#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১২.
মিশকাত তখনই সুবর্ণাকে ফোন করে বলল রেডি হয়ে থাকতে। যাওয়ার সময় তাকে নিয়ে যাবে। পেলবকে-ও সাথে যাওয়ার জন্য বলল, কিন্তু পেলবের না কি কাজ আছে। আগামীকাল মিশকাতের সাথে ঢাকা যাবে, তাই কাজ সেরে রাখতে চায়। আরিন্তাকে বলার সঙ্গে-সঙ্গেই সে রেডি হতে ছুটেছে। আরিন্তাকে সাথে নিয়ে মিশকাত একটা অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিকাল চারটায়। মাঝপথে সুবর্ণা দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে নিয়ে সোজা চলে গেল নতুন একটা রেস্ট্রন্টে। নতুন এই রেস্ট্রন্টে এর আগেও একবার আরিন্তা আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আসা হয়নি। এখানে ঘুরাঘুরি, ছবি তোলার জন্যও সুন্দর জায়গা আছে। সুবর্ণা এসেই মিশকাতের ফোন কেড়ে নিয়ে ছবি তুলতে লেগে পড়েছে। এই ফাঁকে মিশকাত আরিন্তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিচু স্বরে ডাকল,
“এই পোনি, চুপ আছিস কেন?”
আরিন্তা মিশকাতের দিকে তাকিয়ে বলল
“তুমি কি চাইছো আমি গলা ফাটিয়ে গান করি এখানে?”
“তোর গান শুনতে চেয়েছে কে? তারপর রেস্ট্রন্টের সব কাস্টমার ভয়ে পালিয়ে গেলে কতৃপক্ষ আমাকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।”
আরিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি শুনালে তো।”
মিশকাত বলল,
“আজ শেষ ঝগড়া করে রাখ। কাল তো চলেই যাচ্ছি।”
আরিন্তা ক্ষণকালের জন্য চুপ রইল। কী ভেবে আবার বলল,
“শেষ মানে কী বুঝাতে চাইছো? যখন ফিরবে তখন আবার নতুন করে ঝগড়া করব। ওহ্! তুমি যা মানুষ! ফোনেও না আবার ঝগড়া করো আমার সাথে।”
মিশকাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“ঝগড়া আমি করি, না তুই করিস?”
“তুমি করো। আমি উত্তর দিতে গিয়ে ফেঁসে যাই।”
“জাতি জানে কে কেমন।”
আরিন্তা আবারো মুখ বাঁকাল। মিশকাত আবার কোমল গলায় ডাকল,
“আরি?”
আরিন্তা কড়া গলায় বলল,
“একদম দুঃখী-দুঃখী কথা বলবে না আজ। গত দুমাসে তোমার দুঃখী-দুঃখী কথা শুনে-শুনে আমার সব মুখস্থ হয়ে গেছে। কাল চলে যাবে, আজ মনখুলে ভালো কথা বলো।”
“কী করব? তুই তো আমাকে কোনো দুঃখী কথা শুনাচ্ছিসই না।”
“তোমার মতো আমার এত দুঃখ নেই।”
“তাই?”
“কোনো সন্দেহ আছে?”
“কাল থেকে চাইলেও আমাকে আর সামনে পাবি না, এটা ভেবে আফসোস-ও হয় না?”
আরিন্তা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“না। তোমার মতো আমি বুড়ো বয়সে অত আবেগে গলে পড়তে পারব না। কারণ আমি জানি আমি তোমায় আবার ফিরে পাব।”
“আর যদি আল্লাহ্ আমার কপালে আর দেশে ফেরা না লেখে?”
আরিন্তা অসহায় চাহনিতে মিশকাতের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই মিশকাতের আস্তিন চেপে ধরে বলল,
“তুমি কেন চাইছো আমি কাঁদি? বুঝতে পারছো না আমি কাঁদতে চাই না?”
“কারণ আমি যাওয়ার আগে তোর চোখে-ও আমাকে হারানোর ভয় দেখে যেতে চাই।”
“আমার এ ভয় নেই মিশু ভাই। যা আছে, তা শুধুই বিশ্বাস। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আমরা আবার এক হব, হবই।”
এমন সময় তারা সুবর্ণার চোখে পড়ে গেল। আরিন্তাকে মিশকাতের আস্তিন চেপে ধরে কথা বলতে দেখে সুবর্ণা এগিয়ে আসতে-আসতে সন্দিহান কন্ঠে শুধাল,
“একি! তোমরা কি আজ-ও ঝগড়া করছো?”
আরিন্তা চট করে মিশকাতের আস্তিন ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তোর ভাই ঝগড়াটে হলে আমি কী করব?”
মিশকাত শ্লেষের সুরে বলল,
“অ্যাহ্! ভালো মানুষগুলো।”
সুবর্ণা মিশকাতের হাতে ফোন ফেরত দিয়ে বলল,
“আপুর আর আমার ছবি তুলে দাও।”
আরিন্তা আর সুবর্ণার ছবি তুলে দিয়ে মিশকাত নিজেও ওদের সাথে কয়েকটা ছবি তুলল। এরমধ্যে তাদের অর্ডারকৃত খাবার চলে এলে খেতে বসে পড়ল। কিন্তু সবসময়ের মতো আজ আর আরিন্তার মাঝে খাবার নিয়ে সেই পা’গলামি দেখা গেল না। তার যেন আজ অরুচি ধরে গেছে। কোনো খাবারই ঠিকমতো খেতে পারছে না। জোর করে খেতে চাইলে গলায় আটকে যাচ্ছে। সবটাই মিশকাতের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এরপর আরিন্তার জন্য সে লেমন জুস-ও অর্ডার করেছে। সুবর্ণা চিন্তিত মুখে বারবার বলে চলেছে,
“তোমার আজ কী হলো আপু? কিছুই খেতে পারছো না। মনে হয় তোমার রুচিতে সমস্যা হয়েছে।”
মিশকাত কেবল বলল,
“জোর করে খাওয়ার দরকার নেই। যতটুকু খেতে পারবি, ততটুকুই খা।”
কিন্তু শেষমেষ আরিন্তার আর পেটভরে খাওয়া হয়নি। রেস্ট্রন্ট থেকে বেরিয়ে মিশকাত বলল,
“তোদের কিছু লাগবে? তাহলে চল কিনে দিই।”
সুবর্ণা সুযোগ পেয়ে বলে উঠল,
“আজ তুমি নিজের ইচ্ছায় যা কিনে দাও।”
মিশকাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আরিন্তার দিকে তাকাল। আরিন্তা বলল,
“আমি গত সপ্তাহে কেনাকা’টা করেছি। এখন আর কিছু লাগবে না।”
মিশকাত তাদের নিয়ে গেল পরিচিত এক মার্কেটে। সুবর্ণাকে তার পছন্দের সুন্দর একটা ড্রেস কিনে দিলো। আরিন্তাকে দিতে চাইলেও সে নিতে রাজি হলো না। সুবর্ণা বলল,
“আপু ড্রেস না নিলে তাকে অন্যকিছু কিনে দাও।”
আরিন্তা বলল,
“আমার কিছুই লাগবে না বলছি তো।”
মিশকাত বলল,
“তোর না লাগলে তুই সাজিয়ে রেখে দিস। আয়, অন্য দোকানে যাই।”
মিশকাত নিজেই আগে-আগে চলে গেল অন্য দোকানে। দোকানে ঢুকে সে সারা দোকানে চোখ বুলিয়ে ভাবল কী কিনবে আরিন্তার জন্য। মেয়েটার মনের অবস্থা সে ঠিকই টের পাচ্ছে। তবু সে এমন ভাব করছে, যেন মিশকাত কোনোভাবেই তার মনের অবস্থা টের না পায়। সুবর্ণা-ও মিশকাতের সাথে একেকটা জিনিস দেখছে। শেষে সুবর্ণা-ই পরামর্শ দিলো আরিন্তাকে একটা হ্যান্ড ব্যাগ কিনে দিতে। মিশকাত নিজে পছন্দ করে একটা হ্যান্ড ব্যাগ কিনে দিলো। আরিন্তা চুপচাপ তা-ই নিয়ে নিল।
ফ্লাইটের একদিন আগেই মিশকাত বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা চলে এসেছিল। তার সাথে এসেছে পুলক চৌধুরী, পেলব, আরিন্তা আর সুবর্ণা। আরিন্তা, সুবর্ণার আসার কথা ছিল না। কিন্তু আসার আগে হঠাৎ করেই আরিন্তা তার বাবার কাছে বায়না ধরে সে-ও সাথে যেতে চায়। সাথে নেয় সুবর্ণাকে। দুজনের বায়না ফেলতে পারেননি পুলক তালুকদার। শেষমেষ সাথে নিয়ে এসেছেন। ঢাকায় এসে তারা ওঠে আরিন্তার চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। সময় নিয়ে দুই বোনকে নিয়ে ঘুরেফিরে মিশকাতকে কিছু কেনাকা’টা-ও করে দিয়েছে পেলব। ফ্লাইটের দিন মিশকাত যখন রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন চুপিচুপি আরিন্তা এসে দাঁড়ায় তার দরজায়। মিশকাতকে ডাকতেই সে এক লাফে উঠে বসে পড়ে। আরিন্তা ভেতরে ঢুকে এগিয়ে যায় তার কাছে। তার হাতে ছোটো একটা বক্স। বক্সটা মিশকাতের হাতে তুলে দিয়ে সে বলল,
“এটা তোমার।”
মিশকাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলল,
“পোনি দেখছি চালাকি শিখেছে।”
“চালাকির কী করলাম? খুলে দেখো তো।”
মিশকাত বক্স খুলল। বেশ সুন্দর একটা ঘড়ি। দামটা-ও সুন্দর-ই বলা চলে। মিশকাত ঘড়িটা দেখতে-দেখতে প্রশ্ন করল,
“এই অকাজ কখন করলি?”
আরিন্তা মিশকাতের হাত থেকে ঘড়িটা নিয়ে নিল। তারপর সেটা মিশকাতের হাতে পরিয়ে দিতে-দিতে বলল,
“বাড়ি থাকতেই কিনে রেখেছিলাম। সাথে নিয়ে যেয়ো এটা।”
মিশকাত নিজের ঘড়ি পরা হাতটা বারবার উলটে-পালটে দেখছে। ছোটোবেলায় ইদের মেলায় গিয়ে বাবা নতুন ঘড়ি কিনে দিলে যেমন আনন্দ হত, মিশকাতের মনে মনে হচ্ছে বহু বছর পর তার তেমন আনন্দ অনুভব হচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কারণ সে এখন অনেক বড়ো হয়েছে। আরিন্তা বলল,
“মিস্টার পোল্ট্রি, ওখানে গিয়ে নিজের যত্ন না নিলে আপনার একদিন কী আমার যতদিন লাগে।”
“পাবি কোথায় তুই আমাকে?”
“ফোনে তো পাব। আর শোনো, একদম বিদেশি সাদা চামড়ার মেয়েদের দিকে তাকাবে না।”
“তাহলে কি চোখ বন্ধ করে রাখব?”
আরিন্তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ওসব মেয়েদের দেখলে দরকার পড়লে চোখ বন্ধ করেই রাখবে। ওদের স্বভাব ভালো না। তোমাকে ফাঁসিয়ে দিলে?”
আরিন্তার বাচ্চামি কথায় মিশকাত হেসে ফেলল। আরিন্তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল,
“নজর টিকা দিয়ে দে তবে।”
আরিন্তা থু-থু দেওয়া ধরতেই মিশকাত দ্রুত মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“পোনির বাচ্চা, এক মাস তোকে ফোন করব না, তখন শাস্তিটা পাবি।”
আরিন্তা তোয়াক্কা না করে বলল,
“পারলে কোরো না।”
“করবই না, দেখিস তুই।”
“ঠিক আছে, দেখার জন্য আমি চোখ মেলে রাখব চব্বিশ ঘন্টা। এখন ঘুম দাও চুপ করে।”
মিশকাতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরিন্তা রুম থেকে চলে গেল। মিশকাত নীরব চোখে খোলা দরজায় তাকিয়ে রইল। বুক চিরে বেরিয়ে এল ধারালো দীর্ঘশ্বাস। এই অবধি কত আবেগী কথা বলেই না মেয়েটার লুকানো ব্যথাটা প্রকাশের চেষ্টা করেছে সে! অথচ মেয়েটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। মিশকাতের ধারণা তাকে শক্ত রাখার জন্যই আরিন্তার এমন শক্ত আচরণ। কিন্তু নিয়মটা ভাঙল মিশকাতের বিদায়বেলা। তার ফ্লাইট রাত নয়টায়। এয়ারপোর্টে তার সাথে সবাই গেছে বিদায় জানাতে। বিদায়বেলা যখন সুবর্ণা মিশকাতকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদল, তখন-ও আরিন্তা পাথুরে মূর্তির মতো নীরব চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর যখন মিশকাত তার কাছে এল, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল, আরিন্তা কথা খুঁজে পেল না। খুব চেষ্টা করল শেষবেলায় একবার ‘পোল্ট্রি’ ডেকে মিশকাতকে খেপিয়ে দিতে। কিন্তু মুখ দিয়ে কেন জানি টু শব্দটি বেরোলো না। তারপর যখন মিশকাতের ডান হাতটা তার মাথায় পড়ল, তখনই যেন আরিন্তার সমস্ত মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। শান্ত সমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ের মতোই আরিন্তা মিশকাতের বুকে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এমন মুহূর্তে আরিন্তার পাথুরে স্বভাবটা যেন মিশকাতকে পেয়ে বসল। সে তো চেয়েছিল যাওয়ার আগে আরিন্তার চোখে তাকে হারানোর ভয় দেখতে। এখন যখন মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরে অসহায়ের মতো কাঁদছে, তখন কেন তার এত কষ্ট হচ্ছে? আরিন্তা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ফিরে এসো মিশু ভাই। তোমার পোনি অপেক্ষায় থাকবে।”
মিশকাত ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। আরিন্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেও ফিসফিস করে বলল,
“আসব। ভালোবাসি তো। বউ ঘরে তুলতে হবে না?”
“মিশু ভাই?”
“হু?”
“আমিও ভালোবাসি।”
আরিন্তা মিশকাতের বুক থেকে সরে এল। দুহাতে চোখের পানি মুছে শেষবার হাসতে চেষ্টা করল। মিশকাতকে এই হাসিটা দেখানো যেন তার জন্য এ মুহূর্তে বাধ্যতামূলক। দুটো মানুষের ভেতরের উত্তাল ঢেউয়ের শব্দ কেউ শুনতে পেল না। কেউ বুঝল না তাদের চোখের ভাষা, টের পেল না তাদের একে অপরকে হারানোর ভয়। সবাই ভেবে নিল মিশকাত চিরকাল আরিন্তাকে বোনের মতো ভালোবেসেছে বলেই বিদায়বেলায় তাদের এত দুঃখ। পেলব এগিয়ে এল বোনকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু এ ব্যথার কি কোনো সান্ত্বনা হয়? মিশকাত চোখের আড়াল হওয়ার সময়-ও একবার পিছু ফিরে চাইল। সুবর্ণাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আরিন্তার ছলছল চোখ জোড়া-ও তখন তার দিকেই আটকে। আরিন্তার মন চাইল এই মুহূর্তটা এখানেই আটকে থাকুক। ওই তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া এভাবেই তার চোখে চেয়ে থাকুক। কোনো দূরত্ব না পারুক এ দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। মিশকাতের বুকের ভেতর তখন নীরব ঝড়। গত দুমাস ধরে আরিন্তা তাকে যত বুঝ দিয়েছে, সব যেন এক নিমেষে লন্ডভন্ড হয়ে কোথাও হারিয়ে গেল। মিশকাতের কেবল মনে হলো এ দূরত্ব গোটা কয়েক দিনের নয়। এ দূরত্ব এত সহজে কমার নয়। দিনকে দিন বাড়তে-বাড়তে এ দূরত্বই হয়তো একদিন ক্ষুধার্ত বা’ঘের মতো গ্রা’স করে নিবে তার একমাত্র ভালোবাসার সমস্ত অস্তিত্ব। হতে পারে এ দূরত্ব ক্ষণিকের। হতে পারে এ দেখা শেষ দেখা। হতে পারে কোনো এক শুভলগ্নে আবারও চোখে চোখে হবে কথা। হতে পারে এ তৃষ্ণার্ত চোখ একটিবার তাকে দেখার তৃষ্ণায় ধুঁকে ম’রবে চিরকাল। ইশ্! অনিশ্চয়তারা-ও এত ভ’য়ঙ্ক’র হয়!
মিশকাতের কানের কাছে বারংবার ঝংকার তুলে চলল আরিন্তার বলা শেষ বাক্যটা, ‘আমিও ভালোবাসি।’
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৩.
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে আরিন্তা। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে সে। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো ধরতেই টেবিলে রাখা ফোনে ভিডিয়ো কলে বসে থাকা মানুষটা বলে উঠল,
“এই পোনি, তোকে এই গাঢ় রংয়ের লিপস্টিক পরতে বারণ করেছি না? রাখ ওটা।”
আরিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি এটাই পরব। তোমার কী? তুমি তো আর দেখবে না।”
“এজন্য তোর উচিত আমি ফেরার আগ পর্যন্ত লিপস্টিকের সাথে ব্রেকআপ করা। এত সাজগোজ আমি ছাড়া অন্য ছেলেদের কেন দেখাবি?”
“ছেলেদের দেখানোর জন্য কেন সাজব? আমার সাজতে ভালো লাগে, আমি সাজব। তোমার হিং’সা হলে তুমি চোখ বন্ধ করে রাখো।”
আরিন্তা ঠোঁটে লিপস্টিক পরতে শুরু করল। মিশকাত হতাশ কন্ঠে বলল,
“তোকে যে আমি কবে সোজা করতে পারব রে পোনি!”
“আমি সোজাই আছি মিস্টার পোল্ট্রি। আপনার মনে যত প্যাঁচ।”
“পোনি রে, তোকে সামনে পেলে আমি-”
আরিন্তা তাকে থামিয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“সামনে পাবে-ও না তুমি।”
“একদিন তো সামনে পাব। সেদিন সব শোধ তুলব।”
আরিন্তা হাসতে-হাসতে বলল,
“সেদিন তো তুমি আমাকে দেখেই কূল পাবে না।”
মিশকাত একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“তা ভুল বলিসনি। কতদিন তোকে দেখি না পোনি! ভীষণ ইচ্ছা হয় একবার কাছ থেকে দেখতে।”
আরিন্তা তাড়া দেখিয়ে বলল,
“এই, এখন একদম দুঃখী-দুঃখী ভাব আনবে না। আমি এখন বেরোব। দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার।”
মিশকাত বলল,
“তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি।”
“পরে শুনব, ভার্সিটি থেকে ফিরে।”
“রিমা সুন্দরী আমাকে আবার ম্যাসেজ করা শুরু করেছে।”
আরিন্তার মুখোভাব সন্দিহান হয়ে উঠল। চোখে-মুখে দারুণ আগ্রহ নিয়ে সে বলে উঠল,
“কবে, কখন, কী বলল?”
মিশকাত মজা পেয়ে বলল,
“তোর দেরী হয়ে যাচ্ছে না? তাড়াতাড়ি বেরো। ভার্সিটি থেকে ফিরেই শুনিস।”
আরিন্তা মাথা দুলিয়ে বলল,
“না, বেশি দেরী হবে না। তুমি বলো, আমি এখনই শুনব।”
“ওমা! এইমাত্রই না তাড়া দেখালি?”
“উফ্! তুমি বলো তো। কবে ম্যাসেজ করেছে?”
“গতকাল।”
“তারপর? কী বলল?”
“আমার খোঁজ-খবর নিল।”
“তুমি রিপ্লাই দিয়েছিলে?”
মিশকাত ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“দিয়েছিলাম। নরমালি খোঁজ-খবর নিয়েছে, এটুকুই। বেশি কথা বলার সুযোগ দিইনি।”
আরিন্তা সন্তুষ্ট হলো, না অসন্তুষ্ট হলো বুঝা গেল না। বলল,
“ওকে একদম সুযোগ দিবে না। কথা বাড়ালেই ও আরও ঝুঁকে পড়বে তোমার দিকে।”
“যে একদিকেই আজীবন ঝুঁকে পড়ে আছে, তার দিকে অন্য কেউ ঝুঁকলেই কী, না ঝুঁকলেই কী?”
আরিন্তা মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বলল,
“মিশু ভাই, সব কথা উড়িয়ে দিয়ো না। ব্যাপারটা এত সহজ না।”
“সহজ কঠিন বুঝার মতো জ্ঞান আমার আছে। আপনাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না বুড়ি পোনি। এখন আর আপনার দেরী হচ্ছে না?”
আরিন্তা সময়ের দিকে লক্ষ্য করে তাড়াহুড়া করে উঠে পড়ল। বলল,
“আসলেই দেরী হয়ে গেছে। রাখো, হ্যাঁ?”
“সাবধানে যাস। ফিরে ফোন করবি।”
“ঠিক আছে। রাখো।”
মিশকাত ফোন কে’টে দিলো। হাত থেকে ফোন রাখতে গিয়েও কী মনে করে আবার রাখল না। ফোনের ওয়ালের দিকে একমনে তাকিয়ে রইল। আরিন্তা বউ সাজার পর তারা চোখে চোখ রেখে যেই ছবিটা তুলেছিল, সেই ছবিটা ওয়ালে দেওয়া। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মিশকাতের বুকের কোণে কেমন এক চিনচিনে ব্যথা জেগে উঠল। গত অর্ধ মাস যাবত এই ব্যথাটা তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে। অথচ কেউ জানে না তার এ গোপন যন্ত্রণার খবর, কেউ না। কেবলমাত্র আরিন্তা জানে। কিন্তু এই মেয়ে তো আবার নতুন শক্তি অর্জন করেছে। মিশকাত একটু নরম হলেই সে উলটো শক্ত হয়ে মিশকাতের ধৈর্য বাড়িয়ে দেয়। অথচ মিশকাত ঠিকই টের পায় ওপরে শক্ত সাজা মেয়েটার মন তার জন্য ঠিক কতটা পো’ড়ে। ভেতরে-ভেতরে তার বিলাপ করে কান্নার আওয়াজ মিশকাতের কানে বাজে। ভিডিয়ো কলে মেয়েটার মুখ দেখলেই মিশকাত বুঝে যায় তার মনের আকাঙ্ক্ষা, লুকাতে চাওয়া আহাজারি। এরপরও মেয়েটার এক কথা,
“বাচ্চাদের মতো আবেগী হয়ো না তো মিশু ভাই। তোমার সাথে এসব যায় না। সময় কত দ্রুত কে’টে যাচ্ছে, টের পাচ্ছ? ধৈর্য ধরো না। স্রোতের বেগে সময় পেরিয়ে হুট করে একদিন চোখ মেলে দেখবে আমি বধূবেশে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের জন্য তো একটু অপেক্ষা করতেই হয়। তাই না?”
আজ সারাদিন ধরে আরিন্তার সাথে তেমন কথা হয়নি মিশকাতের। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে বলে তাড়াহুড়া করে একটা ম্যাসেজ দিয়ে ভার্সিটি চলে গিয়েছিল। দুপুরের পরে মিশকাত একবার ভিডিয়ো কল করেছিল, কিন্তু আরিন্তা ভিডিয়ো কল কে’টে ম্যাসেজ করে বলেছে তার আজ ভালো লাগছে না। মিশকাত জোর না করে অডিয়ো কল দিয়েছে, তা-ও আরিন্তা কে’টে দিয়েছে। ম্যাসেজে বলেছে তার একটু মাথাব্যথা করছে, তাই এখন ঘুমাবে। ঘুম থেকে উঠে নিজেই মিশকাতকে ফোন করবে। মিশকাত-ও তাকে ঘুমাতে বলল। কিন্তু বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পর-ও আরিন্তার ফোন এল না। রাত আটটার দিকে মিশকাত নিজেই আবার কল করল। এবার কল রিসিভ করল মেরিনা। ঘুমানোর আগে ফোন তার কাছেই রেখে গিয়েছিল আরিন্তা। মেরিনার সাথে কথা বলার মাঝেই মিশকাত সবার সাথে আরিন্তার কথা-ও জিজ্ঞেস করল। মেরিনা বলল আরিন্তা নিজের ঘরে শুয়ে আছে। মিশকাত জানতে চাইল এই সময় আরিন্তা ঘুমাচ্ছে কেন। মেরিনা জানাল গতকাল মাঝরাত থেকে আরিন্তার ভীষণ জ্বর উঠেছে। সারাদিন ধরে মেয়েটা বিছানায় পড়ে আছে। ভার্সিটি যেতে পারেনি। কিছু খেতে-ও চাইছে না। মেরিনা অনেক জোরাজুরি করে কিছু খাবার খাইয়েছে ঔষধ খাওয়ানোর কথা বলে। মিশকাত এই খবর শুনে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। এই মেয়েটা যে তাকে চিন্তামুক্ত রাখার জন্য সারাদিন ধরে এড়িয়ে গেছে, তা তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। মিশকাত শুধু মেরিনাকে বলল সে আরিন্তার সাথে কথা বলতে চায়। মেরিনা বলল সে আরিন্তার কাছে ফোন দিয়ে বলে দিবে মিশকাতকে ফোন করতে। মিশকাত ফোন রেখে অপেক্ষা করতে লাগল আরিন্তার কলের জন্য। মেরিনা গিয়ে আরিন্তাকে ফোন দিয়ে বলল,
“মিশু তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছে। ফোন করে কথা বলিস।”
আরিন্তা ঘ্যানঘ্যান করে বলল,
“আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
মেরিনা বিরক্ত হয়ে বললেন,
“তোদের ভালো লাগে কখন? দেশে থাকতে ছেলেটা নিজে বাড়ি বয়ে এসে তোদের খোঁজ নিত। আর এখন দূরে গিয়েও তোদের থেকে একটু খোঁজ-খবর পাওয়ার ভাগীদার হয় না। উলটো নিজেই ফোন করে-করে সবার খবর নেয়।”
আরিন্তা মনে-মনে হাসল। তার মন বলল,
“মা, তুমি যদি জানতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমার ভাগনে আমাকে জ্বালিয়ে মা’রে! কাছে থাকতে যা-ও একটু শান্ত থাকতে পারত, দূরে গিয়ে আরও বেশি পা’গল হয়ে উঠেছে এই ছেলে।”
আরিন্তা উদাস গলায় বলল,
“তোমার ভাগনের মতো এত দরদী এখনও হয়ে উঠতে পারিনি।”
“বেশি কথা না বলে ফোন কর ওকে। আমার সাথে রোজ কথা বলার সময় ও তোদের কত কথা জিজ্ঞেস করে, জানিস?”
“আচ্ছা, করছি ফোন। একটু পরে করছি, তুমি যাও। আমি কথা বলে নেব।”
“আচ্ছা ফোন করিস কিন্তু মনে করে। তোর জন্য কিছু আনব, খাবি?”
আরিন্তা তীব্র অনীহায় মুখ কুঁচকে বলল,
“না, এখন কিছু খাব না।”
“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি ফোন করিস ওকে।”
“আচ্ছা।”
মেরিনা চলে গেলে আরিন্তা ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বিছানায় একইভাবে চুপ মে’রে পড়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নিজের ফেসবুক আইডি লগইন করতেই মিশকাতের ম্যাসেজের নোটিফিকেশন পেল। ম্যাসেজ সীন করতেই আরিন্তার ভয় লাগল। এতগুলো ম্যাসেজ সীন না করে আইডি লগ আউট করে রাখার অপরাধে নির্ঘাত এক রাম ধমক কপালে জুটবে। আরিন্তা ম্যাসেজ সীন না করতেই মিশকাতের কল এল। ভিডিয়ো কল দেখে আরিন্তার আবার মাথায় হাত। ভেবেচিন্তে সে কল রিসিভ করল ঠিকই, কিন্তু ক্যামেরা অফ করে। ওপাশ থেকে মিশকাত ‘আরি’ বলে ডাকলে, সে ছোটো করে সাড়া দিলো,
“বলো, শুনছি।”
“কী শুনছিস তুই? ক্যামেরা অফ করেছিস কেন?”
“লাইট অফ করে ঘর অন্ধকার করে রেখেছি, তাই।”
“অন কর।”
“অন্ধকারে দেখতে পাবে না তো।”
“আমি অন্ধকারেই দেখব। তুই ক্যামেরা অন কর, নইলে আজ খবর আছে।”
মিশকাতের কথায় জেদের আভাস পেয়ে আরিন্তার সন্দেহ জাগল মা তার জ্বরের খবর দিয়ে বসে আছে কি না। সে মিনমিনে গলায় বলল,
“তুমি রাগ করছো কেন আজ?”
মিশকাত বেপরোয়াভাবে বলল,
“তোকে কী বলছি আমি, শুনছিস না?”
আরিন্তা গাল ফুলাল। কাঁথা টেনে ভালোভাবে কান অবধি ঢেকেঢুকে তবেই সে ক্যামেরা অন করল। ক্যামেরা অন করতেই মিশকাতের কুঁচকানো কপাল আর বিরক্তিভরা মুখটা চোখে পড়ল। কাঁথার ফাঁক দিয়ে মিশকাত শুধু আরিন্তার চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছে। তবু সে প্রথমেই কিছু বলল না এ বিষয়ে। প্রশ্ন করল,
“লাইট না কি অফ?”
আরিন্তা মিথ্যা বলল,
“অন করেছি মাত্র।”
“আচ্ছা? আজ কি বাংলাদেশে খুব শীত পড়েছে?”
“না, একটু ঠান্ডা লাগছে আমার। ফ্যানের রেগুলেটর নষ্ট হয়ে গেছে।”
“কবে?”
“আজকেই।”
“ও, একদিনের ফ্যানের বাতাসেই জ্বর এসে গেছে?”
ধরা পড়ে আরিন্তা দাঁতে জিব কা’টল। মিনমিনে গলায় বলল,
“মা তোমাকে কী বলেছে?”
“তোর যা বলতে লজ্জা লাগছিল তা-ই বলেছে।”
আরিন্তা ভ্রুকুটি করে বলল,
“কিসের লজ্জা?”
“এই যে সারাদিন পর আমাকে খালার থেকে শুনতে হয়েছে তার মেয়ে জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে আছে। অথচ তার মেয়ে আমাকে এই খবর না দিয়ে উলটো অজুহাত দেখিয়ে পালিয়ে ছিল। তার জ্বরের খবর শুনে যদি আমি কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলি, তা ভেবে খালার মেয়ে লজ্জায় পড়ে কিছু বলেনি।”
আরিন্তা বলল,
“আমি তোমার কাজের মধ্যে দুশ্চিন্তা দিতে চাইনি।”
“ও, আর সারাদিন ধরে যে কোনো খোঁজ-খবর ছিল না, তাতে বুঝি আমার দিন খুব ভালো গেছে?”
আরিন্তা চুপ করে রইল। ক্ষণিক নীরবতার পর মিশকাত বলল,
“পোনি, তুই কবে বুঝবি এত দূরে বসে আমি তোর জন্য কত চিন্তায় থাকি?”
“বুঝি বলেই তো চিন্তামুক্ত রাখতে চাই।”
“এভাবে কথা বন্ধ করে চিন্তামুক্ত রাখতে চাস? সারাদিনে একটাবার-ও যদি তুই আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলিস, তাতে-ও আমার মন হালকা থাকে। কিন্তু হুট করে কথা বন্ধ করলে নিজেকে আমার খুব অসহায় মনে হয়, জানিস? মনে হয় কাছে থাকলে এই ভোগান্তিগুলো পোহাতে হত না। কিন্তু আমার ভাগ্য-”
আরিন্তা মন খারাপ করে ডেকে বলল,
“মিশু ভাই, প্লিজ এভাবে কথা বোলো না। আমার দমবন্ধ লাগে। আর কখনো এমন ভুল করব না, প্রমিস।”
মিশকাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“শরীর কি খুব খারাপ লাগছে?”
“এখন একটু কম।”
“খালা বলল কিছু খেতে চাইছিস না? না খেয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে সুস্থ হয়ে যাবি?”
“খেতে ভালো লাগে না।”
মিশকাত অবাক হয়ে বলল,
“ভূতের মুখে রাম নাম শুনলাম মনে হচ্ছে?”
“মিশু ভাই, আমার এখন অসুখ হয়েছে।”
“অসুখ হলে তোর মতো খাদকদের উচিত ডবল খাবার গেলা। কারণ অসুখ হলে সবাই মুখের কাছে খাবার ধরে রাখে।”
“তোমার এত রুচি থাকলে তুমি ডবল খাবার গিলো।”
“আমি তো তোর মতো খাদক হতে পারিনি। তাছাড়া আমি খেলে সেই খাবার তোর পেটে-ও যাবে না।”
“মা আজ আমাকে কী বলেছে জানো?”
“কী?”
“বলেছে তুমি ফোন করলেই আমাদের এত খবর নাও, অথচ আমরা তোমার সাথে কথাই বলি না। খুবই নির্দয় হয়ে গেছি।”
মিশকাত হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে বলল,
“ঠিকই তো বলেছে আমার খালা। এত নির্দয় আচরণ করা ঠিক না কিন্তু পোনি।”
আরিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এসব পোল্ট্রির এত খবর নেওয়ার সময় নেই আমার।”
“তা এত সময় যায় কোথায় তোমার?”
“আমার হবু বরের জন্য সবটা সময় বরাদ্দ।”
“আর আমি কে?”
“উমম…মিস্টার পোল্ট্রি।”
সুবর্ণার নিজস্ব পার্লারের ইচ্ছাটা একটু-একটু করে পূরণ হওয়ার পথে এগোচ্ছে। তার এই ইচ্ছা পূরণে সাহায্য করেছে আরিন্তা। আরিন্তা প্রথমে মিশকাতকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছে সুবর্ণার ইচ্ছাটার কথা। মিশকাত ছাড়া আর কে সুবর্ণার ইচ্ছা পূরণ করবে? কিন্তু মিশকাতের পক্ষে একসঙ্গে পার্লার দেওয়ার মতো টাকা পাঠানো সম্ভব ছিল না। তাই আরিন্তা তাকে বুদ্ধি দিয়েছে সে যেন প্রতি মাসে সামর্থ অনুযায়ী সুবর্ণার জন্য আলাদা কিছু টাকা দেয়। সেই টাকাটা সুবর্ণা খরচ না করে জমাবে। তারপর আস্তে-আস্তে নিজের ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করবে। মিশকাতের এই বুদ্ধিটা সঠিক মনে হয়। তারপর থেকেই সে প্রতি মাসে সুবর্ণার জন্য আলাদা কিছু টাকা পাঠায় পেলবের কাছে, যাতে এ বিষয়ে আগে থেকে কেউ জানতে না পারে। জানলে হয়তো কেউ না কেউ বাঁধা দিবেই। সুবর্ণার পার্লারের সব টাকা পেলবের কাছে জমা। সুবর্ণা নিজেও এ কারণে টিউশনি শুরু করেছে। মিশকাত তাকে বারণ করেছিল। কারণ তার হাত খরচের টাকা নিয়মিত ঠিকই পেয়ে যায় সে। তবু সুবর্ণা ভেবেছে টিউশনি থেকে যা টাকা আসবে, তা সে জমা রাখবে। এতে যদি টাকা জমানো তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। বাবা-মায়ের এতে তেমন আপত্তি ছিল না। কারণ এমনিতেও সুবর্ণা গোটা বিকাল অবসরে কা’টায়। তাই দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা সে টিউশনের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। একটু-একটু করে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগোতে-এগোতে আরিন্তার ভেতরের প্রবল আগ্রহ আর উত্তেজনা দেখতে-ও মিশকাতের এখন ভালো লাগে। আজকাল তো তার মনে হয় বোনের স্বপ্নটা পূরণ করে দিতে পারলেই সে বড়ো ভাইয়ের একটা দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করতে পারবে। সুবর্ণা রোজ তার পার্লার নিয়ে আরিন্তার সাথে গল্প করে। কীভাবে শুরু করবে, কীভাবে সাজিয়ে তুলবে কত কী! নতুন কোনো আইডিয়া মাথায় এলেই সঙ্গে-সঙ্গে সে আরিন্তাকে জানায়। আরিন্তা-ও খুব আগ্রহের সাথে তার মতামত জানায়। মিশকাত পেলবের ওপর দায়িত্ব দিয়েছে ভালো এবং নিরাপদ জায়গা ঠিক করে দিয়ে সুবর্ণার পছন্দমতো পার্লার গড়ে দেওয়ার। পেলব-ও চুপচাপ নিজের দায়িত্ব পালন করছে। বলা বলে পূরণ হতে চলা এক স্বপ্নের পথে চারটা মুখ তাকিয়ে।
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।