#বিয়ে_থা
#পর্ব-১৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
‘বউ কথা কও’ এ বউ কথা বলছে। তবে তার কথাগুলো দিয়ে ঝরে পড়ছে তীব্র রাগ, অভিমান। ফাহিম মাহবুব চুপচাপ খেয়ে চলেছেন। ফারিন নিজেও চুপচাপ আজ। শুধু চুপচাপ নেই ধারা আহমেদ। ঠাস করে এটা সেটা রাখছেন। সাথে তার মুখ দিয়ে অনবরত কথা চলছে।
‘ আমাকে না জানিয়ে আমার ছেলেকে বিয়ে তো দিয়েছেই সাথে এমন একজনের সাথে দিয়েছে যে কি না বিয়ে করা বর রেখে পালিয়ে গেছে। গেছে তো গেছে আমার ছেলে যখন আনতে গেলো তখন কি না ছেড়ে চলে গেছে। অকর্মা লোক কোথাকার। আমার বাচ্চা টা ছয়মাস ধরে বাড়িতে ফিরেনি শুধুমাত্র তোমার জন্য ফাহিম। দার্জিলিংয়ে এতো কাছে থেকেও আমাকে একটাবার দেখা দেয়নি। দোষ করেছো তুমি আর শাস্তি পেতে হচ্ছে আমাকে। ‘
ধারা চেয়ার টেনে বসলেন। প্লেটে ভাত তুলে নিয়ে খেতে খেতে তাকালেন ফাহিম মাহবুবের দিকে। লোকটা নির্লিপ্তভাবে খেয়ে যাচ্ছে। ধারা তার প্লেট টেনে নিলেন। ফাহিম মাহবুব অসহায় চোখে তাকালেন।
‘খাবো না?’
ধারার মুখশ্রী অভিমানে টইটুম্বুর। ফারিন কথা বলল,
‘ বাবাকে খেতে দাও মা। সে তো জানতো না বলো তার বন্ধুর মেয়ে এভাবে ধোঁকা দিবে। ‘
‘মেয়েটি আবার আমার ছেলের কাছে কেন এসেছে?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ফাহিম।
‘সে তোমার ছেলের কাছে যায় নি। ঘুরতে গেছে। আর তাদের দেখা হয়নি। মেয়েটি যখন ক্যাম্পে গেছে তখন ধ্রুব চট্টগ্রামে ছিল।’
ধারার মুখশ্রী উজ্জ্বল হলো। ফাহিম মাহবুবের প্লেটে ভাত তরকারি দিয়ে বললেন,
‘ খাও।’
ফারিন ও তার বাবার ভ্রু কুঁচকে গেলো। নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। তাদের ধারণা সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে ধারা হাসি-হাসি মুখ করে বললেন,
‘ শুনো না, ধ্রুবকে বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করো। যেভাবেই হোক। আমি ওকে বিয়ে করাবো। দেখবে বউয়ের টানে বাড়িতে ফিরবে। আমার ছেলেটা ওই ধোঁকাবাজ মেয়েটাকে ভুলে যাবে দেখো। ‘
ফারিন প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ালো।
‘ একদম না মাম্মা। আমি ওই পুতুলের মতো চেহারার মেয়েটি ছাড়া আর কাউকে ভাবি হিসেবে মেনে নিবো না। তুমি জানো কতো সুন্দর সে? কি নিষ্পাপ তার চেহারা। তোমার ছেলে এমনি এমনি কি পালিয়ে যাওয়া বউদের প্রতি দু’দিনে দূর্বল হয়েছিল বলে তোমার মনে হয়? ‘
‘ সুন্দর মেয়ের অভাব নেই দুনিয়ায়। ‘
ফারিন হাসলো। কল্পনায় মুখটি দেখার চেষ্টা করে বলল,
‘ তুমি সেদিন তাকে হয়তো খেয়াল করোনি মাম্মা। ঝগড়া করেই গেছো শুধু। যদি একটু খেয়াল করে দেখতে তবে বুঝতে পারতে তার মধ্যে অন্যরকম কিছু একটা আছে। যেটা প্রথম দেখাতেই তাকে সবার থেকে আলাদা প্রমাণ করে। আমি সুন্দর বলতে গায়ের রঙ বুঝাইনি মাম্মা। সেদিন আমি চিপস দিতে গিয়ে তার হাতে হাত রেখেছিলাম। অমন নরম তুলার মতো হাত আমি কারো দেখিনি। আমার নিজেরও তো হাত নরম, তবুও তুলো তুলো মনে হয়না। তাকে মোম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে নাকি? প্রশ্ন টা আমার মাথায় এসেছিল জানো? সে সত্যিই ননীর পুতুল। একটু শক্ত করে ধরলেই হাতে চাপ পড়ে যাবে। তুমি তাকে ছুঁয়ে দেখোনি মাম্মা। তাহলে বুঝতে পাপা তোমার ছেলের জন্য কেমন মেয়ে পছন্দ করেছিলেন। ‘
ধারা শক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ সে যতোই ননীর পুতুল হোক, আমার ছেলেকে সে কষ্ট দিয়েছে। আমার ছেলেকে অপমান করে চলে গিয়েছে। একবার নয় দু’বার। এমন মেয়ে দিয়ে কি হবে যদি তার চরিত্রই ঠিক না থাকে? যে মেয়ে বিয়ে করে পালিয়ে যায় আর যাই হোক সে কখনো ভালো চরিত্রের অধিকারী কেউ হতে পারে না। তুমি ছোট আবেগ দিয়ে চিন্তা করছো। বড় হও বুঝতে পারবে। সেদিন যদি আত্নীয় স্বজন ডেকে বিয়ে করানো হতো তবে এই বাড়ির মান সম্মান বলতে কিছু থাকতো না। সবাই জানতো ‘বউ কথা কও’ এর বর্তমান প্রজন্মের বউ বিয়ে করা বরকে রেখে পালিয়ে গেছে! ’
ফারিন দমলো না,
‘ তুমি হয়তো একদিক ভেবে এসব বলছো মাম্মা। তবে কোনো কারণ ছাড়া কেউ নিজের চরিত্রে দাগ লাগায় না। বিয়ে নিয়ে প্রত্যেকটি মেয়েরই শখ থাকে। সে কেন পালিয়ে গিয়ে নিজের চরিত্রে দাগ লাগাবে বলতে পারো? ’
‘ ফাহিম তোমার মেয়েকে উপরে যেতে বলো। তাকে ছোট ছোটর মতো থাকতে বলো। ’
‘ পাপাকে বলতে হবে না, আমিই চলে যাচ্ছি। ‘
ফারিন মন খারাপ করে উপরে চলে গেলো। আর যাই হোক না কেন ওই ননীর পুতুল ছাড়া আর কাউকে সে ভাবি হিসেবে মেনে নিবে না।
‘ আমার মা’টাকে এভাবে না বললেও পারতে। সে ছোট মানুষ, যা পছন্দ তা তাঁর লাগবেই। আমরা তাকে পছন্দের সবকিছুই দিয়েছি। সেজন্য সে ভেবেছে তার এই ইচ্ছে টাও পূরণ করবো। তার তো এখানে কোনো দোষ নেই। সে বাচ্চা মানুষ আবদার করতেই পারে। অভিভাবক হিসেবে আমাদের উচিত ঠিক ভুল বিচার করে তার ইচ্ছে পূরণ করা। যদি সম্ভব না হয় তো ভালোবেসে বুঝিয়ে বলা, যাতে সে মন খারাপ না করে। তার কোমল হৃদয়ে যদি আঘাত লাগে তবে তো আমরাই কষ্ট পাবো বলো? ‘
ধারা টলমলে চোখে তাকালেন,
‘ বেশি ধমকে কথা বলে ফেলেছি? আমার বাচ্চা টা বেশি কষ্ট পেয়েছে তাই না? ‘
ফাহিম মাহবুব হেসে ফেললেন।
‘ নিজে বকা দিয়ে নিজেই কাঁদছো। ‘
ধারা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। প্লেটে ভাত নিয়ে ছুটলেন মেয়ের রুমে। ফাহিম মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তার একটা ভুল ছেলে মেয়ে স্ত্রী সবার মন খারাপের কারণ!
–
ঠান্ডার মধ্যে উষ্ণতা খুঁজছে নিনীকা। কাঁথা টেনে টুনে গায়ে জড়াচ্ছে সে। চোখজোড়া বন্ধ। বাহির থেকে কিচিরমিচির আওয়াজ কানে আসছে। সকাল হয়ে গেছে। নিনীকার ঠান্ডা কপালে কেউ যেন উত্তপ্ত ঠোঁট ছোঁয়ালো। সে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। কিন্তু কেউ ধরা দিলো না। চোখ মেলে তাকালো। কেউ নেই। সে একা। নিনীকা উঠে বসলো। ধ্রুবকে নিয়ে কল্পনা করাটা নতুন নয়। এরকম কত-শত কল্পনা করে সে। হোস্টেলের রুমমেটরা একদিন বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
‘ তাকে ফোন করছো না কেন? শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো। ‘
নিনীকা পারে না। না চাইতেও ধ্রুব তার সবকিছুতে থাকে। যেমন থাকে তার কল্পনায়। সবসময়ই কপালে উত্তপ্ত ঠোঁট ছোঁয়ালে তার ঘুম ভাঙে। হা হা হা কল্পনায়! নিনীকা এর থেকেও গভীর কল্পনা করে। কখনো ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় কখনো আরও গভীর কোনো অনুভূতিতে তলিয়ে যায়।
কল্পনায় সুখী নিনীকা আজকাল ধ্রুবকে সত্যি সত্যি পেতে চায়। অবশ্য চাওয়াটা আজকালকার নয়। কিন্তু মস্তিষ্ক বাঁধা দিতো। আজ মস্তিষ্ক চাইছে বেহায়া হতে। মনের সাথে পাল্লা দিয়ে বলছে,
‘ যাও নিনীকা, তার কাছে যাও। সে তোমার অপেক্ষায় বসে আছে কত-শত দিন ধরে। তুমি আসবে বলে কারোর আকাশে চাঁদ উঠেনি। তুমি যাও।’
নিনীকা বিছানা থেকে নামলো। পড়োনে সাদা প্লাজু ও সাদা শার্ট। তন্মোধ্যে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো সুমিত্রা।
‘ গুড মর্নিং নিনীকা।’
নিনীকা উত্তর দিলো না। গিয়ে দাঁড়ালো কটেজের বারান্দায়। সুমিত্রা চিৎকার করলো,
‘ ইয়ার গরম কাপড় পড়ে যাও।’
নিনীকা গায়ে মাখলো না। একমনে তাকিয়ে রইলো উঁচুনিচু রাস্তার দিকে। সুমিত্রা নিজেই একটি চাদর এনে গায়ে জড়িয়ে দিলো। নিনীকার পায়েও জুতা নেই। মেয়েটা দিনদুনিয়া ভুলে কি ভাবছে কে জানে। সুমিত্রা হাত দিয়ে কাঁধে ধাক্কা দিলো। নিনীকা তবুও তাকালো না। শুধু বলল,
‘ ডিস্টার্ব করো না, তাকে ভাবতে দাও। ‘
সুমিত্রা ভ্যাবাচেকা খেলো,
‘ তুমি কল্পনায় সংসার করতে করতে কবে যেনো পাগল হয়ে যাও ইয়ার। ‘
–
সৈন্যরা তাঁবু থেকে বের হয়ে গেছে। কেউ কেউ মর্নিং ওয়ার্ক করছে। ধ্রুব কটেজের বারান্দায় দাড়িয়ে। নিরব দুটো কফির মগ নিয়ে এসে দাড়ালো। একটি ধ্রুবর দিকে বাড়িয়ে দিলো।
‘ আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে মেজর। ‘
ধ্রুব কফিতে চুমুক দিলো। দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
‘ একটা স্বপ্ন দেখেছি ক্যাপ্টেন। ‘
নিরব কৌতূহল দেখালো,
‘ কিরকম স্বপ্ন? ‘
‘ একটা বাচ্চা ছেলে মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে ‘ বাবা, বাবা, বাবা… ’
নিরব চমকে গেলো,
‘ মাই গড! স্বপ্নে কেউ আপনাকে বাবা ডেকেছে! বাই এনি চান্স সে আপনার ও নিনীকা ম্যাডামের ছেলে নয়তো? ‘
‘ জানি না, তবে তার থুতনিতে তোমার ম্যাডামের মতো একটি তিল আছে। এবং তার মুখশ্রী আমার মতো। তাকে দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারবে এটা আমার ছেলে। ‘
নিরব দ্বিগুণ উৎসাহে চিৎকার করলো,
‘ ও মাই গড, ও মাই গড! ‘
(চলবে)