#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৪.
দেশে আসা এক পরিচিতজনের কাছে মিশকাত সবার জন্য কিছু উপহারের সাথে দুটো স্মার্টফোন পাঠিয়েছে। একটা সুবর্ণা, আরেকটা আরিন্তার জন্য। কিন্তু ফোন পাঠানোর কথা আগে থেকে কেউই জানত না। আরিন্তাকে এখনও তার বাবা ফোন কিনে দিচ্ছে না বলে মিশকাত তার জন্য ফোন পাঠানোর কথা ভাবে। তারপর আবার মাথায় আসে আরিন্তার জন্য একা পাঠালে সুবর্ণার মন খারাপ হতে পারে, বা নানাজন নানা কথা বলতে পারে। তাই দুজনের জন্যই পাঠিয়ে দিয়েছে। অপ্রত্যাশিত উপহার পেয়ে দুজন যেমন অবাক, তেমনি খুশি। কিন্তু পুলক তালুকদার খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একে তো তিনিই এখনও মেয়েকে ব্যক্তিগত ফোন কিনে দেননি, তার ওপর মিশকাত অতিরিক্ত টাকা খরচ করে এসব পাঠিয়েছে। মেরিনা তাকে বুঝালেন, মেয়ের এখন নিজস্ব মোবাইল ফোন দরকার। এমনিতেও যে সে মোবাইল ফোন ছাড়া থাকে, তেমনটা নয়। মেরিনার ফোন সবসময়ই নিজের মতো ব্যবহার করে। মিশকাত-ও বুঝিয়ে বলল এটুকু উপহারে তার বিশেষ আর্থিক ক্ষতি হয়নি। বর্তমানে তার আয়-রোজগার সন্তোষজনক।
মিশকাত রাগে ফুঁসছে। আরিন্তা চুপ মে’রে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজকাল আরিন্তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব বেশি আসছে। এতদিন পুলক তালুকদার চুপ থাকলেও, এবার তার একটা ছেলেকে ভালো লেগেছে। তাই তিনি বিয়ের ব্যাপারে এগোতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এবারেও আরিন্তা আর পেলব বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না আরিন্তা বিয়ে করবে, না পেলব বোনের বিয়ে দিবে। এই নিয়ে এবারেও বাবার সাথে পেলবের তর্ক হয়েছে। কথাটা মিশকাতকে জানাতেই ধুম করে সে রেগে গিয়েছে। তার সমস্ত রাগ এসে পড়েছে ঘটকের ওপর। ঘটক কেন এত বেশি মাথা ঘামাচ্ছে, এটাই তার ক্ষোভের কারণ। আরিন্তা বলল,
“আচ্ছা, এখন এই রাগ দেখানোর দরকারটা কী? এসব তো নতুন না। বিয়েও করে ফেলছি না আমি। তাহলে?”
মিশকাত কোনো প্রত্যুত্তর করল না। আরিন্তা পুনরায় বলল,
“মিশু ভাই, ঠিক এই কারণেই আমি তোমাকে এসব কথা জানাতে চাই না।”
মিশকাত বড়ো একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল,
“বারবার ফিরিয়ে দেওয়ার পরও ওই ঘটক পিছু ছাড়ে না কেন, তুই-ই বল?”
“তাদের তো কাজই এটা।”
“হ্যাঁ, আর তাদের এই কাজের চক্করে আমাকে প্রতিদিন দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়।”
“তোমাকে কে বলেছে দুশ্চিন্তা করতে? আমি বলেছি?”
“সুন্দরী বউ ফেলে রেখে হাজার মাইল দূরে পড়ে থাকলে দুশ্চিন্তা ছাড়া উপায় কী?”
“তোমার বউ কি চাইলেই অন্য কেউ নিয়ে যেতে পারবে? এত সোজা?”
“দিয়ে দিতে কতক্ষণ?”
“কে দিবে?”
“তোর বাপ।”
“দিতে চাইলেই আমি চলে যাব?”
মিশকাত হতাশ কন্ঠে বলল,
“ভালো লাগে না রে আরি। একটা বছর দূরে থেকে কতটা চিন্তা নিয়ে একেকটা দিন পার করতে হয়েছে, তা আমিই বুঝি।”
“আমি বুঝি না তোমায়? তোমায় রোজ-রোজ চিন্তা করতে নিষেধ করলেও তো শোনো না।”
“করতে তো চাই না। কিন্তু চিন্তা যে আমায় ছাড় দেয় না। উপার্জন বাড়ার পর পরিবারের চিন্তা যা একটু কমেছে। কিন্তু তোর চিন্তা তো উপার্জন দিয়ে আটকে রাখার উপায় নেই। মাঝে-মাঝে আমার কী মনে হয় জানিস? তোর চিন্তায়-চিন্তায় আমি একদিন পা’গল হয়ে যাব।”
আরিন্তা হাসতে-হাসতে বলল,
“চিন্তা কোরো না। ততদিনে তোমার চক্করে পড়ে আমিও পা’গল বনে যাব। তারপর দুজন মিলে একসঙ্গে পাগলাগারদে সংসার পেতে নতুন ইতিহাস গড়ব। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হবে না?”
“হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি রকমের ইন্টারেস্টিং।”
আরিন্তা শুধাল,
“কী করছেন মিস্টার পোল্ট্রি?”
“জোড়া চাঁদ দেখছি।”
আরিন্তা বোকার মতো প্রশ্ন করল,
“চাঁদ আবার জোড়া হয় কীভাবে? চাঁদ তো একটাই।”
“আমার আকাশে তো সবসময় জোড়া চাঁদ-ই দেখা যায়। একটা অমাবস্যা এলে হারিয়ে গিয়ে অন্ধকার দিয়ে যায়। আরেকটা সবসময় একইভাবে জ্বলতে থাকে। অমাবস্যা-ও তাকে হারিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।”
আরিন্তা এবার বুঝল মিশকাতের জোড়া চাঁদের রহস্য। সে ঠোঁট টিপে হেসে আবার প্রশ্ন করল,
“বলো কী! তোমার চোখে আবার সমস্যা হয়নি তো? আচ্ছা, শুধু চাঁদ-ই জোড়া দেখো, না অন্য কোনো কিছু-ও?”
মিশকাত বলল,
“দেখি তো, প্রেমিকা-ও জোড়া দেখি।”
“কীহ্! এসব চলছে তাহলে? সাদা চামড়ার মেয়েদের দেখে-দেখে চোখে সমস্যা হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, এজন্যই তো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। এত রমণীদের ভিড়ে কেবল একজনকে পাই না। তাকে তাই চাঁদের পাশে খুঁজে বেড়াই।”
“দেখতে পাও?”
“পাই তো, স্পষ্ট দেখতে পাই। কিন্তু ছুঁতে পারি না।”
আরিন্তা চুপ হয়ে গেল। মিশকাত ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“দিনকে দিন আমার চাঁদাসক্তি যা ভয়ানক বেড়ে যাচ্ছে, আজকাল মনে হয় কোনো একদিন না আমার চাঁদাসক্তি বিরহবিধুর পরিণাম পায়।”
আরিন্তা হঠাৎ বলে উঠল,
“রাখছি।”
“কেন?”
“এমনি, ভালো লাগছে না। ঘুমিয়ে পড়ো।”
“রাগ করেছিস?”
আরিন্তা গাল ফুলিয়ে বলল,
“না।”
“তাহলে গাল ফুলিয়ে রেখেছিস কেন?”
“কই? অডিয়ো কলে-ও আজকাল মানুষের মুখ দেখা যায়?”
“আমি তো দেখতে পাই।”
“কারণ তোমার চোখে সমস্যা। ডক্টর দেখাও।”
“এই সমস্যা দুনিয়ার কোনো ডক্টরই সারাতে পারবে না। পারলে দেখাতাম।”
“আচ্ছা, দেখিয়ো না। যাও ঘুমাও।”
“এত রাগিয়ে ফেললাম?”
“না।”
“আচ্ছা, আর রাগ করার মতো কথা বলব না।”
“তা তুমি প্রতিদিনই বলো।”
“এরপর বললে শাস্তি মাথা পেতে নেব।”
“শাস্তি-ই নিতে পারবে, তবু তুমি এ কথা মনে রাখতে পারবে না।”
“থাকবে কী করে? আমার মনে তো শুধু তোমার বিচরণ আরিপাখি। তাই আর কোনো কথা মনে জায়গা পায় না।”
“চাপাবাজি কম করো তো মিশু ভাই।”
“আমার আকাশসম ভালোবাসাকে তুমি চাপাবাজি বলতে পারলে আরি?”
“পেরেছি বলেই তো শুনতে পারলে।
একটা কথা মনে পড়তেই মিশকাত প্রসঙ্গ পালটে বলে উঠল,
“ভালো কথা, সুবর্ণার পার্লারের কী খবর?”
“ভালো। আজকাল সুবর্ণা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পার্লার নিয়ে। শুধু আমিই অকর্মা হয়ে পড়ে আছি।”
“অকর্মা কীভাবে? সারাক্ষণ খাওয়া-ও একটা কাজ। আপাতত তুই ওটাই কর মন দিয়ে। আমি ফেরার পর না হয় চব্বিশ ঘন্টার পার্মানেন্ট কাজ দিয়ে দিবো।”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে বলল,
“তুমি আবার আমায় খ্যাপানোর চেষ্টা করছো? এবার কিন্তু আমি সত্যি-সত্যি ফোন কে’টে দিবো।”
মিশকাত হেসে উঠে বলল,
“আচ্ছা, আচ্ছা, আর খ্যাপাচ্ছি না।”
শমসের খাঁনের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন তিনি স্ক্র্যাচ ছাড়াই ধীরে-ধীরে হাঁটতে পারেন। তবে তার চিকিৎসা চলমান। মাঝে-মাঝে গিয়ে চেকআপ করাতে হয়। আরিন্তা দুই-তিনবার সাথে গিয়েছিল। অথচ এটাও যে তার জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে, এমন ধারণাই তার ছিল না। শমসের খাঁনের ডক্টরের সাথে পুলক তালুকদারের ভাব জমেছে। ডক্টর অল্প বয়সী যুবক। নাম নিয়াজ মাহমুদ। আরিন্তার দুই-তিনবারের সাক্ষাতেই যে সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসবে, এটা পুলক তালুকদারের কাছেও অবিশ্বাস্য ছিল। ডক্টর নিয়াজের প্রতি বরাবরই পুলক তালুকদারের দারুণ প্রশংসা ছিল। মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব যেন তার কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দের ছিল। একে তো ডক্টর নিয়াজ দেখতে-শুনতে লাখে একটা ছেলে। আচরণ খুবই সুন্দর। মনের দিক থেকে ভেজালমুক্ত ছেলে বলা চলে। তার ওপর পরিবারে-ও কোনোরকম ঝামেলা নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে তার মা কেউই বেঁচে নেই। নিজস্ব বাড়ি আছে। সাজানো বাড়িতে সবই আছে। শুধু নিজের মানুষের বড়ো অভাব। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে তার বাস। বাবার দেখাশোনার জন্য বাড়িতে দুজন কাজের লোক-ও আছে। তবু নিয়াজ যতটুকু সময় বাড়িতে থাকে, তার ভীষণ একাকী বোধ হয়। বাবার সঙ্গে গল্প করে আর কতটুকু সময় কা’টানো যায়? তার ওপর বাবা অসুস্থ মানুষ, বেশিরভাগ সময়ই তার বিশ্রামে কা’টে। অনেকদিন ধরেই নিয়াজ বিয়ে করার জন্য মেয়ে খুঁজছিল। কাউকে তেমন মনে ধরেনি। হুট করে আরিন্তাকে ভালো লেগে যাওয়ায় আর দেরী করতে চায়নি। পুলক তালুকদারের কাছে নিজেই প্রস্তাব রেখেছে। প্রথমবারেই যে পুলক তালুকদার সন্তুষ্ট হবেন, এতটা-ও সে ভাবেনি। তবে আশা রেখেছে এবার তার একটা মানুষ হবে।
পেলব তালুকদার বাড়িতে ডক্টর নিয়াজের প্রস্তাবের কথাটা তুলতেই মেরিনা রাজি হয়ে গেছেন। আত্মীয়-স্বজন যে শুনেছে, সে-ই এক কথায় সহমত জানিয়ে দিয়েছে। এমনকি শমসের খাঁন আর আয়েশা খাতুন-ও। ডক্টর নিয়াজকে পেলবের পছন্দসই মনে হয়। বোনের জন্য যোগ্য পাত্র। মনে-মনে সে রাজি থাকলেও মুখে এখনও তেমন কিছু বলেনি। কারণ আরিন্তার মনের কথা জানা আগে জরুরী। এখন সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত কি না, তা জানা দরকার। তবে পেলবের বিশ্বাস সবার সন্তোষজনক এই প্রস্তাবে এবার আরিন্তা রাজি হবে। মনে-মনে সে এটাও ঠিক করে রেখেছে, ডক্টর নিয়াজের কথা শোনার পরও যদি আরিন্তা অনার্স শেষ করেই বিয়ে করার জেদ ধরে, তবে সে আপাতত বিয়ে পরিয়ে রাখার পরামর্শ দিবে। অনার্স শেষ হলেই না হয় শশুরবাড়ি পাঠানো হবে তাকে। পুলক তালুকদার আগের ঝামেলার কথা চিন্তা করে এবার বিয়ের ব্যাপারে আরিন্তার সাথে কথা বলার দায়িত্ব পেলবের ওপরেই দিয়েছেন। মেরিনা-ও তাই আগে-আগে আরিন্তার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে যায়নি। তাই বলে যে আরিন্তা কিছুই জানে না, তেমনটা নয়। বাড়ির সবার ফিসফিস আলোচনা, আনন্দিত মুখ সবই তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কান সজাগ রেখে আসল খবর সে ঠিকই জেনে গেছে। জানার পর থেকে সে ঘর থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছে। মিশকাতকে আগেভাগেই এ ব্যাপারটা জানাতে চায় না সে। জানালেই যে মিশকাতের পা’গলামি শুরু হবে। তাই বিষয়টা নিজের ভেতর চেপে রেখে সে গোটা দিন ধরে দুশ্চিন্তায় ভুগছে, আর মনে-মনে ডক্টর নিয়াজের চৌদ্দ গোষ্ঠীর তুষ্টি উদ্ধার করছে। নিজেকে-ও বকছে, কেন সে নাচতে-নাচতে খালুর সঙ্গে হসপিটাল গেল। একা-একা সে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অনেক কথা গুছিয়ে রেখেছে। কোন কথার কোন উত্তর দিবে তা আগে থেকেই ভেবে রেখেছে। একটা ভয়ানক সিদ্ধান্ত-ও নিয়ে ফেলেছে। বিয়ের ক্ষেত্রে বরাবরই ভাইয়া তার একমাত্র ভরসা। এবার ভাইয়া পক্ষে থাকলে তো বেঁচেই যাবে। আর বাবার পক্ষ হয়ে কথা বললে মিশকাতের কথা বলে দিবে। যদিও ভাইয়ের প্রতি তার ভরসা আছে। তবু এবার একটু ভয়-ও লাগছে। মিশকাতের সঙ্গে কথা হয়েছে দুপুরের আগে। সে নিজের কাজে ব্যস্ত। বলেছে আবার রাতে ফোন করবে। আরিন্তা-ও এই মুহূর্তে তার সাথে কম কথা বলতে চেয়েছিল। ভালোই হয়েছে মিশকাত আজ বারবার ফোন বা ম্যাসেজ করছে না।
সন্ধ্যায় আরিন্তা নাশতা খেতেও নিচে এল না। মেরিনা আজ সন্ধ্যার নাশতায় সমুচা আর চা করেছেন। পেলব বসে খাচ্ছিল। মেরিনা বারকয়েক গলা তুলে আরিন্তাকে ডেকেছেন। পেলব শুধাল,
“খাওয়ার সময় এতবার ডাকা লাগে কবে থেকে ওকে? শরীর খারাপ না কি আবার?”
মেরিনা বললেন,
“না, শরীর ঠিকই আছে। আজ রুম থেকে তেমন বেরোয়নি।”
“কেন?”
মেরিনা চিন্তিত মুখে বললেন,
“আমার মনে হয় বিয়ের ব্যাপারটা ওর কানে গেছে। এই বিষয়ে কথা ওঠার পর থেকেই ওকে চুপচাপ দেখছি।”
পেলব সমুচায় কামড় দিয়ে কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল,
“দাও, ওর খাবার দিয়ে আসি।”
মেরিনা কিছুটা অবাক হয়ে বললেন,
“তুই?”
“হ্যাঁ। কথা আছে ওর সাথে।”
মেরিনা আরিন্তার খাবারটা গুছিয়ে দিলো। পেলব নিজের খাবারটুকু দ্রুত শেষ করে এক হাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে সমুচার বাটি নিয়ে চলল আরিন্তার রুমে। আরিন্তা পড়ার টেবিলে বসে ছিল। তার সামনে খোলা বই। দৃষ্টি বইয়ে আটকে থাকলেও সে অন্যমনস্ক। মাথায় অনবরত ঘুরছে বিয়ের বিষয়টা। কখন না তার বাবা তাকে ডেকে বিয়ের কথা বলে বসে। পেলব দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল,
“আরি?”
প্রথম ডাকেই আরিন্তার ধ্যান ভাঙল। নড়েচড়ে বসে সে বলল,
“দরজা খোলাই আছে ভাইয়া।”
পেলব দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। তার হাতে খাবার দেখে আরিন্তা হেসে বলল,
“সূর্য কি আজ ভুল দিকে উঠেছিল?”
পেলব আরিন্তার টেবিলে খাবার রেখে বলল,
“মা যে চেঁচিয়ে ডেকেছে, তা কানে শুনিসনি? কতবার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে আসবে তোর জন্য? আজ না কি রুম থেকে বেরোসনি?”
আরিন্তা সমুচা চিবোতে-চিবোতে বলল,
“এই খবর শুনে আমার মুখ দর্শন করতে এসেছ না কি?”
“কথা আছে তোর সাথে। খাওয়া শেষ কর আগে।”
সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তার মুখ থেমে গেল। ভাই কোন বিষয়ে কথা বলবে, তার মন সেটা টের পেয়ে গেছে। মুখের সমুচাটুকু কোনোমতে গিলে নিয়ে আরিন্তা বলল,
“বলো, খেতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
“চা শেষ কর।”
আরিন্তা বাকি সমুচাটুকু একেবারে মুখে পুরে নিল। পেলব বলল,
“এত তাড়াহুড়া করছিস কেন? কথা তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।”
“চা খুব গরম। তোমার কথা বলো, শুনতে-শুনতে খাচ্ছি।”
পেলব একটু সময় নিল। তারপর ধীর গলায় শুধাল,
“ডক্টর নিয়াজকে তো চিনিস, না?”
আরিন্তার বুকের ভেতর ধক করে উঠলেও স্বাভাবিকভাবেই মাথা নেড়ে বলল,
“হুঁ, খালুর চেকআপ করানোর সময় দেখেছিলাম তিনবার।”
“তাকে কেমন মানুষ মনে হয় তোর?”
“আমার সাথে তো কথা হয়নি, দেখা হয়েছে শুধু। বাবার মুখে শুধু প্রশংসা শুনেছিলাম। হয়তো ভালো মানুষ।”
“তোর কাছে কেমন লাগে?”
“আমার কাছে আবার কেমন লাগবে? সবার কাছে যেমন লাগে, তমনই।”
পেলব মায়ের কথার প্রেক্ষিতে আর ইতিউতি না করে সোজা প্রশ্ন করল,
“ডক্টর নিয়াজ যে তোকে পছন্দ করে বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানিস?”
আরিন্তা-ও সোজাসাপ্টা স্বীকার করল,
“হুম।”
“সবাই যে রাজি তা জানিস?”
“হুম।”
“তোর কী মতামত?”
“এখনও আমার অনার্স শেষ হয়নি ভাইয়া। এমন তো কথা ছিল না।”
“সে ব্যাপারে আমি ভেবেছি। তুই বললে আমি আপাতত বিয়ে পরিয়ে রাখার কথা বলব। অনার্স শেষ করেই না হয় শশুরবাড়ি যাবি।”
“তার কী প্রয়োজন? অনার্স শেষ করে একেবারেই না হয় বিয়ে করে শশুরবাড়ি চলে যাব।”
“ততদিন পর্যন্ত কি ডক্টর নিয়াজ বসে থাকবে?”
“কেন বসে থাকবে? তাকেই যে আমার বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই।”
“তা না। এমন পাত্র হাতছাড়া করতে চাইছে না কেউ।”
“আমার এখন বিয়ে করার ইচ্ছা নেই ভাইয়া। তুমি বাবাকে বলে দাও ডক্টর নিয়াজকে ‘না’ বলে দিতে।”
পেলব ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমি তো তোকে এখনই শশুরবাড়ি গিয়ে সংসার করতে বলছি না। বিয়ে করে রাখতে কী সমস্যা তোর?”
“আমার ইচ্ছা নেই।”
“কেন নেই? বাড়িতে থাকলে তো তোর পড়াশোনার কোনোরকম ক্ষতি হবে না। তাহলে আর কী সমস্যা?”
এবারে আরিন্তা কিছুটা বিরক্ত হলো। বলল,
“তোমরা আমাকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলে কেন সবাই?”
“তোকে তাড়াতে চাইছে কে? আশ্চর্য! আমি তো বলছি তুই বাড়িতেই থাকবি। ডক্টর নিয়াজের মতো সবদিক থেকে পারফেক্ট মানুষ কোথায় পাব আমরা তোর জন্য?”
“সবদিক থেকে পারফেক্ট মানুষকেই কেন বিয়ে করতে হবে? ডক্টর নিয়াজ ছাড়া কি দুনিয়ায় ছেলের অভাব? কপালে যে আছে, তাকে এমনিতেই পেয়ে যাবে।”
“উনি নিজে তোকে পছন্দ করেছে। বুঝতে পারছিস না কেন?”
“করুক। উনি পছন্দ করেছে বলেই আমাকে বিয়ে করতে হবে? উনি কি বিশ্বসেরা সুদর্শন পুরুষ?”
“বিশ্বসেরা না হোক, সুদর্শন-ই তো। যথেষ্ট ভালো মানুষ-ও।”
“তোমাকে কি এবার বাবা পটিয়ে তার পক্ষে কথা বলাচ্ছে?”
পেলব মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বলল,
“পক্ষে কথা বলার কী আছে? আমি তো সবসময় তোর ভালো চেয়ে এসেছি। এবারেও ভালো ভেবেই বিয়েতে মত দিতে চাইছি। এই পর্যন্ত ডক্টর নিয়াজের মতো অন্য কোনো পাত্রকে আমার এত পছন্দ হয়নি।”
“তাহলে এক কাজ করো, তুমিই বিয়ে করে নাও।”
“ফাজলামি করিস না আরি। এত অবুঝ হলে চলে না। জীবনের কথাও ভাবতে হয়?”
“তোমার কি ধারণা আমার জীবন শেষ হওয়ার পথে?”
“এটা কোন ধরনের কথা?”
“সোজা ধরনের কথা বলছি, তা-ও তো তোমার ভালো লাগছে না। আর কী বলব?”
“বিয়ে তো এক সময় করতেই হবে।”
“যখন করতে হবে তখন করব।”
“তাহলে এখন সবার পছন্দে করলে কী সমস্যা?”
“অনেক সমস্যা।”
“ডক্টর নিয়াজকে কি তোর পছন্দ না?”
“অপছন্দের কারণ নেই।”
“তাহলে কি তোর নিজের কোনো পছন্দ আছে?”
আরিন্তা ঝুপ করে থেমে গেল। মুখে ভর করল এক ঝাঁক দুশ্চিন্তা। ডক্টর নিয়াজকে পেলবের এত পছন্দ হয়েছে মানে সে সত্যি-সত্যিই বিয়েতে রাজি। এজন্যই বোনকে রাজি করাতে লেগেছে। আরিন্তা অতি দ্রুত ভাবছে এবার সে কী বলবে। মিশকাতের কথাটা বলে দিবে? পেলব তো সবসময় তার ভরসার জায়গা। মিশকাতের কথাটা বুঝিয়ে বললে কি সে বুঝবে? মিশকাতের সঙ্গে তো তার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। হয়তো মানতে পারে। কিন্তু যদি না মানে? যদি কোনো ঝামেলা হয়? চিন্তায় আরিন্তার এলোমেলো লাগছে। গুছিয়ে রাখা কথাগুলো সে খুঁজে পাচ্ছে না। ঠিকঠাক কোনো কথা তার মাথাতেই আসছে না। তার চিন্তিত মুখ লক্ষ্য করে পেলবের টনক নড়ল। সে দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোর পছন্দের কেউ আছে না কি?”
আরিন্তা এবারেও চুপ রইল। পেলব ভরসা জুগিয়ে বলল,
“থাকলে বলে দে। আমি না হয় খোঁজ নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলব। সমস্যা নেই তো।”
আরিন্তা অসহায় মুখ তুলে বলল,
“ভাইয়া, আমার অনেক চিন্তা হচ্ছে।”
“কিসের চিন্তা?”
“বাবা আমার ওপর চটে যায় কি না।”
পেলবের বুঝতে আর বাকি রইল না সত্যিই আরিন্তার পছন্দের মানুষ আছে। অথচ এতদিন সে জানত আরিন্তার এমন কেউই নেই। বিয়ে করলে সে পরিবারের পছন্দেই করবে। সেজন্যই ডক্টর নিয়াজের প্রতি সে এতটা আগ্রহ দেখিয়েছে। পেলব শুধাল,
“ছেলে কে? নাম কী?”
আরিন্তা চোখ নামিয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,
“মিশকাত খাঁন।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৫.
আরিন্তার মুখে মিশকাতের নাম শোনার পর পেলব কয়েক মুহূর্তের জন্য পাথুরে মূর্তি বনে গেল। যেন সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে ভুলে গেল তার কী বলা উচিত, কেমন রিয়্যাক্ট করা উচিত। আরিন্তার নত মুখ দেখে সে নিশ্চিত হলো সে সত্যি বলছে। সত্যিই মিশকাত তার পছন্দের মানুষ। পেলব মনে-মনে উত্তেজিত হয়ে উঠলেও প্রথমেই সে নিজের উত্তেজনা মুখে প্রকাশ করল না। রয়েসয়ে আরিন্তার কাছে গিয়ে বলল,
“মিশু তোর পছন্দের মানুষ?”
আরিন্তা ধীর গতিতে মাথা ঝাঁকাল। পরপরই পেলবের জেরা শুরু হলো,
“ও জানে?”
এবারেও আরিন্তা মাথা ঝাঁকাল।
“ও তোকে পছন্দ করে?”
এবারেও যখন আরিন্তা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল, পেলব সন্দিহান কন্ঠে শুধাল,
“তাহলে কি তোদের মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে?”
আরিন্তা পূর্বের ন্যায় মাথা ঝাঁকাল। পেলব জানতে চাইল,
“কত দিনের সম্পর্ক?”
আরিন্তা নত মস্তকে নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
“চার বছর।”
পেলব অবাক হয়ে বলল,
“চার বছর মানে! কীভাবে কী হলো খুলে বল তো।”
আরিন্তা একবার দ্বিধান্বিত চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকাল। পেলবের মুখে কেবল বিস্ময় ছাড়া মনের অবস্থাটা সে ধরতে সক্ষম হলো না। পেলব বলল,
“বল, এমন একটা খবর বলেই যখন ফেলেছিস, তখন তো সবটা আমার জানা দরকার।”
আরিন্তা প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল। লজ্জা, ভয় দুটোই তাকে জাপটে ধরেছে। তবু শেষমেশ পেলবের ভরসায় একে-একে সে মিশকাতের সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রথম থেকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। পেলব শান্ত মুখে সমস্তটাই শুনল। মাঝে দুই-একটা প্রশ্ন ছাড়া কোনোরকম বাঁধা-ও দিলো না। তার বিস্ময়ের মাত্রা যেন প্রতি মুহূর্তে বেড়েই চলল। নিজের কথা শেষ করে আরিন্তা ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তার উত্তর জানার আশায়। এবারেও পেলবের মুখে গভীর চিন্তা ছাড়া কিছুই সে খুঁজে পেল না। অধৈর্য হয়ে নিজেই শুধাল,
“ভাইয়া, তোমার কিছু বলার নেই?”
পেলব মাথা দুলিয়ে বলল,
“বলার তো আছে অনেক কথাই। আচ্ছা, তুই বলছিস তোদের সম্পর্কের কথা এই পাঁচ বছরেও কেউ জানে না? মানে তোর কোনো বন্ধু-বান্ধবও না?”
“না। এই প্রথম তুমি জানলে।”
“বুঝলাম। মিশু তাহলে তোর সাথে যোগাযোগ করার জন্যই ফোন পাঠিয়েছে?”
“হুঁ।”
“আচ্ছা, থাক তাহলে। আমি যাই।”
পেলব চলে যাচ্ছে শুনে আরিন্তা লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অসহায় মুখে বলল,
“ভাইয়া, তুমি কিছু তো বলো। কী করবে এখন তুমি?”
পেলব বলল,
”দেখি কী করতে পারি।”
“আমি বিয়ে করতে পারব না। প্লিজ তুমি সবাইকে আটকাও।”
“বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে দেখি।”
আরিন্তা চমকে উঠে বলল,
“তুমি কি বাবাকে বলে দিবে?”
পেলব সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা আরিন্তার ফোনটা তুলে পকেটে পুরে নিল। দরজার দিকে পা বাড়াতেই আরিন্তা ছুটে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে বলল,
“তুমি ফোন নিচ্ছ কেন?”
“দরকার আছে।”
“তুমি কী করতে চলেছ ভাইয়া, সত্যি করে বলো তো।”
কথাটা বলেই আরিন্তা মুখ ফুলিয়ে কেঁদে ফেলল। পেলব নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“রুমে থাক আপাতত। ডাকলে বেরোবি।”
“তুমি ঝামেলা করবে না তো? দয়া করে তুমি আমাকে একটু বুঝো ভাইয়া। আমি এখন শুধু তোমার ভরসায় আছি। মিশু ভাই বিয়ের ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না। ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। উনি সবসময় আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। তুমি আমার অনুরোধটুকু রাখো।”
পেলব আরিন্তার ভেজা চোখের দিকেও তাকাল না।। কোনোরকম প্রত্যুত্তর ছাড়াই দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কান্নারত আরিন্তা অসহায়ের মতো দরজার কাছে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে। সে জানে না সামনে কী হতে চলেছে।
পেলব নিচে যাওয়ার পর আর কোনোরকম সাড়াশব্দ পায়নি আরিন্তা। বিচলিত ভঙ্গিতে সে একবার দরজার কাছে যাচ্ছে, বসছে, উঠছে, সারা রুম পায়চারি করছে। বাবার এখনও বাড়ি ফেরার সময় হয়নি। একবার ভাবছে নিচে যাবে। কিন্তু পেলব যে বলল আপাতত ঘরে থাকতে। এত দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে বসেও তো থাকা যাচ্ছে না। মা-ও একবার আসছে না। রাতে মিশকাতের ফোন করার কথা। সে ফোন ঠিকই করবে, কিন্তু আরিন্তাকে পাবে না। আচ্ছা, পেলব ফোন রিসিভ করবে না তো? পেলব তার ফোন নিয়ে কী করছে, তা-ও সে জানে না। ফোন ধরার মতো অন্য কেউ না থাকায় নিরাপত্তা অবলম্বন করে ফোনে কোনো লক-ও রাখেনি সে। পেলব সহজেই ফোনের সবটা ঘেঁটে দেখতে পারবে। তার গ্যালারি ভর্তি মিশকাতের ছবি। মিশকাত একেকটা মুহূর্তের ছবি পাঠাতে-পাঠাতে তার গ্যালারি ভর্তি করে ফেলেছে। নিজের চেয়ে মিশকাতের ছবিই বেশি তার কাছে। মিশকাতের সঙ্গে তোলা তার আগের ছবিগুলোও আছে। সম্পর্ক থাকাকালীন ছবি তোলা বড়ো বিষয় নয়, বিষয়টা হচ্ছে পেলব তাদের ম্যাসেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে কি না। বড়ো ভাই নিজের বন্ধুসম ভাইয়ের সাথে ছোটো বোনের প্রেমালাপ পড়বে, এটা নিশ্চয়ই সুন্দর বিষয় নয়। পেলবের তেমন কিছুই না বলে ফোনটা নিয়ে যাওয়ার কারণ উদ্ধার করতে গিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যাচ্ছে আরিন্তার। পেলবের হাবভাব বোঝার উপায় নেই।
অনেকদিন পর আজ আবার মায়ের ফোনের প্রয়োজন বোধ করছে আরিন্তা। মায়ের ফোনটা হাতে পেলে মিশকাতকে ম্যাসেজ করা যেত। এভাবেই তার সময় কা’টল। এক ঘন্টা, দু্ই ঘন্টা। তারপর যখন পুলক তালুকদার এলেন, তখন রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ল। আরিন্তার বুকের ভেতর কাঁপছে। খাবার টেবিলে পেলব ওই প্রসঙ্গ তুলবে না তো? ভয়ে-ভয়ে সে নিচে গিয়ে দেখল ইতোমধ্যে সবাই খেতে বসে পড়েছে। আরিন্তা একবার ভাবল খাবে না বলে চলে যাবে। কিন্তু পুলক তালুকদার তাকে ডেকে আদুরে গলায় বললেন,
“আরি মা, খেতে বসো। এতক্ষণ লাগে আসতে?”
আরিন্তা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশের চেয়ারে বসল। তার খাবার বেড়ে রাখা ছিল। হাত ধুয়ে খাবারে হাত দিতেই পুলক তালুকদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“তোমার কি শরীর খারাপ মা? মুখটা অমন লাগছে কেন?”
আরিন্তা মিনমিনে কন্ঠে বলল,
“না, এমনি।”
“ঘুম আসছে? তোমারা এ যুগের ছেলে-মেয়েরা রাত জেগেই স্বাস্থ্য খারাপ করো। এসব ভালো না। কদিন ঠিকমতো ঘুমাও, স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে যাবে।”
আরিন্তা পেলবের দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝার চেষ্টা করছে পেলবের মতিগতি। অথচ পেলব নিশ্চিন্ত মনে চুপচাপ খাচ্ছে। আরিন্তার দিকে তাকাচ্ছে-ও না। ওদিকে পুলক তালুকদার আজ মেয়ের সাথে গল্প জমাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। একের পর এক প্রশ্ন করছেন, উপদেশ দিচ্ছেন। আরিন্তার কিছু লাগবে কি না, সে কোথাও বেড়াতে যেতে চায় কি না, খুব আগ্রহের সাথে তা-ও জানতে চাইছেন। আরিন্তা ঠিকই বুঝতে পারছে বাবার মনোভাব। বিয়ের আগে মেয়ের সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করে তাকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টায় লেগেছেন তিনি। কিন্তু বাবার চেষ্টা দেখে আরিন্তার আনন্দের বদলে দুঃখ হচ্ছে। আসন্ন বিপদ যে কতটা ভয়ানক হবে, তা নির্ভর করছে পেলবের ওপর। কারণ আরিন্তা যদি বাড়িতে কাউকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়ে থাকে, সে একমাত্র তার বাবা। পুলক তালুকদার একবার রাগলে বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেলেন। তার ওপর এসব প্রসঙ্গ কানে গেলে কী করবেন তা কল্পনা করেই আরিন্তার মাথা ঘুরে যাচ্ছে।
রোজকার মতো আজ আর তৃপ্তি করে খাওয়া হলো না আরিন্তার। প্লেটের খাবার ফুরাল না। কোনোমতে খাওয়া শেষ করেই সে উঠে ধীর পায়ে চলে গেল মা-বাবার ঘরে। মায়ের ফোনের খোঁজ করল। কিন্তু কোথাও পেল না। তারপর চলে গেল দাদির ঘরে। বৃদ্ধা খায়রুন নেসা ঘুমিয়ে পড়েছেন অনেক আগেই। একা-একা দাদির ঘরে ভালো লাগল না আরিন্তার। তবু দাঁড়িয়ে রইল। বাবা আর ভাই খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেই মায়ের কাছ থেকে ফোনটা চেয়ে নিবে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কান-ও সজাগ রাখল। পেলব ওই প্রসঙ্গে কথা তোলে কি না শোনার জন্য। কিন্তু পেলব এখনও চুপচাপ আছে। পুলক তালুকদার ডক্টর নিয়াজের বিষয়ে কথা বলছেন। তারা বেশি দেরী করতে চাইছেন না। সবার মতামত থাকলে দ্রুতই পাকা কথা সেরে ফেলতে চান। বাবার গল্প যেন থামছেই না। এদিকে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকে আরিন্তার পা ধরে আসছে। পুলক তালুকদারের আগেই পেলব টেবিল ছাড়ল। পুলক তালুকদার উঠলেন আরও পরে। অবশেষে মেরিনা যখন টেবিলের থালা-বাসন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তখন আরিন্তা দাদির ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মেরিনা তাকে দেখে বললেন,
“কী-রে? কিছু লাগবে?”
আরিন্তা মাথা দুলিয়ে বলল,
“তোমার ফোনটা কোথায় মা?”
“আমার ফোন দিয়ে এখন আর কাজ কী তোর?”
“দরকার ছিল একটু।”
“তোর ফোনের কী হয়েছে?”
“আমার ফোনে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই তোমারটা দরকার ছিল একটু।”
মেরিনা বললেন,
“ভাই-বোনের একসঙ্গে ফোনে সমস্যা দেখা দেওয়ার কারণ কী?”
“ভাইয়ার ফোনে সমস্যা?”
“হ্যাঁ, তা-ই তো বলল। খাওয়ার আগে আমার ফোন চেয়ে নিয়ে গেল। বলল ওর ফোনে সমস্যা হয়েছে, তাই আমারটা দিয়ে চলবে আপাতত।”
আরিন্তার মুখটা কালো হয়ে গেল। সে ঠিকই বুঝতে পারছে পেলব ইচ্ছা করে এই কাজটা করেছে, যাতে সে মায়ের ফোন ব্যবহার করতে না পারে। চুপসানো মুখে সে নিজের ঘরে ফিরে গেল। হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। এতক্ষন নিশ্চয়ই মিশকাত কয়েকবার ফোন করে ফেলেছে, ফোনে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে ম্যাসেজ-ও করেছে। কিন্তু এখন আর তার করার কিছুই নেই। আপাতত ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। দেখতে হবে সে কী করে বা কী বলে। তার আগে কোনো কিছুই ভাবা যাবে না। আজকের রাতটা তার দুশ্চিন্তা আর বিরহেই কা’টাতে হবে।
আরিন্তার ফোনে লাগাতার ম্যাসেজ করেছে মিশকাত। হোয়াটসঅ্যাপে তাকে না পেয়ে কন্টাক্ট নাম্বারে কল করেছে। কিন্তু বারবারই ফোন বন্ধ পাচ্ছে। আরিন্তার ফোন চার্জের অভাবে বন্ধ পড়ে থাকবে, এমনটা কখনোই হয় না। মিশকাতের সঙ্গে কথা বলার জন্য সে প্রতিদিন আগেভাগেই ফোন চার্জ দিয়ে রাখে। মিশকাত বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এত রাতে খালার ফোনে কল করাটাও ঠিক মনে হচ্ছে না। ভেবেচিন্তে সে পেলবকে কল করল। পেলব হয়তো তার ফোনকলের জন্য প্রস্তুত ছিল। রিসিভ করে স্বাভাবিকভাবেই সে আলাপ শুরু করল। মিশকাত পেলবকে বলল,
“তোর জন্য তো এখনও কিছু পাঠানো হলো না। এবার ভেবেছি তোর জন্য কিছু পাঠাব। তোর কী লাগবে বল।”
“আমার আপাতত কিছুই লাগবে না।”
“তাহলে কী পাঠাব?”
“কিছুই পাঠানোর দরকার নেই এখন। যখন লাগবে চেয়ে নেব তোর থেকে।”
মিশকাত হেসে বলল,
“তুই চেয়ে নিতে-নিতে আমার ফেরার সময়-ও হয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
“আরে নাহ্, তার আগেই চাইব। আমি নিলে ছোটো জিনিস নেব না কি? বড়োসড়ো কিছুর জন্য প্রস্তুতি নে। ততদিন পর্যন্ত বেশি-বেশি উপার্জন কর।”
“আচ্ছা, নিস তবে। বাড়ির সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
খালা-খালুর খোঁজ নেওয়ার পর মিশকাত প্রশ্ন করল,
“আরির কী খবর?”
পেলব পালটা প্রশ্ন করল,
“ভালোই। তোর সাথে কথা হয় না?”
“হয়। আজ ফোন করেছিলাম, বন্ধ পেয়েছি।”
“ওহ্! ওর ফোনে কী যেন সমস্যা হয়েছে শুনলাম।”
মিশকাতের কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তিত মুখে শুধাল,
“কী সমস্যা হয়েছে?”
“জানি না।”
“ওহ্ আচ্ছা। ঠিক করে দিস।”
মুখে মিশকাত স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও তার মনটা এখন একদমই ভালো লাগছে না। আরিন্তার নিজের ফোনে সমস্যা হলে মায়ের ফোন দিয়ে যোগাযোগ করল না কেন মেয়েটা? সে জানে না মিশকাত সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকে তার সঙ্গে এক দণ্ড কথা বলার জন্য? এই যে আজ সে কাজের ব্যস্ততার মাঝেও মনে-মনে অপেক্ষা করেছে কখন মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারবে, অথচ তার কোনো খবরই নেই। চাইলেও এখন মিশকাত পারবে না তার সাথে কথা বলতে। আরিন্তা তো এত বেখেয়ালি মেয়ে না। সে নিজেও মিশকাতের সঙ্গে কথা না বলে শান্তি পায় না। তবে মায়ের ফোন দিয়ে ফোন বা ম্যাসেজ করল না কেন? নিজের ফোনের সমস্যার কথাটা তো অন্তত জানাতে পারত।
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।