#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৬.
গতরাতে দুশ্চিন্তায় ছটফট করে অনেক দেরী করে ঘুমিয়েছিল আরিন্তা। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতেও দেরী হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে চেঁচামেচি কানে আসতেই সে ফ্রেশ হওয়ার কথা ভুলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। সিঁড়ির ধারে এসে বুঝল তার বাবা চেঁচামেচি করছে। আরিন্তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শুরু হলো। গলাটাও সঙ্গে-সঙ্গে শুকিয়ে কাঠ হলো। তিন-চার সিঁড়ি নেমে দাঁড়াতেই স্পষ্ট শুনতে পেল পুলক তালুকদারের গালাগাল। উচ্চ স্বরে তিনি মিশকাতের নাম ধরে গালাগাল করছেন। আরিন্তার আর বুঝতে বাকি রইল না পেলব সব জানিয়ে দিয়েছে বাবাকে। আর এক সিঁড়ি সামনে পা ফেলার শক্তি এল না আরিন্তার শরীরে। বাবার এই রুদ্রমূর্তি রূপের ফলাফল কী হতে পারে ভেবেই তার হাত-পা অসাড় হয়ে এল। এরমধ্যে কী যেন ভাঙার আওয়াজ শোনা গেল। নিশ্চয়ই পেলব তালুকদার নিজের রাগ দমাতে ভাঙচুর শুরু করেছেন। আরিন্তা নিচে নামল না। উলটা ঘুরে নিজের রুমে ফিরে গেল। দরজা আটকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থম মে’রে বসে রইল।
গোটা সকাল পুলক তালুকদার চেঁচামেচি করেছেন। সকালের নাস্তা খেতে বসে পেলব মিশকাত-আরিন্তার কথা জানানোর পরপরই এক কথা দুই কথায় পুলক তালুকদার রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। খাবারটা আর কারোরই ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। এদিকে মেরিনা হতবাক হয়ে আছেন। এমন অবিশ্বাস্য সত্যি জানার পর থেকে তার মাথা ঘুরছে। পুলক তালুকদার বাইরে চলে যাওয়ার পর পেলবের সাথে তিনি মেয়ের কাছে এসেছেন। পেলবকে দেখেই আরিন্তা বলে উঠল,
“ভাইয়া, তুমি এটা কেন করলে?”
পেলব উত্তর দিলো,
“করাটা ঠিক মনে হয়েছে, তাই করেছি।”
“বাবাকে এভাবে খেপিয়ে তোলা তোমার ঠিক মনে হয়েছে?”
“বাবাকে আমি খেপানোর কেউ না। আজ শুনে বাবা যেমন আচরণ করছে, কাল শুনলেও একই আচরণ করত, স্বাভাবিক।”
“কিন্তু তুমি আজই কেন শোনাতে গেলে? কী ভেবে করলে তুমি এটা? চুপচাপ থেকে তুমি মনে-মনে ছক কষেছ এভাবে বাবার কাছে সব ফাঁস করার? তোমার কি কোনো ক্ষতি হয়েছে?”
মেরিনা বললেন,
“ক্ষতি কারোরই হয়নি। কিন্তু তুই এসব করার আগে একবারও তোর বাবার কথা ভাবিসনি? মিশু যতই ভালো ছেলে হোক, তোর বাবা ওকে কোনোদিন মেয়ে জামাই মানবে?”
আরিন্তা বলল,
“না মানার কী আছে? আমি তো আজেবাজে কোনো ছেলেকে পছন্দ করিনি।”
পেলব বলল,
“বাবা কী বলেছে জানিস তুই? বলেছে মিশু আজীবন যেই থালায় খেয়েছে, বিশ্বাসঘাতকের মতো সেই থালা-ই ফুটা করেছে।”
“বিশ্বাসঘাতকতার কী আছে এতে?”
“কী আছে মানে? সারাজীবন ওদের পরিবার চলেছে বাবার সাপোর্টে। নইলে কবে ভেসে যেত। মিশুর ইনকামে যে এখন একটু দিন ফিরেছে, বাবা সাহায্য না করলে পারত এসব করতে?”
আরিন্তার রাগ উঠল। শক্ত মুখে বলল,
“আপন মানুষকে সাহায্য করেছে, এতে ক্ষতি কী? এই ব্যাপারটাকে এত নিচভাবে নিচ্ছ কেন তোমরা? সাহায্য করেও তোমরা ওই পরিবারকে এমন নিচ মনে করেছ সবসময়? তাহলে লাভ কী এসব করে?”
পেলব মেরিনাকে বলল,
“মা, তোমার মেয়েকে বুঝাও। সহজে না বুঝলে কিন্তু এর ফল পরে খুব খারাপ হয়ে যাবে। তখন বাবার কাছে কেঁদেও লাভ নেই। আমি ওকে বুঝিয়ে মাথা খারাপ করতে পারব না। গেলাম।”
থমথমে মুখে পেলব চলে গেল। মেরিনা মেয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললেন,
“কী করলি তুই আরি? এখন আমি কোনদিকে যাব? আমার কাছে তুই, মিশু সবাই একরকম ছিলি।”
আরিন্তা মমতাময়ী মায়ের সামনে যেন বরফের মতো শীতল হয়ে গেল। নরম কন্ঠে বলল,
“মা, ভাইয়ার মুখে তো সবই শুনেছ বোধ হয়। মিশু ভাই আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করত। আমি ওনাকে ফেরাতে পারিনি।”
“আগে কেন জানালি না আমাকে?”
“আগে জানালে কী হত মা? এখন জেনেই তোমরা কেউ মানতে পারছো না। আগে জানলে মানতে?”
“আত্মীয়-স্বজনের ভেতর সম্পর্ক হলে এমনই হয়।”
“আচ্ছা, মিশু ভাই কি অযোগ্য ছেলে, তুমিই বলো? বাবা আর ভাইয়া কেন এমন করছে?”
“তাদের নারাজ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার বোনের সংসার টিকে আছে তোর বাবার কারণে। ওরা তোর বাবার কাছে অনেক ঋণী। তাছাড়া ওরা তোর বাবার মতো অবস্থাশীল না।”
“মিশু ভাই কত কষ্ট করছে, তা কি তোমরা জানো না? আস্তেধীরেই তো পরিবর্তন আসবে।”
“এসব তুই যতটা সহজ ভাবছিস, বড়োরা এভাবে ভাববে না। তুই তোর বাবার একমাত্র মেয়ে, ভাইয়ের একমাত্র বোন। স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইবে তোকে অনেক ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে। তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবলে মিশুর সঙ্গে তোর বিয়ে সম্ভব না।”
“পকেট ভর্তি টাকা থাকলেই কি সেই পরিবার ভালো হয় মা? তোমরা তো আমাকে সুখী করতে চাও। কিন্তু আমি আসলে কিসে সুখে থাকব, তা কি একবারও ভাবছো? এতগুলো বছর একজনকে কথা দিয়ে এখন আমি তার সাথে বেইমানি করে সুখী হতে পারব?”
আরিন্তার চোখ ভর্তি জল চলে এল। সে মায়ের কাছে বিনীত অনুরোধ করল,
“মা, তোমার কাছে অনুরোধ করছি তুমি অন্তত বাবাকে বুঝাও। বাবাকে না পারো, ভাইয়াকে বুঝাও। ভাইয়া বুঝলেই বাবা বুঝবে।”
“তোর ভাইকে তুই বুঝাতে পেরেছিস? আমি কী বুঝাব বল তো?”
“আমি জানতাম না ভাইয়া-ও আমার বিপরীতে কথা বলবে। ওকে ভরসা করে আমি সত্যি কথা বলেছিলাম। ভেবেছিলাম মিশু ভাইয়ের কথা শুনলে ও অসন্তুষ্ট হবে না।”
“মিশুর সাথে তোর ভাইয়ের যতই ভালো সম্পর্ক থাকুক, তোর বেলায় ও এসব মানবে না। আত্মীয়-স্বজনের ভেতর কোনো সম্পর্কই মানবে না ও। তোর জন্য না আবার মিশুর সাথে আমাদের সবার সম্পর্কই খারাপ হয়ে যায়। তার চেয়েও বড়ো ভয় তোদের জন্য আমার বোনের পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় কি না, তা-ই দেখার বাকি। তোর বাপ-ভাই যা খেপেছে মিশুর ওপর!”
আরিন্তা ধরা গলায় বলল,
“মিশু ভাই আমাকে নিয়ে কতটা দুশ্চিন্তায় থাকে, তা তোমাদের বুঝাতে পারব না। উনি এসব শুনলে কী করবে আমি নিজেও জানি না। এই পরিস্থিতির ভয়েই উনি ছিলেন। আমি সবসময় ওনাকে বলেছি আমি সামলে নেব। কথা দিয়েছি উনি না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। উনি আমার কথার ভরসায় আছেন। আমি কথা রাখতে না পারলে উনি কী পাগলামি করবেন ঠিক নেই। মা, তোমার হাতে ধরি, কিছু একটা করো।”
মেরিনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“আমি পড়েছি ঠেকায়। মিশু আমার বোনের ছেলে। সম্পর্ক খারাপ হলে আমার ক্ষতি, তোর বাবার না। তোর মনে হয় উনি আমার কথা শুনবে? আমি এখন তোর হয়ে কথা বলতে গেলে উলটা আমাকেই কথা শুনিয়ে দিবে।”
“তাহলে এখন আমি কী করব? তোমার-আমার দুজনের ফোনই তো ভাইয়ার কাছে। মিশু ভাইয়ের সাথে কথাও বলতে পারছি না।”
“তুই নিজেই তোর বাবার সাথে কথা বল।”
আরিন্তা চমকে উঠে বলল,
“কী বলছো? বাবা তো আমাকে কিছু জিজ্ঞেসই করেনি এই বিষয়ে। সে আমাকে কিছু না বলতে আমি কীভাবে বলব?”
“আমার মনে হয় না তোর বাবা তোকে কিছু জিজ্ঞেস করবে। কারণ সব কথাই পেলবের মুখে জানা হয়ে গেছে তার। তোর সাথে কথা তুললেই কথা বাড়বে, তা উনি ভালোভাবেই জানেন। সেজন্যই তোর সাথে এ বিষয়ে কথা বলছেন না।”
আরিন্তা বলল,
“মা, ভাইয়ার কাছ থেকে তোমার ফোনটা একটু এনে দিবে? এটুকু উপকার করো দয়া করে। এই মুহূর্তে মিশু ভাইয়ের সাথে আমার কথা বলতেই হবে। নইলে বাবা-ভাইয়াকে বুঝানো সম্ভব না।”
“পেলব এখন ফোন ছাড়বে না। ও নিজেই এখন তোর বিয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি দেখাচ্ছে।”
আরিন্তা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ভাইয়া এমন করবে আমি ভাবতেও পারিনি মা। এই অবধি সবসময় আমি সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছি ওকে। ও ভালোভাবেই জানে আমি বিয়ে করতে চাই না।”
“জানি না মা, আমি কিছু জানি না। কী করবি, না করবি তোরাই জানিস। চারদিক থেকে সবাই আমাকে ঘিরে ধরবি, আমি শুধু শুনব। কারোর হয়ে কথা বলার অবস্থা আমার নেই। যার যা ভালো মনে হয় কর। আমাকে টানাহেঁচড়া করিস না।”
আহাজারি করতে-করতে মেরিনা উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আরিন্তা ভেজা চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরটা ক্ষণে-ক্ষণে মুচড়ে উঠছে তার। কেমন এক পীড়াদায়ক অনুভূতি হচ্ছে। অতিরিক্ত ভালোবাসা হয়তো এভাবেই মানুষকে যন্ত্রণার সাগরে ভাসিয়ে দেয়। যারা হাবুডুবু খেতে-খেতে একসময় তীর ছুঁতে পারে, তারা বেঁচে যায়। আর যারা বহু কষ্টেও তীর খুঁজে না পেয়ে অতল সাগরে ডুবে যেতে বাধ্য হয়, তাদের ভালোবাসা এমনিতেই ম’রে যায়। আরিন্তা জানে না তাদের কপালে কী আছে। শুধু জানে এতদিন সে মনে যে জোর ধরে রেখেছিল, সেই জোর দিয়ে এই পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা সে শেষ পর্যন্ত করবে। কিন্তু ফলাফল তার অজানা।
সারাদিনে আরিন্তা নাওয়া-খাওয়া কিচ্ছু করেনি। পুলক তালুকদার মেরিনাকে বলে গেছেন আরিন্তাকে ভার্সিটিতে যেতে না দিতে। তাই ভার্সিটি-ও যাওয়া হয়নি। ভার্সিটি গেলেও মিশকাতের সাথে যোগাযোগ করার একটা উপায় পাওয়া যেত। বদ্ধ ঘরে আরিন্তা ছটফট করে দিন কা’টিয়েছে। মেরিনা অনেক করে বলেও কথা শুনাতে পারেননি। পেলব-ও কয়েকবার ডাকাডাকি করেছিল, কিন্তু আরিন্তা তার সাথে কথাই বলেনি। রাতে পুলক তালুকদার বাড়ি ফিরে মেয়ের খবর শুনে নিজেই ডাকতে গেলেন। আরিন্তা বাবাকে কিছু বলতে পারল না। কারণ পুলক তালুকদার মেয়েকে খাবার টেবিলে ডাকার বাইরে অন্য কোনো কথা বলেননি। সারাদিনে পেটে কিছু না পড়ায় আরিন্তার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। সবসময় খাই-খাই করা মেয়েটা কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে? খাওয়া-দাওয়া না করলে তার শরীর দুর্বল লাগে। তবু দুশ্চিন্তায় খাওয়ার ইচ্ছা জাগছে না আজ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বাবার ডাকে বদ্ধ ঘর ছেড়ে খাবার টেবিলে এসে চুপচাপ বসেছে। পুলক তালুকদার নিজেই মেয়ের পাতে মাছ তুলে দিয়েছেন। কিন্তু আরিন্তার এখন কাঁ’টা বেছে মাছ খেতে একদমই ইচ্ছা করছে না। কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে সে টেবিল ছাড়তে পারলে বাঁচে। বাবার সামনে এই প্রথম তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। নিচু স্বরে বলল,
“মাছ খাব না।”
মেরিনা শুধালেন,
“কেন?”
“খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“তাহলে কী দিয়ে খাবি?”
পুলক তালুকদার স্ত্রীকে বললেন,
“একটা ডিম ভেজে দাও।”
আরিন্তা বলল,
“লাগবে না। সবজি দিয়ে খেতে পারব।”
পুলক তালুকদার তবু স্ত্রীকে ডিম ভেজে আনতে বললেন। স্বামী, সন্তানদের শান্ত, গম্ভীর মুখে একবার চোখ বুলিয়ে মেরিনা রান্নাঘরে চলে গেলেন। আরিন্তা মাছ রেখে পাতে সবজি নিয়ে মাথা নিচু করে খাওয়া আরম্ভ করে দিয়েছে। বাবা, ভাই কারোর দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। গাম্ভীর্যতা দেখে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে দুজনের মনের মধ্যে এখন কী চলছে। হঠাৎ পেলব বলে উঠল,
“ডক্টর নিয়াজের সাথে কথা হয়েছে।”
সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তার খাওয়া থেমে গেল। পুলক তালুকদার পেলবকে শুধালেন,
“কী বলল?”
“বলল আলাদা করে আর মেয়ে দেখার প্রয়োজন নেই। সে তো দেখেছেই। আর আমি যে ছবি পাঠিয়েছি তা ওনার বাবাকে দেখিয়েছেন। ওনার বাবা না কি বলেছেন এলে একেবারে পাকা কথা বলে ফেলবেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে।”
আরিন্তা চুপ করে শুনলেও এই পর্যায়ে পেলবের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমি বিয়ে করব না।”
পেলব উত্তর না দিয়ে বোনের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পুলক তালুকদার পেলবকে বললেন,
“ওর বাবার ফোন নাম্বারটা দিস আমাকে। তুই আসার দিনের কথা কিছু বলেছিস?”
পেলব বলল,
“আমি বলেছি কাল বা পরশুর কথা। তুমিও কথা বলে দেখো। তারপর না হয় তাদের সুবিধামতো আসবে একদিন।”
আরিন্তা ভীষণ বিরক্ত হলো। যত রাগ এসে পড়ল পেলবের ওপর। এবারেও সে পেলবের দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগত স্বরে বলল,
“আমি কী বলছি শুনতে পারছো না? আমি বিয়ে করব না। কাকে বিয়ে দিবে তোমরা?”
পেলব রাগ দেখাল না। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“বাবাকে বল।”
আরিন্তা বাবার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। পুলক তালুকদার মেয়েকে বললেন,
“সারাজীবন কোনো কাজে বাঁধা দিইনি। এবার অন্তত চুপ থাকো। যা হচ্ছে তোমার ভালোর জন্যই হচ্ছে।”
আরিন্তা ঢোক গিলে থমথমে মুখে বলল,
“আমার অমতে বিয়ে দেওয়া কেমন ভালো বাবা?”
“তুমি ভালো থাকার জন্য ভুল পথ ধরে হেঁটেছ। বাবা হিসাবে আমি সেই ভুল শুধরে দিবো। সময় এলেই বুঝতে পারবে কোনটা তোমার জন্য ঠিক।”
আরিন্তা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাল। বলল,
“আমি বিয়ে করতে পারব না। শুধু-শুধু এসব ঝামেলা কোরো না।”
“ঝামেলা কে করবে? তুমি, না তোমার মিশু ভাই?”
আরিন্তার ডান চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মেরিনা একটা বাটিতে ডিম ভাজা এনে আরিন্তার সামনে রাখল। পুলক তালুকদার পুনরায় মেয়েকে বললেন,
“এত বড়ো হয়েছ, আজ পর্যন্ত আমি তোমার গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, ধমক দিয়ে কথাও বলিনি। একমাত্র মেয়ে হিসাবে সবসময় আহ্লাদ পেয়েছ। সেই সুযোগে যা ভুল করার করেছ। তা নিয়েও আমি তোমার সাথে অযথা ধমকা-ধমকি করতে চাই না এখন আর। কারণ এখন আর ঘটে যাওয়া ঘটনা পরিবর্তন হবে না। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে বাগড়া দেওয়ার মতো দ্বিতীয় ভুলটা কোরো না। যা হচ্ছে হতে দাও। নইলে আমার যে রূপ তুমি দেখোনি, সেই রূপ দেখাতে বাধ্য হব। আহ্লাদের দিন ভুলে যাও, নিজের ভুল শুধরাও। তোমার ইচ্ছায় আর কিছু হবে না। জল্পনা-কল্পনা বাদ দিয়ে এবার নিজের ভালো বুঝতে শেখো।”
আরিন্তা চোখের পানিতে রাগ সামলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মিনমিনে কন্ঠে বলল,
“তোমরা যা-ই করো, আমি বিয়ে করতে পারব না।”
পুলক তালুকদার বললেন,
“খাওয়া শেষ করো।”
মেরিনা-ও বললেন,
“বোস, সারাদিন না খেয়ে ছিলি।”
আরিন্তা কারো কথা কানে তুলল না। হনহনিয়ে হেঁটে সোজা ওপরে চলে গেল। মেরিনা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন। পুলক তালুকদার কিছু সময় থম মে’রে বসে থাকার পর স্ত্রীকে বললেন,
“মেয়েকে বুঝাও। ত্যাড়ামি করে কোনো লাভ নেই। যে আশায় বসে আছে, তা পূরণ হবার নয়। সময় থাকতে বুঝা ভালো। নইলে জোরজবরদস্তি ছাড়া কিছু করার নেই। আর আপাতত আয়েশাদের কারোর সাথে যোগাযোগ করার দরকার নেই। তোমার ভাগনের সাথে ভুলেও কথা বলবে না এখন। বলার হলে সব মিটে যাওয়ার পর বলবে। আপাতত নিজের মেয়ের ভালোর দিকে তাকাও।”
মেরিনা প্রত্যুত্তর করার মতো কথা পেলেন না। কী-ই বা বলবেন? তার যে কারোর পক্ষে কথা বলার সুযোগ নেই। মেয়ের পক্ষ নিলে স্বামী নারাজ হবে। নানান কথা শুনতে হবে তাকে। এই মুহূর্তে মেয়ে সমর্থন পেলে আরও সাহস পেয়ে যাবে। তখন তাকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়বে। আবার মেয়েকে কটু কথাও বলতে পারছেন না তিনি। মিশকাতকে তিনি আজীবন নিজের ছেলের মতো ভালোবেসেছেন। স্বামী এমন নারাজ না হলে তিনি মেয়েকে সমর্থন করতেন। মনে-মনে তিনি বিশ্বাস করেন মিশকাতের মতো ছেলে অবশ্যই তার মেয়ের যোগ্য। কিন্তু এ কথা যে তিনি ছাড়া কেউ বুঝেও বুঝতে চাইছে না।
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।