#বিয়ে_থা
#পর্ব-১৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
( কপি নিষিদ্ধ)
আকাশের সাথে যেন পাহাড় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। নিনীকা ও সুমিত্রা মুগ্ধ চোখে দেখছে। দুজনের পড়োনে গাউন। মাথায় লতাপাতা দিয়ে বানানো ক্রাউন। সবুজ গাউনে তাদের দেখতে প্রকৃতি কন্যা মনে হচ্ছে। দুজন উঁচু একটা পাহাড়ে উঠে শরীর ছেড়ে দিলো। আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। নিঃশ্বাসের সাথে নিতে লাগলো মাতাল করা প্রকৃতির ঘ্রাণ। সুমিত্রা উচ্ছাস নিয়ে চিৎকার করলো,
‘ নিনীকা ইট’স টু মাচ ওয়া-ও। ’
নিনীকার ঠোঁটের কোণে হাসি।
‘ প্রকৃতির সাথে জড়িত সবকিছুই ওয়া-ও মাই ডেয়ার। ’
সুমিত্রার কিছু একটা মনে পড়তেই মুখ কালো হয়ে গেলো। নিনীকা হাতে ভর দিয়ে মাথা উচু করে সুমিত্রার দিকে তাকালো।
‘ মুখ কালো করলে যে? ’
সুমিত্রার চোখ ছলছল করে উঠলো,
‘ ডেয়ার এইবারই মনে হয় আমাদের একসাথে শেষ ঘুরাফেরা। পরিবার থেকে বিয়ে দিতে চাইছে। তোমার সাথে হয়তো এভাবে আর প্রকৃতির বুকে আছড়ে পড়া হবে না। ‘
নিনীকার মন খারাপ হয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড পর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ কাম অন ইয়ার। তোমাকে কি যে সে কারো সাথে বিয়ে দিবে নাকি? জিজুকে বলে আমরা ট্যুর দিবো একসাথে। নো প্রব্লেম! ‘
সুমিত্রা উজ্জ্বল চোখে তাকালো,
‘ তুমি ও জিজুকে মেনে নাও নিনীকা, তাহলে আমি বিয়ে করার পর টু-কাপল একসাথে ট্যুর দিতে পারবো। ওয়া-ও না? ‘
নিনীকা কথা এড়িয়ে গেলো। বলল,
‘ তুমি একটা বিষয় খেয়াল করেছো? ‘
‘কোন বিষয় টা? ‘
নিনীকা চমৎকার করে হাসলো,
‘ আমরা দুজন দুজনকে মাঝে মধ্যে তুমি বলেও সম্মোধন করি। যেমনটা করছি এখন! ‘
সুমিত্রা চমকাতে গিয়ে ও হেসে ফেললো।
‘ সেই প্রথম পরিচয়ের মতো বলো? এখনো মাঝে মধ্যে তুমি এসে পড়ে। ‘
নিনীকা মাথা নাড়ালো। সূর্যের রশ্মি দুজনের উপর পড়ছে। চোখ তুলে উপরের দিকে তাকানো যাচ্ছে না সহজে। সুমিত্রার নজর পড়লো উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তার দিকে। উচ্ছাসে মৃদু চিৎকার করে উঠলো,
‘ নিনীকা..নিনীকা লুক ডেয়ার, মেজর! ও মাই গড জিজু..নিনীকা! ‘
নিনীকা চমকে উঠে বসলো। সুমিত্রার চোখ বড়বড় করে যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে নিজের দৃষ্টি ফেললো। উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তায় দাড়িয়ে আছে একটি জিপ গাড়ি। ধ্রবসহ সবার চোখে গগলস। তারা বন্দুক তাক করে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। নিনীকা ঢুক গিললো। সে শুনেছে একটু গভীর জঙ্গলে বা উঁচু নির্জন পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা লুকিয়ে থাকে। সুমিত্রার হাত চেপে ধরলো সে।
‘ ইয়ার আমরা মনে হয় ভুল জায়গায় চলে এসেছি। এই সৈনিকগুলো বার-বার আমরা যেখানে যাই সেখানেই উপস্থিত হয়ে যায়। ‘
নিনীকার কথার মধ্যে তাদের দিকে লাল গোল চিহ্নের আলো পড়লো। বড় ওই বন্দুক তাদের দিকে তাক করা। সুমিত্রা ও নিনীকা একে অপরকে ধরে কাঁপতে লাগলো। বিরবির করলো,
‘ এবারের মতো বাচিয়ে দাও সৃষ্টিকর্তা। বেঁচে ফিরলে জীবনে আর কখনো নির্জন পাহাড়ে জঙ্গলে আসবো না। ‘
সৈনিকেরা বুটের শব্দ তুলে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। নির্জন পাহাড়ে বুটের শব্দগুলো ঝংকার তুলে বাজতে লাগলো। তাদের ঘিরে ধরলো কয়েকজন মিলে। এতো বন্দুক নিজেদের দিকে দেখে দুজনের অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। একজন সৈনিক ঠোঁট নাড়ালেন,
‘ হু আর..’
নিনীকা ঢুক গিললো,
‘ আমরা ঘুরতে এসেছি। ‘
ততোক্ষণে ক্যাপ্টেন নিরব আয়মান ও মেজর ধ্রুব মাহবুব এসে দাড়িয়েছে। নিরব গগলস খুলে হাতে নিলো। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ আপনারা দুজন কি সবসময়ই বনে জঙ্গলে নির্জনে এভাবে ঘুরে বেড়ান? ‘
সুমিত্রা হাসার চেষ্টা করলো,
‘ আসলে..আমি প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছি। সেজন্য..আরকি। ‘
‘ বুঝলাম। ‘
কথা বলল ধ্রুব,
‘ ওদের ছেড়ে দাও, ঘুরতে এসেছে। ‘
সৈনিকেরা বন্দুক নামিয়ে নিয়েছে। নিনীকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ধ্রুবের দিকে। এই প্রথম সে ধ্রুবকে আর্মির ইউনিফর্মে দেখছে। কতো সুন্দর! তার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ টা তাকে একবারও তাকিয়ে দেখছে না কেন? অনেক বেশিই রাগ করে আছে কি?
সুমিত্রা প্রায় চিৎকার করলো,
‘ ও মাই গড জিজু…আ’ম সো হ্যাপি। কেমন আছেন আপনি? ‘
সুমিত্রার গায়ে পড়া এই স্বভাবে নিনীকা বিরক্ত হলো। হাত টেনে ধরে আস্তে করে বলল,
‘ চুপ কর বেয়াদব। দেখছিস না ডিউটি অবস্থায় আছে? সবার সামনে দাঁত বের করে জিজু ডাকছিস কেন? ‘
ধ্রুব পিছু ফিরে হাটা ধরলো। পেছন পেছন তার সৈন্যরা। নিনীকার কন্ঠে আফসোস ঝরে পড়লো,
‘ একটাবার তাকিয়ে ও দেখলো না! ‘
সুমিত্রা ঠোঁট বাকালো,
‘ দেখবে কেন? হু আর ইউ? সে ডিউটি অবস্থায় আছে। ‘
সুমিত্রা কথা ফিরিয়ে দিতে পেরে আনন্দিত। নিনীকা মুখ কালো করে পাহাড়ি রাস্তায় নেমে হাঁটা শুরু করলো। ততোক্ষণে জিপটি বহুদূরে চলে গিয়েছে। সুমিত্রা হাত টেনে ধরলো,
‘ আরে আমি তো মজা করেছি ইয়ার। ‘
‘ সে একটা বার তাকাতে পারতো! ‘
নিনীকার কন্ঠে বিষাদ। সুমিত্রা বুঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
‘ দেখ তুই তাকে অপমান করেছিস। তোকে কেউ অপমান করলে তুই কি তার সাথে কথা বলতি? ‘
নিনীকা মাথা নাড়িয়ে না করলো।
‘ আমি তো ছায়া ও মারাতাম না। সবার আগে নিজের আত্নসম্মান। ‘
‘ তোর আত্নসম্মান আছে তার কি নেই? সে একজন মেজর! ভুলে যাস কেন? ‘
নিনীকা জিহব কাটলো। সত্যিই তো। সে সেদিন কতো কঠিন কঠিন কথা বলেছে। যা মুখে এসেছে তাই ছুড়ে ধ্রুবকে কথার আঘাতে ব্যথায় জর্জরিত করেছে। যে মানুষ টা তাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে জোর করতো সে ট্রলি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘চলে যাও। ‘ কতোটা আঘাত পেয়ে মানুষটা সেদিন তাকে চলে যেতে বলেছিল সে বুঝতে পারছে। যেখানে সে ধ্রুবের এই সামান্য প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারছে না, সেখানে ধ্রুব তো! মানুষটার মারাত্মক ধৈর্য, নিনীকাকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে মানানোর৷ সে নিজেই বেকে বসেছিলো। ইশ কি হতো সেদিন একটু বুঝতে চেষ্টা করলে? সে আজ এতোটুকু বুঝতে পেরেছে ধ্রুব আলাদা। সবার চেয়ে আলাদা। আত্নসম্মানবোধ সম্পন্ন দায়িত্বশীল একজন মানুষ৷ যে আপনজনদের যত্নে রাখতে জানে। যেমনটা যত্ন করেছিল দু’দিনে নিনীকাকে। পৃথিবীতে এমন যত্নশীল মানুষের খুব অভাব। নিনীকার ভাগ্যটা হয়তো একটু হলেও ভালো নাহলে কি এমন মানুষ নিজ থেকে পালিয়ে চলে যাওয়া বউয়ের খুঁজে আসে! অভিযোগ না করে সময় দিয়েছে তাকে। আর সে বিনিময়ে ফিরিয়ে দিয়েছে কথার তীব্র আঘাত! নিনীকার নিজেকে সহ্য হচ্ছে না। পা টলমল করতে লাগলো। সুমিত্রার হাত চেপে ধরলো,
‘ আমাকে ধরে কটেজে নিয়ে চল প্লিজ। আমার মাথা ঘুরছে৷ ‘
সুমিত্রা নিনীকার মনের ভাবনা বুঝলো না। ভেবে নিলো হয়তো প্রখর রোদে মাথা ঘুরছে।
জিপ গাড়িতে বসা ধ্রুবের ঠোঁট কিঞ্চিৎ বেঁকে গেলো। নিরব সেটা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ম্যাডামকে এভয়েড করেছেন ইচ্ছে করে। ‘
ধ্রুব রিলাক্স মুডে বলল,
‘ তাকে উপলব্ধি করালাম, প্রত্যাখ্যানের আঘাত ঠিক কতোটা যন্ত্রণাদায়ক। ‘
‘ তৃপ্তি পাচ্ছেন? ‘
‘ নাহ্, কম হয়ে গেছে। তাকে আরও বুঝতে হবে। অনুভব করতে হবে তার কথার আঘাতে, প্রত্যাখ্যানে কিভাবে কারো হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছিলো। ‘
নিরব নিশ্চুপে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মেজর তো নিজের অনুভূতি বলতে পেরেছে। না চাইতেও বিবাহে আবদ্ধ হয়ে কাউকে ভালোবেসেছে। কিন্তু সে! সে তো আজও নিজের অনুভূতিটাই জানাতে পারেনি। যার প্রতি তার অনুভূতি তাকে পেতে হাজার বাঁধা। সবথেকে বড় বাঁধা ওই মানুষটা যাকে নিরব নিরবে পছন্দ করে এসেছে এতোদিন!
(চলবে)