বিয়ে থা_২ পর্ব-১২

0
50

#বিয়ে_থা_২
#পর্ব-১২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

সকাল থেকে বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আজ ফারিনের কোচিং-এ যেতে হলো না। সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে সে ও নিনীকা, মিথিলার বানানো ফুচকা ও বেলপুরি খাচ্ছে আরাম করে। ফারিনে বেলপুরি খেতে খেতে চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে ওয়া-ও দেখালো। খেয়ে তারপর বলল,

‘ তোমার হাতের বেলপুরি কি ফ্যান্টাসিক আন্টি! আমি তো এটা খাওয়ার লোভে এখানে সারাজীবন থেকে যেতে পারবো। অথচ মাম্মা প্রতিদিন ফোন দিয়ে বলে কি এমন ফেলি যে বাড়ির কথা তোর মনে পড়ে না! ‘

মিথিলা হেসে ফেললেন শব্দ করে। নিনীকা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

‘ তুমি কি বলেছো? ‘

‘ আমি বলেছি উত্তর টা আপাতত জানি না, জেনে তারপর জানাবো। ‘

‘ এখন তবে জানিয়ে দাও। ‘

ফারিনের ধারাকে ফোন দিলো। গপাগপ করে বেলপুরি খেতে খেতে বলল,

‘ মিথি আন্টির বানানো বেলপুরি খাওয়ার জন্যে হলেও আমি সারাজীবন এখানে থেকে যাবো মাম্মা। তুমি প্লিজ আমাকে নিয়ে আর টানাটানি করো না। বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবো না। ঘরজামাই নিয়ে আমি এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে রাজি আছি। ‘

মিথিলা ও নিনীকা হাসতে হাসতে শেষ। রুম্পা ছোট সোফায় বসে নিজেও বেলপুরি খাচ্ছিল। ওর হাসতে হাসতে নাকেমুখে উঠে গেছে। মিথিলা জলদি পানি খাওয়ালেন। রুম্পা এখন পোয়াতি। বয়সে নিনীকার অনেক ছোট। নতুন বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে। প্রথমবারের মতো মা হচ্ছে।

ফারিন ধারাকে কোনকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। শান্তিতে বসে বেলপুরি খেতে খেতে বলল,

‘ আমি আপনার কাছে বানানো শিখবো আন্টি। ‘

মিথিলা মাথা নাড়ালেন,

‘ অবশ্যই। ‘

দুপুরেও বৃষ্টি থামলো না। নিনীকা ও ফারিন শাড়ি পড়ে ছাঁদে ভিজলো। দুজনে পায়ে আলতা দিয়েছে সুন্দর করে। বৃষ্টির পানিতে সেগুলো ধুয়েমুছে যাচ্ছিল। মিথিলা ছাদের দরজায় দাড়িয়ে ছিলেন। নিনীকা তাকে টেনে নিয়ে গেলো। বহুদিন পর বৃষ্টিতে ভিজে মিথিলা অল্প বয়সী তরুণী হয়ে গেছিলেন যেনো। অনেকক্ষণ পর হাঁচি দিতে দিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচে চলে গেছেন। নাহলে এ দুজন তাকে ছাড়তোই না সহজে।

দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজার ফলে নিনীকা ও ফারিনের ঠান্ডা লেগে গেলো। ঔষধ খেয়ে বিকালে দুজন কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমালো। সন্ধ্যায় রমজান শেখ অফিস থেকে ফিরে নাস্তার টেবিলে দুজনকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হলেন। মিথিলা নাক টানতে টানতে বললেন,

‘ দুটো বৃষ্টিতে ভিজেছে, আমাকেও টেনে ভিজিয়ে ছেড়েছে। তুমি চিন্তা করো না৷ ওরা উঠলেই নাস্তা করবে না-হয়। ‘

রমজান শেখ কোণা চোখে স্ত্রীকে দেখলেন।

‘ তোমারও ঠান্ডা লেগেছে? ‘

মিথিলা মাথা নাড়ালেন। রমজান শেখ পাশে বসতে ইশারা করলেন। মিথিলা বসতেই কপালে হাত দিয়ে চেক করে দেখলেন বেশ গরম৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

‘ এখনই রুমে গিয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আমি নাস্তা করে আসছি। ‘

‘ রাতের রান্না বাকি তো। ‘

‘রুম্পা করে নিবে। সার্ভেন্ট আরও রাখবো দরকার হলে। তুমি রেস্ট নাও গো। ‘

মিথিলা মাথা দুলিয়ে চলে গেলেন। জানেন কিছু বলে লাভ হবে না। তার মাঝেমধ্যে মনে হয় নিনীকা শেখ বাবুর মতো হয়েছে। বাপের মতোই কিছু টা জেদি কি না কে জানে।

প্রায় রাত আটটার পর দুজনের ঘুম ভাঙলো। খাবার টেবিলে রমজান শেখ একা বসে ছিলেন। মাকে না দেখতে পেয়ে নিনীকা চিন্তিত হয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছিল। রমজান শেখ দুজনের প্লেটে ভাত তুলে দিয়ে বললেন,

‘ আজ তোমার মা অসুস্থ, সে রেস্ট নিক। আমি তোমাদের ভাত বেড়ে দিচ্ছি খেয়ে নাও। ‘

নিনীকা অদ্ভুত চোখে নিজের বাবাকে দেখলো। ভাত বেড়ে খাওয়ার মতো বয়স তার হয়েছে। কিন্তু মায়ের বেড়ে দেওয়ার পর ভাত খাওয়াটা নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল। তাই বলে সে নিজের হাতে ভাত বাড়তে পারবে না সেটা কি রমজান শেখ ভেবে নিয়েছেন! নিনীকা ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো।

‘ আমি নিজেই বেড়ে খেতে পারি বাবা। তুমি যদি চাও তোমাকেও ভাত প্লেটে তুলে দিতে পারি। এটা কোনো বড় বিষয় নয়। ‘

রমজান শেখ খেতে খেতে হাসলেন।

‘ কি বলো তো নিনী মা, এটা একটা অভ্যাস। মিথিলার হাতে ভাত বেড়ে খাওয়াটা এ পরিবারের সবার অভ্যাস। আমরা সবাই কিন্তু ভাত বেড়ে খেতে পারি, কিন্তু ওইযে অভ্যাসটা! এটাতে আমাদের আনন্দ। একদিন তার ব্যতিক্রম হলে আমরা ভড়কে যাবো। যেমন আজ তোমাকে আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি বলে তুমি ভড়কে গেছো। ভেবেছো তুমি নিজেই তো ভাত বেড়ে খেতে পারো। অথচ এতোদিন অভ্যাসবশত তোমার মা-ই ভাত বেড়ে খাওয়াতেন তখন কিন্তু এটা তোমার মনে হয়নি। ‘

নিনীকা বুঝতে পারলো। রমজান শেখ মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিলেন।

‘ কয়েকদিন পর তুমি নতুন পরিবারে যাবে। সেখানেও সবাই এইরকম একটি অভ্যাসে অভ্যস্ত থাকতে পারে। নতুন কোনো মানুষ ভাত বেড়ে দিতে পারে। সেটা এখনই বুঝতে পেরে গেছো বলে যখন তুমি ওটার মুখোমুখি হবে তখন তোমার আর অদ্ভুত লাগবে না। তুমি সেটা স্বাভাবিক ভাবেই নিতে পারবে। বা এমনও হতে পারে নতুন মানুষ হিসেবে তোমাকে সবাইকে বেড়ে খাওয়াতে হতে পারে। সেটাতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না বলে আমার ধারণা। ‘

ফারিন মুগ্ধ চোখে রমজান শেখ কে দেখছে। একজন বাবা কি সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে নিজের মেয়েকে বুঝাচ্ছেন বিয়ের পরে কিভাবে সবকিছু সহজ ভাবে নিতে হবে। ফারিন নিজেও ধারার ভাত বেড়ে দেওয়ায় অভ্যস্ত। এখানে মিথিলা বেড়ে দিতেন। সেটা তার কাছে নতুন নতুন লাগতো। আমরা আসলে অভ্যাসগত কিছু থেকে হঠাৎ করে পিছু হেঁটে গেলে থমকে যাই। আজ রমজান শেখ ভাত বেড়ে দিলেন। ফারিনের আজও নতুন নতুন লাগলো। এখানে ধারা থাকলে সেরকমটা লাগতো না। তাদের বাড়িতে যখন নিনীকা বউ হয়ে চলে যাবে তখন কি নিনীকাও ভাত বেড়ে খাওয়াবে? ব্যাপার টা ফারিন কিভাবে নিবে জানে না, তবে সিনটা পুরনো হয়ে গেলে ধারার মতোই লাগবে। অস্বাভাবিক ভাবনাটা পাল্টে যাবে হয়তো।

রমজান শেখ খাওয়ার পর প্লেট গুছাতে লাগলেন। নিনীকা হেল্প করলো তাকে। রুম্পা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে রাতের রান্নাটা করেই চলে যায়। মিথিলা নিজেই সবটা করতেন। আজ বাবা মেয়ে মিলে সব গুছানো হলো। বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে তবেই দুজন কাজ শেষ করলেন। ফারিন উঁকিঝুঁকি দিয়ে তাদের দেখছিল। আচমকা দেখলো নিনীকার মতো শক্ত মেয়ে তার বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়েছে। রমজান শেখ চশমার ফাঁক দিয়ে চোখের কোণে হাত বুলিয়ে হাসছেন। নিনীকা ফুপিয়ে উঠছে বার-বার। বলছে,

‘ বাবা…আমি তোমাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো। ‘

রমজান শেখ মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন।

‘ সবাইকেই তো যেতে হয় মা। এদিক থেকে তুমি লাকি ভালো শ্বশুরবাড়ি পাচ্ছো। যখন তখন গাড়ি চালিয়ে চলে আসবে। তাছাড়া কয়েকদিন পর অফিসের দায়িত্ব তো তোমাকেই বুঝে নিতে হবে মা আমার। আমি আর কয়দিন? ‘

‘ বিয়ে করাটা কি খুবই জরুরি বাবা? এটা না করলে আমি তো তোমার কাছে সারাজীবন থাকতে পারতাম। ‘

রমজান শেখ মেয়ের ছেলেমানুষী কথাতে হাসলেন।

‘ বিয়েটা করা কতোটা জরুরি তুমি ভালো করেই জানো মা৷ বিয়ে মানে দ্বিতীয় জন্ম। তুমি নিজের ইচ্ছেতে নতুন মা বাবা, নতুন পরিবার বেছে নিচ্ছো। ‘

ফারিন বাবা মেয়ের আবেগপ্রবণ ঘটনা দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেললো। তার ঠোঁট তরতরিয়ে কাঁপছে। বিয়ে করাটা জরুরি, তারমানে তাকেও করতে হবে। মা বাবা ভাই ভাবীকে ছেড়ে তাকেও চলে যেতে হবে। আচ্ছা ফারিন কার কাছে যাবে? তাকে ছোট বোন মনে করা ওই নিরবের কাছে?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে