#বিয়ে_থা
#পর্ব- ৪৫ (অন্তিম বিয়ে)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
সকালে সবাই যখন নাস্তা করতে বের হয় তখন মুখোমুখি হয় মিথিলা ও রমজান শেখের। নিনীকা অবাক হলেও খুশি হয়েছে। মিথিলা নাতিকে কোলে নিয়ে বললেন,
‘ তোর বাবাকে রাজি করিয়ে চলে এসেছি বুঝলি। ‘
রমজান শেখ দিব্যর গাল টেনে দিলেন। মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ তোমার মায়ের জন্য আমার অফিস রেখে আসতে হলো নিনী। ‘
ধারা হাসিমুখে বললেন,
‘ এসে ভালো করেছেন। আপনাদের ছাড়া অসম্পূর্ণ লাগছিল। ‘
সবাই একসাথে নাস্তা করে ঘুরতে বের হলেন। পারিবারিক এই বিশাল মেম্বারদের মধ্যে নিরবের মাও বাদ যাননি৷ মিথিলা সাথে করে নিয়ে এসেছেন। সবাই দার্জিলিংয়ের সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত হলো। উঁচু উঁচু পাহাড় আকাশের সাথে মিশে আছে যেনো। দিব্য হাত উঁচু করে বাবাকে দেখাচ্ছে।
‘ বাবা দেখু উ..’
ধ্রুব ছেলেকে এটা ওটা দেখিয়ে দিচ্ছে। আকাশ কোনটা পাহাড় কোনটা চিনিয়ে দিচ্ছে। দিব্যর ছোট মাথায় সেগুলো আটকেছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। তবে সে মাথা নাড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে হাত নেড়ে কিছু একটা বলছে।
*
তারা একটি পার্কে ঘুরতে এলো। নিনীকা ওয়াটার রাইড করবে বললো। ধ্রুব মানা করলো, প্রেগন্যান্ট অবস্থায় রাইড করলে যদি কোনো সমস্যা হয়ে যায়! কিন্তু নিনীকা মানতে নারাজ সে রাইড করবেই। অগত্যা ধ্রুব রাজি হলো। নিনীকাকে দুহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে ওয়াটার রাইড করলো। দিব্য বাবা মাকে পানির মধ্যে থেকে উপরে উঠে চারিদিকে ঘুরতে দেখে খুশিতে হাত তালি দিচ্ছে।
বেলা যখন গড়ালো তখন আরও তিনটা প্রিয়মুখ দেখলো নিনীকা। সুমিত্রা ও অনিরুদ্ধ, সাথে তাদের পাঁচ বছরের মেয়ে অঞ্জলি। সুমিত্রা সেই আগের মতোই নিনীকাকে জড়িয়ে ধরেছে।
‘ নিনীকা ইয়ার মিস ইউ সো মাচ। ‘
নিনীকা এই ফ্যামিলি ট্যুর কে প্রিয়দের সাথে সাক্ষাৎ বলে ধরে নিবে কি না বুঝতে পারছে না। তার জীবনে সুমিত্রার অবদান আছে। এই মেয়েটা তার খারাপ সময়ে পাশে ছিল। কতো বুঝদার ম্যাচিউর আলাপ করতো। ওভারথিংকার নিনীকাকে সাহস দিতো। ধ্রুবর কাছে আসাটাও সুমিত্রার মাধ্যমেই। তাকে দার্জিলিং নিয়ে আসা, বান্দরবানে ঘুরতে যাওয়া। সবকিছুই তো সুমিত্রার মাধ্যমে হয়েছে। ফোনে যোগাযোগ থাকলেও সামনাসামনি আজ দু’বছর পর দেখা। সুমিত্রা দিব্যকে দেখতে এসেছিল দু’বছর আগে।
নিনীকার মাথায় থাপ্পড় পড়তেই সে ভাবনা থেকে বের হলো। সুমিত্রা গাল ফুলিয়ে বলল,
‘ কি ইয়ার? তুমি কি খুশি হওনি নাকি? ‘
নিনীকা ঠোট প্রসারিত করলো।
‘ তোমার এখনো আমাকে সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজে লেখা সেই জলপাইগুড়ি ঘুরে দেখানো বাকি সুমিত্রা। ভুলে গেছো? ‘
সুমিত্রার চোখমুখ উজ্জ্বল হলো।
‘ তুমি মনে রেখেছো ডিয়ার! ‘
নিনীকা মাথা নাড়ালো।
‘ ঘুরে দেখাবে না? ‘
‘ অবশ্যই। ‘
সুমিত্রা নিজেই সবাইকে জলপাইগুড়ি যেতে রাজি করালো। কিভাবে নিনীকা জানে না। তবে দুদিন পর তারা জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নিনীকা বহুকাঙ্ক্ষিত জলপাইগুড়ি ছুয়ে দেখলো। তিস্তার ব্রীজ কতো কি। ফিরে আসার মুহূর্তে সুমিত্রা কানে কানে বলল,
‘ ডিয়ার নিনীকা তোমার এই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তোমার হাসবেন্ডকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দিও। কথাটা তুলেছি আমি কিন্তু সবাইকে রাজি করিয়ে তোমার স্বপ্ন পূরণ করার পথ করে দিয়েছে সে! ‘
নিনীকা দিব্যকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানো ধ্রুবর মুখের দিকে তাকালো তৎক্ষনাৎ। ধ্রুব তাকিয়েই ছিল। চোখে চোখ পড়ে যেতেই হাসলো। নিনীকা আবারও আটকালো এই হাসিতে।
ধ্রুব যত্ন করে এক হাত ধরে গাড়িতে বসালো। নিজেও পাশে উঠে বসলো।
‘ তুমি একটু বেশিই গ্লু করছো মিসেস। ‘
নিনীকা হাত ভাজ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো।
‘ আগে কি গ্লু করতাম না? ‘
‘ ওহ নো, তুমি তো সবসময়ই গ্লু করো। তবে মাঝে মধ্যে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হয়ে যায়। ‘
‘ তো? ‘
ধ্রুব মুখ এগিয়ে এনে বলল,
‘ তো কিছু না। আমার শুধু রাস্তাঘাটে নিজেকে কন্ট্রোল করতে একটু কষ্ট হয় এই যা। ‘
নিনীকা মুখ চেপে ধরে হাসলো। দিব্য একবার বাবা একমার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। ধ্রুব ছেলের মাথার চুল এলোমেলো করে দিলো। দিব্য বাবার মুখে হাত রেখে বলল,
‘ বাবা মাম্মা লাভু ‘
নিনীকা গাল টেনে দিলো,
‘ দিব্যকে ও তার মাম্মা বাবা অনেক ভালোবাসে সোনা।’
‘ চত্তি? ‘
‘ তিন সত্যি। ‘
*
২০৫০ সাল। বউ কথা কও ঝলমল করছে। নিনীকা পুত্রবধূকে বরণ করতে সব তৈরি করে সদর দরজায় দাড়িয়ে আছে। পাশে দাড়িয়ে আছে ফারিন।
তাদের অপেক্ষা শেষ করে গেইট দিয়ে ঢুকলো একটি গাড়ি। ধ্রুব এগিয়ে এসে বলল,
‘ দিব্য বৌ নিয়ে আলাদা গাড়িতে আসছে। সাথে দীবা ও নীরা আছে৷ ‘
নিনীকা মাথা নাড়ালো। ধ্রুব ফ্রেশ হয়ে যখন নিচে নামলো তখন দিব্যকে এখনো বৌ নিয়ে আসতে না দেখে চিন্তিত হলো। বলল,
‘ এখনো আসেনি? ‘
নিনীকা ক্লান্ত মুখে বলল,
‘ না আসেনি। ‘
ধ্রুব সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। ধারা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলেন। বয়স হয়েছে তার। ধ্রুব এগিয়ে এনে পাশে বসালো।
‘ দিব্য এখনো আসেনি? ‘
‘ না মা, কেন যে এতো সময় লাগছে বুঝতে পারছি না। ‘
ধারা নিজেও অপেক্ষা করতে লাগলেন। এই বাড়ির একটা সদস্য কমেছে। ফাহিম মাহবুব চলে গেছেন অনেক বছর হয়েছে। নতুন সদস্য হয়ে দিব্যর বউ পা রাখতে চলেছে বাড়িতে। মেয়েটার নামটা তিনি মনে করতে পারলেন না। আজকাল তার অনেক কিছুই মনে থাকে না।
সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেন স্যুট-কোট পড়া রমজান শেখ। সাথে মিথিলা। বয়সের ছাপ চেহারায় স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু স্টাইল আগের মতোই। রমজান শেখ ধ্রুবর পাশের বসলেন।
‘ বুঝলে মাই চাইল্ড আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরে গেছি। ‘
ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি আব্বু? ‘
‘ দিব্য বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। ‘
ধ্রুব অবাক হলো,
‘মানে? ‘
রমজান শেখ হাসলেন। তন্মোধ্যে সদর দরজা দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলো দীবা ও নীরা। নিনীকা মেয়েকে ধরলো।
‘ এতো হাঁপাচ্ছিস কেন? ‘
দীবা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ ব্রো আমাদের গাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বউমনিকে নিয়ে কোথাও চলে গেছে মাম্মা। ‘
নীরা বলল,
‘ হ্যাঁ মামি, দিব্য ব্রো আমাদের মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বলল তোরা বাড়িতে চলে যা। ‘
ফারিন মেয়ের দিকে চোখ রাঙালো,
‘ তোদের বললো গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে চলে যা আর তোরা ওদের রেখে চলে এলি?
নীরা ঠোঁট উল্টে বলল,
‘আমরা কিছু বলার সুযোগ পাইনি। ব্রো আমাদের নামিয়ে দিয়ে স্প্রিড তুলে চলে গেছে। ‘
নিনীকা মাথায় হাত দিয়ে বলল,
‘কোথায় যেতে পারে ওরা! ‘
সদর দরজা দিয়ে ঢুকলো নিরব। রিলাক্সে গিয়ে ধারার পাশে বসলো। নিনীকার উদ্দেশ্য বলল,
‘ দিব্য বউ নিয়ে পালিয়ে গেছে ভাবী। ‘
ফারিন প্রায় চিৎকার করে উঠলো,
‘ হোয়াট! বউ নিয়ে, বাট হোয়াই? ‘
ধ্রুব বউ ও বোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ মেইবি দিব্য তার মা বাবার থেকেও ইন্টারেস্টিং মাধ্যমে বউ নিয়ে লাইফ শুরু করতে চায়। ২০২৪ এ নিনীকা বর রেখে পালিয়ে ছিলো। সেজন্য সে ২০৫০ এ এসে বউসহ পালিয়ে গেছে। ‘
আকস্মিক শক নিনীকার হজম হয়নি। সে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ধরতেই দীবা ধরে ফেললো। ধ্রুবর উদ্দেশ্যে বলল,
‘ মাম্মা মেবি বেশিই শক পেয়েছে বাবা। ‘
ধ্রুব নিনীকাকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। সবাইকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে বললো।
*
রাত প্রায় দশটা। অন্ধকার নির্জন রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ফুল দিয়ে সাজানো একটি গাড়ি। দিব্য ড্রাইভিং এর ফাঁকে পাশে বসা এলোমেলো বউকে দেখছে মাঝেমধ্যে।
‘ তুমি কি এভাবেই থাকবে? ‘
নতুন বউয়ের গায়ে শাড়ি নেই। জিন্স ও উপরে একটি শর্ট ফ্রক জড়িয়ে সে বলল,
‘ বাসর তো করেই নিয়েছো, শাড়ি ও খুলে ফেলেছো। এখন আর পড়ে কি করবো? ‘
দিব্য ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘ তৈরি হও, আমরা সেকেন্ড বাসর করতে আপাতত দার্জিলিং যাচ্ছি মীরা। ‘
মীরা ক্লান্ত চোখ বন্ধ করলো।
‘ জীবনে এমন এডভেঞ্চার রচনা হবে আমি ভাবিনি। শেষে কি না বিয়ে করে বর নিয়ে পালাতে হলো। ‘
দিব্য শব্দ করে হাসলো,
‘ আমাদের ফুল লাইফটাই এডভেঞ্চার হবে মীরা। বিয়ে দিয়ে তো সবে শুরু করলাম। ‘
মীরা নিজেও হাসলো,
‘ তুমি একটা পাগল। ‘
দিব্য হাত বাড়িয়ে মীরার চুল এলোমেলো করে দিলো।
‘ আ’ম লাভ অফ এডভেঞ্চার মাই মীরা! ‘
*
বউ কথা কও অন্ধকারে ডুবে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডোয়িং রুমের বাম দিকের দেয়ালে নিনীকা ও ধ্রুবর বিয়ের ফটো ফ্রেমের পাশে আরেকটি নতুন ফটো ফ্রেম কাঁচের জানালা দিয়ে আসা বজ্রপাতের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।
(সমাপ্ত)
বিয়ে থা সিজন-০২ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন