#বিয়ে_থা_২
#পর্ব-১৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
শেখ বাড়ির গেইট দিয়ে সাই-সাই করে একসাথে পর-পর কয়েকটা গাড়ি ঢুকলো। ফুলে সাজানো বরের গাড়িটি সবার আগে। চারিদিকে হৈহৈ পড়ে গেলো, বর এসেছে বর এসেছে। শেখ বাড়ির বিশাল ড্রয়িংরুমে আয়োজন করা হয়েছে। ধ্রুব বর সাজে শেখ বাড়িতে ঢুকলো। আশ্চর্য হলেও সত্যি এখানে বর আটকানোর জন্য কেউ ছিল না। ধ্রুবর কাজিন মহল হা হুতাশ করলো। বর কনের জন্য বানানো জায়গায় ধ্রুব বসলো। মাঝখানে একটি পাতলা পর্দা। ওপাশে নিনীকাকেই বসানো হবে।
চারিদিকে ব্যস্ততা সবার। খাওয়া দাওয়া চলছে পুরোদমে। আচমকা সবকিছু যেনো থেমে গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে শেখ কন্যা। পড়োনে ধ্রুবর পছন্দ করে কেনা সেই লাল শাড়ি। মাথায় দোপাট্টা। কপালের টিকলি ও নাকের নোলকে এ এক অন্য নিনীকাকে দেখছে সবাই। ধ্রুব দাড়িয়ে গেছিল অনেক আগে। নিনীকা শেষ সিঁড়িতে পা রাখতেই সে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। চারিদিকে সবার উচ্ছাস আনন্দের ছড়াছড়ি। ধ্রুবর হাত ধরে নিনীকা পাতলা পর্দার আড়ালে বসলো। সমুদ্র ধ্রুবকে টেনে আরেক পাশে বসিয়ে দিলো। ব্যস ধ্রুব শত চেষ্টা করেও পাতলা পর্দার আড়ালে অস্পষ্ট অবয়ব ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছে না আর।
কবুল বলে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো নিনীকা। পুরোটা সময় তার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা ছিলো। একসময় সবার সামনে এমনকি মিডিয়ার সামনে যে মেয়েটা বড় গলায় বিয়ে নিয়ে নেগেটিভ মন্তব্য করতো সে-ই মেয়েটা বিয়ে করে নিলো! ধ্রুব ও নিনীকাকে এবার একসাথে বসানো হলো। নিনীকার ঘোমটা টানা। ধ্রুব দুহাতে ঘোমটা তুলে নিজের বউকে দেখলো। এইতো কিছু মিনিট আগেও যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সে এখন বউ হয়ে গেছে! ধ্রুবর বউ!
সবার অগোচরে ধ্রুব ফিসফিস করে বলল,
‘ মাই মিসেস! ‘
নিনীকা কেঁপে উঠলো। অদ্ভুত মাদকতা মেশানো সম্মোধন শরীরে মনে গেথে গেলো। ক্যামেরাম্যান এর কথায় নানান ভঙ্গিতে দুজন দাড়িয়ে ফটোশুট করতে ব্যস্ত হলো। অস্বস্তিতে নিনীকা একটু দূরত্বেই দাড়িয়ে ছিল। ক্যামেরাম্যান ক্লজ হয়ে দাড়াতে বলতেই ধ্রুব কোনোরকম সঙ্কোচ ছাড়াই নিনীকাকে সামনে দাড় করিয়ে নিজের দু কাঁধে হাত রাখতে বললো। নিনীকার কাঁপা কাঁপা হাত যখন কাঁধে পৌছালো তখনই ধ্রুব শক্ত করে কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে কপালে এঁকে দিলো ভালোবাসা।
বর কনের সাথে একে একে সকলে ছবি তুলছে। বিয়েতে সিনেমা জগতের অনেকেই এসেছেন। আব্রাহাম ও নিরবকে যে-ই দেখছে সেই টাস্কি খাচ্ছে। একই রকম দেখতে দু’জন মানুষকে দেখে অবাক হবারই কথা। ফারিন মায়ের সাথে দাড়িয়ে অপলক তাকিয়ে দেখছে নিরবকে। হেঁসে হেঁসে সবার সাথে কথা বলছে লোকটা। ধারা মহিলাদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হতেই ফারিন নিরবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিরব হেঁসে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কেমন আছেন? ‘
ফারিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘ মন্দ থাকলে কি আপনি ভালো থাকার দায়িত্ব নিবেন?’
নিরব অস্বস্তিতে পড়লো।
‘ আপনি কি ভালো করে কথা বলতে পারেন না? ‘
‘ আপনি অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলা কমিয়ে দিন, আমি ভালো করে কথা বলবো। ‘
‘ মানে? ‘
ফারিন তেতে উঠলো,
‘ ওই তনু পনু আপার থেকে দূরে থাকবেন। মহিলার ধান্দা ভালো না। ‘
নিরব সহসা প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ আপনার কিরকম ধান্দা? ‘
ফারিন নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘ আপনাকে পটানোর ধান্দা, পটবেন? ‘
‘ মেজরকে বলবো? ‘
‘ বলুন, আমি কি ভয় পাই? ‘
নিরব সিরিয়াস হলো,
‘ আপনি প্লিজ এমন মজা করবেন না। আমি আপনাকে ছোটবোনের নজরে দেখি। ‘
ফারিনের মাথায় দপ করে আগুন জ্ব*লে উঠলো যেনো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ আর একবার বোন বলেছেন তো আপনাকে! ‘
‘ আমাকে কি? ‘
নিরব নিতান্তই মজা করে বলেছিলো কথাটা। ফারিন ঝড়ের গতিতে নিজের কাজ করে কে*টে পড়লো। নিরব স্তব্ধ হয়ে ঠোঁটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। তখনই এলেন তনু আপা।
‘ হ্যালো মিস্টার, আপনি কি খেতে বসবেন না? ‘
নিরবের চেহারায় মোটামুটি আতংকের চাপ। তনু আপা সেটা খেয়াল করে বললেন,
‘ আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত? ‘
নিরব গটগট পায়ে হেঁটে প্রস্থান করলো। আড়ালে থাকা ফারিন ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসলো।
*
মালাবদল হওয়ার পর মোটামুটি সবকিছু শেষ। খাওয়া দাওয়ার পর্ব ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। নিনীকা খেতে বসে তেমন খেতেই পারলো না। অথচ সে সকাল থেকে কিছুই খায়নি ঠিক করে। বাঙালি মেয়েদের মতো তার মন ও কি মা বাবা ছেড়ে যাওয়ার জন্যে ভার হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু সে তো চাইলেই চলে আসতে পারবে।
বিকেলের কনে দেখা আলোয় দুজনের সামনে একটি কারুকাজ করা গোল আয়না রাখা হলো। আয়নাতে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ আয়নাতে কি দেখতে পাচ্ছেন ভাবি? ‘
নিনীকা আয়নাতে ধ্রুবর চোখে চোখ রেখে হাসলো।
‘ হাস্যোজ্জ্বল একজন পুরুষ, আমার ধ্রুব। ‘
নিনীকার কথাটা কানে বাজলো। ধ্রুব শিহরিত হলো। ফারিন তীব্র উচ্ছাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি কি দেখতে পাচ্ছো ব্রো? ‘
ধ্রুব চমৎকার করে হাসলো,
‘ মেজর ধ্রুবর মিসেস। ‘
চারিদিকে হাত তালির ধুম পড়লো। এগিয়ে এলো বিদায় বেলা। অন্যদের মতো নিনীকাকে কাঁদতে দেখা গেলো না। রমজান শেখ যখন ধ্রুবর হাতে মেয়ের হাত তুলে দিচ্ছিলেন তখন কান্নারত মিথিলাকে নিনীকা উল্টো সান্তনা দিলো।
‘ কাছেই তো যাচ্ছি মা, চলে আসবো যখন তখন। ‘
ধারা মিথিলাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘ আমার আরেক মেয়ে ও, আপনি কান্নাকাটি করবেন না আপা। আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নিনীকা দুই পরিবারের মেয়ে। যখন যেখানে ইচ্ছে এসে থাকবে। দুটোই ওর বাড়ি। ‘
গাড়িতে উঠে বসলো নিনীকা। পাশে ধ্রুব। ড্রাইভিং সিটে সমুদ্র, তার পাশে ফারিন। সমুদ্র মজা করে বলল,
‘ লাইট বন্ধ করে দিবো নাকি গুরু? ‘
ধ্রুব রাগ দেখাতে চাইলো। সমুদ্র দমলো না। নিনীকাকে বলল,
‘ আপনি আমার ভাইকে অনেক কষ্ট করালেন ভাবী, বেচারা দিনরাত ঘুমাতে পারেনি আপনার জন্য। ‘
ধ্রুব ধমকে উঠলো,
‘ চুপ কর, মন দিয়ে গাড়ি চালা। ‘
সামনে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ফারিন নিনীকার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। ধ্রুব দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না। তাকে সাহায্য করতে ধরনীতে নেমে এলো অন্ধকার। সন্ধ্যার আকাশ ঘন-কালো মেঘে ছেয়ে গেলো হঠাৎ। শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ধ্রুব আলগোছে নিনীকার হাত ধরলো। আঙুলের ভাজে আঙুল ঢুকিয়ে শক্ত বন্ধন তৈরি করলো। নিনীকাকে বুঝিয়ে দিলো সারাজীবন একসাথে থাকার অঙ্গীকার।
বউ কথা কও- তে ধারা আগেই পৌঁছে গেছেন। বধু বরণের জন্য সবকিছু আগেই তৈরি করা ছিল। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে ধ্রুব নিনীকাকে কোলে করেই ফুলে সাজানো পথ দিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। সোফায় বসিয়ে দিতে চাইলে ধারা নাকচ করলেন।
‘ রুমে নিয়ে যা, ফ্রেশ হোক। আত্নীয় স্বজনদের ভীড়ে চাপা পড়ে যাবে বেচারি। ‘
ধ্রুবর কোলে থাকা নিনীকা এতোক্ষণ লজ্জায় মাথা নিচু করে ছিলো। ধারার কথা শুনে তার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। শ্বশুর বাড়িতে প্রবেশ করেই বুঝে ফেললো সে শ্বাশুড়ি নয় মা পেয়ে গেছে।
ধ্রুবর রুমটা ফুলের গন্ধে ভরে গেছে। নিনীকাকে ফুলে সাজানো বিছানায় বসিয়ে দিলো ধ্রুব। শেরওয়ানি খুলে হাতে টিশার্ট টাওজার নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল,
‘ আমি ফারিনের রুমে ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। তুমি ও ফ্রেশ হয়ে নাও। ফারিনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ব্যাগপত্রসহ। ‘
ধ্রুব চলে গেলো। নিনীকার নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করছে বেলীফুলের সুবাস। সাথে কানে বাজছে ধ্রুবর ‘তুমি’ সম্মোধনটা।
(চলবে)