বিয়ে থা পর্ব-২৫

0
222

#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

শাড়ি সামলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে নিনীকাকে। অথচ যেদিন পালিয়ে গেছিল সেদিন শাড়ি পড়েই কত পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল তাকে। মায়ের পরিয়ে দেওয়া শাড়ি ছিল সেটা। সময়ের উপর সব চলে। নিনীকার আগের পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। সেদিন সে না চাইতেও শাড়ি সামলিয়েছে, আজ সে না চাইলেও বর ও ননদ দুজন তার শাড়ি সামলাতে ব্যস্ত হচ্ছে। অবশ্য নিনীকা মনে মনে খুশিই হচ্ছে। এইযে চেয়ারে বসার সময় ধ্রুব যত্ন করে তার আঁচল কোলে তুলে দিলো। ফারিন পাশের চেয়ারে সবার সময় কাঁধের দিকে টেনে দিলো। এইযে তার শ্বশুর মশাই খাওয়ার ফাঁকে বলছেন এটা দিবো মা? ওটা দিবো মা? রোস্ট টা আরেকটু নাও মা! এতোসব কিছু তার ভাগ্যে ছিল৷ তার সুখ। তার সংসারের মানুষগুলো! অথচ সেদিন কি না এসবের থেকে দূরে পালিয়ে গেছিল! পৃথিবীর সবাই একরকম হয় না। তার বরের বাড়ির সবাই চমৎকার। উঁহু তারই বাড়ি। এটা তো তারই, তার পরিবার। নিনীকার ভাবনার মধ্যে ধারা প্লেটে এক চামচ বিরিয়ানি তুলে দিলেন। খেতে ইশারা করে বললেন,

‘ ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করো না নাকি? গাল গুলো ভেঙে ভেতরে চলে গেছে। এখন থেকে ঠিকমতো খাবে। একটু স্বাস্থ্য হলে আরও ভালো লাগবে। ‘

নিনীকার চোখ ছলছল করছে। ধ্রুব নিজের প্লেট দেখিয়ে বলল,

‘ আমার প্লেটেও কিছু দাও, তোমার বউমাকে তো আমি বলিনি না খেয়ে স্লিম হতে। আমার বউ মোটা হোক চিকন হোক আমারই বউ। তুমি যেভাবে আমাকে না খাইয়ে রাখতে চাইছো মনে হচ্ছে আমি বলেছি তাকে না খেয়ে থেকে স্লিম হতে। ‘

ফারিন মুখ টিপে হাসলো। ফাহিম মাহবুব গলা কাঁকড়ি দিলেন। ধ্রুব মূলত নিজের মায়ের সাথে বউয়ের সম্পর্ক সহজ করতে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। বেচারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গড়গড় করে যা-ই বলে তা-ই এলোমেলো। কোনোটার আগামাথা নেই।

ধারা ছেলের প্লেটে রোস্ট ও বিরিয়ানি দিলেন।

‘ খাও, আর তোমার বউকেও খেতে বলো। এ বাড়ির সবাই গুলোমোলো, তোমার বউকেও গুলোমোলো হতে হবে বলে দিও। ‘

ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে খাচ্ছে। নিনীকা চোখ বন্ধ করে রোস্ট চিবুচ্ছে। মুখ দিয়ে তৃপ্তিময় শব্দ বের করে বলল,

‘ আপনার রান্না অসম্ভব সুস্বাদু আঙ্কেল। ‘

ফাহিম মাহবুব হাসলেন। আরও রোস্ট প্লেটে তুলে দিলেন। ধারা গম্ভীর স্বরে বললেন,

‘ সব শ্বাশুড়ির মতো আমি বলবো না মা বলে ডাকো। যদি কখনো মা মনে হয় তখনই না-হয় ডেকো। নয়তো ডাকার দরকার নেই। আর ফাহিমের ইচ্ছে তার ছেলের বউ তাকে বাবা বলেই যেনো ডাকে। ‘

ফাহিম মাহবুব এবারও হাসলেন,

‘ হ্যাঁ মা তুমি আমাকে বাবা বলেই ডাকবে, আমার আরেক মেয়ে হয়েই থাকবে। বাবা হিসেবে আমি অতোটা ও খারাপ নই। তোমার দু’পাশে বসা দুজনকে জিজ্ঞেস করে দেখো। ‘

নিনীকা কিছু বললো না। বাবা শব্দটির মানে তার কাছে অন্যকিছু। যদিও পৃথিবীর সব বাবা এক নন। তবুও তার সময় লাগবে। সুতরাং ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলো।

তাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো সাড়ে দশটার দিকে। সবাই যে খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছে তা সবার চোখে-মুখেই স্পষ্ট। যা দেখে ফাহিম মাহবুবের অসম্ভব ভালো লাগছে। মাঝে মধ্যে স্ত্রীর কানে কানে বলছেন,

‘ দেখেছো? আমিও তোমার মতো রান্না শিখে গেছি। সময় করে আরেকটা আইটেম শিখিয়ে দিও। ‘

ধারা ইশারায় হ্যাঁ জানিয়েছেন। রিটায়ার্ড মানুষটাকে মাঝে মধ্যে রান্না ঘরে ঢুকান তিনি। সে-ই সুবাদেই কিছুটা রান্না আয়ত্ত করেছে তার বর।

সোফায় কিছুসময় বসে থাকা হলো। এগারোটার পর সবাই যার যার ঘরে চলে গেলো। ধ্রুব খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে বলল,

‘ আজ যেনো আমাদের কততম বাসর মিসেস? দার্জিলিংয়ে কয়রাত ছিলাম যেনো? ‘

নিনীকা কিছু বললো না। নিজেও শরীর এলিয়ে দিলো পাশে। ধ্রুব টেনে নিলো বুকে। ফিসফিস করে শুধালো,

‘ তুমি কি আজও ইন্টারেস্টেড নও? ‘

নিনীকা বুকে মাথা রাখলো। আবেগ নিয়ে কপালে দীর্ঘ চুম্বন করলো। রাতের আঁধারে মিলে গেলো দুটি সত্তা। রাত্রির শেষ প্রহরে ধ্রুব ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে বিরবির করলো,

‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি আমার মিসেস। ‘

নিনীকার চোখে ঘুম নেই। এক হাত ধ্রুবের চুলের ভাজে রাখা। নিজেও বিরবির করলো,

‘ আপনার মিসেসও আপনাকে ভালোবাসে ধ্রুব। ‘

চারিদিকে ভোরের আলো ছড়াচ্ছে ধীরেধীরে। নিনীকা তখনো তাকিয়ে। মাঝে মধ্যে ওষ্ঠ দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছে ধ্রুবের কপাল, গাল, ঠোঁট। ধ্রুব নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখতে আদুরে লাগছে। ঠোঁট উল্টে ঘুমাচ্ছে বেচারা। মুখের ক্লান্তি জানান দিচ্ছে তার পরিশ্রম।

নিনীকা ঠেলে দিলো না। বরং আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিজেও চোখ বন্ধ করলো। তাকে ঘুমাতে হবে। দিনের বেলা তার সহজে ঘুম আসে না। তার উপর না ঘুমালে মাথা ব্যথা তো আছেই।

*
আজ ভোরে উঠেছেন রমজান শেখ। সাথে টেনে তুলেছেন মিথিলাকেও। দুজনে নামাজ আদায় করেছেন। রমজান শেখ এর পড়োনে শুভ্র পাঞ্জাবি। মিথিলা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। শুভ্র সুদর্শন পুরুষটির মুঠোয় তার হাত। সুদর্শন পুরুষটি তাকে নিয়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছে। মাঝে মধ্যে ঠোঁট আলগা করে কথা বলছে। মিথিলা বহুদিন পর মুগ্ধ হয়ে নিজের পুরুষকে দেখলেন। আলগোছে কাঁধে মাথা রাখলেন।

‘ আজ তোমাকে দুই যুগ আগের সেই প্রেমিক পুরুষই মনে হচ্ছে শেখ বাবু। আমার জন্ম সার্থক হলো তোমার এই রুপ দেখে। ছেলে হয়ে তুমি এতো রূপবান কেন হলে বলো তো? ‘

রমজান শেখের চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা। সেটা খুলে হাতে নিলেন। মিথিলার পড়োনের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন সযত্নে। হাতের মুঠোয় হাত নিলেন আবারও।

‘ সবই আল্লাহর সৃষ্টি। তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেই আমি তোমার চোখে সুন্দর। ‘

মিথিলা মানতে নারাজ,

‘ তাহলে কেন হাঁটুর বয়সী মেয়েরা তোমাকে আহ্বান করে? ‘

রমজান শেখের ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি।

‘ কারণ তারা আমাকে ভালোবাসে না, বাসলে আহ্বান করতো না। তারা সাময়িক ভাবে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু তুমি অন্যরকম। কতকিছু করেছি ছেড়ে তো গেলেই না উল্টো এতোকিছুর পরও আমাকে আঁকড়ে ধরেছো। আমি কি এসবের যোগ্য মিথি? ‘

মিথিলা হাতের মুঠো শক্ত করলেন,

‘ তুমি অবশ্যই যোগ্য। আমি পুরনো সবকিছু ভুলে যেতে চাই। আমি তুমি মিলে একটা সাধারণ জীবনযাপন করতে চাই। যেখানে শুধু ভালোবাসা থাকবে। সাথে থাকবে আমাদের ছোট্ট মেয়ে নিনীকা। ‘

রমজান শেখ দাঁত বের করে হাসছেন।

‘ তোমার ছোট্ট মেয়েটি বড় হয়ে গেছে মিথি। তার সংসার আছে। তাছাড়া সে তার বাবাকে কখনো ক্ষমা করবে না। ওর জায়গায় আমি থাকলেও করতাম না। আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে বুঝলে। ‘

‘ সব জানলে সে তোমাকে ক্ষমা না করে থাকতে পারবে না। আমার মেয়ে সে, মায়ের মতো ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। বুঝেছো? ‘

‘ সে তো আমারও রক্ত তার শরীরে। বাপের মতো একটি ক্ষত নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতেও তার দ্বিধা হবে না। দেখা গেলো সবশুনে সে আমাকে আরও ঘৃণা করবে। ‘

মিথিলা নাকমুখ কোঁচকান,

‘ তুমি বেশি বেশি বলছো। তোমাদের বাপ মেয়েকে আমি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবো শীগ্রই। আগে তোমাকে ঠিক করি। সন্ধ্যায় আমাদের যেতে হবে। মনে থাকে যেনো। ‘

রমজান শেখ মাথা নাড়ালেন।

‘ আপনার কথাই শেষ কথা আমার বেগম। ‘

মিথিলা কিশোরীদের মতো লজ্জা পেলেন। মুখ লুকালেন সুদর্শন পুরুষটির বুকে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে