বিয়ে থা পর্ব-৩৩+৩৪

0
131

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ )

বাগানে তৈরি করা বসার জায়গার পেছনে বড়বড় করে লেখা ‘ ধ্রুব ও নিনীকার হলুদ সন্ধ্যা।’ পাশাপাশি বসে আছে ধ্রুব ও নিনীকা। নিনীকার পড়োনে হলুদের মধ্যে সুন্দর কাজ করা লেহেঙ্গা। ফুলের গহনা পড়ানো হয়েছে। ধ্রুবর পড়োনে হলুদ পাঞ্জাবি। ধ্রুব সবাইকে দেখিয়েই বউয়ের হাত ধরে বসে আছে।

সর্বপ্রথম হলুদ ছুঁইয়ে দিলেন ধারা ও ফাহিম। তারপর একে-একে সমস্ত আত্নীয়রা। নিনীকার দু-চোখ কাউকে খুঁজছিলো।

সবার শেষে একটি মমতাময়ী হাত ছুঁয়ে দিলো নিনীকার গাল। মিথিলা একা নন পাশে রমজান শেখ দাড়িয়ে আছেন। সবার নজর এদিকেই। আত্নীয়দের মধ্যে একজন বলেই ফেললেন,

‘ কতো ইয়াং শ্বশুর শ্বাশুড়ি ধ্রুবর। ‘

রমজান শেখ হাতে হলুদ নিলেন, সবার আগে ধ্রুবর গালে ছুয়ালেন। তারপর নিনীকার গালে লাগিয়ে দিয়ে হাসলেন। নিনীকা শক্ত হয়ে বসে রইলো। বিস্ময়ে সে কথা বলতে পারছে না।

রমজান শেখ হাতের গিফটটা ধ্রুবর দিকে এগিয়ে দিলেন। ধ্রুব হাসিমুখে সেটা গ্রহণ করলো। ফটোশুট হলো। খাওয়া দাওয়া হলো। সবশেষে দুজনকে বাগানে ব্যবস্থা করা জায়গায় বসিয়ে গোসল করানো হলো। ধ্রুব বউকে কোলে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। ধারার আদেশে নিনীকাকে ফারিনের রুমের ওয়াশরুমে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

তারপর এলো মেহেদী লাগানোর পর্ব। ডোয়িং রুমে ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিনীকা ও ধ্রুবের পড়োনে সবুজ রঙের কারুকাজ করা পোশাক। নিনীকার হাতে প্রথম মেহেদী ধ্রুব নিজেই লাগিয়ে দিলো। বড়বড় করে লিখলো ‘ধ্রুব’ নামটি। বউয়ের মেহেদী দেওয়া শেষে ধ্রুবর হাতে মেহেদী লাগানো হলো। হাতের নখে মেহেদী দিয়ে মাঝে বউয়ের নামটাই লিখতে দিলো শুধু।

মেহেদীর ফটোশুট শেষ হতে হতে রাত্রীর বারোটা বেজে গেছে। নিনীকার দু-চোখ সেই দুজন ব্যক্তিকে খুঁজছে মনে মনে। ফারিনের থেকে জানতে পেরেছে তারা হলুদের অনুষ্ঠানের পরপরই চলে গেছেন, ধারা জোর করলেও থাকেন নি।

পুরো দু’তলা আত্নীয় স্বজনে ভর্তি। ধ্রুবর রুমে তার মামাতো দু’টো ভাইও থাকবে। খাওয়া দাওয়া করে সবাই একটু বিশ্রাম নিতে ঘরে চলে গেলো। ভোরের আগে উঠে আবার বিয়ের আয়োজন করতে হবে। যদিও ধারা কমিউনিটি সেন্টারে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফাহিম মাহবুব তাতে নারাজ। তাদের বংশের কারো বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হয়নি। বউ কথা কও এই হয়েছে৷

বিয়ের দিন। ভোরে উঠতে হয়েছে সবাইকে। বাদ যায়নি ধ্রুব ও। নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকেও কাজ করতে হচ্ছে। বাবুর্চি ইতিমধ্যে বাগানে রান্না করার জন্যে আগুন ধরিয়ে ফেলেছে। সবাই কিছু না কিছু করতে ব্যস্ত। ধারা কিচেনে গিয়ে নাস্তা বানিয়ে নিলেন। কম হলেও চল্লিশ জনের মতো হবে। অনুষ্ঠানে তো আরও মানুষ আসবেন, সবমিলিয়ে দুশোরও উপরে মেহমান। বিশাল আয়োজন হচ্ছে।

খাওয়ার ব্যবস্থা’টা বিশাল ডোয়িং রুমেই করা হয়েছে। কোণায় কনে ও বরের বসার জন্যে দুটি কারুকাজ করা চেয়ার।

দুপুর দুটো। ধারা নিনীকাকে নিচে নিয়ে আসতে বললেন। ফারিন, সুমিত্রা ও সাথে দুটো মেয়ে মাথার উপর দোপাট্টা ধরে আছে। লেহেঙ্গার দুটো সাইড উঁচু করে ধীরে ধীরে নেমে আসছে মেজর ধ্রুব মাহবুবের অর্ধাঙ্গিনী নিনীকা শেখ।

সিঁড়ির কাছে দাঁড়ানো ধ্রুব মুগ্ধ চোখে দেখলো। এর আগে নিনীকাকে বিয়ের সাজে দেখা হয়নি তার। শেষ সিড়িতে পা রাখতেই ধ্রুব নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। নিনীকা সেটায় হাত রেখে তাদের জন্য ব্যবস্থা করা স্থানে চলে গেলো। সবার মধ্যমনি দুজন।

স্যুট বুট পড়া ফাহিম মাহবুব স্ত্রীর দিকে এগিয়ে এলেন। ধারা নীল জামদানী পড়েছেন। ফারিন পড়েছে সাদা গাউন। সুমিত্রা শাড়ি পড়েছে৷

‘লিপস্টিক ছড়িয়ে গেছে মুছে ঠিক করে নাও। ‘

ফাহিম মাহবুব রুমাল এগিয়ে দিলেন। তারপর ফোনের ক্যামেরা বের করে ধরলেন। ধারা সেদিকে তাকিয়ে রুমাল দিয়ে নিজের লিপস্টিক ঠিক করে নিলেন। ভালোবাসা নিয়ে ধরলেন স্বামীর হাত। এগিয়ে চললেন ছেলে ও পুত্রবধুর দিকে।

নিনীকা ও ধ্রুবকে সামনাসামনি দাড় করানো হয়েছে। আংটিবদল হবে। ধ্রুব জ্বলজ্বল করা হীরের আংটি তার অর্ধাঙ্গিনীর হাতে পড়িয়ে দিলো। নিনীকাকে সোনার আংটি দেওয়া হলো ধ্রুবকে পড়ানোর জন্যে। আংটিটা হাতে নিয়ে সে কিছু মুহুর্ত থমকে রইলো। সে যদি আজ চাকরি করতো তবে নিজের হাসবেন্ডকে নিজেই আংটি কিনে পড়িয়ে দিতে পারতো।

সদর দরজা দিয়ে অত্যন্ত সুদর্শন ও সুন্দরী দেখতে একটি জুটির আগমন ঘটেছে। রমজান শেখ মৃদু জোরে বললেন,

‘ মেয়ের জামাইকে তো আমাদের পক্ষ থেকে আংটি দেওয়ার কথা। ‘

নিনীকা চমকে তাকালো। মিথিলার মুখে স্নিগ্ধ হাসি। তিনি একটি আংটির বক্স এগিয়ে দিলেন। ধারা আগেরটা নিনীকার থেকে নিয়ে নিলেন। মিথিলা বললেন,

‘ কিছু মনে করবেন না আপা, এটা তো নিয়ম বলুন। ‘

ধারন হাসলেন,

‘ কিছু মনে করিনি। ‘

নিনীকার ঠোঁটের কোণে হাসি। সোনালী রঙের ঝলমলে আংটিটা পড়িয়ে দিলো ধ্রুবর আঙ্গুলে।

দুজনকে পাশাপাশি চেয়ারে বসানো হলো। একে একে মানুষজন আসছে, উপহার দিয়ে যাচ্ছে। ফটোশুট হচ্ছে। ধ্রুব ফিসফিস করে বলল,

‘ লাল রঙে রাঙানো রক্তজবা আমার, আমি তোমাতে মুগ্ধ হই বার-বার। ‘

নিনীকা মাথা নিচু করে হাসলো। আলগোছে টেনে ধরলো ধ্রুবের বাহু। মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,

‘ লাল শেরওয়ানিতে আমার সুদর্শন জামাই। ‘

অনেক মেহমান খেয়ে চলে গেছে। ধ্রুব ও নিনীকাকে খাওয়ানোর জন্যে টেবিলে বসানো হয়েছে। ধ্রুব নিজ হাতে বউকে খাইয়ে দিলো।

সবার খাওয়া শেষ হতে হতে গোধুলী পেরিয়ে গেলো। জ্বলজ্বল করে উঠলো চারিদিক। ডোয়িং রুমে রঙবেরঙের লাইট অন করা। মালা বদল করা হলো। পৃথিবীতে যখন অন্ধকার নেমে আসবে ঠিক সেই মুহুর্তে দুজনের মাথায় দোপাট্টা ধরা হলো। সামনে ধরা হলো কারুকার্যময় আয়না।

সুমিত্রা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আয়নাতে কি দেখা যায় জিজু মশাই? ‘

ধ্রুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। লাল রক্তজবার মতো ঠোঁট, নাকে নোলক, বন্ধ চোখ জোড়ায় সৌন্দর্যের আলপনা আঁকা। সিঁথিতে শোভা পাচ্ছে ছোট্ট একটি টিকলি। তার নজর আটকালো থুতনির ওই কালো কুচকুচে তিলে।

সুমিত্রা পুনরায় তাড়া দিলো,

‘ কি দেখা যায় জিজু? বলছেন না কেন? ‘

বন্ধ চোখজোড়া খুলে গেলো। ধ্রুব সেই কাজল কালো চোখে তাকিয়ে সম্মোহনী গলায় শুধালো,

‘ আমার মিসেস। ‘

নিরব এই প্রথম সম্বোধন করলো,

‘ আয়নায় কি দেখতে পাচ্ছেন ভাবি? ‘

নিনীকা কারুকার্যময় আয়নায় তাকালো। এ কয়েকদিনে চাপদাড়ি হয়ে গেছে, থুতনির নিচে, কপালে কাটা দাগ। হলদে ফর্সা মুখ, নিচের ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে। পড়োনে শোভা পাচ্ছে লাল শেরওয়ানি। গলায় মালা, পর্যবেক্ষণের এই মুহুর্তে তার ঠোঁট প্রসারিত হচ্ছে। নিনীকা মুগ্ধ চোখ সেই হাসিতে আটকে গেলো। শুধালো,

‘ মেজর ধ্রুব মাহবুবের মিসেস এর ভালোবাসাময় পুরুষ। ‘

চারিদিকে হৈহৈ পড়ে গেলো। সবার মুখে হাসি। ধ্রুব বউকে কোলে করে রুমে রওনা হলো। দরজা খুলতেই চোখেমুখে মুগ্ধতা ধরা দিলো। ফুলের বাগান করে ফেলেছে রুমটা। ফুলে সজ্জিত বিছানায় নিনীকাকে বসিয়ে দিলো। ফারিন তড়িৎ গতিতে নিনীকার পাশে বসলো।

‘ মাম্মা বলেছে নিচে যেতে। ‘

ধ্রুব অসহায় চোখে তাকিয়ে চলে গেলো। সুমিত্রা ফারিনের মাথায় চাপড় মারলো।

‘ শয়তান মেয়ে আমার জিজুটাকে ভালো করে বউকেও দেখতে দিচ্ছে না। ‘

ফারিন কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,

‘ আমার কি দোষ? মাম্মা বলেছে সে না বলা পর্যন্ত এদের একা না ছাড়তে। ‘

নিনীকা গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। সুমিত্রা ধাক্কা দিলো,

‘ কি ভাবছিস? ‘

নিনীকা নিজের মোবাইল খুঁজলো। মনে পড়লো মোবাইলটা ধ্রুবর কাছে। সুমিত্রাকে বলল ধ্রুবকে ডেকে দিতে। সুমিত্রা বিনাবাক্যে ডাকতে চলে গেলো। ধ্রুব এসে বউয়ের কাছে বসলো।

‘ ডেকেছিলে? ‘

‘ মোবাইল দাও। ‘

ধ্রুব মোবাইল বের করে দিলো।

‘ আমি ভেবেছি তোমার আমাকে প্রয়োজন। ‘

সুমিত্রা দরজার পাশে লুকিয়ে ছিল। শব্দ করে হেসে ফেললো। ধ্রুব উঠে দাড়ালো। নিনীকা ফোনে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল,

‘ মা চলে গেছে কি না জানতে হবে। ‘

নিনীকা ডায়াল করতেই মিথিলা রিসিভ করলেন। নিনীকাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না।

‘ নিনীকা আমরা বাড়িতে যাচ্ছি, তোমার বাবাকে একটু পর ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তোমার নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা আমার মা। ‘

নিনীকার রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। কোনো প্রতুত্তর না করে মোবাইল কান থেকে নামিয়ে রাখলো।

ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি হয়েছে? ‘

সুমিত্রা এগিয়ে এলো,

‘ আপনি তাড়াতাড়ি যান জিজু, আন্টি এখন আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখলে রেগে যাবেন। ‘

ধ্রুব চলে গেলো। নিচে অনেক কাজ আছে। ধারার বাবার বাড়ির ও ধ্রুবদের বংশের আত্নীয়রা কিছু রয়ে গেছেন। তারা একেবারে আগামীকাল বৌভাতের পর যাবেন।

ধ্রুবকে ঘরে পাঠানো হলো নয়টার পর। দরজা বন্ধ করে সে যখন বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো তখন দেখতে পেলো তার বউ ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ের সাজ এখনো রয়ে গেছে। গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর চিহ্ন। ধ্রুবর বুক ধক করে উঠলো। আলগোছে নিনীকার মাথা তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। হাত দিয়ে সামনে আসা চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো। গালে হাত ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলো,

‘ মিসেস? ‘

নিনীকা ফট করে চোখ মেলে তাকালো। ধ্রুব প্রশ্ন করলো,

‘ কেঁদেছ কেন? ‘

নিনীকা ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ধ্রুবের চোখ টলমল করছে, ঠোঁট বেঁকে যেতে চাইছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। নিনীকা এক সময় শান্ত হলো। ধ্রুব শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ আজ হয় সব বলবে নয়তো আর কখনোই বলার দরকার নেই। ‘

(চলবে)

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

সময় গড়িয়েছে। রাত দশটা। দুজন কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়েছে। একটু আগে ফারিন দুজনের খাবার দিয়ে গেছে উপরে। নিনীকা শক্ত হয়ে বিছানায় বসে। ধ্রুব নিজেই ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিলো। নিনীকা বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলো। ধ্রুব খেতে খেতে বলল,

‘ কেন এতো অবাধ্য হচ্ছো মিসেস? আমাকে কি এতোদিনে একটুও বিশ্বাস করতে পারোনি? তবে কেন বলেছিলে ভালোবাসো? ‘

নিনীকা টলমল চোখে তাকালো,

‘ আপনাকে আমি ভালোবাসি এবং সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসও করি। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না, ব্যাপার টা আমার মা বাবার বিষয়ে। তিনি যতোই খারাপ হোন তাকে আর কারো কাছে খারাপ প্রমাণ করতে আমি চাই না। আপনাকে কি করে আমি সব বলি! ‘

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাওয়া শেষ করলো। ডিম লাইট অন করে এসে শুয়ে পড়লো ফুলে সজ্জিত বিছানায়। নিনীকা বুকে আছড়ে পড়লো। ধ্রুবের পড়োনের টি-শার্ট টেনে খুলে রাগে ছুঁড়ে ফেললো রুমের এক কোণে। উন্মুক্ত বুকে দাঁত দিয়ে দংশন করে নিজের রাগ, চাপা অভিমান কমাতে চেষ্টা করলো। ধ্রুব মাথায় হাত ভুলিয়ে শান্ত করতে চাইলো।

‘ শান্ত হও, বলতে হবে না কিছু। ‘

নিনীকা ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো। ধ্রুব চোখের পানি মুছে দিলো।

‘ হুস কাঁদে না। ‘

‘ আপনাকে আমি বলবো, তবে কখনো তারা যাতে জানতে না পারে আপনি সব জানেন। ‘

ধ্রুব বউয়ের পড়োনের শার্ট ঘরের আরেক কোণে ছুড়ে ফেললো। নিজের উপর সমস্ত ভর নিয়ে হাতের বন্ধন শক্ত করে বলল,

‘ কেউ জানবে না। ‘

নিনীকা মাথা এলিয়ে দিলো।

‘ আমার আগমনী বার্তা শুনে বাবা খুশি হননি। কেন হননি জানি না। মা বলেছেন তাদের লাভ ম্যারেজ। বাবা ও তিনি একই ক্লাসে ছিলেন। সমবয়সী তারা। প্রথমে বন্ধুত্বের মতো সম্পর্ক গড়ে উঠে, তারপর প্রেম। আবেগের বয়স থেকে তাদের প্রেম বাবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত চললো। তারপর পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হলো। বাবার বাবা মানে আমার দাদার অঢেল সম্পত্তি ছিলো। বাবা স্টুডেন্ট হলেও বেকারত্ব গুছিয়ে ফেলতে চেষ্টা করেছেন দাদার ব্যবসায় ঢুকে। ভালো বংশ, ছেলে ভালো। তার উপর কতো বছরের সম্পর্ক তাদের। সবাই রাজি হবেন স্বাভাবিক। আর আমার নানা মশাই তেমন রাগী মানুষ ও ছিলেন না। আগের যুগ হলেও মেয়ের মতামতের গুরুত্ব ছিল তার কাছে। ব্যস মা বাবার বিয়ে হয়ে যায়। বাবা নাকি মাকে অনেক ভালোবাসতেন। চিঠিপ্রেম ও বাদ যায়নি। তাদের যখন প্রতিষ্ঠান আলাদা হয় প্রেম চলাকালীন তখন নাকি বাবা শহরে বেশিদিন থাকতে পারতেন না। ছুটে গ্রামে এসে লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতেন। বিয়ের পরও বাবার সেই প্রেম এক চিমটিও কমেনি। কিন্তু বিয়ের পাঁচ মাস পর বাবা বদলে যান।

তিনি হোস্টেলে ছিলেন। মাকে ফোন করেছিলেন পরীক্ষা শেষ তিনি ফিরবেন। মা আমার আগমনের সংবাদ ফোনে দিলেন না। বাবাকে বলেছিলেন সারপ্রাইজ দিবেন। বাবা কথা রাখেন নি। পরের দিন বাড়ি ফিরেন নি। তার চার পাঁচ দিন পর বাড়ি ফিরেন। তখন তিনি মায়ের সেই প্রেমিক ছিলেন না, ছিলেন হিংস্র কোনো পশু। সেই যে বাবা বদলে গেলেন। মায়ের উপর তার হিংস্রতা ছিল মাত্রাধিক। আমার আসার খবর শুনে তিনি নাকি মাকে চড় মেরেছিলেন। অথচ এই তিনিই বাসর রাতে স্ত্রীর সাথে কথা বলেছিলেন, তার প্রথম সন্তানের নাম হবে নিনীকা শেখ।

আমার যখন জন্ম হলো তখন নাকি বাবা কোলে নেন নি। আমার এখনো মনে আছে, তখন কতোই বা বয়স হবে চার কি পাঁচ। বাবার কোলে উঠার বায়না করতাম। বাবা নিতেন না। মাঝে মধ্যে যখন আমি ঘরে একা থাকতাম তখন নিতেন। আবার নির্দয় ভাবে ছুঁড়েও ফেলতেন। আমি ব্যথায় ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতাম। তুমি ‘পচা বাবা’ বলে অভিযোগ করতাম।

একটু একটু করে বড়ো হচ্ছিলাম। আমার কাছে একজন ঘৃন্য লোক হলেন আমার বাবা। আমারই সামনে তিনি আমার মাকে অমানুষিক অত্যাচার করতেন। বন্ধ দরজার ভেতর থেকে আমার কানে ভেসে আসতো মায়ের চিৎকার। আট বছর বয়সেই আমাকে আলাদা ঘরে দেওয়া হলো। রাতের আঁধারে আমি মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদতাম। কিন্তু মা আসতে চাইলেও বাবা আটকে রাখতেন।

আমার সাথে কেউ মিশতো না। স্কুলে যেতাম গাড়ি করে, আসতামও গাড়ি করে। কারো সাথে কথা বলতাম না। সবার বাবা তাদের স্কুলে নিয়ে যেতো। আমার বাবা যেতো না। সে কখনো আমার জন্যে চকলেট নিয়ে আসতো না। আমার পছন্দের চিপস খাওয়া বন্ধ করে দিতে হয় তার জন্য। আমার যা পছন্দ হতো, তা তিনি আমার থেকে কেঁড়ে নিতেন। পছন্দের পুতুল, পছন্দের খেলনা। আমি যখন ক্লাস এইটে তখন আমার একটি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়। আমাদের বাড়ির পাশের বিল্ডিংয়ের একটি ফ্ল্যাটে ওরা নতুন এসেছিলো। আমি ওর সাথে মাঠে খেলতে যেতাম। বাবা অফিসে গেলে বের হতাম, ফিরে আসতাম তার আসার আগে। মাঝে মধ্যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ওর সাথে খেলতে চলে যেতাম। মা বারণ করতেন। বাবা জানলে রক্ষে থাকবে না। কিন্তু বাবা কিভাবে যেনো জেনে গেলেন। ওই ছেলেটাকে আমার সামনে প্রচন্ড মারলেন। ক্ষমতার জোরে ওদের শহর ছাড়া করে ছাড়লেন। আমাকে টেনেহিঁচড়ে ঘরে এনে ছুঁড়ে ফেললেন। বললেন, ‘ ছেলেদের থেকে যেনো দূরে থাকি। কোনো পুরুষ যেনো আমার আশেপাশে ও না আসে। ‘

আমি ভাবলাম হয়তো বাবা অন্য কিছু আন্দাজ করে এটা বলেছেন। বুঝাতে চেষ্টা করে বললাম, ‘ও শুধু আমার বন্ধু হয় বাবা, আমরা একসাথে প্রতিদিন মাঠে আরও ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলা করি। ‘

বাবা আমাকে দুদিন ঘরবন্দী করে রেখেছিলেন। মাকেও আসতে দিতেন না। দু’দিন পর আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কোনো ছেলে আমাকে প্রপোজ করলে আমি ভয়ে কাউকে বলতাম না। বাবার কানে গেলে ওই ছেলেগুলোর অবস্থা খারাপ করে দিতো। আমি পাবলিকে চান্স পেলাম। হোস্টেলেই থাকতাম বেশিরভাগ। অনেক ছেলে মেয়েই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। আমি পাত্তা দিতাম না।

টিউশনি করাতে শুরু করলাম। নিজের হাত খরচটা জুটে যেতো। ফাইনাল ইয়ার শেষ করে বাড়িতে তখন। আচমকা বাবা বিয়ে ঠিক করেন। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। মাকে ইমোশনাল ব্লেকমইল করলাম। সে আমাকে পাসপোর্ট এনে দিলো। ঠিক করলাম রমজান শেখের মান ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে চলে যাবো।

বিয়ের দিন আমাকে পালাতে সাহায্য মা-ই করেছেন। বেলকনি দিয়ে বাগানে, বাগান থেকে লুকিয়ে বের হয়ে সিএনজি ধরে নিজের পরবর্তী গন্তব্যে।

বাবার পছন্দের প্রতি কখনোই আমার ভরসা ছিল না। আমার ধীরে ধীরে একটা ফোবিয়া তৈরি হয়ে গেছিলো। আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। ছেলেদের তো নয়ই। প্রত্যেক মেয়ের জীবনে বাবা হয় প্রথম পুরুষ। তার থেকেই পুরুষদের ব্যাপারে ধারণাটা প্রথম পাওয়া যায়। আমার ধারণা পাওয়াটা তেমন ভালো ছিল না। আমি দেখেছি কিভাবে একজন পুরুষ স্বামী নামক ট্যাগ শরীরে লাগিয়ে দিনের পর দিন নিজের স্ত্রীর উপর জঘন্য সব নির্যাতন করে। আমি দেখেছি একজন পাষণ্ড বাবাকে।

সুমিত্রার সাথে পরিচয়টা অনলাইনে হয়। টুকটাক কথা হতো। একসময় সম্পর্ক গাঢ় হয়। আমার জীবনে একজন বন্ধু হয়। ওকে আমি সব শেয়ার করি বিশ্বাস করে। আমি সেদিন ভেবেছিলাম ও হয়তো আপনাকে সব বলে দিয়েছে। সেজন্য ওভাবে রেগে গেছিলাম। আপনার মায়ের সাথে ঝগড়া শুরু করেছিলাম ঠিক, তবে সর্বোচ্চ রাগ তখন হয় যখন তিনি মা বাবা নিয়ে কথা বলেন।

দীর্ঘ কথা বলে থামলো নিনীকা। তার চোখেমুখে কষ্টের চাপ। ছলছল চোখে ধ্রুবর দিকে মুখ তুলে তাকালো।

‘ আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না, বদলে যাবেন না। কথা দিন। ‘

ধ্রুব দু’হাতে মুখ তুলে কাছাকাছি আনলো। কপালে গভীর ভালোবাসা নিয়ে চুম্বন করলো।

‘ তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে আমার হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে যাক, পৃথিবী থেকে ধ্রুব নামটি মুছে যাক। ‘

নিনীকা কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ আমি আপনার মা বাবাকে দেখে, আপনার আমার প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব দেখে এতোটুকু বুঝেছি এক জনমের অর্ধেক সময় অবহেলায় কাটলেও বাকি সময়টা ভালোবাসাতেই কেটে যাবে। আমার এই ধারণাটা যেনো কখনো বদলে না যায়। এটার দায়িত্ব আমি আপনাকে দিলাম। ‘

‘ দায়িত্ব নিলাম তবে। ‘

নিনীকা তলপেটে চাপ অনুভব করলো। ধ্রুব নেশালো কন্ঠে শুধালো,

‘ পৃথিবীর সবকিছু ভেসে যাক, সবাই ছেড়ে চলে যাক। বদলে যাক সবকিছু। আমি মেজর ধ্রুব মাহবুব কথা দিচ্ছি সারাজীবন মিসেসের দেওয়া দায়িত্ব পালন করে যাবো ভালোবেসে। ‘

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে