বিয়ে থা পর্ব-০২

0
268

#বিয়ে_থা
#পর্ব-০২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে রমনীটি এদিক অধিক তাকাচ্ছে। তন্মোধ্যে তার দিকে ছুটে এলো কেউ। জড়িয়ে ধরে প্রায় চিৎকার করে বলল,

‘নিনীকা ইয়ার ওয়েলাম টু আওয়ার ইন্ডিয়া।’

নিনীকা হাতের ট্রলি ছেড়ে নিজেও আলিঙ্গন করলো। সুমিত্রা হাসতে হাসতে বলল,

‘ইশ আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না তুই আমার সামনে। ফটো থেকে তুই বাস্তবে আরও বেশি গ্লু করছিস ডেয়ার। ইউ আর এ বিউটিফুল লেডি নিনীকা।’

নিনীকা গাল টেনে দিলো।

‘তুই ও বিউটিফুল সুমিত্রা।’

সুমিত্রা ট্রলি এক হাতে ধরে আরেকহাতে নিনীকার হাত ধরলো। টেক্সিতে করে তারা চললো সুমিত্রার বাড়িতে।’

সুমিত্রার বাড়ি শিলিগুড়িতে। সেই স্থান যাকে নিনীকা পড়েছে বইয়ের মধ্যে। সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়ে ‘ডুয়ার্সের চা বাগান, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি এসবের প্রতি অদ্ভুত টান জন্মেছিল তার। মনে মনে আশা করেছিল কখনো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে প্রিয় লেখকের লেখায় পড়া জায়গা গুলোতে নিজের পায়ের ধুলো ফেলবে। নিনীকা টেক্সিতে বসে চারিপাশ দেখছে। সমরেশ মজুমদার যেরকম বর্ণনা দিয়েছিলেন তেমন নয়। সবকিছু চেঞ্জ হয়ে গেছে। যুগের সাথে সাথে সবকিছু বদলে যায়। টেক্সি এসে থামলো সুমিত্রাদের বাড়ির সামনে। সুমিত্রা ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লো। নিনীকাকে নিয়ে হাটা ধরলো বাড়ির পথে।

প্রথমে লম্বা একটি রাস্তা সড়কের সাথে। সেই রাস্তার শেষে একটি বাড়ি। মিত্র বাড়ি। সুমিত্রা ডোরবেল বাজালো। মিত্র বাড়ির গিন্নি কাদম্বরী দেবি দরজা খুলে দিলেন। যিনি সম্পর্কে সুমিত্রার মা। তারা ভেতরে ডুকলো। নিনীকা তাকে প্রণাম জানালো। তিনি বললেন,

‘আগে ফ্রেশ হয়ে নাও মায়েরা, আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। ভোরের আলো তো ফুটে গেছে। পারলে গোসল করে নিও। এতোটা পথ এলে যে।’

নিনীকাকে নিয়ে সুমিত্রা নিজের ঘরে গেলো। আজ থেকে দু’বান্ধবী একসাথে থাকবে। দুজন গোসল করে যখন টেবিলে এসে বসলো তখন সকাল সাতটা। সুমিত্রার পরিবারের সবাই টেবিলে নতুন মানুষ দেখে বার-বার তাকাচ্ছে। কথা বলল সুমিত্রা।

‘ও হচ্ছে নিনীকা। আমার বাংলাদেশি বন্ধু। আজ থেকে আমার সাথে থাকবে। মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে গেলে হোস্টেলে সেটেল্ড হয়ে যাবে। এরকমই প্লান।’

সুমিত্রার ভাই সৌরভ খেতে খেতে প্রশ্ন করলো।

‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু তার পরিবার তাকে একা ছাড়লো যে? বড় কেউ এসে দিয়ে যেতে পারতেন।’

‘আসলে দাদা ওর তেমন কেউ নেই। সেজন্য নিজে থেকে সব করতে হয়।’

খাবার টেবিলে নিনীকা টু শব্দ ও করলো না। তার হয়ে সব উত্তর সুমিত্রা দিচ্ছিল। নিনীকা খেত খেতে ভাবলো খুব শীগ্রই তাকে হোস্টেলে উঠে যেতে হবে। এভাবে অন্যের পরিবারে থাকাটা ভালো দেখায় না। যদিও সুমিত্রা তাকে প্রটেক্ট করছে কিন্তু সুমিত্রার পরিবার যদি সেটা ভালো চোখে না দেখে? তারা যদি জানতে পারে সে বিয়ে থা থেকে পালিয়ে এসেছে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে খারাপ ভাববে। সে সুমিত্রার থেকে শুনেছে তাদের ধর্মের বিয়ের অনেক জটিল জটিল সম্প্রদায় আছে। যা নিনীকার ঝং ধরা মাথায় ধরবে না।

তার বিয়ের শাড়িটা খয়েরী রঙের ছিল। মাথার ওড়না গহনা সব সে আগেই ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। যার কারণে তাকে দেখে মনে হয়নি সে বিয়ের কনে হতে পারে। এ যাত্রায় সে বেঁচে গেলো। কিন্তু নিজের নামটা অন্য কারো সাথে যে জুড়ে গেলো তা থেকে কিভাবে বের হবে সে?

খেয়ে দুজন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। নিনীকা বিছানায় শরীর ছাড়া মাত্রই ঘুমে তলিয়ে গেলো। অনেক ক্লান্ত সে।

*
বাড়ির নাম ‘বউ কথা কও।’ বাড়ির ভেতর বিশাল বাগান। সেখানে রয়েছে হরেক রকমের ফুল গাছ। বাড়িটা সারাক্ষণ ফুলের গন্ধে মো মো করে। ফাহিম মাহবুব এর বাবার বাবা ছিলেন ভীষণ বউ পাগল। সে-ই সময়ে তিনি যখন সৈনিক হোন তখনই তাকে বিয়ে করতে হয় অল্পবয়সী একটি মেয়েকে। সৈনিক লোকটার এতো অল্প বয়সী বউ পছন্দ ছিল না। কিন্তু কালের পরিবর্তনে তিনি এমন ভাবে সে-ই কন্যাটির মোহে ডুবেছিলেন যে সবার কাছ থেকে শেষ বয়স পর্যন্ত বউ পাগল সম্মোধন পেয়েছেন। তার ‘বউ পাগল’ হওয়ার একটি নিদর্শন হলো এই লাল সাদার ‘বউ কথা কও’ বাড়ি। তার বাবার বাবা তার বাবাকে বলে গিয়েছিলেন বাড়িটা যেনো সবসময়ই এমন থাকে। যুগের পর যুগ যখন উত্তরাধিকার আসবে সবাইকে যেন এটা বলে দেওয়া হয় যে ‘বউ কথা কও’ বাড়িটা তার তৈরি করা লাল সাদার বাড়িটাই যেনো থাকে। বাবার কথা মেনে ফাহিম মাহবুবের বাবা বাড়িটাকে তেমনই রেখেছেন। তারপর এলো ফাহিম মাহবুবের পালা। তিনি ঝং ধরা গেইট থেকে শুরু করে সবকিছু আগের মতো রঙ করে চকচক করেছেন শুধু। নিজ দায়িত্বে থেকে তার দাদা মশাইয়ের করে যাওয়া বাড়িটা আগের মতোই সাজিয়েছেন পুনরায়। বাড়িটিকে দেখে বুঝার উপায় নেই এটা ঠিক কতো যুগ আগের তৈরি করা। তবে বাড়িটার কারুকার্যে কিছু টা জমিদার জমিদার ভাইব রয়েছে। যার কারণে দূর থেকে অনেকে এটাকে জমিদার বাড়িও মনে করেন।

শান্তশিষ্ট বাড়ির আশেপাশে উড়ে এসে বসে নাম না জানা নানান রকম পাখি। শান্ত বাড়িকে অশান্ত করতে দুইপাশ থেকে ফুলের গাছের সাথে লেগে থাকা কালো রঙের গেইটির দরজা খুলে দিলো দারোয়ান। গেইট দিয়ে প্রবেশ করলো একটি কালো গাড়ি। ড্রাইভার গাড়িটি পার্ক করে দরজা খুলে দিলেন। গাড়ি থেকে নেমে এলেন আভিজাত্যপূর্ণ শাড়ি পরিহিত মধ্যবয়সী একজন মহিলা। যার চোখে শোভা পাচ্ছে কালো চশমা। মুখে মেক-আপের দারুন সাজ। বয়স বুঝা দায়। ওপর পাশ থেকে বের হলো এক কিশোরী। তার পড়োনে দামী পোশাক। সে এ পাশে এসে মায়ের হাত ধরলো। মহিলা তার ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসলেন। মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘চলো বাচ্চা বাড়িতে চলে এসেছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিবে। বেশি মাথা ব্যথা করছে সোনা আমার?’

মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আগের থেকে একটু কম লাগছে মাম্মাম।’

শান্ত বাড়িটার দুই প্রাণ। ফাহিম মাহবুব সোফায় বসে ছিলেন। মেয়ে বউকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে হালকা করে ঢুক গিললেন। তন্মোধ্যে মেয়েটি ছুটে এলো তার বাবার কাছে। জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আ’ম মিস ইউ পাপা।’

মেয়ের কপালে তিনি আদর দিলেন।

‘পাপাও প্রিন্সেসকে মিস করেছে বাচ্চা।’

‘আমি ফ্রেশ হয়ে তিন ঘন্টা ঘুমাবো। দ্যান তোমার সাথে আড্ডা দিবো। ওকে পাপা?’

‘ওকে প্রিন্সেস গো। রেস্ট নাও।’

মেয়েটি উপরে চলে গেলো। ফাহিম মাহবুব এবার নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। যিনি এগিয়ে এসে বসেছেন তার পাশে। কাঁধে মাথা রেখে বললেন,

‘খুব কষ্ট হয়ে গেছে তোমার?’

ফাহিম মাহবুব হাসলেন।

‘তেমন হয়নি।’

মহিলা মন খারাপ করলেন।

‘জানি কষ্ট হয়েছে। তুমি তো আমার রান্না ছাড়া খাও না। বিশ দিন সার্ভেন্টের করা রান্না খেতে হয়েছে। তবে তোমার জন্য সুখবর, আমি এখনই ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে ঢুকবো। তুমি তখন তৃপ্তি করে খেও।’

ফাহিম মাহবুব স্ত্রীকে আগলে নিলেন। ভাবলেন সময় করে স্ত্রীকে তার অবর্তমানে হওয়া ঘটনা খুলে বলবেন। তার ভাবনায় জল ঢেলে তার স্ত্রী ধারা শুধালেন,

‘তোমার গুনধর পুত্রকে এক্ষুনি ইনফর্ম করো। আমি তাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ‘বউ কথা কও’ এ উপস্থিত দেখতে চাই।’

‘কিন্তু ও তো..

‘কোনো কিন্তু না। শেষ কবে বাড়িতে পা রেখেছিল সে? প্রায় ছয়মাস আগে। তুমি তাকে এক্ষুনি বলবে। যদি না আসে তো সারাজীবনের জন্য আমি তাকে ভুলে যাবো।’

ধারা বিচক্ষণ নারী। তিনি জানেন তার পুত্র মাতার এ দ্বারা কথা শুনে বাড়িতে পা রাখতে বাধ্য হবে।

ফাহিম মাহবুব পড়লেন মহা বিপদে। ফোন করলেন নিরবকে। নিরবকে নিজের সমস্যার কথা জানাতেই সে ভয় পাওয়া গলায় বললো,

‘স্যার তো সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছেন। আমি একটা কাজে সেনানিবাসে আছি। আপনি তো জানেন আমি স্যারকে কতো ভয় পাই। তাকে কি করে আমি বলবো যে স্যার আপনাকে স্যার স্মরণ করছেন ইমিডিয়েটলি।’

ফাহিম মাহবুব চোখমুখ কুঁচকে বললেন,

‘সে তো আমি জানিনা বৎস। তোমার স্যারকে বলার দায়িত্বটা তোমার। তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। কিভাবে যোগাযোগ করবে আমি জানি না। তবে তাকে জানিয়ে দিও তাহার মাথা মিসেস ধারা ফাহিম মাহবুব তাকে আসার জরুরি তলব করেছেন। সে যদি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এসে উপস্থিত না হয় তো বাপ বেটা দুজনের গর্দান অনিবার্য।

নিরব ফোন রেখে মহা চিন্তায় পড়লো। তাকে কেন সবসময়ই জল্লাদ স্যারের সবকিছুতে থাকতে হয়?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে