বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-১৭+১৮

0
341

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৭.
ছেলের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলতে গিয়ে আয়েশা খাতুনের মনে কেমন খটকা লাগল। ছেলে মুখে ভালো আছি, সুস্থ আছি বললেও মায়ের মন টের পেল ছেলে ভালো নেই। কিছু একটা সমস্যা আছে। সুস্থ থাকলে, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করলে এই অসময়ে ছেলের মুখটা অমন ছন্নছাড়া দেখাবে কেন? অন্যসময় তো বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় সে বেশ হাসিখুশি মনে কথা বলে। আয়েশা খাতুন চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলেন,
“তোর শরীর কি সত্যিই ঠিক আছে বাবা? মুখটা অমন লাগছে কেন?”
মিশকাত বলল,
“বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছি আজ, সেজন্যই হয়তো। আমি ঠিক আছি মা, চিন্তা কোরো না।”

আয়েশা খাতুনের তবু মনে হলো ছেলে তার মন খারাপ হবে ভেবে স্বীকার করছে না। মিশকাত কিছু সময় চুপ থেকে প্রশ্ন করল,
“খালার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে কবে মা?”
“গতকাল সকালেও তো ফোন করেছিল।”
“আরির সাথে কথা হয়?”
“ও তো বাড়িতেই চলে আসে, ফোনে আর কী কথা বলব? ফোনে কথা হয় সুবর্ণার সাথে।”
“ওই বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে না কি?”

আয়েশা খাতুন কপাল কুঁচকে বললেন,
“কিসের সমস্যা?”
“মনে তো হচ্ছে কোনো সমস্যা হয়েছে।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“কেউই তো ফোন রিসিভ করছে না।”
“কেউ না?”
“না।”
“সবাইকে ফোন করেছিলি?”
“পেলবের সাথে গতকাল কথা হয়েছিল। ও বলল আরির ফোনে সমস্যা হয়েছে। আজ খালাকে ফোন করলাম, রিসিভ করল না। তারপর পেলব আর খালুকেও ফোন করেছিলাম। সবার ফোনেই রিং হয়, কিন্তু কেউ রিসিভ করে না।”

আয়েশা খাতুন অবাক হয়ে বললেন,
“কী বলিস? হঠাৎ করে এমন করবে কেন? এখন আবার ফোন করে দেখ তো।”
“তোমার সাথে কথা বলার আগেও ফোন করেছিলাম। সবাইকেই ফোন করছি, কারোরই রিসিভ করার নাম নেই। খালার ফোন তো এখন বন্ধই বলছে।”
আয়েশা খাতুনের কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। চিন্তিত মুখে সুবর্ণাকে ডেকে বলল,
“হ্যাঁ-রে, আরি আজ তোর পার্লারে যায়নি?”
ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে আরিন্তা রোজ সুবর্ণার পার্লারে যায়। কিছু সময় সুবর্ণার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বা তাকে সাহায্য করে চলে যায়। মায়ের প্রশ্ন শুনে সুবর্ণা উত্তর দিলো,
“না তো। আজ মনে হয় আপু ভার্সিটি যায়নি। গেলে তো পার্লারে যেত।”

আয়েশা খাতুন মিশকাতকে বললেন,
“আরি না কি আজ ভার্সিটিতে-ও যায়নি। সত্যি-সত্যি কোনো সমস্যা হলো না কি আবার?”
“তুমি একটু পেলব আর খালুকে ফোন করে দেখো তো। তোমার ফোন যদি রিসিভ করে।”
“তোর ফোন রিসিভ করবে না কেন তাহলে? আজব ব্যাপার!”
“দেখো তুমি ফোন করে। এখনই ফোন করতে বলো সুবর্ণাকে।”

আয়েশা খাতুন আবার সুবর্ণাকে ডেকে বললেন,
“সুবর্ণা, তোর খালুকে একটা ফোন কর তো।”
মায়ের কথায় সুবর্ণা ফোন করল। প্রথমে পুলক তালুকদার, তারপর পেলব, দুজনকেই ফোন করল। কিন্তু কেউই রিসিভ করল না। পরপর কয়েকবার ফোন করার পরও তাদের পাওয়া গেল না। সুবর্ণা বলল,
“কেউই তো ধরছে না মা।”
আয়েশা খাতুন বললেন,
“কী হলো তাদের?”
মিশকাত বলল,
“মা, একটু খোঁজ নিয়ে দেখো ওই বাড়িতে। তুমি না যেতে পারলে সুবর্ণাকে পাঠাও।”
“আচ্ছা দেখছি।”
“আমাকে জানিয়ো। চিন্তা লাগছে।”
“চিন্তা করিস না। জানাব।”
“রাখছি তাহলে।”
“আচ্ছা রাখ। আমি দেখি সুবর্ণাকে পাঠিয়ে।”

সেদিন আর সুবর্ণা যেতে পারল না। তার পার্লারে জরুরি কাস্টমার ছিল, তাই। গেল তার পরদিন। সকালে পার্লার খুলল না। নাশতা করে একাই চলে গেল খালার বাড়ি।

তখন সকাল দশটা। পুলক তালুকদার খেয়ে-দেয়ে বাইরে চলে গেছেন। পেলব এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। আরিন্তা নিজের রুমে। বাড়িতে ঢুকে দেখা হলো শুধু খালার সাথে। তিনি থালা-বাসন ধুচ্ছিলেন। সুবর্ণাকে দেখে তিনি তেমন অবাক হননি। ওই বাড়ি থেকে কারোর আগমন আগে থেকেই টের পেয়েছিলেন। কারণ হুট করে তাদের অদ্ভুত আচরণের কারণ খুঁজতে কেউ আসবেই। কিন্তু অন্যান্য সময়ের মতো আজ আর মেরিনা তেমন খুশিও হতে পারলেন না। সুবর্ণা যখন বিভিন্ন প্রশ্ন করবে, তখন তিনি কী উত্তর দিবেন তা-ই ভেবে পাচ্ছেন না। ভাবতে-ভাবতেই সুবর্ণা প্রশ্ন করে বসল,
“খালা, তোমরা কেউ ফোন রিসিভ করছো না কেন আমাদের? ভাইয়া আর আমি সবাইকে এত ফোন করলাম, কেউ যে রিসিভ করলে না?”
মেরিনা বলল,
“আমার ফোন পেলবের কাছে।”
“কেন?”
“ওর দরকার দেখে নিয়েছে।”
“তাহলে ভাইয়া আর খালু ফোন ধরছে না কেন?”
“হয়তো ব্যস্ত ছিল।”
“কী বলো? এত ব্যস্ততাই কি থাকে যে আমার আর ভাইয়ার শখানেক ফোনের একটা ধরার সময় নেই? এমন তো জীবনেও হয়নি।”
“জানি না। জিজ্ঞেস করিস তাদেরকেই।”
“আপু ঘুম থেকে উঠেছে?”

মেরিনা মনে-মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়ে তার ঘুম ভুলে গেছে, খাওয়া ভুলে গেছে, তা তিনি মুখের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছেন। তবু তার কিছু করার নেই। মেরিনা বললেন,
“উঠেছে হয়তো। খেতে আসেনি এখনও। তুই গিয়ে ডেকে আন তো।”
“আচ্ছা।”
সুবর্ণা হাঁটা ধরে আবার থামল। বলল,
“খালা, আপু কি দুদিন ধরে ভার্সিটি যাচ্ছে না?”
“গতকাল যায়নি। আজ বন্ধ মনে হয়।”
“আজ কিসের বন্ধ?”
“জানি না। তুই আরিকে ডাক, তারপর দুজন নাশতা কর।”
“আমি খেয়ে এসেছি।”
মেরিনা হঠাৎ বলে উঠলেন,
“তোর ফোনটা একটু দিয়ে যা তো। তোর খালুকে ফোন করতে হবে।”

সুবর্ণা খালুর নাম্বারে ডায়াল করে ফোনটা খালাকে দিয়ে চলে গেল আরিন্তার কাছে। আরিন্তার ঘরের দরজা বন্ধ। দুই-তিনবারের ডাকে আরিন্তার সাড়া না পেয়ে সুবর্ণা এলোপাথাড়ি দরজা ধাক্কানো শুরু করল। আরিন্তা দরজা খোলার পর সুবর্ণা হঠাৎ তাকে দেখে অবাক হলো। খালা বলল আপু ভালো আছে, অথচ তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ অসুস্থ। চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। মুখটা শুকনা লাগছে। চুলগুলো অগোছালো। সর্বোপরি সে নিজেই অগোছালো। সুবর্ণাকে দেখেও আরিন্তা প্রথমে চুপচাপ বিছানায় চলে গেল। সুবর্ণা কাছে গিয়ে চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আপু, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি অসুস্থ?”
আরিন্তা ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে ভাঙা গলায় বলল,
“আমি অনেক ভালো আছি।”
“তাহলে কী হয়েছে তোমার?”
আরিন্তা পালটা প্রশ্ন করল,
“তুই কখন এলি?”
“একটু আগে। গতকাল থেকে তোমরা কেউ রিসিভ করছো না। তাই মা চিন্তায় পড়ে গেছে। আমাকে পাঠিয়েছে খবর নিতে। কী হয়েছে গো আপু? খালা বলছে সে জানে না খালু আর পেলব ভাইয়া ফোন ধরছে না কেন। আমি নিশ্চিত কিছু একটা হয়েছে। নইলে আমি গতকাল থেকে ফোন করছি, ভাইয়া ফোন করছে তারও আগে থেকে, কারোর ফোনই রিসিভ করবে না কেন?”

আরিন্তা হঠাৎ কী ভেবে এক লাফে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর ছুটে এসে সুবর্ণার হাত চেপে ধরে বলল,
“তোর ফোনটা দে তাড়াতাড়ি।”
আরিন্তার এমন অদ্ভুত আচরণে সুবর্ণা অবাক হয়ে বলল,
“কেন?”
“দরকার খুব। দে।”
“আমার ফোন তো খালার কাছে।”
“মা রেখে দিয়েছে?”
“খালুর সঙ্গে কথা বলবে, তাই চেয়ে রেখেছে।”
আরিন্তা রাগে বিছানায় মুষ্ঠাঘাত করল। সুবর্ণা বোকা চোখে আরিন্তাকে পরখ করে বলল,
“আপু, তুমি এমন করছো কেন? কী হয়েছে বলবে আমাকে? তোমাদের কাজকীর্তি কিছু মাথায় ঢুকছে না আমার।”
“আগে আমাকে ফোন এনে দে। কাউকে বুঝতে দিবি না, যা।”

কথাটা বলেই আরিন্তা উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিলো। সুবর্ণা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আরিন্তাকে সে দুবার ডাকল। কিন্তু আরিন্তা সাড়া দিলো না। সুবর্ণার মনে পড়ল খালা তাকে বলেছে আরিন্তাকে খেতে ডাকতে। সেটাই সে ভুলে গেছে। সুবর্ণা বলল,
“আপু, খালা তোমাকে খেতে ডাকছে। খাবে না?”
আরিন্তা মিনমিনে গলায় বলল,
“গিয়ে বল আমার ক্ষুধা নেই। আমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই কারো।”
“ধুর…কিছু বুঝতে পারছি না।”
বিড়বিড় করে কথাটা বলে সুবর্ণা আবার নিচে চলে গেল। মেরিনা তাকে জিজ্ঞেস করল,
“আরিকে খেতে ডাকিসনি?”
“আপু বলেছে তার ক্ষুধা নেই।”
মেরিনা চিন্তিত মুখে বলল,
“ক্ষুধা তো আছেই। না খেয়ে কতদিন থাকতে পারবে ও-ই জানে।”
“আপুর কী হয়েছে খালা? মুখ দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ, কথাবার্তাও অন্যরকম লাগছে। কোনো সমস্যা হয়েছে?”

ডাইনিংয়ে বসে পেলব নাশতা করছিল। মায়ের উত্তরের আগেই সে সুবর্ণাকে ডাকল,
“সুবর্ণা, এদিকে শোন।”
সুবর্ণা এগিয়ে এসে পেলবের মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল,
“বলো।”
“তুই কি এখান থেকে পার্লারে যাবি?”
“হ্যাঁ।”
“কখন?”‌
“এখনই।”
“আজ যাওয়ার দরকার নেই। থাক আজ।”
“না ভাইয়া। পার্লারে কাস্টমার এসে ফেরত যাবে।”
“একদিনে কিছু হবে না। থাক, কাজ আছে।”
“কী কাজ?”
“আরিন্তাকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।”

আচমকা সুবর্ণা আরও এক ধাক্কা খেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে? কই? আমরা কেউ শুনলাম না তো কিছু।”
“এখন তো শুনেছিস।”
“মা-ও তো জানে না।”
“শুধু খালা না, কেউই জানে না এখনও। তারা আসুক, তারপর সবাইকে জানাব। আমিই মাকে বারণ করেছি আগে থেকে সবাইকে জানাতে।”

সুবর্ণা খালার মুখের দিকে তাকাল। সে চুপচাপ নিজের কাজ করছে। কেন জানি সুবর্ণার মনে হলো কিছু একটা গণ্ডগোল আছে এখানে। কোনোকিছু ঠিক নেই। সবার মনে কিছু একটা চলছে। কিন্তু সেটা কী, তা-ই বুঝে উঠতে পারছে না সে। সুবর্ণা সেই বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া, তুমি আর খালু গতকাল থেকে আমাদের ফোন রিসিভ করছিলে না কেন?”
পেলব একটু থমকাল। সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। বলল,
“আজকের ব্যাপারটা মিটে যাক, আমি ফোন করব নে খালাকে।”
“মাকে ফোন করার সাথে আজকের ব্যাপার মিটে যাওয়ার কী সম্পর্ক? আমি কিছু বুঝতে পারছি না তোমাদের কথা। তোমাদের কী হয়েছে আমাকে একটু বলবে প্লিজ। আরি আপুকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে না কি?”
“সমস্যা একটা হয়েছে। কিন্তু এখন ওসব নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। বাড়ি ফেরার আগে জানতে পারবি, সমস্যা নেই। এখন এসব বাদ দে। আপাতত মা আর আরিকেও কিছু জিজ্ঞেস করিস না। আর আরি ফোন চাইলে ভুলেও দিবি না। পাত্রপক্ষ আসুক, ওসব ঝামেলা মিটে গেলে আমি নিজেই তোকে বলব। ঠিক আছে?”
সুবর্ণা বিশৃঙ্খল মস্তিষ্কে সহসা মাথা নেড়ে বলল,
“আচ্ছা।”

পুলক তালুকদার ব্যাগ ভর্তি বাজার এনেছেন। কাজের মেয়েকে নিয়ে সেসব গোছাতে ব্যস্ত মেরিনা। সুবর্ণা বিশৃঙ্খল মস্তিষ্কে থম মে’রে বসে আছে। আরিন্তার কাছেও যাচ্ছে না। কী করবে কিছু মাথায় আসছে না তার। পেলব বাজারে গিয়েছিল। ফিরে এসে সুবর্ণার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আরিকে দিয়ে আয়।”
“কী এটা?”
“শাড়ি।”
“তুমি কিনেছ?”
“হ্যাঁ, আজ এটা পরিয়ে দিস।”
সুবর্ণা মাথা নেড়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই পেলব ডাকল,
“শোন।”
সুবর্ণা পেছন ফিরে তাকালে বলল,
“ফোনটা রেখে যা। আরির হাতে ফোন দিস না।”

সুবর্ণা মনে-মনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা পেলবের হাতে দিয়ে দিলো। সে এখন নিশ্চিত আরিন্তা কিছু একটা অঘটন ঘটিয়েছে, যে কারণে সবাই তার সঙ্গে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে। হুট করে পাত্রপক্ষ আসার কারণও এটাই হবে। সে গিয়ে শাড়ির ব্যাগটা আরিন্তাকে দিয়ে বলল,
“নাও, এটা তোমার জন্য এনেছে ভাইয়া।”
আরিন্তা ব্যাগ ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,
“শাড়ি দিয়ে কী করব আমি?”
“আজ এটা পরে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে বলেছে।”
সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তা শাড়িসহ ব্যাগটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো। রাগে গজগজ করতে-করতে বলল,
“তোর ভাইয়াকেই বলিস এটা পরে সামনে যেতে। ওদের কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই আমার।”
সুবর্ণা চমকে উঠল। মেঝে থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল,
“এমন করছো কেন আপু? কী সমস্যা তোমার?”
“আমার কোনো সমস্যা নেই। সব সমস্যা তোর খালা-খালু আর ভাইয়ের।”
“কী করেছে তারা?”
“আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করিস না তো সুবর্ণা। ভালো লাগছে না আমার। তোর ফোন এনেছিস?”
সুবর্ণা চুপসানো মুখে বলল,
“ফোন ভাইয়ার কাছে।”
“ও, তোর ফোনও আটকেছে শয়তানটা?”
সুবর্ণা চুপ রইল। আরিন্তা বলল,
“এটা নিয়ে যারটা তাকে ফেরত দে। আর আমাকে একটু একা থাকতে দে।”

সুবর্ণা গিয়ে শাড়ির ব্যাগ পেলবকে ফেরত দিলে পেলব মেরিনাকে বলল,
“তোমার মেয়ে যেন মেহমান আসার পর কোনো পাগলামি না করে মা। ভালোভাবে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ো তা।”
মেরিনা উত্তর দিলো,
“নিজেরা তো বুঝাতে পারছিস না। আমাকে ঠেলছিস কেন? আমার সব কথা শুনে বসে আছে ও? শুনলে তো নাওয়া-খাওয়া ছাড়ত না।”
“জোর করে কিছু খাইয়ে দাও গিয়ে। এখন তুমি ছাড়া আর কে বুঝাবে ওকে? সাপের পাঁচ পা দেখেছে। বাপ-ভাইয়ের কথা এখন আর মাথায় ঢোকে না।”

পাত্রপক্ষ এসে পৌঁছাল বিকাল সাড়ে চারটায়। ডক্টর নিয়াজ, তার বাবা, খালা, খালু আর ফুপা এসেছেন। নিজেদের গাড়ি নিয়েই এসেছেন তারা। সঙ্গে এনেছেন দুহাত ভর্তি খাবার-দাবার। পেলব এবং তার বাবা-চাচা মিলে মেহমানদের অতি খাতির যত্ন করতে লেগে পড়েছে। মেরিনা ব্যস্ত মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা নিয়ে। সুবর্ণা খালাকে হাতে-হাতে সাহায্য করছে। মেহমান এসেছে শুনেই সুবর্ণার মন উচাটন হয়ে উঠেছে পাত্র দেখার জন্য। পেলবের হাতে খাবার এগিয়ে দেওয়ার সুযোগ বুঝে তার পাত্র দেখাও হয়ে গেল। কিন্তু পাত্র দেখতে গিয়ে ডক্টর নিয়াজকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে সে খালার কাছে ছুটে গেল। চোখ বড়ো করে বলল,
“খালা, এই ছেলেকে তো চেনা-চেনা লাগছে। উনি না বাবার চিকিৎসা করেছিল?”
“হ্যাঁ।”
“সত্যি? ওনারা এখানে কীভাবে?”
“আরিন্তাকে পছন্দ করেছে ছেলে নিজেই।”
“আপু যখন হসপিটালে গিয়েছিল, তখন?”
“হুম।”
“কী আশ্চর্য! এতকিছু হয়ে গেল, কিছুই জানতে পারলাম না।”

পেলব সুবর্ণাকে বলল আরিন্তাকে রেডি করতে। কিছুক্ষণ পর তাকে সামনে আনা হবে। সুবর্ণা সঙ্গে-সঙ্গে চলে গেল। পেলব মেরিনাকে বলল,
“মা, তুমিও যাও।”
“আমার হাতে কাজ আছে, দেখছিস না?”
“এটুকু হালিমাকে করতে দাও। সুবর্ণার কথা যদি না শোনে? তুমি গিয়ে দেখো।”

আরিন্তা সত্যিই সুবর্ণার কথা শোনেনি। সুবর্ণা তাকে রেডি হওয়ার কথা বলাতে যাওয়ায় সে উলটা সুবর্ণার উপরেই চটে গেছে। মেয়েটার সঙ্গে ধমকা-ধমকি করেছে। মেরিনা গিয়ে এই অবস্থা দেখে মেয়ের কাছে গিয়ে বসলেন। বুঝিয়ে বললেন,
“এই মুহূর্তে কোনো ঝামেলা করিস না আরি। ওনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন। আমাদের মান-সম্মানের কথা ভাব একটু।”
আরিন্তা বলল,
“তোমরা একবারও আমার কথা ভেবেছ? নিজেদের মান-সম্মানের অনেক ভয় তোমাদের। মান-সম্মান নষ্ট করার মতো কাজ কি আমি সত্যিই করেছি?”
মেরিনা থমথমে মুখে বললেন,
“যা করেছিস তা-ই তোর বাপ-ভাইয়ের কাছে মান-সম্মানের ব্যাপার।”
“মান-সম্মান না, বলো অহংকারের ব্যাপার। আমাকে বড়োলোক পরিবারে বিয়ে দিয়ে এলাকাবাসীকে নিজেদের উঁচু জায়গাটা দেখাতে হবে না? মিশকাত খাঁনের তো আর ডক্টর নিয়াজের মতো গাড়ি, বাড়ি নেই। মাসে-মাসে পকেট ভর্তি ইনকাম নেই। তার কাছে মেয়ে দিলে কি আর এলাকাবাসীর কাছে অহংকার করতে পারবে?”

সুবর্ণা হা করে আরিন্তার কথা শুনল। আরিন্তার কথা শেষ হতেই সন্দিহান মুখে বলল,
“ভাইয়ার কথা বলছো কেন? ভাইয়ার সাথে এর কী সম্পর্ক? খালা, ভাইয়া কী করেছে?”
মেরিনা বললেন,
“ওসব পরে শুনিস। এখন ওকে রেডি কর।”
আরিন্তা জেদ ধরে বলল,
“আমাকে জোর করো না মা।”
“ওনারা তোর অপেক্ষায় বসে আছে। দয়া করে মানুষের সামনে এমন করিস না। সামনে যাবি, ওনারা কিছু প্রশ্ন করলে উত্তর দিবি। দেখলেই তো আর সঙ্গে-সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় না। বিয়ে কি এত সোজা? পছন্দ, অপছন্দের ব্যাপার আছে, কথাবার্তা মেলার ব্যাপার আছে। আমার কথাটা শোন মা। এতদূর থেকে মানুষ এসে বাড়িতে ঝামেলা দেখলে অনেক খারাপ ভাববে। ওঠ।”

অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুজিয়ে মেয়েকে রেডি করতে লেগে পড়েছেন মেরিনা নিজেই। আরিন্তা শাড়ি পরবে না। মেরিনা জোর করলেন না। নিজের পছন্দের একটা থ্রি-পিস পরালেন। আরিন্তা সাজগোজ করতে নারাজ। তাতেও মেরিনা জোর করলেন না। কোনোরকমে চুল বেঁধে মুখে একটু ক্রিম মেখেই ছেড়ে দিলেন। পুরোটা সময় সুবর্ণা চিন্তিত মুখে বসে ছিল। তার মাথায় নানান প্রশ্নের জটলা। আরিন্তার অঘটনের সঙ্গে যে তার ভাইয়েরও কোনো যোগসূত্র আছে, তা সে বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু ঘটনাটা কী, তা না জানা অবধি সে শান্তি পাচ্ছে না। আরিন্তার ম্লান, কালো মুখের দিকে তাকিয়ে মেরিনার বুকের ভেতরটা হুঁ-হুঁ করে কাঁদছে। প্রতিদিন যে মেয়েটার জন্য তিনি কিছু না কিছু খাবার প্রস্তুত রাখতেন, কিছুক্ষণ পরপর মেয়ের খাওয়ার অভ্যাস বলে। তার সেই মেয়েটা দুদিন ধরে পেটপুরে খাচ্ছে না। একা ঘরে দিন-রাত কেঁদে-কেঁদে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেলেছে। মেরিনার খুব ইচ্ছা করছে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে বুকে আগলে নিতে। কিন্তু তার যে দাঁড়ানোর জায়গাটাই নেই।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৮.
আরিন্তা ভেবেই নিয়েছিল তাকে অনেক প্রশ্ন করা হবে। সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই। ডক্টর নিয়াজের পরিবারের মানুষ যথেষ্ট ভালো মানসিকতার। তারা জানেন একজন শিক্ষিত, বুঝদার মেয়েকে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার দরকার পড়ে না। সাধারণভাবেই তারা আরিন্তাকে দু-একটা প্রশ্ন করলেন। মেয়ে সম্পর্কে তারা পরিবারের থেকে আগেই জেনেছেন। তাই বেশকিছু জানার আর প্রয়োজন বোধ করলেন না। তার চেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম দেখাতেই আরিন্তাকে সবার পছন্দ হয়েছে। বুঝতে পেরেছেন খনিকের পরিচয়ে আরিন্তার মিষ্টি মুখটা কেন তাদের ছেলের মনে ধরেছে। নিয়াজের বাবা আতাউর রহমান জানালেন ছেলে-মেয়ে চাইলে আলাদা করে কথা বলতে পারে। বিয়ের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে তাদের একে-অপরের নিজস্ব কথা থাকতেই পারে। সঙ্গে-সঙ্গে পেলব বলে দিলো,
“আমার বোনের ব্যাপারে তো অনেক কথাই হয়েছে ভাইয়ার সাথে। ভাইয়া কেমন মানুষ তা-ও শুনেছে ও। ওর আর বলার কিছু নেই। এখন ভাইয়ার কিছু জানার থাকলে তা ভিন্ন ব্যাপার।”

নিয়াজ একটু অস্বস্তি বোধ করল। আরিন্তার কিছু জানার নেই, সে আর নতুন করে কী জানবে? যেটুকু জেনেছে, সেটুকুই যথেষ্ট। বিয়ের পর দুজন দুজনকে এমনিতেই জেনে যাবে। তাই সে-ও জানাল তার কিছু জানার নেই। এই পর্যন্ত আরিন্তা বুকে পাথর চেপে চুপচাপ মাথা নত করে বসে ছিল। কিন্তু এরপর যখন নিয়াজের বাবা সরাসরি বলল মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। সবার সম্মতি থাকলে তিনি হবু পুত্রবধূকে আংটি পরিয়ে দিতে চান। ঠিক তখনই আরিন্তার ধ্যান ভাঙল। মুখ তুলে তাকাল পাশে দাঁড়ানো ভাইয়ের দিকে। দৃষ্টিতে তীব্র নারাজ। কিন্তু মেহমানদের সামনে মুখে কিছু বলতে পারল না। পেলব চোখের ইশারায় চুপ থাকার নির্দেশ দিলো। আরিন্তার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করল। পেলব আরিন্তার হাত এগিয়ে ধরল। আতাউর রহমান অতি আনন্দের সাথে আরিন্তার আঙুলে আংটি পরালেন। টেরই পেলেন না একটা আংটি মেয়েটাকে কীভাবে ভেঙেচুরে দিচ্ছে। আংটি পরানোর পর সবাই হাসিমুখে মিষ্টি খেয়ে মিষ্টি মুখ করছে। বিয়ের পাকা কথা বলতে হবে তাদের। মেরিনা মেয়েকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। পেছন-পেছন গেল সুবর্ণা। মা-বাবার রুমে গিয়েই আরিন্তা ধপ করে মেঝেতে বসে হুঁ-হুঁ করে কেঁদে ফেলল। সুবর্ণা দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো, যাতে কান্নার শব্দ বাইরে না যায়। মেরিনা গিয়ে মেয়েকে তোলার চেষ্টা করলেন। আরিন্তা মায়ের হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে রাগত স্বরে বলল,
“তুমি বলেছিলে না দেখলেই বিয়ে হয়ে যায় না? এখন এটা কী হলো মা?”
মেরিনা অন্ধকার মুখে বললেন,
“আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে তোর বাপ-ভাই?”
“নাটক শুরু করেছে ওরা আমার সাথে? নিজেদের মতো যা ইচ্ছা, তা-ই করছে। আমি কি রোবট, ওরা যা বলবে তা-ই মেনে নেব?”

সুবর্ণা বলল,
“ঠিকই তো। খালু আর ভাইয়া আপুর মতামত না নিয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।”
আরিন্তা বলল,
“মতামতের গুরুত্ব দিলে কি বিয়ে দিতে চাইত? জানেই তো আমি বিয়ে করব না। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিবে, এটাই তো তাদের আসল উদ্দেশ্য।”
মেরিনা বললেন,
“এতকিছুর পরেও তোর মতামত চাইবে, এটা ভাবিস কীভাবে তুই? তোর কারণেই তোর বিরুদ্ধে গিয়েছে তারা।”
আরিন্তা ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“হ্যাঁ, আমি তো পাপ করেছি, মহাপাপ। সেই পাপে আমার পরিবার অশুদ্ধ হয়ে গেছে। এখন বিশুদ্ধ হবার জন্য মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে। কী সাধু পরিবার!”
সুবর্ণা অসহায় মুখে বলল,
“আমাকে কি এবার বলবে ভাইয়ার সাথে কী হয়েছে? আমার মাথা ঘুরছে সারাদিন ধরে।”

নিয়াজের পরিবার চেয়েছিল আজই ঘরোয়াভাবে আকদ সম্পন্ন করে রাখতে। অনুষ্ঠান হবে পরের সপ্তাহে। কিন্তু পুলক তালুকদার এতটাও তাড়াহুড়া করতে চাননি। অনুষ্ঠানের মাত্র এক সপ্তাহ আগে হুট করে আকদ করানোর চেয়ে, এক সপ্তাহ পর একসঙ্গে সবটা করাই ভালো। আলোচনা সাপেক্ষে এক সপ্তাহ পরেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। পুলক তালুকদার চেয়েছিলেন মেহমান আজকের রাতটা থেকে যাক। কিন্তু নিয়াজ রাজি হলো না। সবারই কর্মব্যস্ততা আছে। তাই তারা সন্ধ্যার পরপরই বিদায় নিল।

মেহমান বিদায় নেওয়ার পরই আরিন্তা মা-বাবার ঘর থেকে বেরুল। তারপরই শুরু হলো তার চেঁচামেচি। পেলব তাকে বুঝাতে এলে প্রচণ্ড রাগে সে আঙুল থেকে আংটি খুলে ফেলে দিলো। পেলবের রাগ নিয়ন্ত্রণহারা হলো তখনই। আরিন্তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে সে রাগত স্বরে বলল,
“অনেক সহ্য করছি তোর আজাইরা রাগ। সময় থাকতে থাম বলছি।”
আরিন্তা মুখের ওপর বলল,
“না থামলে কী করবে তুমি? আমার মুখ ছুটাচ্ছ কেন তোমরা? নিজেদের আজাইরা কাজ থামাতে পারো না আগে?”
“অধঃপতন থেকে বাঁচাতে চাইছি, তা ভালো লাগছে না তোর?”
“আমি অধঃপতনে গেলে তোমাদের কী ক্ষতি? তোমাদের কোনো ক্ষতি তো করছি না। আমার জীবন নিয়ে আমার চেয়ে বেশি তোমাদের মাথাব্যথা?”
“নিজের ভালো নিজে বুঝিস না, আবার মুখের ওপর তর্ক করছিস তুই?”
“আমার ভালো আমি খুব ভালোভাবেই বুঝি। তোমাদের অন্তত আমার ভালো বুঝতে হবে না। ভালো করার নামে তোমরা আমাকে নরকে ছুড়ে ফেলতে চাইছো, বুঝতে পারছো না তা? তোমরা আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিবে, আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সংসার করব কীভাবে? আমার আর মিশু ভাইয়ের জীবন তো তোমরা কুরবানি করছই, সঙ্গে আরেকজন লোকের জীবনও নষ্ট করার চেষ্টা করছো।”
“তার জীবন নষ্ট হতে যাবে কেন? ওই লোক নিজে তোকে পছন্দ করেছে। নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করছে।”
“করছে, কারণ লোকটা আমার মনের খবর জানে না। তোমরা জানতে দাওনি। ওই লোকটার সঙ্গেও তোমরা প্রতারণা করছো। তোমাদের কি মনে হয় লোকটা সব জানার পর তোমাদের মাফ করে দিবে? জেনেবুঝে এত বড়ো ভুল কোরো না ভাইয়া। আমি এই বিয়ে করতে পারব না, ম’রে গেলেও না। মিশু ভাইকে আমি কথা দিয়েছি।”
“আর আমরা যে ওই লোকগুলোকে কথা দিয়েছি, সেই বেলায়? বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে, কানে শুনতে পাচ্ছিস না? মান-সম্মান যেটুকু আছে, তা-ও ধুলায় মিশাবি?”
“ও… মিশকাত খাঁন তোমাদের মান-সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিবে, আর ডক্টর নিয়াজ মান-সম্মান আরও বাড়িয়ে দিবে, না? তোমাদের মানসিকতা বুঝতে পারলে তোমাদের মুখে থুথু ফেলবে ওই লোক, মিলিয়ে নিয়ো।”

পেলব রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে বলল,
“মুখ সামলা আরি, এখনও ভালোভাবে বলছি।”
“তোমরা আগে তোমাদের মানসিকতা সামলাও। সময় থাকতে এসব বন্ধ করো। আমি বারবার বলছি আমি বিয়ে করব না। তারপরও যদি জোর করো, তাহলে নিজেদের মান-সম্মানের মায়া-ও ত্যাগ করো।”

মেরিনা ধমকে উঠে বললেন,
“আরি, মুখ বন্ধ কর। তোর বাবা শুনলে মে’রে ফেলবে।”
আরিন্তা ভেজা কন্ঠে বলল,
“এমনিতেই মে’রে ফেলার ব্যবস্থা করছে মা। ভয় পেয়ে আর কী হবে?”

পেলব মেঝে থেকে আংটি কুড়িয়ে মায়ের হাতে দিয়ে বলল,
“এসব পাগলামি বন্ধ করতে বলো। এসব করে যদি ও ভেবে থাকে মিশুর সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবে, তাহলে সেটা দুঃস্বপ্ন। পরে বিয়ে করলেও ওকে অন্য ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। তার চেয়ে ডক্টর নিয়াজ হাজার গুণ ভালো।”

আরিন্তা কান্নাভেজা গলায় চেঁচিয়ে উঠল,
“আমি বিয়ে করব না। শুনেও কেন শুনছো না তোমরা? যে হাতে বড়ো করেছো, সেই হাতেই আমায় ম’রার আগে মে’রে ফেলো না।”
পেলবের কানে সব কথাই পৌঁছাল, তবু সে ফিরে তাকাল না। আরিন্তা মেঝেতে বসে অসহায়ের মতো কাঁদছে আর আহাজারি করছে। মেরিনা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলে সোফায় বসালেন। আরিন্তা মায়ের বুকে পড়ে হেঁচকি তুলে বারবার আওড়াল,
“মা, আমায় বাঁচাও মা। এভাবে মে’রে ফেলো না। আমি ভালো থাকতে পারব না। বাবাকে একটু বুঝাও মা, তোমার পায়ে পড়ি।”

সুবর্ণা এখনও কোনোকিছুই স্পষ্টভাবে শুনতে পারেনি। কিন্তু এতক্ষণে তার আর বুঝতে বাকি নেই, আরিন্তার এই পাগলামি তার ভাইয়ের জন্য। তাদের মাঝে দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সুবর্ণা আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সে ভাবছে এখন তার কী করা উচিত। আরিন্তা আর তার ভাইয়ের সম্পর্কের কথা জানা তো দূর, কখনো আঁচ-ও করতে পারেনি তারা। কিন্তু আরিন্তার পাগলামি দেখে সে টের পাচ্ছে তাদের সম্পর্কটা ঠুনকো নয়। এ কারণেই আরিন্তার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তার ভাই এত চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তার ভাই এখনও এসব ব্যাপার জানে না। জানার পর কি সে-ও আরিন্তার মতোই পাগলামি করবে? তার কি এখন ভাইকে এই খবরটা জানানো উচিত? কিন্তু ফোনটা তো এখনও পেলবের কাছে। সুবর্ণা ঠিক করল সে এখনই বাড়ি ফিরে যাবে। যা করার বাড়ি ফিরেই করতে হবে। এখানে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার ভাইয়ের সাথে কথা বলা দরকার। আগে জানতে হবে আরিন্তা তার ভাইকে যতটা ভালোবাসে বলছে, তার ভাইও আরিন্তাকে ততটাই ভালোবাসে কি না। এসব সত্যি হলে যে আরিন্তার সাথে-সাথে তার ভাইয়ের জীবনেও নিশ্চিত অন্ধকার নেমে আসবে।

সুবর্ণা গেল পেলবের কাছে তার ফোন চাইতে। কিন্তু পেলব তাকে ফোন তো ফেরত দিলোই না, বরং জানাল আগামীকাল তার বাবা-মাও আসবে। পুলক তালুকদার তাদের ফোন করে আগামীকাল জরুরী ভিত্তিতে ডেকেছেন। সুবর্ণাকেও আগামীকাল পর্যন্ত এখানে থাকতে বলা হয়েছে। হতাশ হয়ে সুবর্ণাকে ফেরত আসতে হয়েছে। আগামীকাল পর্যন্ত তাকে এখানে বসে আরিন্তার আহাজারি দেখার সাথে-সাথে নিজেকেও দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবে ভেবেই তার মাথা ঘুরছে। তার ওপর আগামীকাল বাবা-মাকে ডেকে এসব কথা তুললে না জানি কী ঝামেলা বাঁধে। এসবের চাপে পড়ে দুই পরিবারের মাঝের সম্পর্ক নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু না হলেই হয়। আরিন্তার আহাজারি দেখে তার ভীষণ খারাপ লাগছে। আজীবন সে তার খালুকে তার দেখা সবচেয়ে মহৎ মানুষ ভেবে এসেছে, অনেক সম্মান করেছে। ওই মানুষটার জন্যই তো তারা এখনও ভালো আছে। এই প্রথমবারের মতো ওই মহৎ মানুষটাকেই তার ভীষণ স্বার্থপর, ভীষণ নির্দয় মনে হচ্ছে। সঙ্গে পেলবকেও। ওই ছেলেটাকেও তো সে আজীবন নিজের ভাইয়ের মতোই ভালোবেসে এসেছে। অথচ একেকটা মানুষের ভেতরের সত্তা কী বিচিত্র!

শমসের খাঁন আর আয়েশা খাতুন অবিশ্বাস্য ঘটনা শুনে অতি বিস্ময়ে সঠিক কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। দুজনেই ভাবছেন এতসব কখন হয়ে গেল। তাদের সঙ্গে কথা বলছেন পুলক তালুকদার। পেলব আর মেরিনা পাশে থাকলেও তারা কিছু বলছে না। পুলক তালুকদার নিজেই মিশকাত-আরিন্তার সম্পর্কের ব্যাপারে বললেন। সাথে আরিন্তার বিয়ে ঠিক হওয়ার কথাও বললেন। ঠান্ডা মাথায় সোজাসাপ্ট জানিয়ে দিলেন ছেলে-মেয়ে ভুল করেছে, কিন্তু তিনি সেই ভুল মেনে নিবেন না। শমসের খাঁন আর আয়েশা খাতুনকেও জিজ্ঞেস করলেন তাদের কী মতামত। ছেলের পক্ষ হয়ে তাদের কথা বলার জায়গা নেই এখানে। পুলক তালুকদারের কাছে তারা সবসময় ঋণী হয়ে থাকেন। কম উপকার করেননি তিনি তাদের। আজ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে বিবেকে বাঁধল। আয়েশা খাতুন মেরিনার মুখের অবস্থা দেখেই আঁচ করতে পারছেন ছেলের সাথে আরিন্তার হঠাৎ বিচ্ছেদ সহজ নয়। দুলাভাইয়ের সিদ্ধান্তে তার বোন যে অসন্তুষ্ট, তা-ও বুঝতে পারছেন। মনে-মনে আয়েশা খাতুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের জন্য এখন তার চিন্তা লাগছে। এখন বুঝতে পারছেন কেন তার ছেলেকে ঠিক মনে হচ্ছে না। কেন তার ছেলে এত চিন্তিত। আরিন্তার জন্য দুশ্চিন্তা করেই তার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শমসের খাঁন ছেলের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকে সমর্থন করতে পারছেন না। পুলক তালুকদারের সূক্ষ্ম যুক্তির কাছে তার চিন্তা-ভাবনা হার মানতে বাধ্য হলো। তার চেয়ে বড়ো কথা পুলক তালুকদারের সিদ্ধান্তের ওপর বিপরীত কথা বলার সাহস তাদের নেই। তবু আয়েশা শুধু এটুকু বললেন,
“সবই বুঝলাম দুলাভাই। আমার ছেলের হয়ে আমি কথা বলছি না। আপনি মেয়ের যাতে ভালো মনে করেন, করবেন। কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে আরির ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? পরে যদি সংসার জীবনে অশান্তি হয়?”

পুলক তালুকদার বললেন,
“বিয়ের পর আস্তে-আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। অশান্তি কিসের? তোমার ছেলেকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দূরে রেখো, দুজনের মধ্যে কথাবার্তা না হলে আস্তে-আস্তে মানিয়ে নিতে পারবে। যোগাযোগ থাকলেই অশান্তি হবে।”
আয়েশা চুপ করে রইলেন। পুলক তালুকদার পুনরায় বললেন,
“আরিকে আমি ওর সাথে যোগাযোগ করতে দিচ্ছি না। তাই ও আমাকে আর পেলবকে বারবার ফোন করছে। তোমাদের কাছে আমার কথা হচ্ছে, এই মুহূর্তে আরির বিয়ের খবর তোমরা ওকে জানাবে না।”
আয়েশা বললেন,
“কিন্তু মিশু তো বারবার ফোন করে জানতে চাইছে এখানে কী সমস্যা হয়েছে। গতকাল সুবর্ণাকে এখানে পাঠিয়েছিলাম-ও ওর কথায়। এখন তাহলে ও ফোন করে জানতে চাইলে আমি কী বলব আপনিই বলুন।”
“বলবে আমার ব্যবসায় বড়ো লস হয়ে গেছে, তাই মেজাজ খারাপ বলে কারো সাথে কথাবার্তা বলছি না।”
“কিন্তু পেলব? পেলব-ও তো যোগাযোগ করছে না।”
পেলব বলল,
“সমস্যা নেই। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব নে। কিছু জিজ্ঞেস করলে ব্যবসার কথাই বলে দিবো। তোমরাও ওটাই বোলো।”
মেরিনা থমথমে মুখে বললেন,
“এখন না হয় সবাই মিলে মিথ্যা কথা বলে ছেলেটাকে চুপ রাখবে। কিন্তু পরে যখন ও জানতে পারবে, তখন? ওর কথা কি কেউই ভাবছো না? ছেলেটা সবাইকে ছেড়ে এতদূরে পড়ে আছে। শেষমেষ সবার থেকে আঘাত পেয়ে ওর না জানি কী অবস্থা হয়।”

ছেলের আশঙ্কায় বোনের সাথে আয়েশার বুকের ভেতরটাও কামড় দিয়ে উঠল। কিন্তু এখন যে দুশ্চিন্তা আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই করার নেই।

এ বাড়িতে এসেও আয়েশা খাতুন আরিন্তার সঙ্গে দেখা করলেন না। মেয়েটার ব্যথিত মুখটা দেখতে ইচ্ছা করেনি তার। ওই মুখ দেখে তিনি বুকের ব্যথা আরও বাড়াতে চান না। আজকের দিনটা তাদের থাকার জন্য বলেছিলেন পুলক তালুকদার। কিন্তু তারা থাকেননি। কথাবার্তা শেষ করেই বাড়ি ফিরে এসেছেন। ফেরার সময় সুবর্ণাকেও বারবার করে সতর্ক করে দিয়েছে পুলক, যাতে সে আবেগের বশে ভাইকে কিছু না জানিয়ে বসে। বাড়ি ফিরে আয়েশা খাতুন আর সুবর্ণা সবাই নীরব হয়ে আছেন। শমসের খাঁন কিছুক্ষণ পরপর ছেলের ওপর চেঁচামেচি করছেন। জ্ঞানী ছেলে জেনেবুঝে এমন ভুল কেন করল, এটাই তার বক্তব্য। আয়েশা খাতুন ভয়ে ছিলেন কখন ছেলের ফোন আসে, সেই ক্ষণের। দুপুরের দিকে সুবর্ণা ফোন নিয়ে এসে চুপসানো মুখে বলল,
“ভাইয়া ফোন করেছে।”

আয়েশা খাতুন ফোন হাতে নিয়ে কিছু মুহূর্ত চুপ রইলেন। কথা বলার আগেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। নিজের ছেলেকে দূরে বসিয়ে এত বড়ো মিথ্যা কথা বলতে মন সায় দিচ্ছে না তার। তবে ফোন ধরে কথা শুরু করার পর একটু শান্ত হলেন। মিশকাত জানাল পেলব তাকে ফোন করেছিল। পুলক তালুকদারের ব্যবসায় বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে, এটাই জানিয়েছে সে। কারোর মনের অবস্থা ভালো না বুঝতে পেরে মিশকাত আর বেশি প্রশ্ন করেনি। তবে মনে থাকা একটা কথা সে মাকে বলল। মেরিনার ফোন দিয়ে পেলবের এত কী কাজ? এমন করলে মেরিনার সঙ্গে সবাই কথা বলবে কীভাবে? ছেলের এক কথার মাঝেই আয়েশা বুঝলেন, তার ছেলের উস-খুসের আসল কারণ আরিন্তার সাথে কথা বলতে না পারা। মনের কষ্টটা চেপে রেখে আয়েশা এটা-ওটা বলে ছেলেকে ভুলভাল বুঝানোর চেষ্টা চালালেন। সত্য না জানা মিশকাতের কাছে মায়ের সব কথাই স্বাভাবিক মনে হলো। অথচ ফোনের এপাশে বসে প্রতিটা মিথ্যা কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে আয়েশা খাতুনের বুক কেঁপে উঠল। সুবর্ণা পাশে বসে ছলছল চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার যে মা কোনোদিন তাদের সাথে মিথ্যা কথা বলেনি, সে আজ ছেলের সাথে একের পর এক মিথ্যা বলে চলেছে। সুবর্ণা জানে তার মা নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার যত দুশ্চিন্তা হচ্ছে মিশকাতের জন্য। তার ভাইটা তাদের ক্ষমা করবে তো?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে