#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৯
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
( কপি নিষিদ্ধ)
‘ভালোবাসার মিথিলা বেগম,
‘ পত্রে সবার আগে আমার সালাম নিও। বাবাকে আমি তোমার কথা জানিয়েছি অনেক আগে। তিনি শীগগির তোমাদের বাড়িতে প্রস্তাব রাখতে যাবেন। তুমি মনে কোনো চিন্তা রেখো না। হোস্টেল থেকে ফিরলেই আমি তোমাকে দেখা দেবো। ততোদিন একটু মনোকষ্ট সহ্য করে নাও। শহর থেকে পরিচিত একজন ভাই গ্রামে যাচ্ছেন। তাহার কাছে তোমার জন্যে নিজের প্রথম ইনকাম দিয়ে কেনা কিছু উপহার পাঠিয়েছি। দেখা করার সময়ে তোমাকে আমি সেগুলোতে দু-চোখ ভরে দেখতে চাই। প্রাণের মিথিলা বেগম তুমি অপেক্ষায় থেকো। ‘
ইতি
তোমারই শেখ বাবু
‘ পুরনো চিঠিটা পড়ে মিথিলার বুকে ঢেউ বইতে লাগলো। তাদের প্রেমের সময়কার এরকম কতশত চিঠি আছে। দুজন দুজনকে চিঠি লিখতেন মাঝে মধ্যে। রমজান শেখের বাড়িতে বা হোস্টেলে টেলিফোন থাকলেও মিথিলাদের বাড়িতে ছিল সবে একটা। তাও বাবার ঘরে। মিথিলা চুপিচুপি সেটা দিয়ে কথা বলতেন। মনে চলতো ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। অথচ তার বাবা কন্যার এহেন প্রেমের বিষয়ে আগেই অবগত ছিলেন। অগোচরে খোঁজ খবর নিয়ে যখন জেনেছেন ছেলে ভালো পরিবারের তখনই চুপ হয়ে গেছেন। অপেক্ষা করেছেন সঠিক সময়ের। সেই সঠিক সময় আসে। রমজান শেখের বাড়ি থেকে প্রস্তাব রাখা হয়। তারই পরিপেক্ষিতে আজ মিথিলা তার জীবনের একমাত্র প্রেমিকের বউ। দুজন বয়সে প্রায় সমবয়সী। গ্রাম থেকে শহরে বাড়ি করেছেন রমজান শেখ। গ্রামের বাড়িটা এখনো পড়ে আছে। নিনীকা হওয়ার পরই এখানে একেবারে চলে আসতে হয় তাকে। নিনীকার দাদাবাড়ি বা নানাবাড়ির তেমন কারো সাথে যোগাযোগ নেই। রমজান শেখ বাবার একমাত্র পুত্র। এদিকে মিথিলার বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইদের সাথে দূরত্ব বেড়ে যায়। সারাজীবন এই বাড়িতেই কাটিয়েছেন, কখনো সেভাবে কোথাও আর যাওয়া হয়নি।
পুরনো স্মৃতিচারণ বন্ধ করে মিথিলা বিছানার দিকে অগ্রসর হলেন। রমজান শেখের চোখজোড়া বন্ধ। কপাল তীব্র গরম। মিথিলা ওয়াশরুম থেকে পানি নিয়ে এলেন। কপালে জলপট্টি দিতে দিতে আচমকা কিভাবে ঘুমিয়ে গেলেন বুঝতেও পারলেন না।
–
চারিদিকে সবুজে ঘেরা। বাড়িটির বাগানের ঘাসগুলোতে ফুটেছে পুর্তলিকা। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ফারিন ও নিনীকা বাগানে এসেছে। দুজনে হাত বাড়িয়ে ফুল ছিঁড়ে কানে গুঁজেছে। কথা বলতে বলতে কখনো একে অপরের উপর হেসে হেলে পড়ছে। ধারা বারান্দায় দাড়িয়ে কফি খেতে খেতে সে-ই দৃশ্য মনোযোগ সহকারে দেখছেন। ফারিনের চোখ বারান্দায় পড়তেই চকচক করে উঠলো মুখ।
‘ মাম্মা তুমিও এসো। ‘
ধারা বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি, সিঁড়ি পেরিয়ে সদর দরজা পেরোলেন। নেমে এলেন বাগানে। নিনীকা রক্তের মতো টুকটুকে জবা ফুল ছিঁড়ে তার কানে গুঁজে দিলো। ধারার পড়োনে ফাহিম মাহবুবের গতকাল কিনে আনা খয়েরী রঙের জামদানী শাড়ি। ব্রাউন ও কালো রঙের মিশ্রিত চুলগুলোতে ছোট্ট একটি বেনী করা। ঠোঁটে হালকা লিপবাম। ফাহিম মাহবুব বাগানে উপস্থিত হলেন। স্ত্রীর এহেন রুপ মুগ্ধ চোখে দেখলেন। ফারিন হেসে বলল,
‘তুমিও কি কানে ফুল গুঁজবে পাপা? ‘
‘ না আমার মা, ফুল ফুলদেরই মানায়। ‘
‘ আমাদের কেমন লাগছে পাপা? মাম্মাকে দেখো কতো বিউটিফুল লাগছে না? ‘
ফাহিম মাহবুব হাসলেন,
‘ তোমার মাম্মাকে সবসময়ই সুন্দর লাগে। ‘
ধারা গম্ভীর হতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। ছেলেমেয়েদের সামনে স্বামীর প্রশংসনীয় মন্তব্যে তার লজ্জাও লাগছে। ফাহিম মাহবুব সুযোগ নিলেন। বললেন,
‘ দেখো তোমার মা কিভাবে লজ্জা পাচ্ছে। ‘
ফারিন তাকালো,
‘ তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো মাম্মা? ‘
ধারা চুপ করে রইলেন। নিনীকা হাতের ফোনে ক্যামেরা অন করে বলল,
‘ আপনাদের একসাথে একটা ছবি তুলি বাবা? ‘
ফাহিম মাহবুব খুশি হলেন,
‘ অবশ্যই, অবশ্যই। ‘
ধারাকে টেনে নিয়ে ফারিন জবা ফুলের গাছের সামনে দাড় করালো। ফাহিম মাহবুব স্ত্রীর কাঁধে এক হাত জড়িয়ে দাড়িয়ে রইলেন। দুজনের মুখে হাসি। নিনীকা দৃশ্যটি ক্যামেরায় বন্দি করলো। ফারিন মা বাবার মাঝে গিয়ে দাড়ালো। তার কানে পুর্তলিকা ফুল। মা বাবার মধ্যে তাকে একটি পরীর মতো লাগলো। ছোট্ট পরী।
নিরবকে রাতে থেকে যেতে হয়েছিল। ধ্রুবের সাথে কথা বলতে বলতে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে বাগানে এলো। অংশ নিলো আনন্দের এই মুহুর্তে। ফারিন একটি ফুল বাড়িয়ে দিলো,
‘ আপনি কি কানে ফুল গুঁজবেন? ‘
নিরবের কন্ঠ থমথমে,
‘ জি না। ‘
নিনীকা ধ্রুবর কানে বড়ো একটি সাদা পুষ্প গুঁজে দিলো। টেনে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে ক্যামেরায় দুজনকে বন্দি করলো। ধ্রুব ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ এসব কি? আমার কানে ফুল কেন? ‘
‘ কোথায় লিখা আছে ছেলেরা ফুল কানে দিতে পারবে না? আপনাকে ফুলবাবু লাগছে মোবাইলে দেখুন। ‘
ফারিন হাসছে,
‘ তোমাকে সুন্দর লাগছে ভাইয়া। ‘
ফাহিম মাহবুব ছেলেকে দেখলেন।
‘ ফুল কানে দেওয়াতে তোমার দজ্জাল চেহারা কিছু টা নমনীয় লাগছে বেটা। ‘
ধারা চোখমুখ কুঁচকে তাকালেন,
‘ একদম আমার ছেলেকে দজ্জাল বলবে না। নিজে কি ছিলে? চাকরি করতে হলে সবাইকেই ওরকম হতে হয়। সে তো আমি দরদি তোমাকে মায়া করে বিয়ে করেছি, নাহলে বিয়ের জন্য মেয়েই পেতে না। ‘
ফাহিম মাহবুব হাসলেন,
‘ ভাগ্যিস তুমি বিয়ে করেছিলে, নাহলে যে কি হতো! সেটা কল্পনা করেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চেক করে দেখো। ‘
ধারা মুখ শক্ত করে চুপ করে রইলেন। ফারিন খিলখিল করে হেসে পেছন থেকে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলছে। ধ্রুব বোনকে পিঠে তুলে নিয়েছে।
‘ তুই বড় হচ্ছিস না কেন রে? তোকে বিদায় করতে হবে তাড়াতাড়ি। ‘
ফারিন এক হাত ছাড়িয়ে ধ্রুবের চুল টানতে চেষ্টা করলো। ধ্রুব নামিয়ে দিলো তৎক্ষনাৎ।
ধারা মেয়েকে টেনে ধরেছেন। ফারিন ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে,
‘ তোমাকে বিদেয় করবো, তোমাকে বিয়ে দেবো। ‘
ধ্রুব শব্দ করে হাসছে,
‘ আমি তো বিয়ে করে নিয়েছি। ‘
নিনীকাকে দেখিয়ে বলল,
‘ এই দেখ আমার বউ। ‘
‘ তোমার বউকে রেখে তোমাকে বিদেয় করবো। ভাবীকে লুকিয়ে রাখবো। দেখে নিও। ‘
ধ্রুব মিথ্যা ভয় পাওয়ার অভিনয় করলো,
‘ তাই নাকি? আমার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দিন রাজকুমারী। ‘
ফাহিম মাহবুব ছেলেকে মৃদু জোরে ধমক দিলেন।
‘ চুপ করো বাজে ছেলে, আমার মেয়েকে একদম বাজে কথা বলবে না। তুমি ও তোমার মা বিদেয় হবে। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে একা থাকবো এই প্রাসাদে। তাই না আম্মা? ‘
ফারিন তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে ধ্রুবের দিকে রাগী চাহনি নিক্ষেপ করে রেখেছে। ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসছে। নিনীকা আচমকা বলল,
‘ আমিও আপনাদের পক্ষে বাবা। আমিও থাকবো। ‘
ফারিন তৎক্ষনাৎ নিনীকার হাত টেনে নিজের দিকে নিলো। ধ্রুব অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ এ কেমন অবিচার? জাতি এমন অপরাধ মেনে নিবে না। আমার মতো সহজ সরল ছেলের প্রতি তুমি এভাবে অন্যায় করতে পারো না মিসেস। এসো, ফিরে এসো বলছি। ‘
ধারা গম্ভীর স্বরে বললেন,
‘ ছেলের বউ শ্বশুরের পক্ষ নিচ্ছে। একটা মেয়ে জামাই থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের পক্ষ নিতো ধ্রুব। ‘
নিরব নিজের নিরবতা ভাঙলো। তৎক্ষনাৎ এসে দাড়ালো ধারার পাশে।
‘ মেয়ে জামাই নেই তো কি হয়েছে, আপাতত আমি আছি আন্টি। এই নিন আমিও আপনাদের পক্ষে। ‘
ফাহিম মাহবুব অসন্তোষ গলায় বললেন,
‘ সারাজীবন আমাকে স্যার বলে মুখে ফ্যানা তুলে এখন মীরজাফরি করলে অফিসার। তোমার ওই দু’দিনের মেজরের পক্ষ নিলে। দেখবো কতোদিন এমন পক্ষ পক্ষ খেলা চলে। ‘
নিরবের চেহারায় অসহায়ত্ব।
‘ তবে আমি আপনার দলে আসছি স্যার। ‘
ধারা হাত টেনে ধরলেন।
‘ একদম না। তুমি আমাদের পক্ষের। ‘
ওপর পাশ থেকে ফাহিম মাহবুব হাত টেনে ধরলেন।
‘ ছাড়ো ওকে সে আমাদের পক্ষে আসবে বলেছে।
‘ ধ্রুব আমাকে পেছন থেকে টানতে থাক। দেখবো এই লোক কিভাবে তার এই অফিসারকে নিজের পক্ষে নেয়। ‘
ফাহিম মাহবুব পেছনে দাড়ানো কন্যা ও পুত্রবধূকে ইশারা করলেন। ফারিন ও নিনীকা তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে তাকে টেনে ধরলো।
সবার মাঝখানে টানাটানিতে নিরবের হাত খুলে যাওয়ার অবস্থা। বেচারা অসহায় কন্ঠে চিৎকার করলো,
‘ মেজর প্লিজ রক্ষা করুন। ‘
ধ্রুব তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলো ধারাকে। পেছন থেকে দৌড়ে গিয়ে নিনীকাকে টেনে কাঁধে তুলে নিলো। দৌড় দিয়ে চললো বাগান পেরিয়ে। ধারার পুরো ভর ছিল ধ্রুবের উপর। ফারিনের পুরো ভর ছিল নিনীকার উপর। ফাহিম মাহবুব ছিলেন নিরবের দিকে ঝুঁকে। আচমকা ধ্রুবের এহেন কান্ডে একে একে সবাই ধপাস করে নিচে পড়েন। ফাহিম মাহবুব তৎক্ষনাৎ চিৎকার দিলেন,
‘ আরে ধ্রুবকে ধরো, ও আমার পুত্রবধূ নিয়ে পালাচ্ছে। ‘
ধারা ও ফাহিম মাহবুব উঠে ছুট লাগালেন সেদিকে। ফারিন নিরবের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।
‘ আপনি আমাদের পক্ষেরই হবেন, একদম ছুটতে চেষ্টা করবেন না। ‘
নিরব অসহায় চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। দুজন দৃষ্টি ফেললো সদর দরজার দিকে। ধ্রুব ইতিমধ্যে বউ নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। পেছনে ধারা ও ফাহিম দৌড়াচ্ছেন। নিরবের মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো,
‘ ও মাই গড, ও মাই গড! ‘
তাদের কানে ভেসে এলো ফাহিম মাহবুবের চিৎকার,
‘ অসভ্য ছেলে থামো বলছি, ছেড়ে দাও আমার বউমাকে। ‘
(চলবে)