#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
বাংলাদেশের সময় রাত আটটা। ধারা ও ফারিন ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত। ফাহিম মাহবুব খাটে বসে স্ত্রী ও কন্যার কান্ড দেখছেন। মনে মনে বিরবির করে বলছেন,
‘ তোমার আর বউকে নিয়ে লুকিয়ে হানিমুন করা হলো না বাবা। তোমার মা বোন আসছে, পরিবার নিয়ে মুন দেখতে প্রস্তুত হও। ‘
ধারা মাঝে মধ্যে শাড়ি দেখাচ্ছেন।
‘ এটা নেই বলো? এটাতে দার্জিলিংয়ের সাথে ছবি সুন্দর আসবে। আচ্ছা এটা নিবো? ‘
ফাহিম মাহবুবের কাজ হলো মাথা নাড়িয়ে সাই দেওয়া। যদি একবার ভুলবশত মুখ থেকে না বেরিয়েছে তবে তার খবর করে দিবে ধারা আহমেদ। আগামীকাল তারা পথ ধরবেন ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে।
–
বয়স হলেও চেহারা দেখে তাকে যথেষ্ট ইয়াং মনে হয়। রমজান শেখ বিদেশি কৃত্রিম জিনিস ব্যবহার করে নিজের হ্যান্ডসাম লুক ধরে রেখেছেন। এই বয়সে এসেও জেন্স পার্লারে তার আনাগোনা প্রতিনিয়ত। একজন পুরুষ নিজের সৌন্দর্যের বিষয়ে এতো পজেসিভ সেটা হয়তো রমজান শেখ কে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। মাথার ঘন চুলগুলো ও কালো। মুখে চাপদাড়ি। এ বয়সেও তিনি অসংখ্য অল্প বয়সী মেয়েদের প্রপোজ পান৷ তবে তার একটি বিশেষ গুণ হলো তিনি কখনোই সেগুলোতে সিরিয়াস হোন না। প্রত্যাখ্যান করেন তৎক্ষনাৎ। সাথে কমন ডায়লগ ‘আমি তোমার বাবার বয়সী মেয়ে। তোমার বয়সী আমার একটি মেয়েও আছে, বলে কেটে পড়েন।’
এই একটি মানুষের বহুরুপ। স্ত্রীর সামনে নিজেকে চরিত্রহীন প্রমাণ করা যেন তার অভ্যাস। সেজন্য অসংখ্য বার স্ত্রীর সামনে দিয়ে কতশত রমনীকে রুম অব্দি নিয়ে গেছেন। তার স্ত্রী বিশ্বাসও করেছেন যে তিনি একাধিক নারীর কাছে যান। অথচ রমজান শেখ আত্নবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারবেন, ‘ প্রেম, বিয়ে তিনি যেমন একবারই করেছেন। তেমনই এক নারীকে ছাড়া তিনি কখনো দ্বিতীয় কাউকে ছুয়ে দেখেননি। ‘
পৃথিবীটা রহস্যময়। রহস্যময় এই পৃথিবীতে বাস করে রহস্যময় মস্তিষ্কের মানুষ৷ মানুষেরা আজকাল রহস্য করতে ভালোবাসে। রমজান শেখ নিজেকে রহস্যময় চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। পৃথিবী ঠিক কখন কিভাবে তার রহস্য উন্মোচন করবে তা তিনি নিজেও জানেন না৷
সকাল সাড়ে সাতটা। রমজান শেখ নাস্তার টেবিলে খেতে বসেছেন। মিথিলা মাথা নিচু করে প্লেটে নাস্তা তুলে দিচ্ছেন। রমজান শেখ খেতে খেতে লক্ষ্য করলেন স্ত্রীর গলার ভাঁজে একটি লাল হয়ে যাওয়া ব্রাইট। তার মুখে কৌতুকের হাসি। মিথিলা সেটা দেখে বিচলিত হলেন। রমজান শেখ এক হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করলেন,
‘ শেষ বয়স পর্যন্ত স্বামীর সোহাগের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকো দোয়া করছি। ‘
মিথিলা কিছু বললেন না। আবারও বললেন রমজান,
‘ তোমার চুলে একটা-দুইটা সাদা চুল দেখা যাচ্ছে। বাড়িতে পার্লারের লোক চলে আসবে, সব ঠিকঠাক করে নিও। ‘
মিথিলা নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ালেন।
–
ননীর পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটিকে ঠিক কতক্ষণ ধরে দেখে যাচ্ছে সেদিকে হুস নেই ধ্রুবের৷ তার শুধু মনে আছে তার একটি নির্ঘুম রাত কেটে গেছে বুকে শুয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে। ধ্রুবের পুরো জীবনে যৌবনে এতো কাছে কোনো মেয়ে আসেনি। এটাই প্রথম৷ তার ভাবনার মধ্যে ননীর পুতুল মেয়েটি কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠলো। সে মাথায় আঙুল ডুবিয়ে দিলো। মেয়েটি পরম শান্তিতে ঘুমাতে লাগলো৷ ধ্রুব এই ফাঁকে নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত৷ মেয়েটি জেগে থাকলে ধ্রুবের থেকে দূরে দূরে থাকে৷ যা ধ্রুবের একদম পছন্দ না। বউ তার, বুক তার। বউ কেন তার বুকে মাথা না রেখে দূরে দূরে থাকবে?’
ধ্রুবের ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার মুঠোফোন বার্তা আসার শব্দ হলো। সে তৎকালীন সেটা অন করলো৷ তার নিরীহ বাবা লিখেছেন,
‘তোমার মা-বোন ব্যাগপত্র গুছিয়ে আজ দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করছেন। আমি চেষ্টা করেছি আটকাতে তবে ব্যার্থ৷ সাবধানে থেকো৷ ধরা পড়ে যেতে পারি বাপ-ছেলে। ‘
ধ্রুব সেন্ট করলো,
‘ ধরা পড়বো কেন? আমি কি চুরি করেছি? বিয়ে করেছি, বউকে নিতে এসেছি। মা জেনে গেলে আরও ভালো। আমার বউকে শীগ্রই ঘরে তুলার ব্যবস্থা করবেন তিনি। ‘
ফাহিম মাহবুব একটি কাঁদার ইমোজি দিলেন। লিখলেন,
‘আর আমার উপর দিয়ে যে বন্যা, সাইক্লোন, খরা যাবে তার দায়িত্ব কে নিবে বাবা? ‘
ধ্রুব রিপ্লাই দিলো না। বরং মনোযোগ দিলো ননীর পুতুলকে দেখতে। মা কেন পৃথিবী জানুক নিনীকা শেখ নামক রমনীটি তার বউ, মেজর ধ্রুব মাহবুব এর মিসেস।
নিনীকা ফট করে চোখ মেলে তাকালো। ধ্রুবের নজর তার দিকেই। এলোমেলো অগোছালো চুলগুলো ধ্রুবের বুকে লেপটানো। কিছুটা আটকে আছে শার্টের বোতামে। নিনীকা সেটা খেয়াল করলো না। উঠে বসতে গিয়ে চুলে ব্যাথা পেলো। পুনরায় শুয়ে পড়লো বক্ষে। ধ্রুব গম্ভীর স্বরে বলল,
‘এতো তাড়াহুড়ো কিসের? সবে তো আটটা বাজে। আরেকটু থাকো। দশটার পর উঠে একসাথে ফ্রেশ হয়ে খাবো। ‘
নিনীকা প্রচন্ড জোরে চুল টেনে ছাড়িয়ে নিলো। কিছু চুল ছিঁড়ে আটকে গেছে ধ্রুবের বোতামে। সে ওয়াশরুমের দরজা শব্দ করে বন্ধ করে দিলো। ধ্রুব রেগে উঠে বসলো। শার্টের বোতাম থেকে চুলগুলো না ছুটিয়ে শার্ট টাই খুলে ছুঁড়ে ফেললো বিছানার একপাশে। খাট থেকে নেমে দ্রুত গতিতে এসে দাড়ালো ওয়াশরুমের দরজার সামনে। প্রায় চিৎকার করলো,
‘তোমার সাহস কি করে হয় আমার বউয়ের চুল ছিঁড়ার? বের হও স্টুপিট মেয়ে তোমাকে আমি চেপ্টা করে ছাড়বো। বের হও বলছি। ‘
নিনীকার মুখে ব্রাশ। কুলি করে সে আস্তে করে বলল,
‘আমার চুল আমি যা ইচ্ছে করবো আপনার কি? ‘
‘তোমার চুল হলেও তা তোমার নয়। তোমার সবকিছু আমার, আমার বউয়ের চুল ছিঁড়ার দুঃসাহস করার অপরাধে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। বের হও এক্ষুনি। ‘
বিরক্তিতে নিনীকার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে তবেই দরজা খুলে বের হলো। ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ধ্রুব হাত টেনে ধরলো শক্ত করে। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলল,
‘ বেশি করে ফেলছো না? আমি তোমার কে হই ভুলে যাও কেন? ‘
নিনীকা পূর্ণ চাহনিতে তাকালো,
‘ আপনারা পুরুষেরা নারীদের কি জড়বস্তু মনে করেন? পুতুল মনে হয় নারীদের? আপনাদের যা ইচ্ছে তাই করাবেন? নারীদের কোনো ইচ্ছে থাকতে পারে না? ‘
ধ্রুব এক মুহুর্ত থমকালো। নিনীকা বলতে লাগলো,
‘ কথা বলছেন না কেন? উত্তর নেই? ‘
ধ্রুব কেমন করে যেন তাকালো।
‘তুমি ভুল বুঝছো। আমি তোমাকে একদমই পুতুল মনে করছি না। তবে তুমি সত্যিই ননীর পুতুল। তবে সেটা ভালোবাসার। আমি কখনোই তোমাকে জড়বস্তু বানাতে চাই না। আমি যেমন তোমার উপর অধিকার দেখাই, তেমনই তুমিও আমার উপর অধিকার দেখাবে। ভালোবাসার অধিকার। আমি তোমার স্বামী নিনীকা।’
‘আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না মিস্টার মেজর। অধিকার দেখানোর কথা তবে কেন আসছে?’
চির সত্য। সত্যি কথাটা হজম করতে ধ্রুবের বড্ড কষ্ট হলো। আঘাত পেলো মনে। কিন্তু মুখ স্বাভাবিক রাখলো।
‘ আজ ভালোবাসো না কাল যে বাসবে না সেরকম কোনো সত্য নেই। মনে রেখো তোমার আমার সম্পর্ক পবিত্র। পবিত্র সম্পর্কে ভালোবাসতে হয় না। ভালোবাসাটা হয়ে যায়৷ তুমি কিভাবে কখন আমাকে ভালোবেসে ফেলবে তুমি নিজেও বুঝতে পারবে না। দেখে নিও। এই মিস্টার মেজর তোমাকে বলছে। ‘
নিনীকা চুপ করে বিছানায় বসে রইলো। ধ্রুব ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গিয়ে খাবার নিয়ে এলো। ইচ্ছে ছিল দুজন একসাথে বেরিয়ে যাবে। তারপর নাস্তা করবে। কিন্তু নিনীকা তার মুডটা নষ্ট করে দিলো। মেয়েটাকে সে কিভাবে বুঝাবে সে ভালোবাসতে শুরু করেছে!’
(চলবে)