#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৯
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
( অনুমতি ছাড়া কঠোরভাবে কপি নিষিদ্ধ।)
বেলা হতেই সোনালি রোদ উঁকি দিলো দার্জিলিংয়ের আকাশে। পাহাড় পর্বত গাঢ় সবুজ। আকাশে শুভ্র মেঘ জমে আছে। নীল-সাদা আকাশ সোনালী রোদে ঝলমল করছে। সুমিত্রা ও তার দুজন ক্লাসমেইট বসে আছে বিছানায়। তখনই দরজা ঠেলে ঢুকলো নিনীকা। চোখমুখে মারাত্মক বিরক্তি। সুমিত্রা ঢুক গিললো। নিনীকা শান্ত কন্ঠে শুধু বলল,
‘তুই এটা একদমই ঠিক করিস নি সুমিত্রা। আমি তোকে ক্ষমা করবো না।’
‘নিনীকা ইয়ার..’
নিনীকা হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো।
‘তোর কোনো এক্সকিউজ আমি শুনতে চাই না। তুই যা করেছিস তার জন্য তোকে আমার কি কি যে করতে ইচ্ছে করছে তা তুই চিন্তা ও করতে পারবি না। কিন্তু আমি দমে গেছি। অসময়ে তোর সাহায্য পেয়েছি। কিন্তু সে-ই তুই-ই আমাকে যেটা থেকে বের করতে সাহায্য করলি সেটাতেই ঠেলে দিতে দু’বার ভাবলি না। কেন এমন করলি সুমিত্রা? এই তোর বন্ধুত্ব? এটা আমার জন্য তোর গুরুত্ব? এই দিলি প্রতিদান?’
সুমিত্রা কেঁদে ফেললো,
‘বিশ্বাস কর ইয়ার আমি তোর খারাপ চাই না। আমি সবকিছু বুঝে তারপরই করেছি। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। প্লিজ নিনী..এক্সপ্লেইন অল।’
নিনীকা শুনলো না। লাগেজ নিজের হাতে নিয়ে বলল,
‘তাকে আমার ড্রেসও তুই দিয়েছিস। কতো কি করলি। কিন্তু হাহ্, তোদের এসব প্লান সাকসেস হবে না। দেখ আমি কি করি। তোর এই মুখটা আমাকে দেখাস না। চলি।’
নিনীকা ট্রলি টেনে বেরিয়ে গেলো। সুমিত্রা মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। সে তো নিনীকার ভালোর জন্য সব করেছে। নিনীকাকে কষ্টে দেখতে চায় না সে। তবে নিনীকা কেন বুঝলো না? সুমিত্রা কিভাবে তার ক্ষতি হতে পারে এমন কিছু করতে পারে? কিভাবে ভাবলো এটা নিনীকা! এই চিনলো সুমিত্রাকে!
নিনীকা উদভ্রান্তের মতো ট্রলি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গেইটের বাহিরে এক পা রাখার আগেই পেছন থেকে হুংকার ছুড়লো ধ্রুব।
‘এক পাও বাহিরে রাখবে না মিসেস। যেভাবে গেইটের বাহিরে যাওয়ার দুঃসাহস করে হেঁটে গেছো, সেভাবেই হেঁটে পেছনে সরে এসো। নইলে খুবই খারাপ হয়ে যাবে।’
নিনীকা পেছনে ঘুরলো না।
‘কি খারাপ করবেন আপনি আমার? কি-ই বা করতে পারবেন আপনি?’
‘নিনীকা! তুমি যদি আর এক পা বাহিরে রেখেছো তবে এখন এই মুহুর্ত থেকে তুমি আর কখনোই আমাকে দেখতে পাবে না। আমি দেখতে দিবো না।’
নিনীকা বলতে চাইলো,
‘আপনাকে না দেখলে আমি মারা যাবো না।’
কিন্তু বলতে পারলো না। গলার কাছে এসে আঁটকে গেলো। এক পা এক পা করে পিছিয়ে গিয়ে পিঠ লেগে গেলো ধ্রুবের বুকে। ধ্রুব ট্রলি নিজের হাতে নিয়ে নিলো। আরেক হাতে জড়িয়ে ধরলো কোমড়। নিজের বুক করা রুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
‘যেটা পারবে না সেটা করতে যা-ও কেন বলো তো মিসেস?’
‘পারবো না কেন? একশোবার পারবো।’
ধ্রুব ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো,
‘ তুমি পারবে না মিসেস। এক রাত স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছো। প্রেমে তুমি পড়েছো নিশ্চিত। ‘
নিনীকা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে। মনে মনে কিছু কঠিন কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাতে করে ধ্রুব ভাবে তার ভাবনাগুলো মিথ্যা। নিনীকা শেখ কখনো প্রেমে পড়তে পারেনা।
কিন্তু আবারও তা গলায় এসে আঁটকে গেলো। সকালে ধ্রুবের মলিন মুখটা বার-বার চোখে ভাসছে। তার কঠিন কথায় মানুষটা কিরকম আঘাত পেয়েছিলো। নিনীকার নিজের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো। সে কেন এসব ভাবছে? কেন ভাবছে সে। তার তো এখন ধ্রুবকে কিছু কঠিন কথা বলা উচিত। সে পারছে না কেন, কেন পারছে না!
ধ্রুব তাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও হাঁটু গেঁড়ে বসলো। নিনীকার দু’হাত মুঠোয় নিলো।
‘তার কোনো দোষ নেই। সে তোমার বন্ধু, তোমার ভালো চেয়েই সব করেছে। তুমি তাকে হার্ট করে কথা বলেছো। যখন নিজের ভুল বুঝতে পারবে, তখন স্যরি বলে দিও কেমন?’
নিনীকা অবুঝ হলো কি? বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। ধ্রুব গালে হাত ডুবালো,
‘তুমি কেন পালিয়ে এসেছিলে নিনীকা?’
নিনীকা অবাক হয়ে বলল,
‘সুমিত্রা আপনাকে বলেনি?’
‘না নিনীকা, সে তোমার বন্ধু। তুমি বিশ্বাস করে তাকে বলেছো, সে কেন আমাকে বলবে?’
নিনীকা অনুতপ্ত হলো, সুমিত্রাকে বেশি বেশিই বলে ফেলেছে সে। ধ্রুবের উদ্দেশ্যে বলল,
‘সেটা আমি আপনাকে জানাতে চাই না। লিভ মি।’
‘তোমার নিষ্ঠুর রুপ অনেক কষ্টের মিসেস। তুমি রুড হয়ে গেছো, তার মানে সত্যিই কোনো কারণ আছে যা আমি জানি না। বলো মিসেস, কি জন্য এমন করলে?’
নিনীকা জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। ধ্রুব তাকিয়ে দেখছে তার বউ কিভাবে ফুসফুস করছে। যেকোনো সময় হামলে পড়বে ভাব। ঢুক গিললো সে,
‘বলতে হবে না। শান্ত হও। যখন তোমার মনে হবে আমাকে তুমি নির্দ্বিধায় সব বলে দিতে পারবে, তখনই বরং বলে দিও। কেমন?’
নিনীকা ঘাড় কাত করে সায় জানালো। ধীরে ধীরে সে ঠিক হয়ে গেলো। ধ্রুব ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো,
‘তোমার শ্বাশুড়ি স’পরিবারে দার্জিলিংয়ে আসছেন নিনীকা।’
নিনীকার ভ্রু কুঁচকে গেলো।
‘তাতে আমার কি? তিনি নিশ্চয়ই পালিয়ে আসা বউকে আদর যত্ন করতে আসবেন না?’
ধ্রুব হেসে ফেললো,
‘তিনি জানেন তার ছেলে সিঙ্গেল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুতরাং পালিয়ে আসা বউকে আদর যত্ন করতে আসার কোনো কারণ নেই। তিনি জানেন না তার ছেলে বিবাহিত।’
‘ছেলে বিয়ে করেছে মা জানবে না কেন? মজা নিচ্ছেন? ভাবছেন আপনার মায়ের সামনে উপস্থিত করে অপমান করাবেন?’
‘তুমি চার লাইন বেশি বুঝো কেন? সে বিদেশে ছিল আমার বোনকে নিয়ে। মামারা বিদেশে সেটেল্ড। সেজন্য বিয়ের ব্যাপারটা সে জানে না। বাবা কাউকে জানাননি। তিনি চেয়ে ছিলেন তোমার আমার বিয়েটা তোমাদের বাড়িতে ঘরোয়া ভাবে হয়ে যাবে। তারপর মা এলে তাকে জানিয়ে অনুষ্ঠান করা হবে। আসলে আমারও তখন বিয়ের ইচ্ছে ছিল না। এক প্রকার বাবা জোর করাতে কবুল বলেছি।’
‘ওহ।’
‘আমার নানু বাড়ি কিন্তু ইন্ডিয়াতে নিনীকা। তুমি জানো, আমার জন্মও ইন্ডিয়াতে নানু বাড়িতে। ‘
নিনীকা চুপ করে শুনছে। ধ্রুব বলতে লাগলো,
‘আমার মা ইন্ডিয়াতেই বড় হয়েছেন। সেজন্য ইন্ডিয়ার প্রতি টান বেশি তার। প্রতি বছরই ঘুরতে আসেন। মা বাবার প্রেমটা কিন্তু ইন্ডিয়াতেই হয়েছিল জানো? তারপর বাংলাদেশ টু ইন্ডিয়া বিয়ে। নানা মশাই মারা যাওয়ার পর মামারা বিদেশে সেটেল্ড হয়ে গেছেন। মা সেখানে মাঝে মধ্যে যান মা ভাইকে দেখতে। তারাও বাংলাদেশে আসেন মাঝে মধ্যে।’
‘ভালো তো।’
‘তুমি জানো? আমার..
‘না বললে জানবো কিভাবে?’
ধ্রুব চোখ পাকালো,
‘চুপচাপ শুনবে।’
নিনীকা মাথা নাড়ালো।
‘আমার নানু সেনাবাহিনীর জব করতেন। বাবাকে তিনি পছন্দ করতেন অনেক। সীমান্তে তাদের আলাপ হয়। বাবা নানু বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন মাঝে মধ্যে। তারপরই মাকে তার ভালো লাগে। প্রেম হয় দুজনের। কিন্তু বিয়েটা করতে অনেক কষ্ট করতে হয়। আমার নানু মেয়েকে এতো দূর বিয়ে দিতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু মায়ের পাগলামির জন্য রাজি হতে হয় শেষে।’
‘তারপর?’
‘তারপর ব্যস। তাদের বিয়ে হয়। আমি জন্ম নেই। আমার যখন বারো বছর তখন আমার একটি বোন জন্ম নেয়। নাম ফারিন, তুমি দেখোনি তাকে। তবে আজ দেখাবো।’
নিনীকা উঠে দাড়ালো। দরজা ঠেলে যেতে যেতে বলল,
‘আসেপাশে ঘুরে আসছি।’
ধ্রুব চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার একটু ঘুমঘুম পাচ্ছে। এ রমনীকে সে পরে দেখে নিবে। ধ্রুবের ঘুমটা দীর্ঘ হলো। বেলা গড়িয়ে বিকেল হলো।
নিনীকা তখন হোটেলের দিকে ফিরে আসছে। পড়োনে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত একটি স্কার্ট ও টি-শার্ট। পায়ে সাদা কেডস। মাথার টুপি টা হাতে। সে যখন রোদের তাপ থেকে বাঁচতে হোটেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন হোটেলের গেইটের কাছে এসে থামে একটি টেক্সি। নিনীকা একটু পিছিয়ে যায়। তার হাঁটার গতি ধীর ছিল নাহলে সে এতোক্ষণে টেক্সির নিচে চাপা পড়তো। গাড়ি থেকে নামলেন স্কার্ট, শার্ট ও গলায় ওড়না পেছানো একজন মধ্যবয়সী মহিলা। তার পায়েও কেডস। ঠোঁটে লিপস্টিকের আস্তরণ। চোখে রোদচশমা। মহিলাটির বয়স বোঝা দুষ্কর। তবে তাকে দেখতে একদমই মন্দ লাগছে না। নিনীকা বুঝলো তিনি তার মতোই ঘুরতে এসেছেন। সে যখন টেক্সিকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে তখনই মহিলাটি তাকে ডাকলেন। সে এগিয়ে এসে দাড়ালো। মহিলাটি ঠোঁট নাড়ালেন,
‘শুনো মেয়ে এখানে সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ হোটেলের নাম বলতে পারবে?’
নিনীকা না করলো। সে প্রথমবার এসেছে কিছুই জানে না চিনে না। মহিলাটির তার উত্তর পছন্দ হলো না।
‘জানো না কেন? তুমি জানো এখানকার সবচেয়ে ভালো হলো মাউন্টেন ভিউ রুম।’
নিনীকা বলল,
‘আপনি নিজে যখন জানেন তবে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
‘তুমি তো ভারী বেয়াদব।’
নিনীকা চোখমুখ কুঁচকে তাকালো,
‘আপনি আজাইরা প্রশ্ন করে এ রোদের মধ্যে আমাকে শুধু শুধু দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।’
মহিলা রেগে বোম হয়ে গেলেন। তখন গাড়ির পেছন থেকে ব্যাগপত্র বের করে এসে দাড়িয়েছেন একজন পুরুষ। নিজের বউকে ফুসফুস করতে দেখে চমকে গেলেন। আরও চমকালেন সামনে দাড়ানো মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটা এখানে কি করছে!
(চলবে)