#বিয়ে_থা
#পর্ব-২২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
( কপি নিষিদ্ধ )
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। ধ্রুবের হাত এখনো ড্রাইভিং এ ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে তারা থেমে দাড়িয়েছে। মাঝে মধ্যে এদিক সেদিক ঘুরেছে। খেয়েছে রেস্টুরেন্টে। তাদের দুজনেরই বাড়ি ফেরার তেমন তাড়া নেই। ঘুরেফিরে যখন তখন ফিরবে। ততোক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটু এনজয় তো করাই যায়। নিনীকা মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখলো চার্জ নেই। অগত্যা ধ্রুবের মোবাইল চাইলো। ধ্রুব এগিয়ে দিলো।
‘ কাকে ফোন করবে মিসেস? ‘
‘ মা’কে। ‘
নিনীকা নাম্বার তুলে ডায়াল করলো মিথিলার নাম্বারে। সন্ধ্যা বেলা মিথিলা একলা বারান্দায় বসে থাকেন। সাতটার পর রমজান শেখ অফিস থেকে ফিরবেন, তিনি বারান্দায় দাড়িয়ে সে-ই দৃশ্যই দেখেন মনোযোগ দিয়ে। মানুষটা গাড়ি থেকে যখন এক পা বের করে তখন তার হৃদয় কম্পিত হয়। যখন নেমে দাড়ায় সুদর্শন পুরুষদের মতো, তখন মিথিলা বার-বার প্রেমে পড়েন। এই বয়সে এসেও মানুষটা কতো সুদর্শন, কতো সুন্দর! মিথিলার ভাবনার মাঝে তার হাতের মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্কিনে অপরিচিত নাম্বার দেখে রিসিভ করলেন না। কিন্তু দ্বিতীয়বার কল আসতেই রিসিভ করে কানে ধরলেন। ওপাশ থেকে নিনীকার গলা শুনা গেলো।
‘ মা…’
মিথিলা চমকে গেলেন। প্রায় সাড়ে ছয়মাস পর সন্তানের কন্ঠস্বর শুনছেন তিনি। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত ভাবে কাঁপতে লাগলো। দু’চোখের কোণে জল জমলো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকিয়ে ডাকলেন,
‘ নিনীকা…? ‘
‘ হ্যাঁ মা..। ‘
মিথিলা এক হাতে মুখ চেপে ধরলেন। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি তো ভেবেছিলেন এ জনমে তার মেয়ের সাথে কখনোই কথা হবে না। মেয়েটা যে একরোখা, অভিমানী। যা সিদ্ধান্ত নেয় তার বিরুদ্ধে কখনোই কিছু করবে না। যেমনটা করেনি বিয়ের বেলাতেও। বাবাকে ঘৃণা করে বলে পৃথিবীর সব পুরুষের প্রতি তার ঘৃণা। তার মতে সব পুরুষেরা এক। সেজন্য ছোটবেলায় একবার রমজান শেখের অমানুষিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিলো,
‘ পৃথিবীর সব পুরুষের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মাক। মেয়েরা পুরুষদের সম্পর্কে প্রথম ধারণা লাভ করে নিজের বাবা থেকে। আমি করলাম। তুমি জেনে রেখো মা, আমি নিনীকা শেখ কখনোই রমজান শেখদের মতো পুরুষদের কাছে নিজেকে সঁপে দিবো না। আমি আজ থেকে জানলাম, মেনে নিলাম বাবা নামক পুরুষেরা সন্তানদের ইচ্ছেকে শুধু মেরে ফেলতেই পারে। আর স্বামী নামক পুরুষেরা শুধু গায়ে হাতই তুলতে পারে। করতে পারে নির্যাতন। যেমনটা তুমি সয়ে এসেছো মা। কিন্তু আমি সইতে পারবো না। সেজন্য আজ থেকে পুরুষদের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা। এই ঘৃণা কখনো কমে না যাক। পৃথিবী জানুক সব বাবারা ভালো হয়না! ‘
মিথিলা শেখের ভাবনার মধ্যে নিনীকা মৃদু জোরে ডাকলো,
‘ মা, মা, মা,..’
মিথিলা চমকে বললেন,
‘ হ্যাঁ মা..?’
নিনীকা অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘ আমাকে তুমি ভুলে গেছো? ‘
মিথিলা আবারও চমকালেন, নিনীকার কন্ঠে অভিমান। অবিশ্বাস্য!
‘ নিনীকা, আমার মেয়ে। মা আমার তুই কেমন আছিস?’
নিনীকার কন্ঠে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়লো,
‘ আমি ভালো আছি আমি। এখন খুব খুব বেশি ভালো আছি। তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে মা। তুমি কি শুনবে? ‘
‘ কি বলবি মা বল? মা শুনবো তার কথা। ‘
নিনীকা আড়চোখে ধ্রুবকে দেখে নিলো। বলতে শুরু করলো,
‘ আমি বাংলাদেশে আছি মা। এই মুহুর্তে মেজর ধ্রুব মাহবুব অর্থাৎ আমার হাসবেন্ডের সাথে জিপে বসে আছি। সে একমনে ড্রাইভ করছে। যাতে আমাকে নিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে তার বাড়িতে পৌছাতে পারে। তার এই মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভিং করাতেও আমি আমার প্রতি তার গুরুত্ব দেখতে পাচ্ছি মা। ‘
মিথিলা ভয়াবহ রকমভাবে চমকালেন।
‘ কিহ্! কিভাবে তুমি..ধ্রুব..আমি কি ঠিক শুনছি নিনী?’
নিনীকা মুচকি হাসলো,
‘ তুমি ঠিক শুনছো মা। আমার মনে হচ্ছে তোমার কথা লেগে গেছে। তুমি বলতে না? পৃথিবীর সব পুরুষ একরকম হয়না? আমার জন্যে কেউ না কেউ থেকে যাবে? তোমার কথা লেগে গেছে মা। আমার জন্যে সত্যিই কেউ থেকে গেছে। আমাকে পুনরায় ভাবতে বাধ্য করেছে সে। আমার ভেতরের সব জটিল ভাবনার সুতো ছিঁড়ে নিজের জন্য আমার মনে স্থান করে নিয়েছে। এমন জটিল কাজ যে করে ফেলতে পারে তাকে কি আমি সুযোগ না দিয়ে থাকতে পারি মা? সে সবার থেকে আলাদা বলেই তাকে আমি সুযোগ দিচ্ছি। তোমার কি এ বিষয়ে কিছু বলার আছে মা? ‘
মিথিলা চোখে অশ্রু নিয়ে হাসলেন,
‘ একদম না মা আমার। আমার এতো খুশি লাগছে তোমাকে আমি ফোনে বলে বুঝাতে পারবো না। আল্লাহ সেই সন্তানের মা বাবাকে দীর্ঘজীবী করুন। এমন সন্তান জন্ম যারা দিয়েছে তারা কতো ভালো মানুষ জানো? মা বাবা ভালো বলেই সন্তান এতো ভালো। আমি চাইবো তুমি সাংসারিক জীবনে সুখী হও। নিজের ওভারথিংকার ভাবনাটা একপাশে সরিয়ে রেখে ভালোবেসে সবকিছু চিন্তা করবে। দেখবে নেগেটিভ কোনো ভাবনাই মনে আসবে না। মা তোমাকে শুভকামনা জানাচ্ছে নিনীকা। কত বড় হয়ে গেছো তুমি। আমার মা আমার নিনীকা সংসার করবে! ভাবতে পারছো কতোটা খুশি হয়েছি আমি? অনু়ভব করতে পারছো তো? ‘
‘ পারছি মা। আমার মনে হচ্ছে তোমার এই খুশির জন্যে হলেও আমাকে নেগেটিভ সব চিন্তা এক সাইডে রেখে সাংসারিক জীবনে পা রাখা উচিত। তুমি কতোদিন পর এমন খুশি হয়েছো মা? ‘
মিথিলা চুপ থাকলেন। এর থেকে বেশি খুশি ও কষ্ট দু’টো সেদিনই পেয়েছেন। যে-দিন নিজের স্বামীর অতীত জেনেছেন। মেয়েটা ছোট থেকে বাবাকে নিয়ে ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়েছে। এখন কিছু বললে উল্টো প্রভাব ফেলবে। সুতরাং এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। বাপ-মেয়ে দুটোকেই তিনি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবেন। নিনীকার ওভারথিংকিং মারাত্মক! যখন একবার ধরে সব ছাড় খাঁড় করে তবেই ছাড়বে। মেয়েটা আগে সাংসারিক জীবনে পা রাখুক। দিন যাক, তিনি ধ্রুবের সাথে কথা বলবেন। সাথে বুঝাবেন রমজান শেখ কে। তার মেয়ে সংসার করবে তা জেনে রমজান শেখের অনুভূতি কিরকম হবে? বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে মিথিলার।
তার ভাবনার মধ্যে গেইট দিয়ে ঢুকলো কালো একটি গাড়ি। মিথিলা তৎক্ষনাৎ বললেন,
‘ নিনী মা আমার, এখন রাখছি। তোমার নতুন জীবনের জন্যে অনেক শুভকামনা জেনো সোনা আমার। মা তোমার পাশে সবসময়ই আছি। আমার জামাই রাজাকে তার আরেক মায়ের স্নেহময় ভালোবাসা জানিয়ে দিও, কেমন? ‘
মিথিলা মোবাইল কান থেকে নামালেন। ততোক্ষণে রমজান শেখ বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন। গটগট পায়ে হেঁটে এসেছেন মিথিলার কাছে। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললেন,
‘ তুমি কার সাথে কথা বলছিলে? ‘
মিথিলা চমকালেন,
‘ আমি ফোনে কথা বলছিলাম আপনি জানলেন কিভাবে? ‘
রমজান শেখ ঠোঁট বাকিয়ে হাসলেন,
‘ ডেয়ার মিথি, প্রিয়তমা আমার। তুমি এতো বোকা কেন? আমার রুমের বারান্দা থেকে শুরু করে ওয়াশরুম পর্যন্ত সিসিটিভি ক্যামেরা সেট করা। তুমি যে ওয়াশরুমে যাও সেটাও আমি দেখতে চাই। বারান্দায় ফোনে কথা বলছো সেটা বুঝতে পারব, না? ‘
মিথিলা ভড়কে গেলেন। নাক-মুখ কুঁচকে গেলো তার।
‘ শেষ পর্যন্ত ওয়াশরুম ও বাদ রাখলেন না? ছিঃ! ‘
‘ তুমি ফোনে কথা বলতে বলতে কাঁদছিলে কেন মিথি? কে ছিল ফোনের ওপাশে? বলো আমায়! ‘
মিথিলা ঢুক গিললেন।
‘ তোমাকে বলা যাবে না, এসেছো ফ্রেশ হও। তারপর রিলাক্স করো গো। ‘
রমজান শেখ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,
‘ আমাকে অর্ডার করছো? সাহস বেড়ে গেছে দেখছি। ‘
মিথিলা মাথা নিচু করে ফেললেন,
‘ এইতো এখন মাথা নিচু রেখে কথা বলছি, খুশি হয়েছেন? ‘
রমজান শেখ পায়ের গতি বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। হাত রাখলেন কোমড়ে। নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে আঙুলের সাহায্যে মুখ উঁচু করলেন।
‘ তুমি যখন আমার সাথে আগের মতো চোখে চোখ রেখে কথা বলো, তখন আমার অনুশোচনা হয় মিথি। আমার মনে হয় আমি না চাইতেও তোমাকে এক আকাশ দুঃখ দিয়ে ফেলেছি। তুমি কখনো আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলবে না মিথি। আমার নিজের প্রতি ঘৃণা বেড়ে যায়! যখন আগের মতো তুমি বলে সম্মোধন করো তখনও ঘৃণা হয়। যখন ভয় পেয়ে আপনি বলে সম্মোধন করো তখনও ঘৃণা হয়। তুমি আমাকে আগের মতো রমজান শেখ বলে ঘৃণা ছুড়ে দিও মিথি। তাহলে আমার অনুশোচনা হবে না। আমি জানবো তুমি আমাকে আগের মতোই ঘৃণা করো! ‘
(চলবে)