#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
অনেক সময় চেনা পরিচিত মানুষ গুলো কোনো কাজে আসে না। আবার অনেক সময় অচেনা অপরিচিত মানুষগুলো ও বিপদে পাশে দাড়ায়। সুমিত্রার সাথে নিনীকার পরিচয় হয় ফেসবুকে। টুকটাক আলাপ চলতে চলতে দুজনের মধ্যে একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন হয়। বুকের ভেতর প্রতিনিয়ত গুমরে মরা নিনীকা নিজের মনমতো বন্ধু পেয়ে শেয়ার করে একের পর এক দুঃখ কষ্টের কথা। সুমিত্রা ও নিজের দিক থেকে অনেক কিছু জানিয়েছে। দুজনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। তাদের বন্ধুত্বের তিন বছর। যে মেয়েটিকে সে সামনাসামনি কখনো দেখেনি, কিন্তু নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছে শতসহস্র লুকনো ব্যথার কথা। যে মেয়েটা তার অসময়ে তাকে সঙ্গ দিতে সবসময়ই থাকে। আগে ছিল ফোনের মাধ্যমে, এখন সামনাসামনি।
দুপুরের তীব্র রোদে চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দুজন খেয়ে বের হয়েছে। উদ্দেশ্য নিনীকাকে আশপাশ একটু ঘুরিয়ে দেখানো। দুজনই লেডিস টিশার্ট ও জিন্স পড়েছে। হাতে হাত রেখে হাঁটছে পথ দিয়ে। তাদের দেখতে কিশোরী লাগছে। মনে হচ্ছে তারা ছোটবেলার বন্ধু, একে অপরের সাথে আছে যুগের পর যুগ। হাঁটতে হাঁটতে অনেকে সুমিত্রাকে প্রশ্ন করেছে, ‘মেয়েটা কে রে সুমিত্রা?’
সুমিত্রার এক উত্তর, ‘আমার সখী।’
তারা একটি দোকান থেকে কোণ আইসক্রিম কিনলো। খেতে খেতে একটি টেক্সিতে চেপে বসলো। উদ্দেশ্য তিস্তা নদী।
শিলিগুড়ি ছোট্ট একটি শহর। শহর থেকে একটুূ দূরে গেলেই পাহাড় দেখা যায়। মন চাইলে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ট্যাক্সি চালিয়ে চলে যাওয়া যায় তিস্তার পাড়ে। তিস্তার পাড়ে গেলে মনে হবে, এই নদীর ওপারে বাংলাদেশও আছে।
নিনীকা সাতকাহনে পড়েছিল বৃষ্টি হলেই তিস্তার পানি বেড়ে যেতো। শিলিগুড়ির ভবনগুলোর একতলা দুইতলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে যেতো। সেই শিলিগুড়ির তিস্তা নদীর পাড়ে দাড়িয়ে আছে সে। এ যেনো এক অবিশ্বাস ঘটনা। সে দেখছে চোখ ভরে, মন ভরে দেখছে। উচ্ছ্বাসে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে সুমিত্রার একটি হাত। সুমিত্রা হাসছে। দুঃখীনি নিনীকাকে এক টুকরো খুশি দিতে পেরে তার আনন্দ হচ্ছে।
নিনীকা দু-হাত দু’দিকে মেলে দিলো। একটু আকটু বাতাস গায়ে লাগছে। সে মনপ্রাণ ভরে শ্বাস টেনে নিলো। মস্তিষ্কে ঝং ধরা ব্যাথারা উধাও হয়ে গেলো। নিনীকা সবকিছু ভুলে তিস্তার অপরুপ প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে চাইলো। কানে ক্লিক করার শব্দ আসতেই সে তাকালো। সুমিত্রা হাসলো,
‘কিছু ছবি তুলে নিলাম তোর। শেষ কবে ফেসবুকের প্রোফাইল চেঞ্জ করেছিস বল তো?’
নিনীকা নিজেও হাসলো,
‘ভালো করেছিস। প্রোফাইল চেঞ্জ করা জরুরি। সাথে ক্যাপশনে লিখতে হবে ‘সাতকাহনের সেই তিস্তা নদী।’
‘জলপাইগুড়িতে তিস্তা নদীর উপর সেতু আছে। একদিন সব ঘুরাবো তোকে।’
তিস্তা নদীতে একটি নৌকা দেখা গেলো। সুমিত্রা ও নিনীকা ভাড়া নিয়ে নিলো সেটা। দুজন উঠে বসলো নৌকাতে। পানিতে ছলাৎছলাৎ শব্দ। মাঝি বৈঠা হাতে অভ্যাসগত ভাবে নৌকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিনীকা পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো। সুমিত্রা আঁতকে উঠলো,
‘পা তুল ইয়ার।’
নিনীকা খিলখিল করে হাসলো। গান ধরলো-
‘তিস্তা নদীর চিকন বালা রে
জলপাই ধরে ঝোকা ঝোকা।
ট্যাকা নাই’ও পয়সা’ও নাই’ও রে
কি দিয়া কিনিম মুই স্বাদের জলপাই?
আইসো বাহে উত্তরবঙ্গের গীত শুনিয়া যাও
তোমরা ভালো বাংলা গানের নামে কি জানি সব খাও
হামার ভাওয়াইয়া গান বাহে একেবারে সেরা সেরা
সরল কথা সুরে সুরে মন হবে দিশাহারা।
পালাটিয়া ভাওয়াইয়া বিয়া বাড়ির গীত
নদী ভাঙ্গন মরার খড়া হাড়কাঁপানো শীত
কইনা কান্দে যৌতুক ফান্দে বরের বাপে হাসে,
চেংড়ির বাপের ঘুম হারাম টাকার সর্বনাশে।
তিস্তা নদীর চিকন বালারে
জলপাই ধরে ঝোকা ঝোকা
হামাক যে না খাবা মনাইছে
স্বাদের পাকা ছেকো জলপাই। ‘
সুমিত্রা মুগ্ধ হলো। মনে মনে প্রার্থনা করল গান গেয়ে চলা মেয়েটির সব দুঃখ মুছে গিয়ে সুখের সূর্য উদয় হোক।
–
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদীর নাম। জন্ম ভারতের সিকিম রাজ্যে ২৩ হাজার ফুট ওপরে হিমালয়ের পাহুনরি হিমবাহ থেকে। তারপর হিমালয় থেকে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উত্তর সিকিম থেকে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার হয়ে বাংলাদেশে পড়েছে। সেই তিস্তা এখনো বইছে। কোথাও উদ্দাম, কোথাও শ্লথ। কোথাও আবার চর। কোথাও আবার দুই কূল দেখা কঠিন।
এই তিস্তা সিকিমের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে নেমেছে দার্জিলিংয়ের সমতল ভূমি সেবকে। তারপর এখান থেকে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার হয়ে বাংলাদেশে। তিস্তার দৈর্ঘ্য ৪১৪ কিমি। তিস্তা চলেছে সিকিমের ১৫১ কিমি, পশ্চিমবঙ্গের ১২৩ কিমি এবং বাংলাদেশের ১২১ কিমি পথ ধরে। এর মধ্যে আবার ১৯ কিমি পথ সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ধরে প্রবাহিত হয়েছে। লাচেন, লাংচু, রোঙ্গিচু, রংপো, রঙ্গিত, লিশ, ঘিশ, চেল, নেওরা ও করলা তিস্তার উল্লেখযোগ্য উপনদী।
হিমালয়ের ৭ হাজার ৬৮ মিটার উচ্চতার কাংসে হিমবাহ থেকে সৃষ্টি এই তিস্তার। এখান থেকে লাচেন চু এবং লাচুং চু নামের দুটি নদীর ধারা সিকিমের চুংথান জনপদে নেমে একটি ধারায় তিস্তা নামে এগোতে থাকে। সেটিই আজকের তিস্তা নদী। তারপর এই ধারা চলে আসে সিকিমের রংপোতে। এখানে রংপো নদী মিশে যায় তিস্তার সঙ্গে। রংপো সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত।
রংপো সীমান্ত পার হয়ে সিকিমে ঢুকতে হয়। ভারতীয়রা নিজস্ব পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঢুকতে পারে। বিদেশিরা বিশেষ অনুমতি ছাড়া ঢুকতে পারে না। এই রংপো থেকে তিস্তা বাজার সেতু পার হয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে সিকিম থেকে দার্জিলিং জেলায় ঢোকে তিস্তা। তিস্তা সেতু থেকে এই নদী দার্জিলিংয়ের সেবকে সমতলে নামে। তিস্তা বাজার সেতু থেকে রংপোর দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। আর শিলিগুড়ির দূরত্ব ৫০ কিমি। আবার সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের দূরত্ব ৬৪ কিমি। এই তিস্তা বাজার সেতু থেকে একটি পথ দার্জিলিং এবং অন্য একটি পথ গ্যাংটক গেছে। তবে এই তিস্তা রাজধানী গ্যাংটক ছুঁয়ে যায়নি। গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি আসতে সিমথনে এই তিস্তা পাহাড়ি পথ ধরে সেবকে নামে। সিমথন থেকে গ্যাংটকের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। সিমথন থেকে এই তিস্তা সেবক হয়ে জলপাইগুড়ি ছুঁয়ে কোচবিহারের পাড় মেখলিগঞ্জের ঝাড় সিংহাসন নামক স্থানে বাংলাদেশে ঢোকে তিস্তা। তারপর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় এসে মিশেছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে।
–
নিনীকা ও সুমিত্রা যখন বাড়ির পথে হাটা ধরলো তখন গোধুলি বিকেল। দুজন ফুচকা খেয়ে নিলো যাওয়ার পথে। বাড়ি যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কাদম্বরী দেবি সুমিত্রাকে ঝাড়লেন অনেক। সেই দুপুরে বেরিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে। সুমিত্রার রুম হতে নিনীকা সব শুনতে পেলো। তার হঠাৎ করেই ভীষণ মন কেমন করলো। তার মা কেমন আছেন বাংলাদেশে?’
–
একদিন পরের ঘটনা। ধারা আহমেদের কথার অবাধ্য হয়ে ধ্রুব প্রথম বারের মতো বাড়িতে এলো না। ধারা বিস্মিত চিন্তিত হলেন। যে ছেলে মায়ের ডাককে কখনো উপেক্ষা করে না, সেখানে তিনি থ্রেড দিয়েছেন। অথচ তার ছেলে এলো না! চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কি তার এক মিনিটও সময় হয়নি? না আসতে পারলে অন্তত ফোন করে বলতে পারতো, যে মা আমি আটকে গেছি আসতে চাইলেও আসতে পারবো না। তিনি কি তখন রাগ করতেন? না। তিনি জানেন এইরকম পেশায় হুটহাট আসা যায় না। কিন্তু ধ্রুব তো সেটা করেনি। বরং মায়ের মনে দুঃখ দিয়েছে। ধারার অভিমান হলো নিজের ছেলের উপর। নাক টেনে ফাহিম মাহবুবকে ফোন করলেন তিনি।
ভদ্রলোক রিটায়ার্ড মানুষ। বিকেলে হাঁটতে বের হোন। গল্প করেন চেনা পরিচিত সবার সাথে। স্ত্রীর ফোন পেতেই তার চোখমুখ শুকিয়ে গেলো। প্রায় কেটে যাওয়ার মুহুর্তে তিনি রিসিভ করলেন।
ধারা নাক টেনে বললেন,
‘আমার বাচ্চাটা বদলে গেছে ফাহিম। সে তার মাকে প্রচন্ড দুঃখ দিয়েছে।’
ফাহিম মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এই মহিলা তো তাহলে দুঃখ কি সেটাই জানে না। বললেন,
‘হয়তো কিছুতে আটকে গেছে, বা নেটওয়ার্কের বাহিরে। দেখবে তোমার সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করবে। আমি নিরবকে বলে দেখছি কোনো খোঁজ দিতে পারে কি না।’
‘ঠিক আছে।’
ফোন রেখে ফাহিম মাহবুব হালকা লাল রঙা আকাশের দিকে তাকালেন। তার চোখমুখ মুহুর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রঙধনু। সাতরঙের রঙধনুর দেখা মিলেছে আকাশে। তিনি ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসছেন। বাচ্চাদের মতো খুশি হতে দেখা যাচ্ছে তাকে। মনে মনে প্রার্থনা করলেন,
‘আমার ছেলের জীবনটা রঙধনুর মতো রাঙিয়ে দিও সৃষ্টিকর্তা।’
(চলবে)