বিয়ে থা_২ পর্ব-২২

0
47

#বিয়ে_থা_২
#পর্ব-২২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

তখন গোধূলি বিকেল। বউ কথা কও বাড়িটির ড্রয়িংরুমে সবাই গোল হয়ে বসে আছে। মধ্যমণি হলো ফারিন। একটু আগেই এডমিশনের রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে। আলোচনার বিষয় সেটাই।

বিয়ের কয়েকমাস হয়ে গেছে। ধ্রুব ঢাকাতেই টান্সফার হয়েছে। তবে বর্তমানে সে একটি মিশনের কাজে দেশের বাহিরে অবস্থান করছে। কয়েকমাস আগে ফারিনের বার্থডের দিন ধারা পইপই করে বলেছেন ভালো ভার্সিটিতে যাতে চান্স হয়, নাহলে ফারিনের কপালে দুঃখ আছে। হুমকিটি দেবার কারণ আছে অবশ্য, ফারিনের পরিবর্তন হয়েছে। চোখের নিচের কালো দাগই তার প্রমাণ। গুলোমোলো মেয়েটি শুকিয়ে গেছে অনেক৷ ধারা মেয়ের পরিবর্তন লক্ষ করে বুঝেছেন শুধু এডমিশনের চিন্তা নয় আরও কিছু একটার চিন্তা ফারিনের মনে রয়েছে। নাহলে তার নাদুসনুদুস বাচ্চাটার এমন হাল হওয়ার কোনো মানেই হয়না। ধ্রুবর মতো ফারিন ও পড়াশোনাতে অনেক ভালো। কিন্তু সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে সেই ফারিন পাবলিকে চান্স পেলো না। দুঃখে নয় মেয়ের চিন্তায় ধারা আজকের এই মিটিং বসিয়েছেন।

ফারিন চুপচাপ সবার মাঝে বসে আছে। ফাহিম মাহবুব গলা পরিষ্কার করে বললেন,

‘ সবসময়ই তোমার বন্ধু হতে চেষ্টা করেছি, তুমি যদি নিজের সমস্যাটা খুলে না বলো তবে সমাধান হবে কিভাবে মা? ‘

ধারা বুকে আগলে নিলেন।

‘ তুই নির্ভয়ে সব বলতে পারিস। আমরা তো তেমন মা বাবা নই যে সন্তানকে বুঝবো না। বলো না মা, কি হয়েছে তোর? ‘

এ পর্যায়ে কথা বললো নিনীকা।

‘ তোমার ভাইয়া ফোন করেই তোমার কথা জিজ্ঞেস করেন। তুমি যে ভালো নেই সেটা বাতাসের সাথে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও কি চুপ করে থাকবে? ‘

ফারিন আহ্লাদে, অভিমানে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। ফাহিম মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ বাবা ক্যাপ্টেন নিরব আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে৷ ‘

ফাহিম মাহবুব অবাক হয়ে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

‘ তুমি তাকে অনুভূতি জানিয়েছিলে? মাই গড! ‘

ধারা কটমট চোখে বাপ মেয়েকে দেখছেন।

‘ এটা তবে তোমার মেয়ের প্রেমের কাহিনি! আমি আরও কতো কি ভেবে দিশেহারা হয়েছি। যেমন বাপ তেমন মেয়ে। দুজনেই সারাজীবন জ্বা*লিয়ে মা*রলে। ‘

ফাহিম মাহবুব ধমক দিতে গিয়ে ও দিলেন না। ফারিনকে কান্না থামিয়ে শান্ত হয়ে বসতে বললেন। ফারিন শান্ত হয়ে বলতে শুরু করলো কয়েকমাস আগের ঘটনা।

‘ ভাইয়ার থেকে ক্যাপ্টেন নিরবের নাম্বার নিয়েছিলাম আমি। তাকে ফোনও করেছি। দুই এক দিন বন্ধ পাওয়ার পর একদিন ফোন ঢুকে। তিনি রিসিভ করেন। আমি নিজের পরিচয় দেওয়ার পর কেন ফোন করেছি কারণ জানতে চান। আমি তাকে নিজের অনুভূতি জানালে তিনি আমাকে মুখের উপর প্রত্যাখান করেন বাবা! ‘

ফারিনের কষ্টে ঠোঁট ফুলে যাচ্ছে। ফাহিম মাহবুবের বুক হাহাকার করলো।

‘ তোমাকে বলেছিলাম বাবাকে তোমার অনুভূতি জানাতে মাই চাইল্ড। বাকিটা না-হয় আমরা বড়োরা পারিবারিক ভাবে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতাম! হুট করে কেউ তো কাউকে পছন্দ করতে পারবে না! তুমি নিরবকে পছন্দ করো, কারণ তুমি তার মধ্যে পছন্দ করার মতো কিছু পেয়েছো। নিরব তোমাকে চিনেই না ভালো করে। সেখানে সে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করবে সেটা স্বাভাবিক বিষয়। এর জন্য কেঁদেকেটে নিজের এমন হাল করতে হবে কেন? এডমিশন দিলে কষ্ট করে অথচ কষ্টের ফল পেলে না! ‘

ফারিন কানে কানে ধারাকে লুকিয়ে বলল,

‘ আমি পরীক্ষার হলে গিয়ে সব ভুলে গেছিলাম বাবা। কিন্তু বিশ্বাস করো সব কমন পড়েছিলো, সেটা আমার টাইম শেষ হওয়ার পর মনে পড়েছে। ‘

ফাহিম মাহবুব অবাক হচ্ছেন শুধু। ভাবলেন এ বিষয়ে শীগ্রই কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। তার আহ্লাদী মেয়ে টা কষ্ট সহ্য করতে পারে না। এই কয়েকমাস যে মনে মনে এতোসব পুষে রেখেছে সেটা ভেবেই তিনি বিস্মিত হচ্ছেন।

‘ তোমার মেয়েকে পাইভেটে ভর্তি করে এসো যাও। পড়াশোনা তো আকাশে তুলে বসে আছে। ‘

ধারা রাগ দেখিয়ে উঠে গেলেন। ফারিন ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

‘ আমি সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দিবো বাবা? ‘

ফাহিম মাহবুব দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।

‘ দরকার নেই মা, পাইভেটে পড়তে তো আপত্তি নেই তোমার? তবে এক বছর নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া ক্যাপ্টেন সাহেবকে বিয়ে করতে তাড়াতাড়ি বড়ো হতে হবে না? ‘

ফারিনের চোখমুখ উজ্জ্বল হলো। নিনীকা হেসে ফেললো। তার শ্বশুর বাড়ির সবাই এতো চমৎকার!

রুমে এসে নিনীকা ধ্রুবর নাম্বারে ডায়াল করলো। না বন্ধ দেখাচ্ছে। ধ্রুব নিজ থেকে ফোন না দিলে নাম্বার টা সারাক্ষণ বন্ধই থাকে। নিনীকা রুমের ডিভানে পা ছড়িয়ে বসলো৷ কতোমাস হলো মানুষটাকে সে দেখে না৷ নিনীকা এখন সাংসারিক হয়ে গেছে। বিয়ের আগের রাতের মিটিং টা ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ধ্রুবসহ সবাইকে সেটা জানানো ও হয়েছে। বিয়ের পর নিনীকা স্যাোশালে স্ট্যাটাস ও দিয়েছে এ বিষয়ে। সে সিনেমাজগত থেকে সরে এসেছে। এসবের প্রতি তার আর কোনো টান নেই। ধ্রুব যখন জেনেছিল তখন বুঝিয়ে বলেছিল নিনীকা চাইলে নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করতে পারবে। ধ্রুব কোনো বাঁধা দিবে না। কিন্তু নিনীকার মন মানতে নারাজ৷ সিনেমাকে সে কখনো লাইফ বানায়নি। শখ শেষ হয়ে গেছে। তার এখন শখ সংসার করা৷ সে মনপ্রাণ দিয়ে সেটাই করছে। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হয়েছে। এখনো হয়। অনেক সিনেমার অফার আসে।

নিনীকা সংসার করার ফাঁকে শেখ বাড়ির বিজনেসটা ও দেখছে। পুরোদমে সে অফিস করছে না৷ তবে মাঝে মধ্যে রমজান শেখ তাকে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে উপস্থিত করান।

বিয়ের আগের নিনীকা ও পরের নিনীকার মধ্যে এই হলো তফাত।

নিনীকা আলমিরা থেকে ধ্রুবর শার্ট বের করলো। শরীরে জড়িয়ে নাক টেনে গন্ধ নিলো। সে সবকিছুতে ধ্রুবর অভাববোধ করছে। মানুষটাকে মারাত্মক ভাবে মিস করছে। কবে দেশে ফিরবে সেটা অজানা। মিশন শেষ হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় বলেনি ধ্রুব। তবে মানুষ টা যে বেশ পরিশ্রমী ও সাহসী সেটা মানতে হবে। মিশনে যাওয়ার পর একবারই ভিডিও কলে দেখেছে নিনীকা। তারপর আর দেখেনি। মানুষ টা কি প্রতিদিন একবার করে ভিডিও কল করতে পারে না? এইযে নিনীকার চাতক পাখির মতো পথ চেয়ে থাকে, সেটা কি মানুষটার অজানা?

উঁহু মানুষ টা সব বুঝে। নিনীকাকে আগাগোড়া বুঝার ক্ষমতা স্বামী নামক মানুষ টা কিভাবে যেনো আয়ত্ত করে ফেলেছে। কিছু লোকাতে চাইলেও নিনীকা ধরা পড়ে যায়।

দুদিন আগের ঘটনা। নিনীকা মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে। কপালের সাইডে একটু লেগেছিলো তার। ধ্রুবর থেকে লুকাতে চেষ্টা করতে গিয়ে পড়েছিল বিপদে। নির্লজ্জ লোক বলেছিলো,

‘ হিসেব অনুযায়ী আমি তো কয়েকমাস হলো তোমার কাছে নেই। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার রিজন তবে কি হতে পারে? ‘

নিনীকা লুকিয়ে না রেখে শেষমেশ বলেছিলো প্রেশার লো হয়ে যাওয়ার কথা। ফারিনকে নিয়ে বাহিরের ছোট ফুচকা খাওয়ার পর থেকেই তার কেমন একটা লাগছিলো। হয়তো ওগুলো ভালো ছিলো না। ধ্রুব সব শুনে শাসনের স্বরে বলেছে,

‘ ফুচকা খেতে হলে রেস্টুরেন্টে যাবে, নয়তো বাড়িতে বানিয়ে খাবে। খবরদার রাস্তাঘাটের খোলা খাবার খাবে না! আমি যদি এসে আমার সুস্থ স্বাভাবিক বউকে ফিরে না পাই তবে তোমাকে শাস্তি দিবো। ‘

নিনীকার ঠোঁটে হাসি। ধ্রুবকে মনে করে মিটিমিটি হাসছে সে। তখনই রুমে ঢুকলো ফারিন। নিনীকাকে হাসতে দেখে বলল,

‘ ভাইয়াকে মনে করে হাসছো নাকি ভাবী? ‘

নিনীকা আগের থেকে গুলোমোলো হয়েছে। গাল দুটোয় গোলাপি আভা থাকে সারাক্ষণ। লজ্জা পেলে তা যেনো আরও স্পষ্ট হয়। ফারিন ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

‘ আমি তবে সত্যি বলেছি, তুমি ভাইয়াকেই ভাবছিলে! ‘

ধরা পড়ে নিনীকা লজ্জা ভুলে হেঁসে ফেললো৷ চোখের সামনে ভেসে উঠলো ধ্রুবর চমৎকার হাসিখুশি মুখশ্রী।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে