বিয়ে থা পর্ব-২১

0
229

#বিয়ে_থা
#পর্ব-২১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

ফারিনকে বলা এক সপ্তাহের মধ্যে দেওয়া কথা রাখতে চলেছে ধ্রুব। আজ সে নিনীকাকে নিয়ে রওনা হবে ‘বউ কথা কও’ এর উদ্দেশ্যে। ডিউটি তার শেষ। বর্তমানে সে দাড়িয়ে আছে বান্দরবানের উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তায়। জিপ গাড়িতে পিঠ এলিয়ে দিয়েছে। হাতে গগলস নিয়ে নাড়ানাড়ি করে চারদিকে তাকাচ্ছে। অপেক্ষা নিনীকার। ঘড়ির কাটা দশ মিনিট অতিক্রম করলো। নিনীকা ও সুমিত্রা এসে বসলো জিপে। সুমিত্রা চটাস করে কথা বলছে। জোর করে নিনীকাকে বসিয়ে দিয়েছে সামনে। সে ব্যাগপত্র নিয়ে বসেছে পেছনে।

‘ আমাকে সড়কে উঠে গাড়িতে তুলে দিলেই হবে। বাকিপথ চলে যেতে পারবো কোনো চিন্তা করবি না। ‘

ধ্রুব ড্রাইভ করার ফাঁকে নিনীকার দিকে তাকিয়ে দেখছে। বলল,

‘ তবুও আমার দায়িত্ব আছে শালীকা। আপনাকে এক ছাড়া যাবে না। এক কাজ করা যায় আপনিও আমাদের সাথে চলুন। ‘

সুমিত্রা ইতস্তত করে বলল,

‘ যাবো জিজু বাট অন্য কোনো দিন। আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে, বুঝতেই পারছেন এ সময় বাড়ি ফেরাটা কতোটা ইম্পর্ট্যান্ট? তবে আপনার ও নিনীকার আনুষ্ঠানিক বিয়েতে আমি অবশ্যই থাকবো। সাথে বর ও থাকবে। আপনাদের দুজনকে কিন্তু আমার বিয়েতে যেতে হবে। তাছাড়া নিনীকা তো পড়াশোনার জন্য শিলিগুড়িতে যাবেই আবার তাই না? দেখা হওয়ার কতো কারণ আছে দেখেছেন? ‘

‘ ধরুণ আপনার বান্ধবীকে আমি ইন্ডিয়াতে আর পড়তে দিলাম না, তখন কি করবেন? ‘

সুমিত্রা নাক ফুলালো,

‘ একদম আপনি এরকম করবেন না। আমি জানি আপনি ওকে পড়তে দিবেন। এবং শিলিগুড়িতেই দিবেন। ‘

ধ্রুব ঠোঁট উল্টালো,

‘ আপনার বান্ধবীকে যে আমার প্রয়োজন শালীকা। সে যাবে, তবে যে কটা দিন আমি ছুটিতে আছি ততোদিন সে বাংলাদেশেই থাকবে। এবং তারপর আমি তাকে নিজে গিয়ে শিলিগুড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবো। পারলে ডিউটি অবস্থায় সময় ফেলে মাঝে মধ্যে চলেও যাবো তার কাছে। ‘

সুমিত্রা হাসলো,

‘ সে তো যাবেনই, তবে জিজু নিনীকা যখন মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফেলবে তখন কিন্তু আপনাকে ডিউটি ফেলে দৌড়াতে হবে না। ওকে নিজের সাথে সাথে রাখতে পারবেন। যেখানেই আপনার বদলি হয় সেখানেই ও আপনার সাথে থাকতে পারবে। ‘

ধ্রুব আড়চোখে নিনীকাকে দেখে নিলো।

‘ সে তো ঠিকই, তবে আমার ম্যাডাম যদি চাকরি বাকরি করতে চান তাহলে সে চান্স হয়তো থাকবে না। চাকরিসূত্রে দুজন দু’শহরে অবস্থান করবো হয়তো। ‘

নিনীকা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

‘ আপনারা কি শুরু করেছেন বলুন তো? যখন যেটা আসবে তখন দেখা যাবে। আগে তো শ্বশুরবাড়িতে পা রাখি। জানি না ভাগ্যে কি আছে। আমার জন্যে না জানি কি কি অপেক্ষা করছে। আফটার’অল পালিয়ে যাওয়া বউ বলে কথা। ‘

ধ্রুব ফুস করে শ্বাস ছাড়লো,

‘ তুমি কোনো কারণ বসত সেটা করেছো। আমি এদিকটা দেখে নিবো। কেউ যাতে তোমাকে কোনো রুপ অপমান বা কথা শুনাতে না পারে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। সো চিল থাকো মিসেস। আমি আছি না? ‘

সুমিত্রা হাসছে,

‘ আপনাদের ভালোবাসায় নজর না লাগুক। ‘

উঁচু উঁচু পাহাড় পেরিয়ে তারা সড়কে চলে এসেছে। সুমিত্রাকে ভারত’গামী টেনে তুলে দিবে নিরব। যে বর্তমানে একটি কালো গাড়িতে বসে আছে। সুমিত্রা ধ্রুবের দিকে তাকালো। ধ্রুব ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো,

‘ আপনাকে একা ছাড়াটা ঠিক হবে না, যতোই হোক আমার মিসেসের বান্ধবী হোন। ক্যাপ্টেন নিরব আয়মান আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। বাকিটা পথ আপনি একাই সাচ্ছন্দ্যে চলে যেতে পারবেন বলে আমার ধারণা। ‘

সুমিত্রা কৃতজ্ঞতা চোখে তাকালো,

‘ আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না জিজু। বাংলাদেশের অনেক কিছুই আমি চিনিনা। আমি বলা সত্ত্বেও আপনি আমার জন্যে এতোটুকু করেছেন সেজন্য আপনাকে আমি আমার বিয়েতে ডাবল রোস্ট খাওয়াবো বলে কথা দিচ্ছি। নাও এখন আসি? ‘

সুমিত্রার ব্যাগপত্র ধ্রুব গাড়িতে রাখলো। নিনীকা ও সুমিত্রার দীর্ঘ একটি আলিঙ্গন হলো। নিনীকা বিরবির করে বলল,

‘ আবারও দেখা হবে। আমাকে ভুলে যাস না। ‘

সুমিত্রা আবেশিত হলো,

‘ একদম না, আগে পৌঁছাই গিয়ে। তারপর সবদিক দেখে আমরা আবারও শিলিগুড়িতে দৌড়ে বেড়াবো কেমন? একদম বেশি বেশি ভাববি না। যা হবে ভালোর জন্যে হবে। নতুন পরিবারে মানিয়ে নিতে একটু আনইজি লাগবে প্রথম। তবে আমার বিশ্বাস যার একটি ধ্রুব আছে তার এরকম ছোটোখাটো ব্যাপারে কোনো অসুবিধা হতেই পারে না। ‘

ধ্রুব নিরবকে চোখের ইশারায় সব বুঝিয়ে দিলো। সুমিত্রাকে নিয়ে নিরব চলে গেলো ভারত’গামী ট্রেনের উদ্দেশ্যে। সড়কে তারা দুজন। সময়টা সকাল নয়টা। চারিদিকে মৃদু বাতাস বইছে। ধ্রুবের পড়োনে ডেনিম প্যান্টের সাথে কালো টিশার্ট। নিনীকা আড়চোখে নিজের মানুষকে দেখে নিচ্ছে। মানুষটাকে কালোতে দারুণ মানায়। টি-শার্টের উপর দিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে বলিষ্ঠ শরীর। নিনীকা ঢুক গিললো, তার নিজেরই না নজর লেগে যায়।

ধ্রুবের চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

‘ দেখতে হয় ভালো করে তাকিয়ে দেখো। আমি তোমারই৷ আমাকে দেখার অধিকার তোমার আছে। নাও লুক এট মি মিসেস। দেখো৷ চোখ ভরে দেখো। ‘

নিনীকা লজ্জা পেলো। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে চায় না বলে ধ্রুবের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। ধ্রুব আকাশ পাতাল কাপিয়ে হাসলো।

‘ বাবা বলেছিলেন তার বউমা নাকি আমাকে হাসতে না দেখে পালিয়ে গেছে। অথচ দেখো তোমার সঙ্গে থাকলে আমি সবমসময়ই হাসি। কারণে-অকারণে হাসি। তুমি একটা মানুষ নিনীকা, যাকে দেখলে অকারণেই কারো চারিপাশে এক ধরনের আনন্দিত ভাব চলে আসে। যার কারণে আমি সবমসময়ই হাসতে পারি। যার কারণে আমার চারিপাশ সবসময়ই উজ্জ্বল মনে হয়। তুমি আমার জীবনের এক টুকরো হাসি নিনীকা। ‘

নিনীকার পড়োনের সাদা পাতলা শার্টটি বাতাসে উড়ছে। চুলগুলো উপরে তুলে বেঁধে রাখা। তা থেকে একটা দুটো চুল বের হয়ে কপালে জায়গা করে নিয়েছে। ধ্রুব হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। জিপে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ঠিক করে দিলো কপালের সামনে আসা চুল। কানে গুঁজে দিয়ে বলল,

‘ সেদিন সীমান্তে ঘুমন্ত অবস্থায় যদি তোমাকে স্বপ্নে না দেখতাম, তবে আজ তুমি আমার হতে না। ‘

নিনীকার এক হাত ধ্রুবের বুকের পাশে। ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

‘ স্বপ্ন? কিরকম স্বপ্ন? ‘

ধ্রুব গাল টেনে দিলো,

‘ আমি তোমাকে আবছায়া দেখেছি প্রথম স্টেশনে। পুরো মুখশ্রী দেখিনি। তারপর দেখেছি স্বপ্নে। সেখানেও তুমি আবছায়া হয়ে ছিলে। আমাকে আহবান করছিলে ‘তুমি এসো, একবার এসো।’ আমি সেই অলীক কন্যার আহবানে বসে থাকতে পারিনি। ছুটে গিয়েছি সব ভুলে তার কাছে। দার্জিলিংয়ে পা রাখাটা পরিকল্পনা ছিল। সুমিত্রাকে আমিই বলেছিলাম তোমাকে দার্জিলিং নিয়ে আসতে। ক’জ আমরা প্রথমবার সামনাসামনি নিজেদের মুখ দর্শন করবো। স্মৃতিচারণ করার জন্যেও ভালো একটি জায়গাতে মুখ দর্শন করা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে আমার প্রজন্মকে বলতে পারি তাদের মায়ের প্রথম মুখ দর্শন করেছি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর একটি জায়গা দার্জিলিংয়ে। ‘

নিনীকা পিটপিট করে তাকালো,

‘ এতো অল্প সময়ে এতো কিছু মাথায় আসে কিভাবে আপনার? ‘

ধ্রুব শরীর দুলিয়ে হাসলো,

‘ একবার জড়িয়ে ধরবে? ‘

নিনীকা সম্মোহনকারী মেজরের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলো না। ধ্রুব দু’হাত মেলে দিলো, নিনীকা ঢলে পড়লো সেথায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ঢুকে যেতে চাইলো বক্ষে। ধ্রুবের বুকের উঠানামা বাড়লো। নিনীকাকে মিশিয়ে নিলো সর্ব শক্তি দিয়ে। চুলের ভাজে ছুঁইয়ে দিলো ওষ্ঠ। সেথায় ঠোঁটের স্পর্শ রেখেই প্রগাঢ় প্রেম নিয়ে শুধালো,

‘ এই যে এলে,
এই চলে আসাটাই যেনো শেষ হয়।
সারাজীবন ধ্রুবের বুকে’ই
মিসেসের স্থান যেনো রয়। ’

নিনীকা বিরবির করলো,

‘ এই যে এলাম,
এটাই শেষ আসা।
যাবো না কভু আর
ধ্রুবের ওই প্রেমময় বুক ছেড়ে
মেঘেরও ওপারে। ’

আলিঙ্গন দীর্ঘ হলো। একসময় নিনীকা নিজেকে শূন্যে অনুভব করলো। ধ্রুব তাকে পাশের সিটে বসিয়ে দিয়েছে। চোখে গগলস পড়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। তাদের গন্তব্য এবার ঢাকা। যেথায় অবস্থান করছে ‘বউ কথা কও’ এ প্রজন্মের বউয়ের জন্যে!

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে