#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
( কপি নিষিদ্ধ)
মিথিলা ছলছল চোখে তাকালেন। বুকে মাথা রাখলেন সন্তপর্ণে।
‘ আমি তো তোমাকে ভালোবেসে শেখ বাবু বলেই ডাকবো। সেই পুরনো ডাক। যতোই তুমি ভয় দেখাও, ঘৃণা করতে বাধ্য করো। আমিও দেখবো কে জিতে। আমার ভালোবাসা নাকি তোমার নিজ থেকে তৈরি করা ঘৃণার এই দেয়াল! ‘
রমজান শেখ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পিঠে এক হাত জড়িয়ে ধরলেন।
‘ কার সাথে কথা বলছিলে বললে না যে? ‘
মিথিলা অকপটে জবাব দিলেন,
‘ নিনীকার সাথে। ‘
রমজান কিঞ্চিৎ চমকালেন। কিন্তু তার প্রভাব মুখশ্রীতে পড়তে দিলেন না। বরং স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ নিনীকা! কি বললো সে? এতোদিন পর? ‘
‘ বলেছে অনেক কিছুই। আপনি কোনটা শুনতে চাইছেন? আপনাকে নিয়ে কোনো ঘৃণার বাক্য ছুঁড়ে দিয়েছে কি না? ‘
রমজান শেখের বুক মুচড় দিয়ে উঠলো। তিনিই মনে হয় প্রথম বাবা যিনি নিজ ইচ্ছেতে সন্তানের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা বেছে নিয়েছেন।
‘ হু, দেয়নি? ‘
মিথিলা ট্রাই ঢিলে করতে শুরু করেছেন,
‘ দিয়েছে, সাথে এটাও বলেছে সে তার বাবার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত একজন পুরুষের সাথে সংসার শুরু করতে যাচ্ছে। দোয়া চেয়েছে আমার। ‘
রমজান শেখ এবার চমকে গেলেন।
‘ কি! সে সংসার করবে মানে? সে বিবাহিত মিথি। তার স্বামী আছে। পালিয়ে গেছে বলে সে যাকে তাকে নিয়ে সংসার শুরু করবে তা তো হবে না। আগে প্রথম জনের সাথে সেপারেশন বা ডিভোর্স হতে হবে। তারপর সে দ্বিতীয়বার সংসার করতে পারবে। তার কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? ‘
মিথিলার চোখ উজ্জ্বল হলো,
‘ তুমি একটা ভালো কাজ করেছো মেয়ের জন্য শেখ বাবু। যদিও নিজের অজান্তে। তুমি চেয়েছিলে খোঁজখবর না নিয়ে বাল্যকালের বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে নিনীকার ঘৃণা বাড়িয়ে দিতে। অথচ দেখো হলো উল্টো। তোমার বাল্যকালের বন্ধুর ছেলেটি এতোই ভালো যে নিনীকা তার সাথে সংসার করার পথে পা বাড়িয়েছে। তুমি নিজের মেয়ের জন্য সঠিক জীবনসঙ্গী এনেছো শেখ বাবু। তোমার মেয়ে এদিক থেকে তোমাকে একটু হলেও ভালো ভাববে। ‘
রমজান শেখ শুধু বিস্মিত হচ্ছেন। যার সাথে বিয়ে দিয়ে তিনি মেয়ের মনে ঘৃণা বাড়াতে চাইলেন, সেই পুরুষকেই কি-না তার মেয়ে পছন্দ করেছে। আবার সংসার ও করবে। রমজান শেখ খোঁজখবর না নিয়ে বিয়ের আয়োজন করেছিলেন শুধুমাত্র নিনীকার মনের ঘৃণাটা বাড়াতে। ঘৃণা বাড়লো, নিনীকা বিয়ে করে ও পালিয়ে গেলো। কিন্তু! এখন সে সংসার করবে মাই গড!
রমজান শেখকে বিস্মিত হতে দেখে মিথিলা মিটিমিটি করে হাসলেন। ট্রাই ধরে টেনে চোখ টিপে বললেন,
‘ খুব আফসোস হচ্ছে শেখ বাবু? নিজ থেকে মেয়েকে ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে দেওয়ার কারণে তোমাকে গুনে গুনে দশটা চুমু খাবো। এসো। ‘
রমজান শেখ ছুঁড়ে ফেললেন মিথিলার হাত। রাগে চোখমুখ শক্ত হলো তার। মিথিলার গাল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘ একদম না। আমার মেয়ে কেন সংসার করবে? সে কেনো কোনো পুরুষকে ভালোবাসবে? তুমি জানো না? তুমি জানো না পুরুষেরা ভালো হয়না! জানো না তুমি? তুমি কিভাবে ওকে অনুমতি দিলে? মাথায় কি গিলু নেই তোমার? আমার এই পঁচিশ বছর ধরে করা ঘৃণার অধ্যায়টা এভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলো ওই ছেলেটা! আমার মেয়ের মনে পুরুষদের নিয়ে ভিন্ন চিন্তা ঢুকিয়ে দিলো। ছাড়বো না ওকে আমি! নিনীকার সামনে আবারও প্রমাণ করবো পুরুষদের সত্তা কখনোই ভালো হয়না। ওরা শুধু পারে জুলুম করতে, নির্যাতন করতে। অত্যাচার করতে! পুরুষেরা কখনোই ভালো স্বামী, ভালো বাবা হতে পারে না। আমি নিনীকাকে আবারও বুঝিয়ে দিবো প্রিয়তমা। তখন তুমি গুনে গুনে একশোটা চুমু দিও কেমন? ‘
রমজান শেখ এক প্রকার ছুঁড়ে ফেললেন তাকে। মিথিলার কপাল গিয়ে লাগলো রেলিংয়ের কোণে। কপাল ফুলে গেলো। কিন্তু তিনি টুঁশব্দ ও করলেন না। বরং এগিয়ে গেলেন রমজান শেখের দিকে। চোখে চোখ রেখে অসহায় কন্ঠে বললেন,
‘ তুমি ভালো স্বামী হতে পারোনি, তবে ভালো প্রেমিক ছিলে শেখ বাবু। তুমি চাইলেই পারতে ভালো স্বামী হতে। পারতে ভালো বাবা হতে। কিন্তু তুমি তা হওনি। বরং নিজের সত্তাকে ঘৃণা করার সাথে সাথে আমাকে আমার মেয়েকে ঘৃণা করাতে বাধ্য করেছো। এসব করে কি পেয়েছো তুমি? ঘৃণা? কি করবে সেটা দিয়ে তুমি? এটা কি জীবন শেখ বাবু? তোমার মেয়ে তোমাকে বাবা ডাকে না শেখ বাবু! তুমি কতোটা ব্যর্থ বুঝতে পারছো? আজ চাইছো মেয়ের জামাইয়ের সাথে লাগতে! মেয়ের জীবনের ভিলেন হতে চাইছো? তুমি তো আমার জীবনে ভিলেন ছিলে, কিন্তু আমার মেয়ের জীবনের হইয়ো না প্লিজ। তাকে ভালো থাকতে দাও। আমার জীবন চলে গেছে, যে’কটা বছর বাঁচবো এভাবেই চলে যাবে। কিন্তু আমার মেয়ের সবে শুরু। তার ভরা সংসার হবে। স্বামী, সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার আমি দু-চোখ ভরে দেখবো। যা তুমি আমাকে দিতে পারোনি তা আমার মেয়েকে তার স্বামী দিবে। হিংসা হচ্ছে বুঝি? হিংসা করো না গো, তোমারই তো মেয়ে। তার সুখ তোমার কেন সহ্য হবে না? তোমার এই ট্রমা থেকে বের হও শেখ বাবু। পৃথিবীতে তাকিয়ে দেখো। আমরা চাইলেই সুখী হতে পারি। চলো আমার সাথে, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালে তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।
মিথিলা আঁকড়ে ধরলেন রমজানের হাত,
‘ চলো শেখ বাবু। আমরা ভালো করে বাকিটা জীবন কাটাবো। যেখানে শুধু ভালোবাসা থাকবে। পৃথিবীর সব পুরুষ এক হয়না শেখ বাবু। তুমি কেন নিজেকে একটি গোলকধাঁধায় আটকে রেখেছো? কেন এমন করছো তুমি? পৃথিবীর সবারই কোনো না কোনো দুঃখ থাকে শেখ বাবু। তাই বলে কি সবাই সুখের মুখ দেখা বন্ধ করে দেয়? চোখ খুলো শেখ বাবু। তুমি চাইলেই পারবে। আমি তোমার পাশে থাকবো। বলো তুমি রাজি? বলো..! ‘
মিথিলা চিৎকার করে কাঁদছেন। রমজান শেখের বুকে কিল-ঘুষি দিচ্ছেন একাধারে। নির্লিপ্ত রমজান শেখ ঢলে পড়লেন আচমকা। মিথিলার কাঁধে গরম জল অনুভব হলো। বুঝলেন মানুষটা অজ্ঞান হয়ে গেছে।
মিথিলার চিৎকারে সার্ভেন্ট ছুটে এলো। ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার এলেন আধঘন্টা পর। বললেন,
‘ জরুরি ভিত্তিতে ভালো ডাক্টারের শরণাপন্ন হোন। ব্রেইনে মারাত্মক ট্রমা নিয়ে বেঁচে আছে যার কারণে সাময়িকভাবে শক খেয়ে অজ্ঞান হয়েছে। তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবেন। যেভাবেই হোক। ‘
ডাক্তারটি তিনি যিনি মিথিলাকে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে চিনেন। পারিবারিক ডাক্তার তাদের। মিথিলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ডাক্তার প্রয়োজনীয় সবকিছু করে চলে গেলেন। অপেক্ষা করতে বললেন জ্ঞান ফিরার। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। মানুষটা সবে অফিস থেকে ফিরেছে। তিনি কেন যে উত্তেজিত হলেন। সারাদিন অফিসে কি না কি খেয়েছে। নিশ্চয়ই অনেক ক্ষুধার্ত ছিলো। তার মধ্যে ব্রেনে চাপ পড়েছে। অজ্ঞান তো হবেই। মিথিলা নিজের গালে চড় মারলেন। আজ যদি বড়সড় কিছু হতো তবে তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন না। থাক না মানুষটা যেভাবে ইচ্ছে, কাউকে তো কিছু করছে না। মিথিলা এতো বছর সহ্য করেছেন আরও কয়েক বছর সহ্য করলেন না-হয়। ক’দিন ই বা বাঁচবেন আর। মানুষটাকে সারাজীবন সহ্য করে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিবেন না-হয়। রমজান শেখ অন্তিম অধ্যায় পর্যন্ত দেখবে আর আফসোস করবে তাকে ভালোবেসে ঘৃণা ভরা সংসারেও মিথিলা কিভাবে টিকে ছিলেন পুরো একজীবন। শুধুমাত্র ভালোবেসে! হাহ্ রমজান শেখের ওই আফসোস ভরা মুখটা মিথিলার বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উচ্চারণ করলেন,
‘ মৃত্যু আয়, দ্রুত আয়। শেখ বাবুর আফসোস হয়ে আয়! ‘
মিথিলা বেগমকে অবাক করে দিয়ে রমজান শেখের জ্ঞান ফিরলো। এবং তিনি স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের সহিত বললেন,
‘ আমি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবো মিথি। তুমি আমাকে সুস্থ করতে যা করতে হয় সব করো। আমি কোনো বাঁধা দিবো না আমার প্রিয়তমা। ‘
(চলবে)