#বিয়ে_থা_২
#পর্ব-২০
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
সারাদিন পর শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে। ঝিমুনি ভাব চলে এসেছে। নিনীকা ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। ধ্রুবর দেখা নেই। ফ্রেশ হয়ে কোথাও একটা চলে গেছে। বাহিরের অন্ধকার জানান দিচ্ছে রাত গভীর হচ্ছে। মানুষটা এখনো আসছে না কেন?
নিনীকার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হলো। ঘড়ির টাইম রাত এগারোটায় গিয়েছে৷ ধরনী সাদা হয়ে আবার কালো হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড ঝড় উঠেছে। নিনীকার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় দাড়ালো। টিপটপ করে পানি পড়ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে নিনীকার পড়োনের শুভ্র রঙের ওয়েস্টার্ন গাউনটা। উন্মুক্ত পায়ে বৃষ্টির পানি পড়তেই শরীর শিরশির করে উঠলো৷ নিনীকা হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতে চাইলো। মুখশ্রী উঁচু করে দিলো। থুতনি বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে গলায়। শুভ্র রঙের পাতলা গাউনটা ভিজে দেহের সাথে মিশে গেছে৷ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেহের প্রতিটি ভাজ। নিনীকার ভেজা চোখ গেলো গেইটের দিকে। জীপগাড়িটি প্রবেশ করছে। নিনীকা চোখ সরিয়ে নিলো। কোথাও একটা অভিমান চাপা পড়ে গেলো।
দ্রুত পায়ে বাড়িতে ঢুকলো ধ্রুব। শরীর ভিজে গেছে। ভেজা চুল কপালে লেপ্টে রয়েছে। নিজের রুমে প্রবেশ করতেই শূন্যতা অনুভব করলো। রুমের রানীর অনুপস্থিতি মনে ধাক্কা দিলো।
ধ্রুব ওয়াশরুম চেক করে দ্রুত পায়ে বারান্দায় এলো। অন্ধকার বারান্দার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো কাউকে। অস্থির মন নিয়ে এগিয়ে গেলো। জড়িয়ে ফেললো নিজের সাথে।
নিনীকার নরম মোমের মতো শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। শরীরে তীব্র কাঁপুনি। ধ্রুবর বুক কেঁপে উঠলো। গালে হাত ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ভিজেছো কেন? ‘
নিনীকা উত্তর দিলো না। ধ্রুব অপেক্ষা না করে কাঁধে তুলে নিলো। ছেড়ে দিলো ওয়াশরুমে। আলমিরা থেকে কাপড় বের করে এগিয়ে দিলো।
‘ জলদি চেঞ্জ করে আসো। ‘
নিনীকা নড়লো না, আর না হাতে কাপড় নিলো। ধ্রুব নিরব অভিমানীকে দেখলো।
‘ হঠাৎ কাজ পড়ে গেছিলো, এতো দেরি হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। আমি দুঃখীত মিসেস। ‘
নিনীকা কোনো উত্তর দিলো না। ধ্রুব অসহায় চোখে তাকাতেই থমকে গেলো। এতোক্ষণ খেয়াল করা হয়নি। নিনীকার পড়োনের ওয়েস্টার্ন গাউনটা তার নজর কেঁড়ে নিলো। বুঝে ফেললো সব কিছু। হাতের কাপড় ছুঁড়ে ফেললো এক কোণে। নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ মিসেসের অভিমান কিভাবে কমবে? ‘
নিনীকা নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। ধ্রুব সর্বশক্তিতে নিজের সাথে চেপে ধরলো।
‘ তাকাবে না? ও মিসেস…? ‘
নিনীকা তাকালো। তীব্র গতিতে টানলো ধ্রুবর শার্ট। ধ্রুব তড়িঘড়ি করে নিজের শার্ট খুললো। বুকে দাঁত বসিয়ে থেমে থাকলো না নিনীকা৷ রক্ত বের করে তবেই ছাড়লো। ঠাস করে বন্ধ করলো ওয়াশরুমের দরজা। ধ্রুব বুকে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে এখনো হা করে তাকিয়ে আছে৷
নিনীকা চেঞ্জ করে শুভ্র রঙের টাওয়াল পড়ে বের হলো। হতভম্ব ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে ঢুকলো রুমে।
ধ্রুব চেঞ্জ করে ঢিলেঢালা টাইজার পড়ে বেরিয়ে এলো। বুকের যে পাশে নিনীকা দাঁত বসিয়েছে সেখানে একটা হাত চেপে ধরে রাখা। ধ্রুব বিছানায় এসে দেখলো নিনীকা অলরেডি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ফেলেছে। হাত বাড়িয়ে কাঁধ স্পর্শ করলো।
‘ আমি জানি তুমি ঘুমিয়ে পড়োনি। ‘
জবাব এলো না। ধ্রুব আর্তনাদ করে বলল,
‘ অনেক বেশিই যন্ত্রণা দিয়েছো। দেখো কিরকম লাল হয়ে গেছে। তাকাও না একটু। ‘
ধ্রুব চেষ্টার কমতি রাখলো না। কিন্তু নিনীকা তো নিনীকাই। টু শব্দ ও করলো না। ধ্রুব এবার রেগে গেলো। জোর করে সরালো কাঁথা। মুখের উপর থেকে দু-হাত ছাড়িয়ে টেনে বসালো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বেশি বেশি করছো না? ‘
নিনীকা পুতুলের মতো মাথা রাখলো বালিশে।
‘ যা করার তাড়াতাড়ি করবেন, আমার ঘুম পেয়েছে। ‘
ধ্রুব ভাষাহীন চোখে তাকালো। মেয়েটা তাকে শুধু ভুল বুঝে কেন? সে তো অভিমান ভাঙাতে এতোক্ষণ চেষ্টা করেছে। অপমানে থমথমে মুখশ্রী নিয়ে ধ্রুব উঠে দাঁড়ালো। নিজের ব্যাগ বের করে জামাকাপড় ভরতে লাগলো। নিনীকা দেখেও যেনো দেখলো না।
‘ আমি কি ঘুমিয়ে পড়বো তবে? ‘
ধ্রুব শার্ট ঢুকাতে গিয়ে থেমে গেলো। মুখ তুলে তাকালো না। দৃষ্টি শুভ্র রঙের শার্টে রেখে বলল,
‘ ইচ্ছে। ‘
নিনীকা কাঁথায় নিজেকে প্যাকেট করে ফেললো। ধ্রুব ব্যাগ গুছিয়ে ঘরের ছোট্ট সোফাতে বসে রইলো দীর্ঘক্ষণ। রজনী শেষ হতে চললো। নতুন তারিখ চলে আসার সময় হলো। মধ্যরাত পেরিয়ে ফজরের আজান কানে ভেসে এলো। এতোক্ষণ মেজর ধ্রুবর শক্ত মুখশ্রী বিছানার দিকে ছিলো। আজান কানে আসতেই তা সরে গেলো। গোপনে ত্যাগ করলো দীর্ঘশ্বাস। চটজলদি নামাজ পড়ে গায়ে জড়ালো আর্মি ইউনিফর্ম। কোমড়ে শক্ত বেল্ট লাগিয়ে, পায়ে বুট পড়ে হাতে তুলে নিলো ক্যাপ। ধীরপায়ে হেঁটে এলো নিনীকা যে পাশে ঘুমিয়েছে সেখানে। হাত বাড়িয়ে কাঁথা সরালো মুখ থেকে। ঝুঁকে ঠোঁটের স্পর্শ দিলো কপালে। ধ্রুবর বিচক্ষণ চোখ দেখলো লাল হয়ে যাওয়া চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। মনে মনে উচ্চারণ করলো,
‘ পাষাণী! আমিও দেখবো তোমার নির্লিপ্ততা, কঠোরতা কতোদিন থাকে। তুমি অনুভূতি লুকিয়ে রাখো নিনীকা! বেশ আমি অনুভূতি প্রকাশ করা ছেড়ে দিলাম। ‘
মুখে বলল,
‘ আসছি, নিজের যত্ন নিও। ভালো থেকো। ‘
ধ্রুব ব্যাগ তুলে নিলো হাতে। দরজার সামনে গিয়েও ফিরে তাকালো। মনে মনে চাইলো একবার সে পিছু ডাকুক। বলুক যেও না। ধ্রুব যাবে না। অভিমানী মিসেসের কথা সে ফেলতে পারবে না।
ধ্রুবর চাওয়া পূরণ হলো না। জীপগাড়িতে বসে আবারও তাকালো বাগানের কাছের বারান্দার দিকে৷ নেই কেউ নেই। ক্ষোভে স্প্রিড তুলে ছুটে চলে গেলো গাড়ি নিয়ে। পেছনে ফেলে গেলো সবকিছু। সত্যিই কি ধ্রুব সবকিছু ফেলে যেতে পেরেছে? দু’দিনের বউয়ের জন্য কি তার মন কেমন করেনি?
নাস্তার টেবিলে খেতে বসেছে সবাই। ধারা ছেলের রাগ ছেলের বাপের উপর ঢেলে দিচ্ছেন। ফাহিম মাহবুব চুপচাপ খাচ্ছেন। ধারা নিনীকার প্লেটে মাংস তুলে দিয়ে আফসোস করে বললেন,
‘ যেমন বাপ তেমন ছেলে। দু’দিন হলো বিয়ে করেছে, বউ ছেড়ে চলে গেছে। বউয়ের থেকে চাকরি বড়ো তার।’
ফাহিম মাহবুব এ পর্যায়ে কথা বললেন,
‘ ওর ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ার পথে ছিলো। কিন্তু ও আমাকে বলেছিল ততোদিনে নিজের টান্সফারের ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করবে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাতে টান্সফারের বিষয়েই তো কথা বলতে গতকাল বের হলো। আমাকে বললো হয়ে যাবে চিন্তা নেই। রাত পোহাতেই কি হলো বুঝতে পারছি না ধারা। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেছে। নাহলে ও যেতো না। ‘
নিনীকা সবে মুখে খাবার তুলতে চেয়েছিলো। তার হাত থেমে গেলো। ধ্রুব তবে গতকাল এ জন্যই দেরিতে বাড়িতে ফিরেছে! নিনীকার বুকের ভেতর হাহাকার শুরু হলো। পাঁজরে কিছু একটা যেনো খামচে ধরেছে।
‘ কেন সে মানুষটাকে একবার কথা বলার সুযোগ দিলো না! জিজ্ঞেস করতে পারতো কেন দেরি হলো! ‘
নিনীকার চোখ জলে টইটম্বুর। চোখে ভাসছে দরজার সামনে দাড়ানো ধ্রুবর ফিরে তাকানো। নিনীকা আড়চোখ সবটাই যে দেখেছে! মন তখন চেয়েছিল ধ্রুবকে কষ্ট দিতে। তাকে অপেক্ষা করিয়ে বাহিরে সময় কাটিয়ে আসার শাস্তি দিতে।
ধ্রুবর চোখে কিছু একটার আকুতি ছিলো, আশা ছিলো। নিনীকার পাষাণ মন গলে নরম হয়ে ব্যথায় জর্জরিত হয়ে আন্দোলন করে বলছে,
‘ তুমি তাকে ফেরাতে পারোনি! তুমি পাষানী! অভিমান করার অধিকার তোমার নেই। ‘
বুকে দাঁত বসিয়ে দেওয়ার পরেও ধ্রুব তাকে কিছু বলেনি। নিনীকা কিভাবে পারলো মানুষটাকে কষ্ট দিতে!
(চলবে)