#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
দুপুরের হওয়া ঝিরঝিরি বৃষ্টিতে দার্জিলিংয়ের শুকনো মাটি কাদা হয়ে গেছে। তার উপর দিয়ে স্কার্টের দু’দিক উঁচু করে দৌড়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে। নাম তার নিনীকা। ধ্রুব মাহবুব এর ননীর পুতুল।
মেয়েটি কাদায় পা পিছলে ধপাস করে পড়ে গেলো। চোখমুখ খিঁচে ব্যথা সহ্য করলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো কিছু মিনিট আগেই ‘শালা’ বলে সম্মোধন করা তার বর কাছাকাছি চলে এসেছে। নিনীকা তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। বরং হুমড়ি খেয়ে আরেকটু সামনে জমে থাকা পানি যুক্ত কাদামাটিতে পড়লো। সুন্দর মুখটি কাঁদা পানিতে ঢেকে গেলো। ততোক্ষণে এগিয়ে এসেছে তার বরটি। হাতে নিনীকার স্মার্টফোন। যেটা কিছুক্ষণ আগে কেঁড়ে নিয়েছিলো। নিনীকার বর মশাই ডেনিম প্যান্টের পকেটে সেটা রাখলো। চুলে ঢেকে যাওয়া চোখমুখ, তবুও সে পিটপিট করে দেখলো একজোড়া কালো শার্ট পড়া হাত তাকে টেনে নিজের কোলে তুলে নিয়েছে।
নিনীকা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। আকাশ থেকে বজ্রপাত ধরনীতে নামুক। পৃথিবী থমকে যাক। সে অজ্ঞান হয়ে যাক। এসব মিথ্যা হোক।
ভাবনার মাঝে নিজের মুখের উপর গরম নিঃশ্বাস অনুভব করলো সে। পুরুষটি ফিসফিস করে বলল,
‘ বরকে শালা হনুমান বলে পালাতে চাইলে এমনি হবে মিসেস। স্বামী সোহাগি হও, তা না পালিয়ে বেড়াচ্ছো! মেজর ধ্রুব মাহবুবকে চিট করার অপরাধে তোমাকে আমৃত্যু দন্ডে দণ্ডিত করলাম। তুমি চাও বা না চাও সারাজীবন তোমাকে ধ্রুব মাহবুব এর বুকেই মাথা রাখতে হবে। আজ থেকে বিছানার বালিশ তোমার জন্য নিষিদ্ধ করলাম। ‘
নিনীকার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে তবুও চোখ মেললো না। ধ্রুব ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে হোটেলে বুক করা রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। রিসিপশনে পা রাখতেই বিকালের সেই রিসেপশনিস্টকে দেখতে পাওয়া গেলো। সে এদিকেই তাকিয়ে আছে। ধ্রুব যখন রিসিপশন পেরিয়ে যাবে তখন সে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
‘মেজর সাব এ কোন হে? আপকি বিবি?’
ধ্রুব যেতে যেতে উত্তর দিলো,
‘ হ্যাঁ হামারি মিসেস। ‘
ধ্রুব রুমের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। নিনীকাকে সোজা ওয়াশরুমে নামিয়ে দিলো। নিনীকা দেয়াল ঘেষে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। চুলে চোখমুখ ঢেকে রেখেছে। ধ্রুব যত্ন করে চুল কানে গুঁজে দিলো। গালে হাত রেখে বলল,
‘ ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমার জামাকাপড় এনে দিচ্ছি। ‘
ধ্রুব এক মিনিটের মাথায় এনে দিলো। বেরিয়ে যেতেই নিনীকা শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ধ্রুব ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তার মিসেসের সংস্পর্শে আসার পর থেকে সে শুধু হেসে যাচ্ছে। হয়তো তার উপস্থিতি ধ্রুবর ভালো লাগছে। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা হতেও সময় নিবে না। পবিত্র সম্পর্ক তাদের। নিনীকা শেখ কে সে নিজের প্রতি দূর্বল করেই ছাড়বে। তখন দেখবে কিভাবে বর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
বিশ মিনিট পর নিনীকা নিজের দিকে চোখ রেখে বের হলো। ধ্রুব দাড়িয়ে তখনো। নিনীকার হাত টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। গালে হাত ডুবিয়ে অপলক তাকিয়ে তাকলো।
‘তাকাবে না? দেখবে না আমায় মিসেস?’
নিনীকা তাকাচ্ছে না। ধ্রুব মন খারাপ করলো,
‘ বাবার কথাই কি তবে সত্যি? তুমি আমাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছো? ‘
নিনীকা এবার চোখ তুলে তাকালো। ধ্রুব উত্তরের আশায় নিজেও তাকিয়ে আছে। কিন্তু নিনীকা কিছু বলছে না। শুধু তাকিয়ে আছে। হয়তো নিজের বিয়ে করা বরকে দেখছে। যাকে না দেখে সে পালিয়ে এসেছিল। সময় অতিক্রম হলো। নিনীকা প্রায় চার মিনিট পর মুখ খুললো,
‘ চেহারা আপনার মাশাআল্লাহ৷ ভয় নয় আপনাকে দেখলে প্রেমে পড়া যায়৷ কিন্তু আমি তো আপনাকে দেখিই-নি। সুতরাং আপনাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছি সেরকম কোনো কারণ নেই। আপনার বাবার বলা কথাটি অবান্তর। ‘
কি সুন্দর! গোছানো কথা। ধ্রুব মুগ্ধ হয়ে শুনলো। তার বউ মিষ্টি করে গুছিয়ে কথা বলে। অথচ তখন বরের কথা জিজ্ঞেস করায় কি না কি বলেছিলো। হয়তো বেচারি ভাবতেই পারেনি সামনে দাঁড়ানো পুরুষটা তার নিজেরই বর হবে।
‘ তাহলে কিসের জন্য পালিয়ে এসেছিলে? তা-ও বিয়ে করে! ‘
‘ আপনাকে বলতে বাধ্য নই। ‘
মুখের উপর জবাব পেয়ে ধ্রুবের চোয়াল কঠিন হলো। নিনীকা পুনরায় বলল,
‘ আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন? কেন এসেছেন? আপনার সাথে সংসার করার ইচ্ছে থাকলে আমি তো পালাতাম না। সুন্দর চেহারা হ্যান্ডসাম আছেন, মেয়ের অভাব হবে না। অন্য কাউকে দেখে বিয়ে করে নিতেন। ‘
ধ্রুব চোখমুখ শক্ত করে কথা হজম করলো। নিনীকা বেরিয়ে যেতে চাইলে ধ্রুব হাত আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। শক্ত কন্ঠে বলল,
‘অনেক বলে ফেলেছো। খেয়ে ঘুম দিবে আমার সাথে। কথা বলতেও এনার্জি প্রয়োজন। বাকিটা ঘুম থেকে উঠে রিলাক্স হয়ে বলবে। যদি কিছু ভুলে যাও আমি মনে করিয়ে দিবো না-হয় মিসেস।’
নিনীকা রাগে ফুসফুস করতে লাগলো।
‘আপনি কেন বুঝতে পারছেনা না?’
‘কি বুঝাতে চাও তুমি মিসেস?’
‘আমি..আমি চাইছি না আপনাকে। ইনফেক্ট কাউকেই না। আমি যদি কাউকে লাইফে চাইতাম তবে সেদিন বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও পালিয়ে আসতাম না।’
ধ্রুব ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দিলো। নিনীকা কেঁপে উঠলো। পুরুষালী শক্ত হাতটি তাকে নিয়ে বসালো বিছানায়। ছোট্ট টেবিল থেকে ঢেকে রাখা খাবার হাতে তুলে নিলো। নিনীকা বুঝলো সে যখন ওয়াশরুমে ছিল তখন ধ্রুব খাবারের ব্যবস্থা করেছে। ধ্রুব ভাত মাখিয়ে নিজের বড় হাতের মুঠোয় বড় লোকমা নিনীকার মুখের সামনে ধরলো। নিনীকা চোখ বড়বড় করে বলল,
‘এতো বড় লোকমা আমার মুখ দিয়েই তো ঢুকবে না, খাওয়া তো পরের ব্যাপার।’
ধ্রুব ঠেসেঠুসে ঢুকিয়ে দিলো। নিনীকার গিলতে বড্ড কষ্ট হলো। কথা বলতে না পেরে চোখ দিয়ে শাসাতে চেষ্টা করলো কিঞ্চিৎ। ধ্রুব একের পর এক বড় লোকমা খাইয়ে তবেই থামলো। নিনীকার মনে হলো তার পেট এখনই ফেঁটে যাবে। ধ্রুব ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
‘স্লিম হওয়ার জন্য কম কম খাওয়ার দরকার নেই। তোমার হাসবেন্ড স্লিম থাকলেও তোমাকে ভালোবাসবে, মোটা হলেও তোমাকেই ভালবাসবে মিসেস।’
নিনীকার মাথা ঘুরতে লাগলো। সে কোন জনমে নিজের হাসবেন্ডের কথা ভেবে কম খেয়ে স্লিম হতে চেষ্টা করেছে?’
নিনীকার ভাবনার মধ্যে ধ্রুব হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। নিনীকার পাশে পা তুলে বসলো সাহেব হয়ে। হাতের মুঠোয় হাত নিয়ে বলল,
‘নিয়ম যদি বলি তো আজ আমাদের প্রথম রাত। সেজন্য বাসর রাত ধরে নেওয়া যেতে পারে। তোমার হাসবেন্ড তোমার জন্যে অলওয়েজ রেডি মিসেস। তুমি কি ইন্টারেস্টেড?’
নিনীকার চোখমুখ গরম হয়ে গেলো। এ কেমন নির্লজ্জ স্বামী তার?
ধ্রুব পুনরায় বলল,
‘লজ্জা পাবে না, আমিই তো তোমার লজ্জা ভাঙাবো বলো?’
‘আপনি চুপ করবেন?’
ধ্রুব ঠোঁট উল্টালো,
‘বলছো না কেন?’
নিনীকা মহা’বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আপনি ঘুমিয়ে যেতে পারেন।’
‘ঘুমিয়ে যাবো? ঠিক আছে।’
একটা বালিশ নিজের কোমড়ের নিচে রেখে আরেকটা মাঝামাঝিতে রাখলো সে। শুয়ে বুক পেতে নিনীকাকে ইশারা করলো।
‘বলেছিলাম না তোমার জন্য বালিশ নিষিদ্ধ?’
নিনীকা ঢুক গিললো। এ কেমন জ্বালা? যেটা থেকে সে পালিয়ে বেড়াতে চেষ্টা করলো সেটাই তার সামনে। তাকেও মায়ের মতো স্বামীর সবকিছু মানতে হবে নাকি? নিনীকা পারবে না সেটা। সে প্রতিবাদী মেয়ে। এই শালা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তবে সে এখানকার স্থানীয় পুলিশকে জানাবে। বলবে এ বেটা মেয়ে ধরা।’
ধ্রুব তখনও ইশারা করেই যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ঠোঁট চোকা করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। নিনীকা নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘এমন অশ্লীল ইঙ্গিত দিবেন না। ভালো ছেলেরা এসব দেয় না।’
ধ্রুব নিরীহ চোখে তাকালো,
‘বউয়ের কাছে তো ভালো ছেলে হতে নেই।’
‘কে বলেছে?’
‘ ও মাই গড মিসেস। তুমি জানো না? পৃথিবীর সব চাইতে ভালো ইনোসেন্ট ছেলেটিও বউয়ের কাছে নির্লজ্জ হয়।’
নিনীকা কিছু বললো না। আস্তে করে মাথা রাখলো বক্ষে। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রইলো। মনে মনে বিরবির করলো, ‘ঘুম আয়, ঘুম আয়।’
(চলবে)