বিয়ে থা পর্ব-১৩

0
192

#বিয়ে_থা
#পর্ব-১৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

(কপি নিষিদ্ধ)

শীতকাল। কাঁচের জানালায় শিশির বিন্দু জমেছে। মিথিলা হাত দিয়ে তা ছুয়ে দিলেন। শরীর শিরশির করে উঠলো তার। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলেন। নাস্তা তৈরি করে রমজান শেখ কে ডাকতে এলেন। রমজান শেখ তখন তৈরি হয়ে নিচে নামতেই যাচ্ছিলেন। মিথিলা নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো,

‘খেতে এসো।’

রমজান শেখ ধীর পায়ে হেটে এলেন। দুহাতে মিথিলার মুখশ্রী তুলে ধরলেন। শব্দ করে চুম্বন করলেন ঠোঁটে। মিথিলার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। রমজান শেখ ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকালেন।

‘হুসস কাঁদে না।’

মিথিলা ফুপিয়ে উঠলেন,

‘সবসময় এরকম ভালোবাসতে কেন পারো না? তোমার কোন সত্তাকে আমি বিশ্বাস করবো?’

রমজান শেখ মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেলেন। মিথিলার গাল চেপে ধরলেন শক্ত করে।

‘বেশি বেশি কথা আমার পছন্দ না। চুপচাপ থাকবে।’

মিথিলা নিজেকে স্বাভাবিক করলেন।

‘খেতে এসো।’

রমজান শেখ হাঁটা ধরলেন। যেতে যেতে করুণ চোখে পেছন ফিরে দেখলেন একবার।

মিথিলা নিচে নামলেন না। বিছানা গুছিয়ে রাখতে গিয়ে বালিশের উপর একটি ডায়েরি দেখতে পেলেন। ডায়েরিটা তিনি সবসময়ই দেখেন। কখনো টেবিলে কখনো বিছানায়। কিন্তু কখনো খুলে দেখা হয়নি। আজ কৌতুহল নিয়ে হাতে নিলেন৷ রমজান শেখ ডায়েরিতে নিজের অনেক কথা লিখেন। যেমন লিখতেন প্রেম চলাকালীন মিথিলা কে নিয়ে নানান কথা।

মিথিলা পাতা উল্টালেন। সাল দেখে বুঝলেন তার ও রমজান শেখের প্রেমের শুরুর পর ডায়েরিটা লেখা শুরু করা হয়েছে। পুরনো স্মৃতি ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগলো তার। মানুষটা তাকে কতো ভালোবাসতো। তাকে নিয়ে কতো না বলা অনুভুতি লিখে রেখেছে। আস্তে ধীরে পৃষ্ঠা পাল্টাতে লাগলো। একটা পৃষ্ঠাতে চোখ আটকে গেলো মিথিলার। উপরে বড়বড় অক্ষরে লেখা,

‘ ঘৃণার শুরু’ ১৫ জুন

মিথিলা প্রচন্ড কৌতুহল নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

‘ আমি রমজান শেখ। আমার প্রিয়তমা মিথিলা ভালোবেসে আমাকে শেখ বাবু বলে ডাকে। তাকে আমি বিয়ে করেছি ভার্সিটি দ্বিতীয় বর্ষে। আজ থেকে আমি নতুন কিছু শুরু করবো। যেটা হবে ঘৃণার। তীব্র ঘৃণার। নিজেকে ঘৃণা করার এই যাত্রার শুরুটা আমি স্মরনীয় করে রাখতে লিখে রাখছি। আজ পনেরো জুন। মিথিলাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি পাঁচ মাস আগে। আমাদের টোনাটুনির সংসারে ঝুটঝামেলা নেই। আমার বাবার অটেল সম্পদ। সুতরাং বউ পালতে আমার কোনো অসুবিধা হয়না। মিথিলার বাবাও সব বুঝেই আমার মতো স্টুডেন্টের কাছে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া আমি ছাত্র হিসাবে ভালো। ইতিমধ্যেই বাবার ব্যবসাতে হাত দিয়েছি। বিশ দিন আগে হোস্টেলে এসেছিলাম পরীক্ষার কারণে। আজ আমার শেষ পরীক্ষা ছিল। আমি খুশিমনেই পরীক্ষা দিয়েছি। আমার হৃদপিণ্ড, আমার মিথিলাকে টেলিফোন করে বলেছি আমি আগামী কালই গৃহে ফিরবো। হোস্টেল রুমে আমার সাথে আরও তিনজন থাকেন। হোস্টেলের প্রত্যেকটা রুমেই এমন করে। রুমে যারা থাকেন তাদের সাথে আমার কোনো সখ্যতা নেই। আমি পড়ার সময় পড়ি বাকিটা সময় প্রিয়তমাকে ভেবে কাটিয়ে দেই। সুতরাং আশপাশের খেয়াল আমার কখনোই ছিল না। এখন ভোর রাত। ঠিক তিনঘণ্টা আগে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হয়ে গেছে।

আমি তখন হোস্টেলের জানালা দিয়ে চাঁদ দেখছি। মনে মনে ভাবছি প্রিয়তমাকে। সে টেলিফোনে বলেছে আমি বাড়িতে গেলে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। সেটা কি হতে পারে ভাবছিলাম। তন্মধ্যে আমার পেছনে এসে দাড়িয়েছে সাতজন পুরুষ। তারা ফাইনাল ইয়ারের। তিনজন আমার রুমমেট। বাকি গুলো হোস্টেলেরই কোনো না কোনো রুমের। আমি তাদের সালাম দিলাম। ভাবলাম হয়তো সিনিয়র বলে উপদেশ দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু আমার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ হলো। আমি তখনো মনে মনে মিথিলাতে ডুবে। তাদের জঘন্য পরিকল্পনা আমি স্বপ্নেও বুঝতে পারিনি।

সমকামী অহরহ রয়েছে। কিন্তু আমার সামনে দাড়ানো সাতজন সিনিয়র যে তারই অন্তর্ভুক্ত তা আমি জানতাম না। আমাকে ওরা হাত পা বেঁধে উলঙ্গ করে নির্যাতন করলো। মেয়েদের বেলায় ধর্ষণ শব্দটা ব্যবহার হলে পৃথিবীর সবাই জেগে উঠে। বিচার চেয়ে রাস্তায় নামে। আমি একজন পুরুষ। নির্যাতিত পুরুষ। একজন পুরুষকেও ধর্ষণ করা যায় সেটা কি এই সমাজ মেনে নিবে?

আমাকে ছাড়া হলো তিনটার দিকে। ব্যাথায় আমি অজ্ঞান ছিলাম আধাঘন্টা। সাড়ে তিনটার দিকে হুশ আসে। আমার চোখে বারবার ভাসছিল আমার ভালোবাসা আমার অর্ধাঙ্গিনী প্রিয়তমার মুখ। সে যখন জানবে তার স্বামী সাতজন সমকামী দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে তখন সে কি ঘৃনা করবে না?

চারটার দিকে আমি টেলিফোন করলাম পুলিশ স্টেশনে। বাবার ব্যবসার সুবাদে অনেক বড়বড় অফিসারদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। তাদের মধ্যেই শহরের একজনকে নিজের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা বললাম। ভদ্রলোক বেশ মজা পেলেন। পুরুষ সমাজের প্রতি আমার ঘৃনা বাড়িয়ে দিলেন তীব্র ভাবে। অফার করলেন,

‘তুমি চাইলে আমাকে এক রাত দিতে পারো। মেয়ে ছেলে ইন্টিমেট কমন। বাট ছেলে ছেলে নট কমন। ফিল করতে পারছো? মজা না?’

ঘৃণায় আমি বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। রুমে আমি ছাড়া কেউ নেই। প্রায় এক ঘন্টা শরীর ঢলে গোসল করলাম। তবুও যেনো সব রয়ে গেলো। আমি আমার শরীরের কোথাও আমার মিথিলার ছোঁয়া অনুভব করতে পারলাম না। আমার মিথিলার ভালোবাসাময় আদরগুলো চাপা পড়ে গেছে সাতজন সমকামীর ঘৃণ্য স্পর্শের কাছে।

আমি কপালে পাগলের মতো হাত ছোঁয়ালাম। বুকে কপালে কোথাও আমার মিথিলার ভালোবাসার স্পর্শ পেলাম না। তৃষ্ণার্থ হয়ে মিথিলাকে খুজলাম। আমার এই ব্যথা একমাত্র ও ভুলিয়ে দিতে পারবে। ওকে আমার প্রয়োজন। তীব্র ভাবে প্রয়োজন।

এই সময় টেলিফোনে তাকে পাওয়া গেলো না। দীর্ঘ এক ঘন্টা থম মেরে বসে থাকার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জীবনে যতোদিন বেচে থাকবো ততোদিন আমি পুরুষদের তীব্রভাবে ঘৃনা করে যাবো। নিজের পুরুষ সত্তাকে ঘৃনা করে যাবো। আশেপাশের সবাইকে ঘৃনা করতে বাধ্য করবো। পৃথিবীতে সূচনা করবো ঘৃণ্য একটি সত্তার।

আমার মিথিলা, প্রিয়তমা আমার। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার শেখ বাবু হয়ে থাকতে পারলাম না গো।


মিথিলার চোখের পানিতে ডায়েরির পাতা ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। মুখ চেপে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। হাত দিয়ে উল্টালেন পৃষ্ঠা।

তারিখ ২০ জুন

‘ পাঁচ দিন পর বাড়িতে এসেছি। মিথিলা অভিমানী মুখ নিয়ে আমার পাশে ঘুরঘুর করছে। আমি জানি আমার নির্বিকার ভাব তাকে কষ্ট দিচ্ছে। দিক, ঘৃনার সূচনাটা আজ থেকেই হোক।’

রাতে ঘুমানোর সময় মিথিলা আমার ভালোবাসা চাইলো। আমার অপবিত্র শরীর মিথিলার পবিত্র শরীর স্পর্শ করবে সেটা আমি চাই না। কিন্তু মিথিলা হার মানার পাত্রী নয়। সে আমাকে উত্তেজিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করলো। কিন্তু পুরুষ সত্তাকে হার মানিয়ে আমার জেদ, ঘৃণা জিতে গেলো। আমি দূর্বল হলাম না। শেষরাতে মিথিলা কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত তার পেটে রাখলো।

আমি চমকে গেলাম। তার বলা সেই সারপ্রাইজটা আমার পছন্দ হলো না। হয়তো আগের আমি হলে খুশিতে কেঁদে ফেলতাম। কিন্তু এখনকার আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মিথিলার গালে প্রথমবারের মতো আমার শক্ত হাতের থাপ্পড় বসালাম। আমি দেখেছি ও বড়বড় দুটো চোখে কিভাবে আমাকে দেখছিল। হয়তো বেচারি স্বপ্নেও ভাবেনি আমি কখনো তাকে আঘাত করতে পারি।

৪ জুলাই

আমি ওর থেকে দূরে থাকতে পারি না। অনেকদিন পর ওকে কাছে টেনেছি। অভিমানে ও আমার বুক ভাসিয়েছে। আমি নির্দয় পাষানের মতো কাছে টানার পর ওকে ছুঁড়ে ফেলেছি। দ্বিতীয় বারের মতো ও বড়বড় চোখে আমাকে দেখেছিলো।

বির বির হরে পেটে হাত রেখে হয়তো আমাদের সন্তানকে বিচার দিচ্ছিলো।

‘ তোর বাবা পাল্টে গেছে সোনা, তোর আসার খবর পেয়ে সে খুশি হয়নি। তুই একজন ভালো বাবা পাবি না।’

মিথিলার চোখের পানি বাঁধ মানছে না। চিৎকার করে কাঁদছেন তিনি। বাকিটা পড়ার শক্তি তার আর নেই। তার চিৎকারে নিচ থেকে সবাই উপরে উঠছে। সার্ভেন্ট থেকে শুরু করে কাজের মহিলা। রমজান শেখ এলেন সবার শেষে। মিথিলার হাতে ডায়েরি দেখে রাগলেন না। তিনি জানেন রহস্য একদিন সামনে প্রকাশ হবেই।

মিথিলা সবার সামনে ঝাপিয়ে পড়লেন স্বামীর বুকে। রমজান শেখ নির্দয়ভাবে ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে। চোখের সানগ্লাস ঠিক করে বললেন,

‘অফিসে যাচ্ছি, ফিরে এসে যেনো এসব নাটক আর না দেখি।’

রমজান শেখ প্রস্থান করলেন। মিথিলা বুক চেপে আহাজারি করে কাঁদলেন। পৃথিবী এতো নিষ্ঠুর! তার অমন নরম মানুষটাকে কিভাবে বদলে দিলো। সহজ সরল হাসিখুশি মানুষটাকে কিভাবে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিলো। ভেঙে দিলো তাদের ভালোবাসাময় সংসার।’

যে মানুষটা বুক ফুলিয়ে বলতো,

‘আমার মতো আর কেউ পাবে না বুঝলে? কেউ তোমাকে আমার মতো করে ভালবাসবে না।’

নিজেকে নিয়ে গর্ব করা মানুষটা নিজেকে ঘৃণা করে!

কাঁদতে কাঁদতে মিথিলার চোখের অশ্রু ফুরিয়ে গেলো। মেঝে থেকে উঠে টলমল পায়ে বিছানাতে শুয়ে পড়লেন। নাক টেনে অনুভব করতে চাইলেন প্রিয় মানুষটার ঘ্রাণ।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে