#বিয়ে_থা
#পর্ব-১৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
(কপি নিষিদ্ধ)
রোদের তাপে চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। নিনীকা হাসফাস করছে। তন্মোধ্যে কানে এলো সেই দুটো অফিসারকে আরেক অফিসার বলছে,
‘ একদম এসব ভাবতে চেষ্টা করো না। স্যার জানলে কি হবে বুঝতে পারছো? ‘
অফিসার দুটো ঢুক গিললো,
‘ স্যার জানবেন না। চলো এদের সাথে কাজ সেরে তারপর ছেড়ে দেই। স্যার আসার আগেই কাজ শেষ। সুতরাং জানতে পারবে না।’
অফিসার টি শেষ বারের মতো সতর্ক করলো,
‘একদম না। স্যার যাওয়ার আগে আমাকে সবদিকে খেয়াল রাখতে বলে গেছেন। আমি আমার দায়িত্ব পালন করা থেকে পিছু পা হবো না। তোমরা যদি বাজে কোনো কাজ করো তবে তোমাদের সাসপেন্ডের ব্যবস্থা আমি নিজেই করবো। তোমাদের সাহস কিভাবে হয় একজন ক্যাপ্টেন কে বাজে কাজের প্রস্তাব দেওয়ার!’
অফিসার দুটো এইবার একটু ভয় পেলো।
‘আমরা খুবই দুঃখীত স্যার। প্লিজ আপনি স্যার এলে কিছু বলবেন না। আমরা কোনো বাজে কাজ করবো না।’
অফিসারটি নিজের ক্যাপ হাতে নিলেন। গর্ব করে বললেন,
‘আমি এই পোশাক সগৌরবে পড়ি। তোমরা কি তেমন করে পড়ো?’
দুটো অফিসার মাথা নিচু করে ফেললো।
‘ তোমরা নতুন অফিসার হয়েছো। ধীরে ধীরে সবকিছু আয়ত্তে আনবে। যে পেশায় এসেছো সেটার সম্মান ধরে রাখা তোমাদের দায়িত্ব। তোমাদের মা বাবা নিশ্চয়ই তোমাদের উপর ভরসা করেন?’
অফিসার দুটো মাথা নাড়ালো।
‘আমরা হলাম রক্ষক। আমাদের দায়িত্ব জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া। দেশের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। দেশের জনগণকে হ্যারাস করা নয়। তোমাদের একটা ঘটনা বলি। একজন সৈনিক একবার তার এক আত্মীয়ের বউয়ের সাথে রাত কাটাতে গিয়ে ভোর রাতে ধরা পড়েন। সেই আত্মীয় লোকটা চাকরি তো খেয়েছেই সাথে ওই বউটাকেও ছেড়েছে। সমাজের সবাই জেনেছে রক্ষকের মধ্যেও ভক্ষক থাকে। তোমরা কি ভক্ষক হতে চাও? সেই সৈনিক কিন্তু ডিউটি অবস্থায় কিছু করেনি। তবুও তার সম্মান গেছে সাথে চাকরি। তোমরা ডিউটি অবস্থায় আছো!’
অফিসার দুটো অনুতপ্ত হলো। হাতজোড় করে বলল,
‘আপনি মেজর স্যারকে কিছু বলবেন না প্লিজ। আমরা আজ থেকে ভালো হয়ে যাবো। দেশের ভক্ষক নয় রক্ষক হবো। কথা দিচ্ছি আপনাকে স্যার। এরপর থেকে যদি কখনো আমাদের বাজে কিছু তে পান তো আপনার যা ইচ্ছে তা-ই শাস্তি দিতে পারেন আমাদের। আমরা মাথা পেতে নিবো।’
অফিসারের নাম নিরব আয়মান। চোখের গগলস টা সে খুলে হাতে নিলো। আঁড়চোখে দেখে নিলো কাঠের বারান্দায় হাঁটু গেঁড়ে বসিয়ে রাখা দুজনকে। রোদের তাপে মেয়ে দুটোর মুখশ্রী লাল। হয়তো এলার্জি প্রব্লেম আছে। নিরব গগলস পুনরায় চোখে পড়ে নিলো। বলল,
‘ম্যাডামদের কাছে ক্ষমা চাও, আর তাদের সসম্মানে কটেজে পৌঁছে দিয়ে এসো।’
অফিসার দুটো মাথা নাড়িয়ে এগুলো। নিনীকা ও সুমিত্রার কাছে অনুনয় করে ক্ষমা চাইলো। বাঁধন খুলে দিয়ে বলল,
‘আপনারা জিপে উঠুন, আপনাদের কটেজে পৌঁছে দিবো। ‘
নিনীকা ও সুমিত্রা একে অপরের দিকে তাকালো।
‘আপনাদের ধন্যবাদ। আমরা চলে যেতে পারবো।’
‘আমাদের স্যারের অর্ডার ম্যাডাম।’
সুমিত্রার চেহারা উজ্জ্বল হলো,
‘কোন স্যার আপনাদের? মেজর টাইপ কেউ? ‘
‘মেজর স্যার তো ভোর রাতে চলে গেছেন। এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যে। আপনাদের স-সম্মানে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার অর্ডার আমাদের ক্যাপ্টেন নিরব আয়মান দিয়েছেন।’
নিনীকা এ সুমিত্রা নেমে এলো কটেজের বারান্দা থেকে। সম্মুখ্যে দাড়ানো ক্যাপ্টেন নিরব আয়মান নিজের বলিষ্ঠ শরীর দিয়ে বুক ডাউন দিতে ব্যস্ত। নিনীকা আড়চোখে দেখে নিলো তাকে। তারা জিপে উঠবে তখনই নিরব এলো। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে বলল,
‘ আপনাদের জন্য দায়িত্ব টা আমার কাছে বেশিই। উঠে পড়ুন।’
নিনীকা কিছু বুঝতে পারলো না। অফিসার দুটোকে নিরব চলে যেতে বললো। জিপটা আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। মাঝপথে নিরব কথা বলল,
‘আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেন নি ম্যাডাম। আমি ক্যাপ্টেন নিরব আয়মান। মেজর ধ্রুব মাহবুবের বউয়ের ব্যাপারে খুঁজ খবর নেওয়ার দায়িত্ব টা অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার ফাহিম মাহবুব দিয়েছিলেন আমায়। বিয়ের দিন আমি উপস্থিত ছিলাম। তবে আপনি আমায় দেখেননি।’
নিনীকা চমকে গেলো। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো তার। সুমিত্রা উচ্ছাস নিয়ে তাকালো।
‘ধ্রুব জিজু তো মেজর তাই না? ওই অফিসার গুলো বললো মেজর কিছুক্ষণের মধ্যে আসবেন। এটাই কি তবে..
‘হ্যাঁ মেজর আসবেন।’
সুমিত্রা চিৎকার করে নিনীকার হাত চেপে ধরলো,
‘ ও মাই গড নিনীকা ইয়ার।!’
নিরব লুকিং গ্লাসে নিনীকার থমথমে কঠিন মুখশ্রী দেখে নিলে। ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,
‘ আমার মনে হচ্ছে আপনার ইয়ার খুশি নন। হওয়ার কারণও নেই। তিনি বিয়ে করে পালিয়ে এসেছিলেন। ‘
নিনীকা দৃঢ়ভাবে বলল,
‘কটেজের সামনে নামিয়ে দিন এসে গেছি।’
সুমিত্রা ও নিনীকা নেমে গেলো। নিরব মাথা বের করে দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
‘ একটু ভেবে দেখবেন ম্যাডাম। মেজর ধ্রুব মাহবুব কোথাও না কোথাও ভালো নেই!’
নিনীকাদের অতিক্রম করে গেলো জিপটি। সুমিত্রা নিনীকার বিধ্বস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার চোখেমুখের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় কেঁদে ফেলবে। নিনীকা ঢুক গিললো,
‘আমাকে একটু ধরে রুমে নিয়ে যাবি সুমিত্রা?’
–
দুপুর গড়িয়ে গেলো মেজর ধ্রুব মাহবুব ক্যাম্পে ফিরলেন না। সূর্য যখন নিভু নিভু করছে, বিকেলের গোধুলি পেরিয়ে যখন সন্ধ্যা নামবে ঠিক তখনই আর্মি ক্যাম্পে তার জিপ গাড়িটা এসে থামলো।
দেহের সাথে আটসাট করে জড়ানো আর্মির পোশাক। নেমপ্লেটে সুন্দর করে লিখা ‘মেজর ধ্রুব মাহবুব।’ বুট জুতার শব্দ তুলে কাঠের কটেজে উঠলো সে। পা মাড়িয়ে যখন দরজা দিয়ে ঢুকবে তখনই তার দৃষ্টি আঁটকে যায় কিছুতে। মনে মনে চমকায় ভীষণ। সে তো এখানে আসবার কথা নয়!
মেজর ধীরপায়ে হেঁটে সেটা কুড়িয়ে নিলেন। হাতের সুন্দর একটি ব্রেসলেট। এই ব্রেসলেট টা তার চেনা। খুব কাছের কারো হাতে তিনি দেখেছেন। কিন্তু এটা এখানে আসবে কিভাবে!
মেজর ধ্রুবের সম্মুখে এলো নিরব। ব্রেসলেটের দিকে চোখ পড়তেই বুঝে গেল সব। বলল,
‘সকালে দুটো মেয়ে এসেছিল স্যার। আমাদের অফিসাররা তাদের কুচক্রীদের কেউ ভেবে বেঁধেছিলো। আমি তাদের ছেড়ে দিয়েছি, এবং স-সম্মানে কটেজে পৌঁছে দিয়েছি।’
ধ্রুব ব্রেসলেট টা পকেটে ভরে নিলো। নিরব ঠোঁট কামড়ে হাসছে।
‘আপনি যা ভাবছেন তা-ই মেজর। সে-ই!’
ধ্রুব চমকে গেলেও মুখশ্রীতে তা প্রকাশ পেলো না। শুধু বলল,
‘কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
‘আমি সামলে নিয়েছি।’
‘কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলো?’
‘বললেন ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছেন কৌতুহল নিয়ে।’
ধ্রুব দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে যেতে হয়েছিলো তাকে। যদি না যেতো তবে হয়তো দেখা হয়ে যেতো। কেন এসেছিল সে? ধ্রুবের খুঁজে? অসম্ভব! ধ্রুব তাছ্যিল হাসলো। আর যাই হোক তাকে খুঁজতে কখনোই আসবে না। সে আর সবার মতো নয়। কঠিন সত্তা তার। ধ্রুব কেন মিছে আশা করবে, কেন ভাববে তাঁকেই খুঁজতে এসেছিলো!
পড়োনের ইউনিফর্ম খুলে ফেললো সে। প্রচুর ক্লান্তি শরীরে। ভেবেছিলো ক্যাম্পে পৌঁছে কয়েক ঘন্টা ঘুমাবে। কিন্তু তার ঘুম হারাম হয়ে গেলো। আজ আর ঘুম আসবে না। বেহায়া মন আবারও তাকে ভাববে। ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে যাবে।
–
তাঁবুর বাহিরে একলা দাড়িয়ে আছে নিরব। চারিদিকে অফিসার রা অবস্থান করছে। সে একটু দূরে দাড়িয়ে আছে। পকেট থেকে বের করলো পার্সোনাল মুঠোফোন। ডায়াল করলো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই বলল,
‘ সে এসেছিলো ক্যাম্পে।’
ফারিন উত্তর দিলো,
‘কে এসেছিলো? ‘
‘আপনার ভাবি।’
ফারিন চমকালো,
‘ কোথায় সে?’
নিরব হাসলো,
‘ এসেছিল ঘুরতে চলে গেছে। স্যার মাত্রই এলেন। জানালাম তাকে। দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।’
ফারিন চোখমুখ কুঁচকে বলল,
‘ আপনি বড্ড মেপে মেপে কথা বলেন। সবকিছু খোলাসা করে বলুন। কিভাবে কি।’
‘সেটা তো সম্ভব না, আমাকে এখন রাখতে হবে। আমি আপনাকে জানালাম, কারণ আপনি যাতে স্যারকে জানিয়ে দিতে পারেন।’
‘ আমি বাবাকে জানিয়ে দিবো।’
নিরব ঠিক আছে বলে রেখে দিলো। আশেপাশে কোথাও কোনো জন্তু ডাকছে। নিরবের তাতে হেলদোল নেই। সে একমনে তাকিয়ে আছে অন্ধকার উঁচুনিচু রাস্তার দিকে। ধীরে ধীরে উঠে এলো কটেজের বারান্দায়।
কাঠের কটেজ রুমটা অন্ধকার। সেখান থেকে নিরবের কানে ভেসে এলো তার স্যারের বিরহ নিয়ে গাওয়া গান।
‘ তুমি বৃষ্টি চেয়েছো বলে,
কত মেঘের ভেঙেছি মন
আমি নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি।
তুমি যাওনি কিছুই বলে
আজও পাল্টে ফেলিনি মন,
শুধু নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি…
‘ তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি…… ’
ধ্রুব খালি গলায় গান গাইতে গাইতে কফি হাতে বারান্দায় চলে এসেছে। গাইছে,
‘ তুমি অন্য ঘরেই থেকো
আমার নামে রাগ জমিয়ে রেখো,
আমি সবটুকু দোষ তোমায় দিয়েছি….
তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি…… ’
নিরবের ছায়া দেখে ধ্রুব থেমে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘কি করছো অন্ধকারে?’
নিরব ধ্রুবের পাশাপাশি দাঁড়ালো। আকাশের দিকে মুখ রেখে বলল,
‘আপনার কন্ঠে বিরহ ঝরে পড়ছে স্যার। একটু চেষ্টা করা যায় না?’
ধ্রুবের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো।
‘ আমি করেছি, সে ফিরিয়ে দিয়েছে। মেজর ধ্রুব মাহবুবের আত্নসম্মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এবার আমি নয় সে আসবে। অন্যথায় ধ্রুব মাহবুব এর জীবনে নিনীকা শেখ নামে কারো অস্তিত্ব থাকলেও ধ্রুব মাহবুব সেটা ভুলে যাবে!’
‘ভুলতে পেরেছেন?’
ধ্রুব শক্ত করে কফির মগ চেপে ধরলো।
‘ সে আমাকে বিশ্বাস করেনি নিরব৷ আমাকে…আমাকে কাপুরুষদের সাথে তুলনা করেছে। আমি নাকি ওইসব পুরুষদের মতো যারা অধিকার দেখিয়ে বিছানায় নিয়ে যায়! সে আমাকে…’
ধ্রুবের কন্ঠ রুদ হয়ে এলো। নিরব নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হাত রাখলো ধ্রুবের কাঁধে।
ধ্রুব জড়িয়ে ধরলো বাচ্চাদের মতো। এই ছেলেটা তার বন্ধুর মতো। দুজনের বয়সের গ্যাপ দুই বছর। কিন্তু দুজন দুজনের সাথে থাকে সবমসময়। ধ্রুব নিজের সবকথা এই ছেলেটাকেই বলে দেয় অনায়াসে। তাকে বুঝতে পারে ছেলেটা। ঠিক যেমন ধ্রুব বুঝতে পারে নিরব আয়মান গোপনে কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে তার মতো করেই!
(চলবে)