভাবিক শ্বাসটাকে সামলে নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
“মিশু ভাই?”
“চিনতে পেরেছিস?”
“না চেনার কথা ছিল?”
“কত কথাই তো ছিল।”
আরিন্তা চুপ রইল। মিশকাত প্রশ্ন করল,
“ডক্টর নিয়াজ কেমন আছেন?”
“ভালো।”
“আর তুই?”
“আমি? আমি তো ভালোই থাকি।”
“সত্যি-সত্যি ভালো থাকিস, মিথ্যা না।”
“থাকব।”
“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবি না?”
“কেন? সে কি আমি জানি না?”
মিশকাত মৃদু শব্দে হাসল। সে হাসির শব্দ যেন আরিন্তার হৃদয়ে শত অপ্রকাশিত অভিযোগের ফলা ছুঁড়ে দিলো। আরিন্তা বলল,
“সব ঠিক আছে ওখানে?”
“কেন? এত মাস পর ফোন করেছি বলে অবাক হয়েছিস?”
“তুমি কি আমার প্রশ্নের সোজা কোনো উত্তর দিবে না মিশু ভাই?”
“আমার এত সাহস আছে না কি? বল কী জানতে চাস।”
“এতদিন পর হঠাৎ ফোন করলে যে?”
“করতাম না বিশ্বাস কর। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ফোন না করার। তোর ফোন নাম্বার সেভ ছিল। কতবার ফোন করব ভেবেও করিনি। আজ কীভাবে যেন ভুল করে ফেলেছি। আজকের পর আর করব না। আমার যা-ই হোক, ভুল করেও তোর জীবনে আমি ব্যাঘাত ঘটাব না।”
“তুমি ভুল করে কল করেছ আমায়?”
“আসলে আজ লতিফের সাথে কীসব ছাইপাশ খেলাম। তারপর থেকেই না কী করব বুঝতে পারছি না। তোর সাথে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছা করছিল।”
আরিন্তা সন্দিহান মুখে শুধাল,
“তুমি কি ড্রিংক করেছ?”
মিশকাত কেমন অপরাধ স্বীকার করা বাচ্চাদের মতো বলল,
“খেতে চাইনি বিশ্বাস কর। লতিফ বলল বুকের যন্ত্রণা কমবে, তাই খেয়েছি। বুকের যন্ত্রণা সহ্য করতে কষ্ট হয় জানিস? মনে হয় দমটা ফুরিয়ে যাবে। আমি জানি তো তুই এসব পছন্দ করিস না। আজ ক্ষমা কর, ঠিক আছে পোনি? আর কোনোদিন খাবো না প্রমিস।”
আরিন্তা ঠোঁট ফুলিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। নাক টেনে বলল,
“তুমি কি আমার অপরাধবোধ কমতে দিবে না মিশু ভাই? কেন আমাকে দিন-দিন আরও অপরাধী করে তুলছ?”
“ধুর পা’গলি! তুই তো আমার নিষ্পাপ চাঁদ। আমার চাঁদকে কোনোদিন এক ফোঁটা দোষ আমি দিয়েছি? ওহ্ হ্যাঁ! তুই না কি জানতে চেয়েছিস এক আকাশে স্থায়ীভাবে বাস করা এক চাঁদ কখনো অন্য আকাশে জায়গা বদল করতে পারে কি না? বাস্তবে হয়তো পারে না। কিন্তু দুঃস্বপ্নে পারে। এসব বাজে ঘটনা দুঃস্বপ্নেই ঘটে। আমার জীবনটা না সেই দুঃস্বপ্নের মধ্যেই আটকে আছে। বাস্তব জীবন তো আমার থেকে হারিয়ে গেছে সেই কবেই।”
আরিন্তার নীরব কান্নার গতি বাড়তেই মিশকাত বলল,
“কাঁদছিস? দেখেছিস, বলেছিলাম না আমি ফোন করলেই তোর জীবনে ব্যাঘাত ঘটবে? কাঁদিস না। আমি আর ফোন করব না। এবার-ই শেষ। অন্যদের মতো আমি বলব না তুই আমাকে ভুলে যা। তোর মতো ঘাড়ত্যাঁড়া মেয়ে তো আমার কথা শুনবে না। শুধু বলছি, ভালো থাকিস। আমার পোনিকে হারাতে দিস না, যত্নে রাখিস।”
আরিন্তা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল,
“আমাকে তুমি ভালো থাকতে বোলো না মিশু ভাই। আমি সব সহ্য করে নিয়েছি, কিন্তু ভালো থাকার মতো শাস্তি আমি সহ্য করতে পারব না। ভালো থাকা আমার কাছে এখন অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার চেয়েও কঠিন।”
“আমি চাই তুই ভালো থাক। তুই খুব ভালো থাক আরি। নিজেকে একদম অবহেলা করবি না। আমি জানি ডক্টর নিয়াজ তোকে ভালো রাখতে চায়। তাকে হতাশ করিস না।”
“আর তুমি? আমি যদি বলি আমিও চাই তুমি ভালো থাকো, তুমি আমার কথা শুনবে?”
“তোকে কেউ দিন-রাত ভালো রাখার চেষ্টা করছে। তার জন্য হোক বা নিজের জন্য, তোর ভালো থাকা উচিত।”
“এমন কেউ যদি তোমার জীবনেও আসে?”
“তুই চাস আসুক?”
“তোমাকে শেষবার এক নজর দেখা ছাড়া এই স্বার্থপর জগতের কাছে আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।”
“চাইতে তোর মানা নেই রে। তুই সবকিছু চাস, শুধু তোর পোল্ট্রির জীবনে দ্বিতীয় কারো দখল ছাড়া। শেষবার আমাদের সাক্ষাৎ অবধি আমি বেঁচে থাকি চাইলে অন্তত ওসব চাস না। কেবলমাত্র ওই মুহুর্তের জন্য আমার নাকের ডগায় শ্বাসটা আটকে আছে।”
আরিন্তা কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
“তবে কেন তুমি আমার ভালো চাও? আমার সংসার জীবনের সুখ চাওয়ার মতো শাস্তি তুমি আমায় কেন দিলে মিশু ভাই? স্বার্থপর আমি তো এক মুহুর্তের জন্য চাইনি তুমি অন্য কারো সাথে সুখী হও। তাহলে তুমি কেন চাইলে?”
“হয়তো আমি তোর মতো করে ভালোবাসতে পারিনি। তাই তোর মতো স্বার্থপরও হতে পারিনি। যে গোলক ধাঁধায় তোর জীবন আটকে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে তোর মৃ’ত্যু আমি কী করে চাইতাম রে? জানিস তো? স্মৃতি হচ্ছে বিষাক্ত সাপ। একবার দংশন করলে সেই বিষ দিন-দিন ছড়িয়ে পড়ে গোটা জীবনটাকে মৃ’ত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। আমি নিজে ম’রে গেলেও তোর এমন দিন দেখতে চাই না।”
“তোমার কি মনে হয়? এভাবে বেঁচে থাকাকে বেঁচে থাকা বলে? তুমি মরে গিয়ে আমাকে তুমি আদৌ বাঁচিয়ে রাখতে পারবে?”
“মরছি না তো। বেঁচেই তো আছি। তুইও বেঁচে থাক। মুখে হাসি নিয়ে বেঁচে থাক। কী-রে? পারবি না?”
“পারছি বলেই তো এখনও পর্যন্ত টিকে আছি।”
“থাক, টিকে থাক। আমি এসে যেন তোর হাসিমুখ দেখতে পাই। মনে থাকবে?”
“তুমি কবে আসবে মিশু ভাই?”
মিশকাত এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বরং মিছে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
“আমার কাজ আছে। শোন, ডক্টর নিয়াজকে আমার তরফ থেকে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দিস। আমার চাঁদকে ভালোবেসে ভালো রাখার জন্য আমি তার কাছে এক জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। রাখছি, ভালো থাকিস কিন্তু।”
“তুমি কি সত্যিই আর ফোন করবে না?”
আরিন্তার শেষ প্রশ্নটা শোনার অপেক্ষাও মিশকাত করল না। কল কে’টে দিলো। আরিন্তা পেছনে ঘুরে নিয়াজকে পেল না। একটু আগেই তো সে এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আরিন্তা এগিয়ে গিয়ে দেখল নিয়াজ গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরিন্তা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে দুহাত বাড়িয়ে দিলো। ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। মুহুর্তেই আরিন্তা তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। নিয়াজ নীরবে তার পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। আরিন্তা শান্ত হলো অনেক সময় পর। নিয়াজ তখন বলল,
“বাসায় চলো।”
আরিন্তা তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
“আপনার কি এখনও জানতে ইচ্ছা করছে না আমি কেন আপনাকে স্বামীর অধিকার দিয়েছি, কেন মেনে নিয়েছি?”
নিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আরিন্তা যখন থেকে তার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই তার দৈনন্দিন জীবনে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। একাকীত্ব আর তাকে কুঁড়ে খায় না। কত ব্যথা এই মেয়েটা তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কখনও সে এই প্রশ্নের উত্তর শোনার সাহস করেনি। আরিন্তা এমন কতবার জিজ্ঞেস করেছে সে কেন জানতে চায় না, কে তার কৌতুহল নেই। কোনোবারই সে এসব সিরিয়াসভাবে নেয়নি। মূলত সে নিতে চায়নি। কারণ সে জানে আরিন্তার উত্তর তার জন্য একদমই সুখকর হবে না। মেয়েটা তার কষ্টের গল্প জানার পর থেকেই নিজে তার কষ্টের কারণ হতে চায় না, তাকে ভালো রাখতে চায়, ভালো রাখার সবরকম চেষ্টাও সে করে। তার জীবনের দুর্ঘটনার শাস্তি সে নিয়াজকে দিতে চায় না। আজকাল আর নিজের দুঃখও সে নিয়াজের সামনে প্রকাশ করে না। নিয়াজ বরাবরই তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করে। তাকে ভালোবাসায় কোনোরকম খাদ সে রাখেনি। এতকিছুর পরও যে মেয়েটা মন থেকে ভালো থাকতে পারে না, তা তার অজানা নয়। মেয়েটা তার সংসার জীবনে সুখ এনে দিয়েছে। কিন্তু সেই সুখের এক অংশও সে নিজের জন্য নেয়নি। নিয়াজের জন্য হলেও আরিন্তা নিজেকে যথেষ্ট গুছিয়ে নিয়েছে। নিয়াজ চায় না পুরোনো ব্যথা তুলে মেয়েটাকে আবার এলোমেলো করে দিতে।
আজও আরিন্তার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে নিয়াজ গাড়ি থেকে টিস্যু বের করে এনে আরিন্তার অশ্রুভেজা চোখ-মুখ মুছে দিলো। আরিন্তা হাল না ছেড়ে পুনরায় বলল,
“আপনার জানতে ইচ্ছা করে না আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি কি না?”
নিয়াজ আরিন্তার গালে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে আদুরে গলায় বলল,
“তুমি আমার জন্য যা করো তা-ই তো আমার কাছে ভালোবাসা। এই যে আমার অগোছালো জীবনটাকে তুমি নিজের হাতে গুছিয়ে দিলে, আমার সমস্ত বাজে স্মৃতির জায়গায় তুমি রোজ কত সুন্দর স্মৃতি সাজিয়ে দিলে, আমার নিত্যদিনের হাসির কারণ হলে; এসব ভালোবাসা ছাড়া আর কী? এরপরও আমি প্রশ্ন কেন করব? আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার কাছে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বিষয় নেই আরিন্তা।”
“আমি মিশু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলায় আপনি কষ্ট পেয়েছেন?”
নিয়াজ মাথা দুলিয়ে বলল,
“নাহ্। তুমি তো কেঁদেকে’টেই আমায় বড়ো কষ্টটা দিচ্ছ।”
“আপনি ভয়ও পাচ্ছেন না?”
“কিসের ভয়?”
“আমাকে হারানোর।”
নিয়াজ খানিক থমকাল। পরক্ষণেই আরিন্তার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
“কোথায় হারাবে? আমি জানি তুমি আমার। তুমি আমায় ছাড়বে না। তোমাকে কেড়ে নেওয়ার মতো দুঃসাহস-ও আমি কাউকে দিবো না। রাত বাড়ছে, বাসায় চলো।”
পথেই আরিন্তা সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়িতে পৌঁছে গাড়ি পার্কিং করেও মেয়েটার ঘুম ভাঙতে ইচ্ছা করল না নিয়াজের। সিটবেল্ট খুলে সে মেয়েটার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থেকে তার বুকের ভেতর কেমন কেঁপে-কেঁপে উঠল। আরিন্তাকে আলতো করে সে বুকে আগলে নিল। কপালে, গালে একের পর এক ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে সে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তার ব্যাকুল মন বারংবার আহাজারি করছে,
“সৃষ্টিকর্তা যেন আমায় এমন কোনো দিন না দেখায় যেদিন তোমাকে হারিয়ে আবারও আমায় অসহায় হতে হবে। এরপর আর আমি এমন একাকীত্ব মেনে নিতে পারব না। তুমি আমার ধৈর্যের শেষ সীমা।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।