#বিয়ে_থা
#পর্ব-১১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
( কপি নিষিদ্ধ)
গভীর রাত। নিস্তব্ধ বারান্দায় একা বসে আছেন রমজান শেখ। একের পর এক সিগারেট টেনে চলেছেন প্রায় দু’ঘন্টা ধরে। চোখগুলো অন্ধকার তারা বিহীন আকাশে নিবদ্ধ। আকাশে চাঁদ ও নেই। নিস্তব্ধতার মধ্যে রমজান শেখ একা, একলা। তার বুক ছিঁড়ে বের হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। আজ আষাঢ়স্যের পনেরো তারিখ। এই তারিখ কারো জন্ম তারিখ নয়, কারো মৃত্যু তারিখ ও নয়। কারো বিবাহ তারিখও নয়। এই তারিখটা তার জীবনটা কুলষিত করার তারিখ। আজকের এই তারিখেই এমনই একটি রাতে তার জীবনটা বদলে গেছিল। তিনি বেছে নিয়েছিলেন ঘৃণা। নিজের প্রতি ঘৃণা। পুরো বিশ্বের পুরুষ সমাজের প্রতি ঘৃণা। এতো ঘৃণা রমজান শেখ কাউকে করেন নি। যতোটা নিজেকে করেন। তার ঘৃণা হয় পুরুষ সত্তার প্রতি। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে পুরুষালি অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে দিতে। কেন তিনি পুরুষ হলেন? কেন তাকে এই ঘৃণ্য সত্তা নিয়ে জন্ম নিতে হলো।
পুরনো স্মৃতি গুলো আবছায়া হয়ে ধরা দিলো চোখে। তার চোখ গরম হয়ে টুপটাপ করে অশ্রু বিসর্জন দিলো। রমজান শেখ বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বড্ড ঘৃণামিশ্রিত কন্ঠে উচ্চারণ করলেন বিষ বাক্য।
‘পৃথিবীর সবাই জানুক পুরুষদের মতো ঘৃণ্য কেউ হতে পারে না। আমি পৃথিবীকে জানাবো। নিজের এই পুরুষ সত্তার প্রতি তীব্র ঘৃণা আমার। সবার ঘৃণা জন্মাক আমার প্রতি। আমার এই পুরুষ সত্তার প্রতি।’
আচমকা তিনি হু হা করে হেসে উঠলেন। একা একা বিরবির করলেন,
‘আমি চাই সবাই পুরুষদের ঘৃণা করুক। নিনী মা আমার তুমিও ঘৃণা করো। তীব্র ভাবে ঘৃণা করো। পুরুষদের কখনো আপন ভাববে না। আ’ম সাকসেসফুল ডেয়ার। তোমার বাবা সাকসেস। তুমি আজ সত্যিই পুরুষদের অবিশ্বাস করো। নিনীকা আমার মেয়ে, তুমি কখনো পুরুষদের মায়ায় আটকাবে না। শুনছো মা আমার? বাবা ইচ্ছে করে পাসপোর্টের লকারের চাবিটা তোমার মাকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। তোমার বাবা জিতে যাচ্ছে মা। তুমি কখনোই পুরুষদের বিশ্বাস করবে না মা। তোমার বাবা যা সহ্য করেছে তুমি তা কখনোই সহ্য করবে না। পুরুষদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মাক তোমার, ঠিক তোমার মায়ের মতো। বুঝলে মা আমার? নিনীকা! তুমি যখন জন্ম নিয়েছিলে তখন আকাশে চাঁদ উঠেনি। তারাগুলো ছুটি নিয়েছিল মনে হয়। আমার ননীর পুতুলের আগমনে তারা খুশি হয়নি। যেমনটা খুশি হইনি আমি। তোমাকে তো বড় হলে কোনো না কোনো পুরুষের সাথে জড়িয়ে দিতে হতো মা। বাবা তা কি করে পারতাম? বাবার প্রতি খুব ক্ষোভ না তোমার? বাবা যা করেছি তোমার ভালোর জন্যে করেছি মা। করেছি বলেই তো তুমি পুরুষদের থেকে দূরে দূরে থাকো। বাবা তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে মা। বাবাকে ক্ষমা করো।’
রমজান শেখ উঠে দাঁড়ালেন। বিরবির করতে করতে বিছানায় বসলেন। ড্রিম লাইটের আলোয় মিথিলার ঘুমন্ত মুখ দেখা যাচ্ছে৷ শরীরে কাপড়ের ছিটেফোঁটা নেই। অঙ্গে রমজান শেখের অত্যাচারের পরিচয় বহন করছেন এই মুহুর্তে। রমজান শেখের ঘৃণ্য পুরুষত্ব জেগে উঠলো। ক্লান্ত, ঘুমন্ত মিথিলার উপর হামলে পড়লেন আবারও। আচমকা আক্রমণে মিথিলা ভয় পেয়ে গেলেন। কিছু বলতে পারলেন না। তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দুঃখের অশ্রু। চোখ বুঝতে বুঝতে দেখে নিলেন তার ও রমজান শেখের প্রথম রাত। বাসর রাত। মানুষটা সেদিন তার হাত ধরেছিল শক্ত করে। বুকে জড়িয়ে বলেছিল, ‘আমার একটি ননীর পুতুল চাই বুঝলে? তাকে আমি-তুমি মিলে ভালো রাখবো। সে হবে আমাদের মেয়ে। নিনীকা শেখ।’
মিথিলা তখন হেসে ফেলেছিলেন।
‘বাসর করার আগেই মেয়ের নাম ঠিক করে ফেললে শেখ বাবু?’
আর কল্পনায় কিছু ভাসলো না। কানে শুধু ভেসে এলো রমজান শেখের বিরবির করে বলা, ‘পুরুষদের আমি ঘৃণা করি।’ কথাটি।
কথার সাথে সাথে মিথিলার কষ্ট বাড়ছে। কিসের রাগ মিটায় লোকটা তার উপর? কিসের এতো ঘৃণা পুরুষদের প্রতি। কেন তার শেখ বাবু বদলে গেলো! তার সুখের সংসারে কার যে কু-নজর লেগেছিল। সবকিছু ধ্বংস করে দিলো। মিথিলা মুখ এগিয়ে আনলেন রমজান শেখের কানের কাছে। ফিসফিস করে বড্ড দুঃখী কন্ঠে বললেন,
‘ভালোবাসারা আজ বুকের ভেতর গুমরে মরে শেখ বাবু। তারা মুক্তি পেতে চায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে চায় আপনার তরে। আপনি কেন বদলে গেলেন শেখ বাবু?’
রমজান শেখ থমকে গেলেন। হুট করে আবেগ বেড়ে গেলো তার। প্রচন্ড ভালোবাসা নিয়ে চুম্বন করলেন স্ত্রীর কপালে। মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললেন,
‘আর কষ্ট দিবো না, সত্যি দিবো না।’
মিথিলা কিছু বললেন না। রাতের কথা সকালে বদলে যাবে। বদলে যাবে তার মানুষটার আচরণ।
*
ভোর ছয়টা। ক্ষিধায় পেট চু চু করছে নিনীকার। সে বিরস মুখে বসে আছে বিছানায়। ধ্রুব ফোন হাতে পায়চারি করছে। তার বউয়ের ক্ষিধে লেগেছে অথচ এই ভোরে কোথাও খাবার নেই। সে কিভাবে খাবার এনে দিবে এখন? নিরব বেটা ফোন ধরছে না। ফাহিম মাহবুব ও ফোন ধরছেন না। সে শেষ আশা নিয়ে ফারিনকে কল করলো। ফারিন রিসিভ করতেই তড়িৎ গতিতে জিজ্ঞেস করলো,
‘তোর কাছে চকোলেট বিস্কুট কিছু একটা হবে? বা চিপস?’
ফারিন ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
‘এই ভোরে ফোন দিয়ে তুমি এসব জিজ্ঞেস করছো আমাকে? তুমি কি ক্ষুধার্ত ভাইয়া? ক্যাম্পে খাবার সংকট নাকি তোমার ওই অফিসার একাই সব খেয়ে ফেলেছে?’
ধ্রুব বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,
‘আমাকে বলতে দিবি তুই?’
ফারিন সিরিয়াস হলো,
‘বলো শুনছি।’
‘যে হোটেলে আছিস সেটার বাম দিকের শেষের রুমটাতে যতো চিপস, চকোলেট, বিস্কুট আছে সব নিয়ে এখনই আয়।’
ফারিন ঘোরের মধ্যে আচ্ছা বললো। কিন্তু মস্তিষ্কে চাপ পড়তেই বিস্মিত হলো।
‘তুমি হোটেলে! ও মাই গুডনেস ব্রো। মাম্মা পাপা জানে এটা? মাই গড তুমি ও আমাদের ট্রিপে জয়েন করবা বলোনি তো। আমি আরও আফসোস করছিলাম আমার ভাইটা ট্রিপটা মিস করে যাচ্ছে বলে।’
ধ্রুব ধমক দিলো,
‘একদম চুপ। মা বাবা কাউকে কিছু বলবি না। নিঃশব্দে এসে সব দিয়ে যা। এলেই দেখতে পাবি ট্রিপে জয়েন করতে এসেছি নাকি হানিমুন করতে এসেছি।’
ফারিন চুপসে গেলো। ভাই রেগে গেছে তার মানে সিরিয়াস কিছু। সে আসছি বলে ফোন রাখলো। মনে মনে ভাবলো ভাই নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত। সাথে যদি তার ওই নিরব ফিরব থাকে তো সেও নিশ্চয়ই ক্ষুধার্তই হবে। সে নিজের কাছে থাকা সব নিয়ে নিলো। বেলা গড়ালে আবার না-হয় কিনে ফেলবে।
বাম দিকের শেষের রুমটাতে যখন সে টুকা দিলো তখন দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বের করলো ধ্রুব। ভাইকে দেখে ফারিন উচ্ছাসে মৃদু জোরে চিৎকার করলো। ধ্রুব টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ফারিন বিছানায় মাম্মামের সাথে ঝগড়া করা মেয়েটিকে দেখে চোখ বড়বড় করে ফেললো। চিৎকার করলো উচ্চস্বরে,
‘ও মাই গড ব্রো তার মানে সেই ছেলেটা তুমি ছিলে। আমার আগেই মনে হচ্ছিল মেয়েটাকে টেনে নিয়ে আসা ছেলেটা তোমার মতো কিছু টা।’
ধ্রুব ওর মুখ চেপে ধরলো।
‘ মেয়েটা তোর ভাবী হয়।’
ফারিনের চোখ বড়বড় হলো। সে চিৎকার করতে চাইলো প্রাণপণে। ধ্রুব হেসে ফেললো,
‘মুখ থেকে হাত সরাবো তার আগে বল চিৎকার করবি না।’
ফারিন মাথা নাড়াতে লাগলো। ধ্রুব হাত সরিয়ে বলল,
‘আস্তে নাড়া খুলে পড়ে যাবে।’
ফারিনের হাত থেকে সব নিয়ে রাখলো বিছানায়। নিনীকার চোখ লেগে এসেছিল। ফারিনের চিৎকারে চোখ মেলেছে সে। কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। ধ্রুব ওকে ইশারা করে বলল,
‘আপাতত এগুলো ছাড়া আর কিছুর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় মিসেস। খেয়ে নাও।’
নিনীকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চিপসের একটি প্যাকেট হাতে তুলে নিলো। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলো চিপসের প্যাকেট এর দিকে। চোখে ভাসলো ছোটবেলার একটি ঘটে যাওয়া দৃশ্য।
রমজান শেখ থাপ্পড় মেরে চিপসের প্যাকেট কেঁড়ে নিয়ে চিৎকার করে বলছেন,
‘আজ থেকে চিপস খাবে না।’
নিনীকা ফুপিয়ে কাঁদছে,
‘চিপস খেতে ভালোবাসি বাবা।’
রমজান শেখ শুনলেন না। সেদিন থেকে জেদে রাগে নিনীকা চিপস খায়নি। আজ সামর্থ্য থাকলেও তার খেতে ইচ্ছে করে না। অথচ এক সময় ভাবতো নিজের টাকা হলে বাবাকে দেখিয়ে ট্রাক ভরে চিপস নিয়ে আসবে। পাড়া-মহল্লার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে বলবে, ‘আমার নিজের ইনকাম করা টাকা দিয়ে প্রথম চিপস কিনেছি। দোয়া করবেন যাতে ভবিষ্যতে আরও ট্রাক ভরে চিপস কিনে আপনাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারি।’
(চলবে)