#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
( কপি নিষিদ্ধ)
রাত সাড়ে দশটা। বাহিরে প্রকৃতির তান্ডব চলছে। টেবিলে ধারা গরম খাবার এনে রাখছেন। ফাহিম মাহবুব চেয়ার টেনে বসলেন।
‘ ছেলেমেয়েরা কোথায়? ‘
‘ আমি এসে গেছি পাপা। ‘
সিঁড়ি দিয়ে নামলো ফারিন। পড়োনে বারবি ফ্রক। সেটা দুলাতে দুলাতে আসছে সে। বাবার পাশে বসে গলা জড়িয়ে ঝুলতে লাগলো। ফাহিম মাহবুব শব্দ করে হাসলেন। মেয়ের কপালে আদর দিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ দেখেছো আমার মা কতো খুশি হয়েছে? তোমাকে যখন ভিডিও কলে দেখাচ্ছিলাম ড্রেসটা তখন তুমি বলেছিলে ওর পছন্দ হবে না। অথচ এখন সে খুশিতে লাফাচ্ছে। ‘
ধারা আড়চোখে বাপ মেয়েকে দেখে নিলেন।
‘ তোমার মেয়ের কখন কোনটা ভালো লেগে যায় আমি কিভাবে বলবো? আজ এটা কাল ওটা। নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ নেই তার। ‘
ফারিন আদুরে বাচ্চাদের মতো ঠোট চোকা করলো,
‘ আমাকে প্রিন্সেস লাগছে না মাম্মা? ‘
ধারা এবার হাসলেন, এগিয়ে এসে দাড়ালেন ফাহিম মাহবুবের পেছনে। দুজনের গাল টেনে দিয়ে বললেন,
‘ বাপ মেয়ে দুজনকেই সুন্দর লাগছে। ‘
‘ তুমি পড়োনি কেন? পাপা তো সবার জন্যে এনেছে। ‘
‘ এখন কেন পড়বো? পরে কখনো পড়ে দেখবো। ‘
‘ কিন্তু এখন পড়লে পাপা তো খুশি হতো, তাই না পাপা? ‘
ফাহিম মাহবুব নতুন কেনা পাঞ্জাবির কলার টেনে বললেন,
‘ সে তো হতামই। তবে তোমার মাম্মামের বোধহয় আমার কেনা শাড়ি পছন্দ হয়নি। ‘
ধারা পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে দিলেন,
‘ তোমাকে বলেছি আমার পছন্দ হয়নি? আচ্ছা যাও খেয়ে পড়বো। পড়ে ঘুমাবো ভালো হবে? ‘
‘ দৌড়াতেও পারো সমস্যা নেই। ‘
ফারিন খিলখিল করে হাসলো। ধারা চোখ গরম করে তাকালেন। তন্মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিচে নামলো নিনীকা। পেছনে ধ্রুব। দুজনেই সদ্য গোসল করেছে। চুল শুকিয়ে তবেই নিচে নেমেছে। নিনীকাকেও কাঁপতে দেখে ফারিন হেসে বলল,
‘ বৃষ্টির দিনে ঠান্ডা লাগে অনেক তোমার? ‘
নিনীকা থমথমে কন্ঠে উত্তর দিলো,
‘ তেমন না, তবে আজ বেশিই ঠান্ডা। ‘
ধ্রুব মিটমিট করে হাসছে। নিনীকা ফুসফুস করতে করতে চেয়ার টেনে বসলো। আজ তার মাথায় মস্ত বড় একটি ওড়না জড়ানো, ফাহিম মাহবুবের দেওয়া থ্রিপিসের জর্জেট ওড়না। যা শরীর পুরোটাই ঢেকে রেখেছে। ধারা চিন্তিত হয়ে কপালে হাত রাখলেন।
‘ তোমার কি বেশিই ঠান্ডা লাগছে? এসিটা অফ করে দেই তবে। যেভাবে কাপছো খেতে পারবে তো নিজ হাতে? ‘
নিনীকা কাঁপা হাতের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। ধারা নিজেই আবার বললেন,
‘ সমস্যা নেই, আমি আছি, ফাহিম আছে, তোমার বর আছে, তাছাড়া ফারিনও আছে। বলো কার হাতে খাবে?’
নিনীকার চোখে বিস্ময়। আর কতো অবাক হবে সে? ধ্রুব কিঞ্চিৎ কাশলো,
‘ বলো মিসেস কার হাতে খেতে চাও? ‘
ফারিন ফুড়োন কাটলো,
‘ ওতো খুশি হওয়ার দরকার নেই, ভাবী নিশ্চয়ই তোমার হাতে খাবে না। হুহ! ‘
ধ্রুব বোনের মাথায় গাট্টা মারলো। নিনীকা ঠোঁট চেপে হাসছে। তার হুট করেই কান্না পাচ্ছে। ফাহিম মাহবুব বললেন,
‘ আমি খাইয়ে দেই মা? এখনো মাঝে মধ্যে এ বাড়ির সদস্যদের একসাথে বসে খাইয়ে দেই মাঝে মধ্যে। তুমি তো সবে এলে, চলো এখন থেকে তোমাকেও খাইয়ে দিবো। ‘
ফারিন বাবার গলা ছেড়ে চেয়ার থেকে নামলো। দ্রুত গতিতে হাতে তুলে নিলো প্লেট।সেটাতে ভাত ও রোস্ট নিয়ে মাখাতে মাখাতে বলল,
‘ একদম না, আমি খাওয়াবো তাকে। ‘
টেবিলের সবাই হাসছে। ধারা ফারিনের হাত থেকে প্লেট টেনে নিতে চাইলেন। সে দিলো না। ছোট হাতে ভাত তুলে ধরলো নিনীকার মুখের সামনে। নিনীকা খেয়ে নিলো। ধ্রুব বলল,
‘ ভাইকে তো কখনো খাইয়ে দিলি না, একদিনের ভাবির জন্যে এতো দরদ। দে আমার বউকে আমি খাইয়ে দিবো, তুই তোরটা খা। ‘
ফারিন দিলো না। ধারা নিজেই টেনে নিলেন। ফারিন দামী বারবি ড্রেসের মায়া ত্যাগ করে নিচে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লো। ফাহিম মাহবুব হায়হায় করে উঠলেন। মেয়েকে টেনে এক প্রকার কোলেই নিলেন। ধারাকে মিছে রাগ দেখালেন,
‘ তোমার এতো বড় সাহস, তুমি আমার প্রিন্সেসকে দুঃখ দাও। ধারা! ‘
ফারিনকে বুঝ দিলেন,
‘ চলো আজ বাবা সবাইকে খাইয়ে দিবো। তোমার মা বা ধ্রুব কেউ তোমার ভাবীকে খাওয়াবে না। তুমি তো খাইয়েছো তাই না? এবার বাবা সবাইকে খাইয়ে দেই? ‘
ফারিনের কাঁধ পর্যন্ত চুল কাটা। গোলগাল মুখশ্রী। বয়স এবার ষোলো হবে। ফেইস রিয়াকশন দেখে যে কেউ বলবে মেয়েটি ইমম্যাচিউর। অথচ পরিবার ছাড়া সবখানেই মেয়েটি বড়োদের মতো দাপিয়ে বেড়ায়। ফারিন চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে নিলো। বলল,
‘ ঠিক আছে। ‘
ধারা মেঝেতে শীতলপাটি বিছিয়ে দিলেন। নিনীকা একে-একে সব খাবার সেখানে রাখলো। সবাই গোল হয়ে বসলেন। নিনীকার একপাশে ধ্রুব। তার এক হাত সবার অগোচরে বউয়ের কাঁধে। আরেক পাশে ফারিন। তারপর মাঝে ফাহিম মাহবুব। ধ্রুব ও ফাহিম মাহবুবের মাঝখানে ধারা বসলেন। ফাহিম মাহবুবের সামনে একটি প্লেট। যেটাতে তিনি ভাত মাখাচ্ছেন। তারপর একে একে স্ত্রী, কন্যা, পুত্র এবং পুত্রবধূকে খাইয়ে দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে স্ত্রী, কন্যা, পুত্র ও পুত্রবধূ তার মুখেও ঠেলে দিচ্ছে খাবার।
বাহিরে প্রকৃতির তান্ডব বেড়েছে। ডোয়িং রুমের কাঁচের জানালাগুলো খোলা। বাতাসে পর্দাগুলো উড়ছে। বউ পাগল পরিবারটির নাম বউ কথা কও। বাড়িটা যেনো মায়ায় ঘেরা। মায়ায়ঘেরা বাড়িটার মানুষ গুলোও প্রচন্ড মায়াময়। কি নেই এখানে। চারিদিকে সারাক্ষণই এক ধরনের সুখ বিরাজ করে। আকাশ গর্জন করছে। মাঝে মধ্যে সাদা হয়ে আলোকিত করে তুলছে ডোয়িং রুমের দৃশ্যটি। সুখী একটি মুহুর্ত।
সুখি এই দৃশ্যে একজন উধাও। বাড়িটার বর্তমান প্রজন্মের কন্যা ফারিনের বর। কে হবে সে? ওই যে দেখা যাচ্ছে ফাহিম মাহবুবের পাশে আরেকটু জায়গা ফাঁক রয়ে গেছে। ওখানে কে করে নিবে জায়গা?’
চারিদিকে নিস্তব্ধতা। কারেন্ট চলে গেছে বলে জেনারেটর চালু করা হয়েছে। মাঝে মধ্যে সুখি পরিবারের মানুষদের কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে আচমকা শুনা গেলো বিকট একটি শব্দ। ফাহিম মাহবুব তখন সবে ধ্রুবের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরেছেন। ধ্রুব মুখে নিতে গিয়ে থেমে গেলো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সদর দরজার দিকে।
ধারা জানলা দিয়ে বাহির দেখলেন। চিন্তিত স্বরে স্বামীকে বললেন,
‘ এ অসময়ে কে আসতে পারে গো? ‘
ফাহিম মাহবুব ধ্রুবের মুখে ঠেলে ভাত ঢুকিয়ে দিলেন। আবারও বেজে উঠলো সেই শব্দ। ধ্রুব উঠে দাড়ালো।
‘ আমি দেখছি। ‘
ফাহিম মাহবুব ছেলেকে মানা করলেন।
‘ একদম না বাবা, আগে জানা প্রয়োজন বাহিরে কে বা কারা আছে। আমাদের চাকরিসূত্রে কিন্তু শত্রুর অভাব নেই ধ্রুব। ‘
ধ্রুব দমে গেলো। বসে পড়লো আগের জায়গায়। ফাহিম মাহবুব ধারাকে চোখের ইশারা করলেন। তিনি উঠে গিয়ে দরজার ফাঁক গলিয়ে বাহিরে তাকালেন। ধারা কিছু টা চমকে গেলেন। ফাহিম মাহবুব ইশারায় জানতে চাইলেন, ‘কে?’
ধারা এসে পাশে বসলেন। হা করে মুখে ভাত ঢুকিয়ে চিবাতে চিবাতে বললেন,
‘ ফারিন বেটা আমার দরজাটা খুলে দিয়ে এসো। ‘
ফারিন বারবি গ্রাউনটা দুদিকে তুলে দুলতে দুলতে দরজা খুলতে গেলো। সবার নজর দরজার দিকে। সদর দরজা খুলে গেলো। কাক ভেজা পুরুষটি কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে ঢুকে ফারিনকে দেখেই থমকে গেলো। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলো ধ্রুবদের দিকে। ফারিন দরজা বন্ধ করে পুনরায় নিজের জায়গায় এসে বসেছে। ফাহিম মাহবুব চিন্তিত স্বরে বললেন,
‘ কি হে অফিসার তোমার এই অবস্থা কেন? ‘
নিরব অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ একটা কাজে বের হয়েছিলাম স্যার, হঠাৎ প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলো। মাঝরাস্তায় গাছ ভেঙে পড়ে আছে। গাড়ি টেনে আনা সম্ভব না। কাছেই আপনাদের বাড়ি, সেজন্য চলে এলাম। ‘
বলেই চারিদিকে চোখ ভুলিয়ে পুনরায় বলল,
‘ আমি মনে হয় ডিস্টার্ব করলাম এসে। বৃষ্টি কমলেই রওনা দিবো। গাড়ি পেয়ে যাবো আশা করি। ‘
ফাহিম মাহবুব প্লেটে ভাত মাখাচ্ছেন।
‘ তুমি আগে কাপড় চেঞ্জ করো। তারপর বাকি কথা হবে। ‘
ধ্রুব উঠে দাড়ালো,
‘ এসো ক্যাপ্টেন৷ ‘
নিরব ধ্রুবের দেওয়া টিশার্ট ও টাউজার পড়ে নিচে নামলো। ফাহিম মাহবুব নিজের পাশের ফাঁকা জায়গাটি দেখিয়ে বললেন,
‘ এখানে বসে পড়ো। এসেই পড়েছো যখন আমাদের পরিবারের এই মুহুর্তের খাওয়াপিনায় অংশগ্রহণ করো।’
নিরব বসলো। তার একপাশে ফাহিম মাহবুব আরেক পাশে ফারিন। ফাহিম মাহবুব যখন তার দিকে ভাতের লোকমা ধরলেন তখন সে অবাক হলো না। এই বাড়ির সবকিছুই তার জানা। যদিও এর আগে এরকম মুহুর্তের সাক্ষী হওয়া হয়নি। আজ হয়ে গেলো। তার বড়োই ভালো লাগলো। নিজেকে মনে হলো এই পরিবারেরই একজন!
(চলবে)