#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তির
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৯.
জমকালো আয়োজনে ধুমধাম করে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন পুলক তালুকদার। সুনাম করার বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখেননি। গোটা এলাকা জুড়ে লোকমুখে তার প্রশংসা,
‘তালুকদার মেয়ে বিয়ে দিয়েছে দেখার মতো আয়োজন করে। পাঁচ এলাকায় এমন আয়োজন কেউ করতে পারেনি। টাকা থাকলেই হয় না, আত্মা থাকতে হয়। তালুকদারের আত্মা আছে। কপাল করে জামাইও পেয়েছে লাখে একটা। যেমনি চেহারা, তেমনি টাকা। পারিবারিক অবস্থান তো দেখলেই বুঝা যায়। কোনোদিকে কমতি নেই। মেয়ে বাবার বাড়ি রাজকন্যার মতো ছিল, শশুরবাড়ি গিয়েও রাজরানি হয়ে থাকবে।’
আরিন্তার বিদায়ের পর মেরিনা ড্রয়িংরুমে নেতিয়ে পড়ে আহাজারি করে কেঁদে চলেছেন। চোখ মুছতে-মুছতে আয়েশা বোনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। চুপচাপ বসে চোখের পানি ফেলছেন পুলক তালুকদার-ও। পেলব ঘরের দরজা আটকেছে বোনকে বিদায় দিয়েই। বাড়িসুদ্ধ লোকজনকে চোখের পানি দেখাতে চায় না সে।
সুবর্ণা ব্যাগ হাতে দোতলা থেকে নেমে এল। তা দেখে দুই-একজন জিজ্ঞেস করল সে ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। সুবর্ণা কারোর সাথে কথা বলল না। কান্নারত মেরিনার কাছে গিয়ে বসতেই আয়েশা তার ব্যাগের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
সুবর্ণা মেরিনার এক হাত ধরে বলল,
“খালা, আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। কান্নাকাটি করে শরীর খারাপ কোরো না তুমি। আপুর সাথে ঠিকমতো কথা বোলো।”
আয়েশা বলে উঠলেন,
“তুই এখনই বাড়ি যাচ্ছিস মানে কী?”
সুবর্ণা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে কিছু জিজ্ঞেস কোরো না মা। তোমাদের যখন ইচ্ছা যেয়ো, আমাকে এখন যেতে হবে।”
মেরিনা সুবর্ণার হাত আঁকড়ে ধরে বললেন,
“তুই এখনই যাচ্ছিস কেনো? রাগ করেছিস?”
“আমি ছোটো মানুষ, কার ওপর রাগ করব? আমার কাজ আছে, থাকতে পারব না।”
“আমি জানি তুই রাগ করেছিস। যাস না মা। তোরা-ও চলে গেলে আমি কী করব?”
“আমাকে আর এখানে থাকতে বোলো না খালা। আমার দম বন্ধ লাগছে। আমি বাড়ি ফিরে শান্তিতে থাকতে চাই।”
সুবর্ণার গলা ধরে এসেছে। মেরিনা কাঁদতে-কাঁদতে বললেন,
“আমার মিশুকে বলিস আমাকে মাফ করে দিতে মা। আমার মিশুর খারাপ আমি কোনোদিন চাই না। আমার বাবার মনে কষ্ট দিতে চাইনি আমি। এতদূরে একা-একা আমার বাবা না জানি কত কষ্ট পাবে! ও সুবর্ণা, ওকে বলিস আমার ওপর রাগ না করতে।”
পুলক তালুকদার আয়েশাকে ইশারা করে বললেন,
“তোমার বোনকে রুমে নিয়ে যাও। সবার সামনে আবোল-তাবোল বলতে বারণ করো।”
আয়েশা বললেন,
“আপা, ওঠো। কান্নাকাটি বন্ধ করো। রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো, চলো।”
সুবর্ণা বলল,
“খালা, তুমি এমন কোরো না। আমরা সবাই তো জানি তুমি কেমন। ভাইয়া তোমার ওপর রাগ করবে না। যাও, রুমে যাও।”
তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা, আমি গেলাম। তুমি খালার কাছে থাকো।”
“সাবধানে যাস। রাতে একা ঘরে ঘুমাস না। কাউকে ডেকে নিস।”
“আচ্ছা।”
সুবর্ণা পুলক তালুকদারকে বলে চলে গেল। পুলক তালুকদার কিছুই বললেন না। কাছে থাকা আত্মীয়দের দুই-একজন যাদের কানে তাদের কথাবার্তা গেছে, তারা কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই হয়তো প্রশ্ন করে বসবে। সুবর্ণা চলে যেতেই মেরিনাকে ধরে আয়েশা রুমে নিয়ে গেল।
•
নিয়াজের ঘরে বাসর সাজানো হয়েছে। ঘরভর্তি দারুণ সব ফুলের মৌ-মৌ গন্ধ। অথচ এত মিষ্টি গন্ধ আরিন্তাকে অনুভব করতে পারছে না। মন ছুঁতে পারছে না ঘরের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। মালিকানা পাওয়া ঘরটাকে আপন লাগছে না। বাসরঘরে বসে থেকেও মন কারো আগমনের অপেক্ষায় ধুকপুক করছে না। নতুন জীবন নিয়ে সাজাচ্ছে না কোনোরকম নতুন স্বপ্ন। মস্তিষ্ক জুড়ে চক্রাকারে ঘুরছে শুধু একটি নাম, মিশকাত খাঁন; যাকে দেওয়া কথা ভেঙে আরিন্তা আজ অন্যকারো সহধর্মিণী। যার অজান্তে আরিন্তা বাসরঘরে বসে আছে অন্য কোনো পুরুষের জন্য। অথচ বিষাক্ত অনুভূতিটা এখনও অবধি সে একাই বয়ে বেড়াচ্ছে। মন খুব করে চাইছে এই অসহ্য যন্ত্রণা ওই মানুষটাকে ছুঁতে না পারুক। কিন্তু মন এটাও জানে, আজ বা কাল এই নরক যন্ত্রণা মিশকাতকেও গ্রাস করবে। তার চেয়েও ভয়ানকভাবে ভেঙে দিবে ওই মানুষটাকে। পাগলপ্রায় ভালোবাসার পরিণতিতে কী অপেক্ষা করছে, জানা নেই আরিন্তার। তবে এটুকু জানে, মিশু ভাইয়ের জীবন সে এমনভাবে এলোমেলো করে দিয়েছে, যা গুছিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারোর নেই। আরিন্তা খুব চেষ্টা করেছিল বিয়েটা আটকানোর। সবসময় সমর্থন করা ভাইয়ের সাথে রীতিমতো ঝগড়া করেছিল। ভাইয়ের ভেতরের পাষাণ রূপটা সে বাগে আনতে পারেনি। না পেরে শেষমেশ বাবার পায়ে অবধি পড়েছিল। কাঁদতে-কাঁদতে কত আকুতি-মিনতি করেছিল! অথচ বাবা গাম্ভীর্যের সঙ্গে এড়িয়ে গিয়েছিল। বারবার ব্যর্থ হয়ে শেষে বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালানোর মতো ভয়ানক সিদ্ধান্ত-ও সে নিয়েছিল। গন্তব্য অজানা জেনেও চেষ্টা করেছিল নিজেকে লুকিয়ে নেওয়ার। কিন্তু ভাইয়ের কড়া নজরদারির কাছে ধরা পড়ে আরও বিপদ বেড়ে গিয়েছিল। পেলব সেদিন খুব বেশি রেগে গিয়েছিল। আরিন্তার সঙ্গে চেঁচামেচি তো করেছিলই, রাগের মাথায় হুমকিও দিয়েছিল। মিশকাত যেদিনই দেশে ফিরুক, তাকে সে এলাকায় পা রাখতে দিবে না। মিশকাতসহ তার পুরো পরিবারের সাথে আজীবনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবে। এমনকি তাদের এলাকাছাড়া করতেও সে দুবার ভাববে না। নিজেদের সম্মান বাঁচাতে সেদিন পেলবের পাষণ্ড রূপ বেরিয়ে এসেছিল। আরিন্তার সমস্ত পথ বন্ধ ছিল, কেবল আত্মত্যাগ ছাড়া। কিন্তু সে পথে পা বাড়ানোর সাহস সে ভুল করেও করেনি। কেবলমাত্র একজন মানুষকে আরও একবার চোখের দেখা দেখার জন্য, হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরের এক সপ্তাহ আরিন্তা যেন ঘোরের মধ্যে কা’টিয়েছে। প্রতিটা মুহূর্ত তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তার মনের মৃ’ত্যু। ডক্টর নিয়াজ বিয়ের আগে হবু বউয়ের সঙ্গে ফোনালাপ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আরিন্তা পারেনি কথা বলতে। মনের ভয় থেকে পেলব নিজেই কথা বলতে দেয়নি। আরিন্তা লাজুক, ফোনে কথা বলতে চাইছে না, এটা-ওটা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে।
কাজিনমহলের দাবি মিটিয়ে কোনোমতে তাদের হাত থেকে ছাড় পেয়ে নিয়াজ আরিন্তার কাছে আসতে পেরেছে। মেয়েটাকে একা বসে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাতে খারাপ লাগছিল তার। আজ তাদের নতুন জীবনের শুরু। কত কথা আছে একে-অপরের। পরস্পরকে ভালোভাবে জানতে হলে একটা দীর্ঘ আলাপের প্রয়োজন আছে তো। নিয়াজ জানে এই বিশেষ দিনটিতে মেয়েদের মনে অনেক কথা জমে থাকে। জীবনসঙ্গিনী তাদের মনকে প্রাধান্য না দিলে তারা সেসব কথা প্রকাশ করতে পারে না। এটা তাদের মনোকষ্টের-ও কারণ হতে পারে। নিজের মনের কথা নিজের মানুষের সঙ্গে শেয়ার করার সুযোগটা কোন মেয়ে না চায়? নতুন জীবনের শুরুতেই নিয়াজ কোনো ভুল করতে চায় না। তার নিজের মনেই তো কতশত কথা জমে আছে আরিন্তার জন্য। গত এক সপ্তাহে সেসব জমানো কথারা তাকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। মনখুলে কথাদের মুক্তি না দেওয়া অবধি যেন পেটের ভেতরের মোচড়া-মুচড়ি থামবেই না। গোটা দুনিয়ার কাছে চাপা স্বভাবের এক শক্ত মনের পুরুষ নিয়াজ। একমাত্র আরিন্তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার বহুদিনের। নিয়াজের আগমন টের পেয়েও আরিন্তার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। নিয়াজ বলল,
“নতুন জায়গায় একা বসে থাকতে খারাপ লাগছিল তোমার?”
আরিন্তা প্রশ্ন শুনল, কিন্তু উত্তর দিলো না। নিয়াজ পুনরায় বলল,
“আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না। কালকের মধ্যে বাসা ফাঁকা হয়ে যাবে। তারপর দেখবে নতুন পরিবেশ দুদিনেই পুরোনো মনে হচ্ছে। তুমি কি বাবা-মাকে মিস করছো? আসার পর কথা বলেছ তাদের সাথে?
আরিন্তা এবারেও নিরুত্তর। একইভাবে ঠাঁয় বসে আছে। নিয়াজ স্পষ্ট দৃষ্টিতে আরিন্তার দিকে তাকাল। মেয়েটা কথা বলা তো দূর, নড়াচড়াও করছে না। লজ্জা পাচ্ছে, না ভয়? নিয়াজ এগিয়ে গিয়ে আরিন্তার সামনে বসল। আরিন্তার পরনের শাড়ির আঁচল টেনে মাথার তালু অবধি ঘোমটা দেওয়া। মাথা নিচু করে বসেছে সে। নিয়াজ নিজের মাথা নিচু করে উঁকি মে’রে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি লজ্জায় কথা বলছো না?”
আরিন্তা সঙ্গে-সঙ্গে মুখ তুলে উত্তর দিলো,
“না, আমার লজ্জা কম। সবার জন্য আসে না।”
নিয়াজ যেন ছোটোখাটো এক ধাক্কা খেল। বিয়ের প্রথম রাতে প্রথম কথাতেই বউ নিজের মুখে বলছে তার লজ্জা কম। এমন অদ্ভুত কাণ্ড বোধ হয় আরিন্তাই প্রথম করল। তার ওপর নিয়াজের সাথে এটাই তার প্রথম কথা। সারাদিনে নিয়াজ অনেকবার তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে প্রতিবারই নীরব ছিল। নিয়াজ ভেবেছিল অতিরিক্ত লজ্জায় কথা বলছে না। তাহলে এটা কী বলল আরিন্তা! ধাক্কাটা সামলে নিয়ে নিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“তাহলে? সারাদিন যে কথা বললে না আমার সাথে? বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও তো লজ্জায় কথা বললে না। এখন হঠাৎ করে লজ্জা কমে গেল কীভাবে?”
“আপনি বুঝবেন না।”
“আমি বুঝব না? তুমি আমার সিনিয়র, না আমি তোমার সিনিয়র?”
আরিন্তা এবারেও উত্তর না দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। নিয়াজ আবারও মাথা নিচু করে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে বলল,
“কান্নাকাটি করে চোখ দুটোর কী অবস্থা করেছ! তোমার কান্না দেখে মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছি।”
“হ্যাঁ, কিডন্যাপই বলা চলে।”
নিয়াজ হাসল। পরক্ষণেই নরম সুরে বলল,
“তুমি জানো তুমি কত সুন্দর?”
আরিন্তা উত্তর দিলো,
“সত্যি কথা না জানার কিছু নেই।”
নিয়াজ ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি সরাতে পারছে না। তার নতুন বউ যে এমন বাচ্চামি কথাবার্তা বলছে, এটা অদ্ভুত হলেও তার মজা লাগছে। সে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“জানতে না কি? কতবার শুনেছ তুমি এই প্রশংসা?”
“অসংখ্যবার।”
“ও বাবা! এত প্রশংসা কারা করেছে?”
“যার কাছে আমি চাঁদের মতো।”
নিয়াজ ভ্রুকুটি করল। সে ভাবেইনি আরিন্তা এমন নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারে। সে ভেবেছিল বিয়ের পর বউয়ের লজ্জা ভাঙতেই তাকে যথেষ্ট ভুগতে হবে। কিন্তু হলো তার উলটোটা। তবে আরিন্তার মনখোলা স্বভাবটা নিয়াজের ভীষণ ভালো লাগছে। সে হাসিমুখে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে আরিন্তার নত মুখে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা সত্যিই চাঁদের মতো সুন্দর। অন্যদের থেকে প্রশংসা শোনা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
“তোমার না লজ্জা কম? তাহলে মাথা নিচু করে থাকো কেন? চাঁদের মতো মুখটা মনভরে দেখতে না দিলে প্রথম চোখাচোখি সার্থক হবে কীভাবে? দেখি, তাকাও তো আমার দিকে।”
কথাটা বলে নিয়াজ আরিন্তার থুতনি ছুঁতে হাত বাড়াতেই আরিন্তা পেছনে হেলে পড়ল। ফলস্বরূপ খাটের হেডবোর্ডের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে তার মাথা ধরে গেল। চোখ-মুখ কুঁচকে সে মাথার পেছনে হাত চেপে ধরল। কিন্তু মুখ দিয়ে ব্যথাতুর শব্দ বের করল না। নিয়াজ চমকে উঠে দুহাতে আরিন্তার মাথা ধরে বলল,
“ব্যথা পেয়েছ? দেখি।”
আরিন্তা আবারও মাথা সরিয়ে নিল। অসন্তুষ্ট চোখে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি তো দেখি কিছুই জানেন না। আশ্চর্য!”
নিয়াজ শুধাল,
“কী জানি না?”
“আমাকে ছোঁয়ার অনুমতি চেয়েছেন আপনি?”
নিয়াজ আরেক ধাক্কা খেয়ে পূর্বের জায়গায় বসে পড়ল। চমকিত হয়ে বলল,
“তুমি তো আমার অভিজ্ঞ গুরুজন। আমি যা না জানি তা শিখিয়ে দাও।”
“অভিজ্ঞ না, বুঝদার। এত বড়ো মানুষ, ভুলভাল কথা বলছেন কেন?”
“আমার তো মনে হচ্ছে তুমি আমার চেয়ে শত বছর বড়ো মানুষ।”
“আপনার মন বড্ড কাঁচা। কোনোকিছুই বুঝতে পারে না।”
হাতের তালুতে মাথা ঘষছে আরিন্তা। নিয়াজ ভাবুক সুরে বলল,
“তুমি এত পাকা কথা বলো, বুঝে উঠতে এখন আমার নিজেকেই গাধা মনে হচ্ছে। আচ্ছা থাক, মাথা অনেক ব্যথা করছে? দেখতে দাও আমাকে।”
আরিন্তা এবারেও বাঁধা দিয়ে বলল,
“দেখতে হবে না। কিছু হয়নি।”
“ব্যথা করছে, আবার বলছো কিছু হয়নি?”
“এটুকু ব্যথায় কিছু হয় না। সয়ে নিয়েছি।”
“ডক্টর আমি, না তুমি?”
“পুরুষরা বাইরে ডক্টর, ঘরে না। ঘরে নারীরাই আসল ডক্টর।”
নিয়াজ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“সালাম তোমাকে আমার ঘরের ডক্টরনি।”
আরিন্তাকে নিজে থেকে কোনো কথাই বলতে না দেখে নিয়াজ প্রশ্ন করল,
“তোমার কি খুব খারাপ লাগছে এখানে?”
আরিন্তা সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ।”
নিয়াজ ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বাড়ি থেকে হসপিটাল, হসপিটাল থেকে বাড়ি ছুটে চলি। বাবাকেও ঠিকমতো সময় দিতে পারি না। জানি বাবার একা থাকতে খারাপ লাগে, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। এখন তুমি এসেছ। বাবা হয়তো তোমাকে পাশে পেয়ে একাকিত্ব ভুলে যাবে। এটা ভেবে আমার শান্তি লাগছে। কিন্তু এটা ভেবেও খারাপ লাগছে যে, বাবার একাকিত্ব হয়তো তোমাকে পেয়ে বসবে। কী করব বলো? মা নেই। আমি ছাড়া কোনো ভাই-বোন নেই। আমরা একাকিত্বেই অভ্যস্ত। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, আমার জন্য একটু কষ্ট করে মানিয়ে নিয়ো প্লিজ। আমার প্রতি তোমার অভিযোগ থাকলেও আমাকে জানিয়ে দিবে। আমি কিছু মনে করব না। এই পরিবারটার তোমাকে খুব প্রয়োজন আরিন্তা। নিজের করে নিয়ো একে।”
আরিন্তা চুপচাপ নিয়াজের কথা শুনল। কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। তার মনের অবস্থা তো নিয়াজ জানে না। নতুন বউয়ের কাছে মনের কথা বলাটা তার জন্য স্বাভাবিক। নিয়াজ বলল,
“আমার কথা শুনতে কি তোমার খারাপ লাগছে? কিছু বলছো না যে?”
আরিন্তা বলল,
“আমি জানি না আমার কী বলা উচিত।”
“মনে যা আসে বলো, তোমার কথাও তো আমার শুনতে হবে।”
“আমার মনে তো কোনো কথা নেই।”
“নতুন জীবনের শুরুতে তোমার মনে কোনো কথাই নেই? এতদিনেও তোমার মনে কোনো কথা জমা হয়নি?”
“না।”
নিয়াজ অবাক হলো। আরিন্তাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। একটু আগেও তো মনে হচ্ছিল মেয়েটা প্রচুর কথা বলতে পারে। এখন বলছে তার মনে কোনো কথাই নেই। সে কি বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও নিজের নতুন জীবন, নতুন মানুষ নিয়ে ভাবেনি? এটা কীভাবে সম্ভব? পুরুষ হয়েও তো নিয়াজ গোটা এক সপ্তাহ এসব ছাড়া কিছু ভাবতে পারেনি। বিষয়টাকে বেশি না ঘেঁটে নিয়াজ প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আজ আমাদের সম্পর্কের সূচনা। স্মরণে রাখার মতো দিন। আমার কাছে তোমার কী চাওয়ার আছে আরিন্তা?”
“কিছু না।”
“লজ্জা কোরো না। মন যা চায় বলো। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার প্রথম চাওয়া পূরণ করার।”
আরিন্তা একটু চুপ থেকে বলল,
“যা চাইব তা-ই দিবেন?”
“দিবো, বলো কী চাও।”
“যদি আপনার ফোনটা চাই?”
নিয়াজ ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমার ফোন? তোমাকে তো আমি নতুন ফোন কিনে দিবো। আমারটা পুরোনো হয়ে গেছে।”
“কিছু সময়ের জন্য চাই।”
“ও, বাড়িতে কথা বলবে? তোমার ফোন আনোনি?”
“আনতে দেয়নি।”
“আচ্ছা, সমস্যা নেই। ওটার আর দরকার নেই। আমি কালকের মধ্যেই ফোন এনে দিবো।”
নিয়াজ নিজের ফোনটা বের করে আরিন্তাকে দিয়ে সামনে থেকে উঠে গেল। আরিন্তা ফোন অন করতেই লকস্ক্রিনে নিয়াজের পেশাগত বেশের একটা ছবি চোখে পড়ল। আরিন্তা শুধাল,
“পাসওয়ার্ড?”
“তোমার নাম।”
আরিন্তা আবাক হয়ে তাকাল। এরমধ্যেই লোকটা পাসওয়ার্ডে তার নাম বসিয়ে দিয়েছে? নিজের নাম দিয়ে ফোন আনলক করে আরিন্তা আরেক দফা অবাক হলো। হোমস্ক্রিনে এরমধ্যে তাদের বিয়ের ছবিও দিয়ে রেখেছে। লোকটা তো বেশ অ্যাক্টিভ। আরিন্তা প্রথমে একটা ম্যাসেজ করল। ঠিক এক মিনিটের মাথায় তার কল এল। শব্দ শুনে নিয়াজ বলল,
“তুমি ফোন করতে।”
আরিন্তা ফোন কানে ধরে চুপ করে আছে। ওপাশ থেকে মিশকাতের উৎকণ্ঠা চলছে,
“আরি? হ্যালো, কথা বলছিস না কেন? এই পোনি? শুনতে পাচ্ছিস না?”
আরিন্তা ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“শুনছি।”
“এতদিন পর তবে মনে পড়ল অসহায় প্রেমিককে?”
“কেমন আছো মিশু ভাই?”
“জানিস না তুই কেমন রেখেছিস?”
“তবু তো দিন কে’টেছে।”
“আমার সময় তো এক জায়গাতেই থমকে ছিল।”
“না, সময়ও বদলেছে। ভালো থাকতে শিখে ফেলো।”
“আমার ভালো থাকা যার ওপর নির্ভর করছে সে ভালো থাকলেই চলবে।”
পরক্ষণেই বলল,
“এই, এটা কার নাম্বার? কার ফোন দিয়ে কথা বলছিস?”
আরিন্তা বলল,
“এতদিন পর কথা বলছি। আমি কেমন আছি তা না জিজ্ঞেস করে তুমি কী নিয়ে পড়ছো?”
কথাটা বলতে গিয়ে আরিন্তার গলাটা মৃদু কেঁপে উঠল। মিশকাত হেসে বলল,
“কত ভালো ছিলেন তা গলা শুনেই বুঝা যাচ্ছে। ফোন ঠিক করা হয়নি এখনও?”
“না।”
“তাহলে এটা কার নাম্বার?”
“পরিচিত মানুষেরই। তোমার কাজ কেমন চলছে?”
“প্রেমিকার বিরহে কি আর কাজ থামিয়ে রাখার উপায় আছে? কাজ কাজের মতো চলছে প্রতিদিন।”
“কাজের সাথে কোনোকিছু গুলিয়ে ফেলবে না। মন দিয়ে কাজ করবে সবসময়। কাজের মধ্যে থাকলে সবকিছু ভুলে থাকা যায়।”
“এসব ভুলভাল কথা কে বলল তোকে? আমি তো এক মুহুর্তের জন্যও ভুললাম না। ভোলার প্রসঙ্গই বা আসছে কেন?”
“জীবনে সব প্রসঙ্গেরই দরকার আছে। কোনো প্রসঙ্গই অপ্রয়োজনীয় নয়। বলা তো যায় না, কখন কোনটা এসে ভাগ্যে জুটে যায়। পূর্ব অভিজ্ঞতা ভালো।”
মিশকাত সন্দিহান কন্ঠে ডাকল,
“আরি?”
মিশকাতকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে আরিন্তা বলে উঠল,
“মিশু ভাই, একটা প্রশ্ন করব, সত্যি উত্তর দিবে?”
“মিথ্যা উত্তর কবে দিয়েছি?”
“তুমি বিশ্বাস করো আমি শুধুমাত্র তোমাকে মন থেকে চেয়েছি?”
মিশকাতের কপালে ভাঁজ পড়ল। মেয়েটার মনে কী চলছে বুঝতে পারছে না সে। তবে মন যে ঠিক নেই তা টের পাচ্ছে। সে শান্ত স্বরে শুধাল,
“কী হয়েছে আমার পোনির? এ কদিনে মন তো আমারও এলোমেলো হয়ে ছিল। তাই বলে এভাবে কথা বলতে হবে?”
“আমি তোমার মুখে উত্তরটা শুনতে চাইছি।”
“উত্তর তুই জানিস না?”
“জানি, তবু শুনব।”
“অবিশ্বাসের কী আছে? আমরা দুজনই জানি আমরা একে অপরকে কতটা চাই, কতটা ভালোবাসি। আমাকে মন থেকে না চাইলে তুই অযথা আমার জন্য অপেক্ষা করে আছিস কেন? তোর রোজকার অপেক্ষা, মনের আকাঙ্ক্ষা এসবই তো তোর প্রশ্নের উত্তর।”
আরিন্তার চোখ ভর্তি জল চলে এল। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মিশু ভাই, ভীষণ ভালোবাসি। প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকেই আমি চেয়েছি।’
কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য বাঁধায় আরিন্তার গলায় সমস্ত কথা আটকে গেল। কন্ঠনালিতে দলা পাকানো কান্না চেপে সে বলল,
“আমার ভালোবাসা যদি এক মুহুর্তের জন্যও তোমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে থাকে, তবে পারলে আমায় মাফ করে দিয়ো মিশু ভাই। আমি তোমার কাছে অপরাধী হয়ে রইলাম, সরি। আমার জন্য হলেও নিজেকে ভালো রেখো। কোনো একদিন শেষ দেখার বেলাতেও আমি তোমায় সুস্থ দেখতে চাই।”
হতবাক মিশকাতের প্রত্যুত্তর শোনার অপেক্ষাটুকু-ও আরিন্তা করল না। সঙ্গে-সঙ্গে ফোন কে’টে নাম্বারটা ব্লক করে দিলো। ওদিকে নিয়াজ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। কিন্তু ল্যাপটপ রেখে সে তখন থেকে হতভম্ব হয়ে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাসর ঘরে বসে তার সদ্য বিয়ে করা বউ তারই ফোন নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলছে। এ যেন তার জন্য আজকের সবচেয়ে বড়ো চমক। নিয়াজ কী রিয়্যাকশন দিবে বুঝে উঠতে পারল না। আরিন্তা চোখ ভর্তি ছলছল জল নিয়ে নিয়াজের দিকে তাকাল। নিয়াজের প্রশ্নভরা চোখের দিকে তাকিয়ে সে ফোনটা ফেরত দিয়ে ধরা গলায় বলল,
“সরি, সম্ভব হলে আপনিও আমায় মাফ করবেন। আমি সবার কাছে অপরাধী।”
কথাটা বলেই আরিন্তা হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতক্ষণে চেপে রাখা কান্নারা বাঁধ ভেঙে অঝোরে গড়িয়ে পড়ল। নিয়াজ বিস্ময়ের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে ফোনের নাম্বারটা চেক করল। কোন দেশের নাম্বার তা ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও, আরিন্তার ‘মিশু ভাই’ নামক মানুষটাকে চিনতে তার ভুল হলো না। আরিন্তার খালু যখন হসপিটালে ভর্তি ছিল, তখন অনেকবার ছেলেটার সাথে তার দেখা হয়েছিল, কথা-ও হয়েছিল। আমেরিকা চলে যাওয়ার আগেও ছেলেটা তাকে ফোন করে বাবার ব্যাপারে কথা বলেছিল। তখনই তার দেশ ছাড়ার কথা শুনেছিল নিয়াজ। ফোন থেকে চোখ তুলে কান্নারত আরিন্তার দিকে তাকিয়ে নিয়াজ বিভ্রান্ত মুখে শুধাল,
“এটা কি তোমার ওই খালাতো ভাইটা, হসপিটালে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”
আরিন্তা মুখ তুলল না, উত্তর-ও দিলো না। নিয়াজ মাথায় এক ঝাঁক বিশৃঙ্খল চিন্তা নিয়ে কিছুক্ষণ নিরব রইল। তারপর নিচু স্বরে বলল,
“কান্না থামাও আরিন্তা। এটা কান্নার সময় নয়। আমার সঙ্গে কথা বলো।”
আরিন্তা ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে নাকচ করল। নিয়াজ বলল,
“এইমাত্র তুমি যে সাহসটা দেখালে, এরপরও তোমার মনে হয় না আমার সঙ্গে তোমার খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত?”
আরিন্তা উত্তর দিলো,
“আমি জানি না।”
“তোমাকে জানতে হবে। আমরা কেউই বাচ্চা নয় যে এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় ভেবে নেব। আজ আমাদের দুজনের একটা নতুন পথ শুরু হয়েছে। একসঙ্গে চলতে গেলে আমাদের একে অপরকে জানতে হবে। তুমি আমাকে না জানতে চাইলেও, আমি তোমাকে জানতে চাই। কারণ গোটা জীবন আমি তোমার সঙ্গে কা’টাব। তোমার মনে কী চলছে তা আমাকে জানতে হবে। আমি চাই না আমার স্ত্রী মনে গোপন ব্যথা রেখে আমার হোক। তাছাড়া তুমি যেহেতু নিজ থেকেই আমার সামনে এমন একটা বিষয় তুলে আনলে, সেহেতু আমার মনে হয় না তোমার কোনোকিছু গোপন রাখার ইচ্ছা আছে।”
আরিন্তা হাঁটুতে মুখ গুঁজে রেখেই বলল,
“আমি পারছি না। আমাকে একটু একা ছেড়ে দিবেন, প্লিজ?”
“তোমার যতটা সময় প্রয়োজন আমি দিবো। তবু আমি তোমার মনের কথা জানতে চাই। আমাকে নিয়ে হোক বা তোমার মিশু ভাইকে নিয়ে হোক, তোমার মনে কী চলছে আমাকে জানতে হবে। এটা আমাদের জীবনের ব্যাপার। তোমাকে আমার যথেষ্ট বুদ্ধিমতী বলেই মনে হয়। একটু বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ।”
আরিন্তা কিছু সময় পর মুখ তুলল। তার সারা মুখ অশ্রুসিক্ত। লাল টকটকে দুচোখ ভর্তি যন্ত্রণা। নিয়াজ তার বিষণ্ণ মুখটার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। আরিন্তা তাকাল না। কোলের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ভাঙা গলায় বলল,
“বুঝতে পারছি আপনার কথা। কিন্তু আমি মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন। দয়া করে আমাকে একটু সময় দিন। আমার সত্যিই কোনোকিছু গোপন রাখার ইচ্ছা নেই। আমি নিজেই আপনাকে সব বলব।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২০.
মিশকাতের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা আরিন্তা নিয়াজকে বলেছে। বাদ দেয়নি বাবা-ভাইয়ের করা অন্যায়ের কথা-ও। কথার মাঝে সে বারবার থেমেছে, কখনও কেঁদেছে; তবু নিয়াজ বিরক্ত হয়নি। আরিন্তাকে সময় দিয়ে ধৈর্য ধরে সবটা শুনেছে। অথচ তার ভেতরে মিশ্র অনুভূতির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তোমার সাথে এটা সত্যিই ঠিক হয়নি। আমি এসব আগে থেকে জানতে পারলে হয়তো ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না।”
আরিন্তা ব্যথিত মুখে বলল,
“আপনি জানতে পারলেও গড়াত। আপনি বিয়ে ভেঙে দিলে অন্য কোনো বড়োলোক পাত্র খুঁজে আমার বিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু আপনার মতো বুদ্ধিমান একজন মানুষ যে বিয়ের আগে অন্তত হবু বউয়ের সঙ্গে একবার কথা বলে নিবে না, এটা আমি ভাবিনি।”
“তখন তো পেলব বলেছিল তুমি কথা বলতে চাও না। আর আমি ওর মুখে তোমার এত গল্প শুনেছি যে, আমার মনেই হয়নি তোমার অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে। তোমার অস্বস্তির কথা ভেবেই আমি আগে কথা বলার গুরুত্ব দেখাইনি। বড়োদের সামনে লজ্জা-ও লাগছিল। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তো আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তখন-ও পেলব একই কথা বলেছিল।”
“কারণ তারা জানত কথা বলতে দিলেই বিয়েটা ভেঙে যাবে।”
“কিছু মনে কোরো না। আমি তাদের অনেক ভালো মনের মানুষ ভেবেছিলাম।”
“মনে করার কিছু নেই। সবার কাছে সবসময় তারা ভালো মনের-ই মানুষ। এবারে একটু রূপ বদলাতে হয়েছে অহংকারে আঘাত লাগায়। চিন্তা নেই, ওই রূপ আপনাকে কখনও দেখতে হবে না। আপনি তাদের বড়ো সাধের জামাই বলে কথা।”
নিয়াজ মাথা দুলিয়ে বলল,
“তোমার সাথে এটা একদম ঠিক করেনি।”
“আপনার সাথেও ঠিক করেনি।”
নিয়াজ স্থির দৃষ্টিতে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে শুধাল,
“তুমি আমায় গ্রহণ করবে না, তাই না আরিন্তা?”
“আমার ভালোবাসার পাত্রটা আমি এক পুরুষকে দিয়ে দিয়েছি। আমার হাতে অবশিষ্ট কিছু নেই বিশ্বাস করুন।”
“তোমাকে যে আমার বড্ড প্রয়োজন।”
আরিন্তা এ কথার জবাব দিলো না। নিয়াজের চোখের গভীরে, কন্ঠের কম্পনে কী যেন এক ব্যথা স্পষ্ট। সে বুঝতে পারছে, কিন্তু নিয়াজের অপ্রকাশিত ব্যথার কারণ জানার আগ্রহ তার নেই। নিয়াজ বলল,
“জানো আরিন্তা? গত এক সপ্তাহে আমি তোমার জন্য এত কথা জমিয়ে ফেলেছি যে, এখন আমার কথার ঝুলিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। তোমার বর্তমান অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। তাই ওসব কথা গিলে নিলাম। পরে কখনও সুযোগ হলে বলব। জানি আমাদের সম্পর্কটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। তোমার মনে হয়তো আমার জায়গাও হবে না। কিন্তু আমার কাছে তুমি আর এই সম্পর্ক, দুটোই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
কথাটা শুনেই আরিন্তার মুখটা কালো হয়ে গেল। নিয়াজ বলল,
“তোমার ভয় নেই। আমি কখনোই তোমাকে কোনোকিছুতে জোর করব না। তোমার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাই। আপাতত আমাকে তুমি ভালো বন্ধু মনে করতে পারো। বন্ধু হিসেবে আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”
“তারপর?”
“তারপরের প্রশ্নটা থাক না। সম্পর্কটা যখন তৈরি হয়ে গেছে, এখন তো আমাদের কিছু করার নেই। আমি তোমাকে মেনে নিতে বলছি না। কিন্তু কষ্ট হলেও এখন তোমার এই সংসারে থাকতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। আমাকে তুমি না মানলেও বন্ধু হিসেবে আমার একটা অনুরোধ তুমি রেখো। আমার বাবাকে একটু আপন করে নিয়ো। ওই মানুষটা তোমার মুখে বাবা ডাকটা শোনার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। তাকে ডাকার কেউ নেই।”
আরিন্তা-ও জানে এখন এই সংসারে পড়ে থাকা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। চারদিকের সব পথ বন্ধ। এতক্ষণে তার বুঝতে বাকি নেই নিয়াজ কেমন মানসিকতার ছেলে। চাইলে এই মুহূর্তে নিয়াজের থেকে সে এক কথায় মুক্তি চাইতে পারে। কিন্তু মুক্তি নিয়ে তার যাওয়ার জায়গা নেই। কার কাছে যাবে সে? যার কাছে যাওয়ার আছে, সে-ই যে শত-সহস্র মাইল দূরে। মুক্তি মেললে-ও তার কাছে ছুটে যাওয়া সম্ভব না। বাবার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছাটা তার ম’রে গেছে। তার ওপর নিয়াজের সাথে সম্পর্ক নিয়ে টানাহেঁচড়া তারা কেউই মেনে নিবে না।
তখন থেকে সুবর্ণার ফোন বেজে চলেছে। কিন্তু সে ফোন ধরার সাহস পাচ্ছে না। কারণ স্ক্রিনে ভাসছে ইংরেজি অক্ষরের ‘ভাইয়া’ শব্দটা। এই প্রথম ভাইয়ের ফোন ধরতে ভয় লাগছে তার। প্রথমবারে সুবর্ণা ফোন রিসিভ করতে ব্যর্থ হলো। দ্বিতীয়বারে ফোন কে’টে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রিসিভ করল ঠিকই, কিন্তু সবসময়ের মতো সঙ্গে-সঙ্গে কথা বলতে পারল না। মিশকাত বলল,
“হ্যালো সুবর্ণা, শুনতে পাচ্ছিস?”
সুবর্ণা গলা ঝেড়ে বলল,
“হ্যাঁ ভাইয়া। কী খবর তোমার?”
“তোদের কী খবর তা আগে বল। কোথায় আছিস?”
“বাড়িতেই।”
“বাবা-মা কোথায়?”
“বাড়িতে নেই।”
“পেলবদের বাড়ি?”
“হুঁ।”
“তুই একা বাড়িতে?”
“একা না, মিলিকে ডেকে এনেছি। ও ঘুমাচ্ছে।”
“তুই ওই বাড়িতে যাসনি?”
“গিয়েছিলাম, আবার চলে এসেছি বিকালে।”
“কেন? বৌ-ভাতের আগেই বিয়ে খাওয়া শেষ তোর?”
সুবর্ণা চমকে উঠল। মিনমিনে গলায় বলল,
“তুমি জানো?”
“জানতাম না। ফেসবুকে ঢুকিনি সারাদিন। একটু আগে সাইফুলের পোস্ট চোখে পড়ল। ওই বাড়িতে ফোন করলাম, কেউ রিসিভ করেনি। বাবা-মাও না। যাইহোক, কেমন কা’টল তোর বোনের বিয়ে?”
ভাইয়ের এত স্বাভাবিক কথাবার্তা সুবর্ণার কাছে ভালো লাগল না। সে ধরা গলায় বলল,
“সরি ভাইয়া। সবকিছু জানার পরেও তোমাকে কিছু জানানোর সুযোগ পাইনি আমি।”
“আরে তোকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। কৈফিয়ত ছাড়াই আমার সব বুঝা হয়ে গেছে। শুধু একটু দেরী হয়েছে বুঝতে। তোর বোনকে আমার তরফ থেকে নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানিয়ে দিস। বিয়ের উপহার পেয়ে যাবে সময়মতো, সমস্যা নেই। দাওয়াত পাইনি তো কী হয়েছে? বড়ো ভাইয়ের একটা দায়িত্ব আছে না?”
সুবর্ণা কাঁদতে-কাঁদতে উত্তর দিলো,
“আপুকে তুমি ভুল বুঝো না ভাইয়া। সে শুধুমাত্র তোমার জন্য একা-এটা অনেক লড়াই করেছে, কিন্তু সবার সাথে পেরে ওঠেনি। উলটো মানসিক টর্চার চলেছে তার ওপর। তাকে সামনে থেকে দেখলে বুঝতে, প্রাণটা ফেলে রেখে সে শশুরবাড়ি গিয়েছে। এই সম্পর্কটা কতদিন টিকে, তা নিয়েই সন্দেহ হচ্ছে আমার।”
“সুবর্ণা, তোর আপুকে যদি এই পৃথিবীতে সবথেকে ভালোভাবে যে চিনে থাকে, সে আমি। আমার পর দ্বিতীয় কেউ তাকে অমনভাবে চিনতে পারবে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমার কাছে কাউকে দোষী হতে হবে না। তোর ভাইয়ের ভাগ্য তো এমনই, দেখছিস না?”
“তুমি কষ্ট পেয়ো না ভাইয়া, প্লিজ।”
“চিন্তা করিস না। আমি ভালো থাকব। আমাকে তো ভালো থাকতে হবে। নইলে এতগুলো মানুষকে কী করে ভালো রাখব আমি?”
“আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ো না। আমি বাচ্চা নই।”
“আমি ম’রব না রে বোন। যতদিন মাথার ওপর দায়িত্ব আছে, ততদিন আমার নিঃশ্বাস চলবে। তোর বোনকেও বলিস ভালোভাবে বেঁচে থাকতে। তাকে জানিয়ে দিস, সমস্ত সম্পর্ক হারিয়ে গেলেও, তার সাথে আমার শেষ দেখাটা বাকি আছে। সেই দিনটির জন্য তাকে বাঁচতে হবে।”
সুবর্ণা কাঁদছে। মিশকাত সেই কান্নার শব্দ শুনতে পারল না। ফোন কে’টে দিলো। ফোন রাখতে গিয়েও চোখ থমকাল ফোনের ওয়ালপেপারে ভাসতে থাকা সেই ছবিটা, যেখানে নববধূ সাজা আরিন্তার চোখে তার চোখ আটকা পড়ে ছিল। মিশকাত কয়েক মুহূর্ত ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ওয়ালপেপারের ছবিটা পালটে চুপচাপ ফোনটা রেখে দিলো। সময়ে-অসময়ে অন্য কারো অপরূপা বধূকে মগ্ন হয়ে দেখার অধিকার সে কী করে কেড়ে নিবে?
সকাল থেকে বেশ কয়েকবার পেলব নিয়াজকে ফোন করেছে। আরিন্তার সাথে কথা বলতে চাইছে সে। নিয়াজ আরিন্তার কাছে ফোন দিতে চাইলেও প্রতিবারই আরিন্তা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কাটকাট বলে দিয়েছে নিজ হাতে তার সাজানো জীবন নষ্ট করে দিয়েছে, এমন মানুষের সাথে বাকি জীবনেও তার সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার সাধ নেই। নিয়াজ তাকে বুঝাতে চেয়েছিল, কিন্তু সে তার কথায় অনড়। তবে আরিন্তা মায়ের ফোন উপেক্ষা করেনি। মেরিনা যখন ফোন করেছে, তখন সে ভালোভাবেই কথা বলেছে। বাবার সাথেও কথা হয়েছে, তবে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি আরিন্তা। একদিন বাদেই তার বউভাত। আপনজনরা সবাই তার শশুরবাড়ি আসবে। এটা নিয়েও তার বিন্দুমাত্র আনন্দ নেই। নিয়াজের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই আজ চলে গেছে। বউভাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না তারা। হয়তো আগামীকাল অতিথি হয়ে এসে পেটভোজ সেরে চলে যাবে। এদিকে সমস্ত আয়োজন নিয়ে নিয়াজ ভীষণ ব্যস্ত। একা সবদিক সামলে উঠতে পারবে না বলে সে ছেলেপুলে ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। আরিন্তা এখানে নতুন হলেও, নিয়াজের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যে তাদের খুব বেশি সুসম্পর্ক নেই, তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি তার। বিশেষ করে তার বাবার দিকের আত্মীয়রা আপন হয়েও কেমন পর। ছেলের বিয়েতে সবাই এসেছে কেবল অতিথি হয়ে। কারো কোনো দায়ভার নেই। তবে নিয়াজের মায়ের দিকের আত্মীয়দের মধ্যে তার খালা-খালু আর খালাতো, মামাতো ভাই-বোন এসেছে। তবে তারা সংখ্যায় খুবই কম। ভাইদের সংখ্যা নিতান্তই কম হওয়ায় নিয়াজকে সাহায্য করার মতো লোকের অভাব পড়েছে।
নতুন সংসারের প্রতি বিশেষ আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও আরিন্তাকে প্রথম দিনেই কাজের মহিলাটি বিপাকে ফেলে দিয়েছে। বাড়ির কোথায় কী আছে, নিয়াজের আত্মীয়-স্বজনরা কে কেমন, নিয়াজ আর তার বাবার কখন কী প্রয়োজন সমস্ত কথা সে গড়গড় করে বলে চলেছে। আরিন্তা তাকে বারণ করতে না পেরে চুপচাপ সব কথা গিলছে। মহিলারই বা কী দোষ? সে তো ভাবছে নতুন বউয়ের এই সংসার সম্পর্কে সবকিছু জেনে নেওয়া দরকার। শাশুড়ি নেই, সংসারটা তো তাকেই নিজ হাতে গুছিয়ে নিতে হবে। মানবতার খাতিরে আরিন্তা কাজে হাত লাগাতে চেয়েছিল, কিন্তু নিয়াজের খালা তাকে হাত লাগাতে দেয়নি। দুদিন বাদে তারা চলে গেলে মেয়েটাকেই সারাবছর এই সংসার একা হাতে সামলাতে হবে। অন্তত প্রথম দুয়েকটা দিন সবকিছু দেখেশুনে নিজেকে প্রস্তুত করুক। সারাদিন নিয়াজ ব্যস্ত থাকলেও সময় পেলেই আরিন্তার খবর নিতে ভোলেনি। শুধু নিয়াজ নয়, তার বাবাও কিছুক্ষণ পরপর পুত্রবধূর খোঁজ করেছে। নিয়াজের বাবার আচরণ, কথাবার্তা আরিন্তাকে আকৃষ্ট করেছে। লোকটা পছন্দ করার মতো একজন মানুষ। তার প্রতিটি কথা খুবই সুন্দর। কথার মাঝে আরিন্তাকে যখন বারবার ‘মা’ বলে ডাকছিল, তখন তার অজান্তেই বেশ ভালো লাগছিল। লোকটার ডাকে কেমন অদ্ভুত মায়া মিশে আছে। নিজেকে অনুভূতিশূন্য মনে হলেও এই মানুষটার সাথে কথা বলার পর আরিন্তা ভাবছে, এটুকু সময়ের মধ্যেও কারোর কথার মায়ায় পড়া যায়? কী অদ্ভুত মন!
বিয়ের দ্বিতীয় রাতেও স্ত্রীকে বিছানার মাঝে কোলবালিশের দেয়াল গড়তে দেখে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিয়াজ। ইচ্ছা করলেই সে আরিন্তার সামনে অনেক জ্ঞানমূলক যুক্তির ঝুলি খুলে বসতে পারে। কিন্তু সে আরিন্তার বর্তমান মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছে। সে জানে মানসিক অশান্তি একটা মানুষের জন্য কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। নিয়াজ বরাবরই যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। না ভেবে সে কোনো ভুল কাজ করে না। সে চাইলেই পারে আরিন্তার ওপর জোর খাটাতে। আইনত অধিকার আছে তার। কিন্তু সে কাপুরুষ নয়। জীবনে কোনোদিন সে এমন কোনো কাজ করেনি যাতে মানুষ তাকে কাপুরুষ ভাবে। নিজের স্ত্রীর সামনে কাপুরুষ সাজার তো প্রশ্নই আসে না। আরিন্তা তার পছন্দের মানুষ, ভীষণ শখের নারী। সম্পর্কটার শুরু এমন বাজে অভিজ্ঞতা দিয়ে হলেও, সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার। আরিন্তাকে নিজের করে ধরে রাখার। তবে সেটা জোর খাটিয়ে নয়। সে চায় না মনে অন্য কাউকে রেখে আরিন্তা নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তার হোক। এমন কোনো দিন এলে যেন আরিন্তা সজ্ঞানে মন থেকে তার কাছে ধরা দেয়।
আরিন্তা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নিয়াজ আপনমনে অনেকটা সময় ভাবার পর ড্রয়ার খুলে দুটো বাক্স এনে আরিন্তার সামনে রেখে বলল,
“এগুলো তোমার জন্য।”
আরিন্তা বাক্সগুলোর দিকে তাকাল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে একটা গয়নার বাক্স, আরেকটা ফোনের। আরিন্তা বলল,
“ধন্যবাদ, কিন্তু আমার এসব চাই না।”
নিয়াজ বলল,
“জানি তুমি চাও না। তবু এগুলো তোমায় নিতে হবে।”
নিয়াজ গয়নার বাক্সটা খুলল। একটা হার, দুটো বালা, দুটো আংটি আর এক জোড়া মাঝারি আকারের কানের দুল। কানের দুল দুটো তকতকে নতুন মনে হলেও বাকিগুলো একটু পুরোনো মনে হচ্ছে। নিয়াজ বলল,
“এই হার, বালা আর আংটি আমার মায়ের। এগুলো এতদিন তোমার জন্য রাখা ছিল। এসব তোমার পাওনা। দয়া করে না করবে না। বাবা আমাকে বারবার করে মনে করিয়ে দিয়েছে এগুলো তোমাকে দেওয়ার জন্য। তুমি ফিরিয়ে দিলে সে কষ্ট পাবে। আর এই কানের দুল দুটো আমি তোমার জন্য গড়িয়ে রেখেছিলাম। গতকাল দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেওয়া হয়ে ওঠেনি। আমাদের ভেতরকার সম্পর্ক যেমনই হোক আমি চাই না তা অন্য কেউ জানুক। বাড়ি ফিরলে নিশ্চয়ই সবাই জানতে চাইবে তুমি আমার থেকে কী উপহার পেয়েছ। আমি নিজেও অস্বস্তিতে পড়তে চাই না, তোমাকেও অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না।”
“সম্পর্কই যেখানে ঠিক নেই, সেখানে এতকিছু ভেবে কী হবে? অন্য কারো কথাকে আমি আসলে তোয়াক্কা করি না আর। তোয়াক্কা করার দিন চলে গেছে আমার।”
“তবু আমার কথাগুলো একবার ভেবে দেখো। আমি তোমাকে অযথা কথা বলছি না।”
আরিন্তা কিছু সময় চুপ থেকে শুধাল,
“আর ফোন দিচ্ছেন যে? আপনার ভয় লাগছে না সব জেনেবুঝে আমার হাতে ফোন দিতে?”
“একজনের জন্য তো আমি তোমাকে সারা দুনিয়ার মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি না। আপনজনদের সাথে যোগাযোগ করার অধিকার আছে তোমার।”
“আপনার মনে হচ্ছে না আপনি ভুল করছেন?”
নিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“জানি না। হয়তো ভুল-ই করছি। যে থাকার সে এমনি থাকবে। চলে যাওয়ার হলে সে মানুষকে তো আর বেঁধে রাখা যায় না। তুমি আমার কাছে বন্দিনী নও। তবে এটা ভেবো না যে আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো। ছেড়ে দেওয়ার মতো অত বড়ো ভুল অন্তত আমি করতে পারব না, দুঃখিত। আমি তোমায় মুক্ত রেখেই অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধার চেষ্টা করব। সফল হলে তুমি সেচ্ছায় থেকে যাবে।”
“আর ব্যর্থ হলে?”
“তোমার প্রতি আমার অভিযোগ থাকবে না। ব্যর্থতা আমি নিজের করে নেব। তোমার কাছে শুধু অনুরোধ থাকবে ভুল পথে না হাঁটার। তোমার প্রতি অনেক অন্যায় হয়েছে। তাই বলে তুমিও সেই পথে পা বাড়িয়ো না। এরপর যা করবে, নিজের জ্ঞান থেকে ভেবে কোরো।”
“আপনি জানেন আপনার এসব কথা শুনলে লোকে আপনাকে অতি বোকা ভাববে?”
“তুমি কী ভাবছো?”
“বুদ্ধিমান।”
নিয়াজ হেসে বলল,
“দ্যাটস্ মাই প্লেজার।”
বউভাতের বিরাট আয়োজন হয়েছে নিয়াজের বাড়িতে। আপনজন থেকে বাইরের অতিথিই তার বেশি। আছে হসপিটালের সহকর্মীরা। বাড়িভর্তি লোকজনের মধ্যে একমাত্র আরিন্তা চুপচাপ এক জায়গায় বসে আছে। আজ তার কাজই সেজেগুজে বসে সবার সাথে ফটোশুটে অংশ নেওয়া। বাবার বাড়ির মানুষ এলেও আরিন্তা স্বাভাবিক কুশল বিনিময় ছাড়া কারো সাথেই তেমন কথা বাড়ায়নি। পেলব তার কাছে এসে বসলেও সে ভাইয়ের সাথে এক বাক্যও ব্যয় করেনি। মেরিনাও এসেছে। সে এসে হতেই মেয়ের কাছে-কাছে থাকছে। বুঝার চেষ্টা করছে মেয়ের মনে কী চলছে। পেলব অনেকবারই বোনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই আরিন্তা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। খাওয়ার সময়ও আরিন্তার পাতে এটা-ওটা তুলে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। আরিন্তা তখন নিচু গলায় মেরিনাকে বলেছে,
“মা, আমার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত যত্নের আর প্রয়োজন নেই তোমাদের। এতদিন যা যত্ন নিয়েছ, তাতেই আমি তোমাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। এখন আর আমি এত যত্ন নিতে পারছি না, মাফ করো।”
মেরিনা ইশারায় পেলবকে বারণ করল আরিন্তার কাছে আসতে। পাশে বসা নিয়াজ অনেক চেষ্টা করল আরিন্তাকে খাওয়ানোর জন্য। আরিন্তা তেমন কিছু খেতে পারেনি। আরিন্তা খেয়াল করেছে তার খালা-খালু, সুবর্ণা কেউই আসেনি এখানে। এই নিয়ে সে কোনো প্রশ্ন-ও করেনি। মেরিনা নিজেই একবার যেচে বলেছিল,
“তোর খালা-খালু আগেই আসবে না বলে দিয়েছে। সুবর্ণাকে অনেক সাধলাম, এল-ই না। তুই আসার পর আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেল, আর আসেইনি মেয়েটা। আজ তুই বাড়ি গিয়ে ওকে আসতে বলিস। তুই বললে ও না এসে পারবে না।”
আরিন্তা উত্তর দিয়েছিল,
“ক্ষত খোঁচানোর কী দরকার মা? আমার ভাইয়ের প্রতি আমার যেমন তীব্র ঘৃণা আসছে, ওর ভাইয়ের জন্য ওর তেমন তীব্র কষ্ট হচ্ছে। কারোর জন্য আর ভেবো না মা। সবাইকে যার যার মতো থাকতে দাও। ভালো থাকুক, খারাপ থাকুক, সবাই নিজের মতোই থাকুক। অন্তত কাউকে বারবার বাজেভাবে আঘাত দিতে তোমাদের নরকে ডেকো না।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।