বিয়েকথন পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
577

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

শেষ পর্ব (প্রথমাংশ)

ওয়াহিদ ফিরেছে গতকাল সন্ধ্যেয়। দু’সপ্তাহের টানা ঘুরাঘুরিতে ও যে কতটা ক্লান্ত সেটা বুঝেছে বাসায় পা দিয়ে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় যেতেই ঘুমে কখন তলিয়ে গিয়েছিলো বলতে পারবে না।

ফ্লাইট থেকে নেমে একবার, বাসায় ঢুকে আরেকবার ফোন দিয়ে ঠিকঠাক পৌঁছানোর কথা জানিয়েছিলো অপরাজিতাকে। এরপর ঘুমেই রাত পার করেছে। ফোন, মেসেজ দেওয়ার সুযোগ হয়নি। এখন বাজে সকাল দশটার মতো। শুক্রবার যেহেতু, অপরাজিতার ক্লাস নেই আজকে। বাসায়ই থাকবে। চাইলেই দেখা করতে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু দুপুরে জুম্মায় মসজিদে যেতে হবে। ওইটুকু সময়ে অপরাজিতা কোথায় আবার অপেক্ষা করবে! তারচেয়ে দুইটার দিকে দেখা হলে সব থেকে ভালো হয়। ভেবেচিন্তে অপরাজিতাকে ফোন দেয় ও। ঘুম ঘুম কন্ঠে ভেসে আসে অপরাজিতার প্রশ্নভরা কথা, “হ্যালো! ওয়াহিদ। এতো সকালে উঠেছেন! আমি তো ভাবলাম অনেকক্ষণ ঘুমাবেন আজকে।”

ওয়াহিদ সহসা জবাব দিতে পারলো না। ঘুম ঘুম কন্ঠে যে এমন মাদকতা থাকতে পারে সেটা অপরাজিতার সঙ্গে প্রতিদিন সকালে কথা বলতে গেলে টের পায় ও। সকালে হেঁটে এসে অপরাজিতাকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে জাগানো রীতিমতো অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। সন্তপর্ণে শ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলায় ও। হাসিমুখে বলে, “গুড মর্নিং, অপরা। অনেকক্ষণই ঘুমিয়েছি। প্রায় এগারো ঘন্টার মতো।” হাই চেপে ছোট্ট করে অপরাজিতার বলা ‘ওহ’ শুনে ওয়াহিদের হাসি দীর্ঘ হয়। ও এবারে জিজ্ঞেস করে, “দেখা করবে আজকে? দুপুরে?” অপরাজিতা ভেবে উত্তর দেয়, “সেটা করতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। সাড়ে চারটায় পড়াতে যেতে হবে। এন্ড বিফোর ইউ সে এনিথিং, নো! টিউশন ক্যানসেল করা যাবে না।” অপরাজিতার বলার ধরনে ওয়াহিদ শব্দ করে হাসে। অনুরোধের সহিত প্রশ্ন করে, “টিউশনটা কি তিনটায় নেওয়া যায়? তাহলে ছয়টায় দেখা করতে পারতাম।” অপরাজিতা স্টুডেন্টকে ফোন দিয়ে, ওকে শিওরলি জানাবে বলে ফোন রাখে। ওর কন্ঠে ঘুমের রেশ এখনও রয়ে গেছে। আরও খানিকক্ষণ বোধহয় ঘুমাবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।

ওয়াহিদ রুম ছেড়ে বেরোয়। ঘিয়ে ভাজা পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ করেই। ছুটির দিনে সকালের নাস্তা ওদের বাসায় সবাই একসাথে করার চেষ্টা করে। আজকেও আম্মু ডেকেছিলো ওকে নয়টার পর পর। কিন্তু আলসেমিতে উঠতে ইচ্ছে করেনি। এখন ঘিয়ে ভাজা পরোটার কথা বললে পরোটার সাথে দুই-একটা বকাও ফ্রিতে পাওয়া যাবে! অবশ্য আম্মুর বকা খাওয়া-ই যায়। ও চটজলদি মা’কে গিয়ে বললো পরোটার কথা।

জোহরা সুলতানা শুনলেন ছেলের কথা। কোনো উচ্চবাচ্য না করে ছেলেকে টেবিলে বসতে বলে ডিপ ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন পরোটা বের করলেন। চা বসিয়ে, ঘি দিয়ে পরোটা ভাজলেন সময় নিয়ে। নিজের মনে চলতে থাকা কথাগুলো গুছিয়ে নিলেন ছেলেকে বলবেন বলে। চা-পরোটা, গরুর মাংস নিয়ে ছেলের সামনে রেখে নিজেও বসলেন ওর মুখোমুখি চেয়ারে। ওয়াহিদ মায়ের থমথমে চেহারা তখনও খেয়াল করেনি। পরোটার সঙ্গে চা দেখেই মন খুশি হয়ে গেছে ওর। খেতে শুরু করে গরুর মাংস কতটা মজা হয়েছে সেটা বলতে গিয়েই টের পেলো মায়ের মন মেজাজ ঠিক নেই। সহসাই খাওয়া থেমে গেলো ওর। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু হয়েছে আম্মু? তোমার মুড অফ কেনো?” জোহরা সুলতানা গম্ভীরস্বরে জবাব দিলেন, “মুড অফ হওয়াটা কী স্বাভাবিক না? তুই, তোর আব্বু আমাকে কিছুই বলছিস না। আকদের প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো অথচ বউ এখনও বাসায় আসলো না। ক্লিয়ার করে বল সমস্যাটা কোথায়?”

ওয়াহিদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। আম্মু এতো ক্ষেপে আছে জানতো না। কিছু বলার আগেই জোহরা সুলতানা আবার বলেন, “কোন নতুন বউয়ের সঙ্গে তার শাশুড়ীর একবারও কথা হয় না? বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা যখনই হোক, এতোদিনে একবার কথা বা দেখা হওয়া কী উচিত ছিলো না?” ওয়াহিদ মায়ের আক্ষেপ বুঝলো। মা’কে শান্ত করতে চাইলো। ওর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি ফের বলে উঠেন, “তোর আব্বু কে কিছু জিজ্ঞেস করলেও লাভ নেই। ভাঙা রেডিওর মতো এক কথা! সময় হলেই নাকি প্রোগ্রাম হবে। সেই সময়টা হচ্ছে না কেনো? তুই আর তোর আব্বু মিলে কি লুকাচ্ছিস?” পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাচ্ছে। সেটা সামলাতেই ওয়াহিদ দ্রুত বলে উঠে , “কিছুই লুকাচ্ছি না আম্মু। বিয়ে টা হঠাৎ হয়েছিলো। তাই বলে প্রোগ্রাম তো হঠাৎ করা যায় না। আব্বুর, অপরাজিতার বাবার কত চেনা-জানা মানুষ! সবাইকে একসঙ্গে করতেও তো সময় লাগে।” ছেলের দেওয়া যুক্তি ভুল না। জোহরা সুলতানা কিছুটা নিভলেন। আগের চেয়ে শান্ত হয়ে বললেন, “সেটা মানলাম। কিন্তু তাই বলে এতো সময়ও লাগে না।” ওয়াহিদ রয়েসয়ে মা’কে বুঝায়, “এতো সময় কোথায়! এখনের বিয়েতে তিন-চার মাস ধরে শুধু প্ল্যানিংই হয় আম্মু। ওয়েডিং প্ল্যানার ঠিক করা, পছন্দের কনভেনশন হলে বুকিং দেওয়া, গেস্ট লিস্ট, শপিং, খাবার মেন্যু এসবে সময় লাগে না?”

জোহরা সুলতানা ভেবে দেখলেন কথা ভুল না। তার ছোট মেয়ের বিয়ের সময়ে যে কনভেনশন হলে প্রোগ্রাম আয়োজন করতে চাইলেন সেটায় বুকিংই দিতে হয় দু’মাস সময় হাতে নিয়ে। দেরি হয়, হোক। তবু মেয়ে আর জামাইয়ের ইচ্ছে ছিলো ওখানেই বিয়ে হবে। সবাই মেনে নিয়েছিলো। দুইমাস অপেক্ষা করেই শেষে বিয়ে হয়েছিলো। অপরাজিতারও এমন ইচ্ছে হতেই পারে। সেটায় কোনো অসুবিধে নেই। তার প্রশ্ন অন্যখানে। তিনি মন খারাপ করে ছেলেকে বলেন, “সব বুঝলাম। তবুও আমার মনে হয় কিছু একটা ঠিক নেই।”

মায়ের দুশ্চিন্তা বোঝে ওয়াহিদ। কিন্তু সিচুয়েশনটা এতোই গোলমেলে, চাইলেই সত্যিটা বলা যায় না। ও অসহায় বোধ করে। মন খারাপটা আটকে রেখে প্লেটের পরোটার দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করে। অথচ একটু আগের প্রচন্ড খিদে কোথায় মিলিয়ে গেছে।

জোহরা সুলতানা গভীর চোখে ছেলেকে লক্ষ্য করেন। নিজকে প্রশ্ন করেন, সব যদি বেঠিকই হতো ওয়াহিদ কী শ্বশুরের সঙ্গে ইন্ডিয়া যেতো? তার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে অপরাজিতার সঙ্গে ওয়াহিদের কথা হয় কি না। তবে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখেন। ছেলে বড় হয়ে গেছে। বিয়ে করে ফেলেছে। নিজেরটা ভালোই বোঝে। চাইলেই হাজারটা প্রশ্ন তিনি করতে পারেন না। কিছুদিন পর বউ এলে এমনিতেও নিজের ফ্ল্যাটে চলে যাবে।

ওনাদের পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের প্রথম দু’তলা ডুপ্লেক্সের আদলে করা হলেও পরের তিন তলায় স্বাভাবিক নিয়মেই এক ইউনিটের ফ্ল্যাট। ওয়াহিদের আব্বু তিন ছেলেকে যথাক্রমে তিন, চার, পাঁচ তলার ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর ছেলেরা বউ নিয়ে যার যার ফ্ল্যাটে উঠে যাবে এমনটাই ঠিক হয়ে আছে। বড় ছেলে ওয়ালিদের পর এবার মেজ ছেলে ওয়াহিদের পালা।

একসময় ভরা সংসার ছিলো জোহরা সুলতানার। চার মেয়ে-তিন ছেলে কখনও মিলেমিশে, কখনও ঝগড়া-মারামারি করে বাড়ি মাথায় করে রাখতো। তাদের এই বিশাল বাড়ি তখন যতোটা মুখরিত থাকতো এখন ততোটাই শব্দহীন হয়ে থাকে। মেয়েদের নিজের সংসার হয়েছে। তারা আসা-যাওয়ার মাঝে থাকলেও, ব্যস্ততায় সেটাও বেশি সম্ভব হয় না। এখন প্রতি শুক্রবার ছেলেদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার চেষ্টা করেন কেবল। সেটাও সবসময় হয়ে উঠে না। একেকজনের কাজকর্ম, অফিস পার্টি লেগেই থাকে। ছোট ছেলে ওয়াসিফও যখন চলে যাবে নিজের ফ্ল্যাটে তখন এতো বড় বাড়িতে তিনি আর মাজহার সাহেব একা থাকবেন, ভাবতেই বুকের ভেতরে হাহাকার টের পান। কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই জগতের নিয়ম। ছেলেমেয়েরা কেনো জলদি বড় হয়ে যায়? কেনো অতটা বড় হয় যতটা বড় হলে সম্পর্ক ঠিক রাখতে দূরে চলে যেতে হয়?

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। সেই সঙ্গে যেনো ঝেড়ে ফেলেন সকল মন খারাপ, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তাদের। আজীবন ধরে দূরে চলে আসার নিয়ম তিনি যেমন মেনেছেন তার ছেলেমেয়েরাও একইভাবে মানবে। দেখে যাওয়া ছাড়া এখানে তার আর কোনো ভূমিকা নেই।

***

ওয়াহিদ তৈরি হচ্ছিলো নামাজে যাবার জন্য। ঘড়ির কাঁটায় একটা বাজে তখন। ওর মন খারাপের অবসান ঘটিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে অপরাজিতার মেসেজে আসে সেইসময়, “গুড মর্নিং ওয়াহিদ। যদিও দুপুর হয়ে গেছে। তা-ও। স্যরি, তখন ভয়াবহ ঘুম পাচ্ছিলো। আবোলতাবোল কিছু বললেও ওটা কিন্তু আমি নই! সাড়ে পাঁচটায় দেখা করতে পারবো। খিলগাঁওয়ের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে। রিকশায় করে। যাবেন?”

না যাওয়ার কোনো কারণ ওয়াহিদের নেই। বরং এইটুকু কথায় ওর মনের কোনে জমে থাকা সকল বিষাদ ছুটি নিলো। রিপ্লাইয়ে কোনো অসুবিধে নেই জানিয়ে দিয়ে, নিজ মনেই হাসলো।

নামাজ শেষে বাসায় ফিরে, সবার সঙ্গে লাঞ্চ করতে বসলেও আশ্চর্যজনক ভাবে খেয়াল করলো ওর অস্থির লাগছে। খাচ্ছে, কথা বলছে ঠিকই কিন্তু মন চলে যাচ্ছে অপরাজিতার কাছে। এতদিন পর দেখা হবে বলেই কী এই অস্থিরতা? খাওয়ার পাট চুকিয়ে ও দ্রুত তৈরি হয়। টি-শার্ট পরবে ভেবেও মত বদলে জিন্সের সাথে সাদা শার্ট পরে ফেলে। সাদা শার্ট পরলে বউ যে একটু বেশি বেশি তাকায় সেটা ও দেখেছে। বউয়ের চোখের মুগ্ধতার কারণ হতে পারা চাট্টিখানি কথা না!

ওয়াহিদ যখন বাসা থেকে বের হয় তখন সাড়ে তিনটের বেশি বাজে। জ্যামে পরলেও সময়মতো পৌঁছে যেতে পারবে। সিএনজি চলতে শুরু করতেই ওর অস্থিরতাও কমতে শুরু করে। মন-মস্তিস্ক থেকে যেনো সকল ইন্দ্রিয়ে অপরাজিতার দেখা পাওয়ার বার্তা পৌঁছে গেছে!

***

অপরাজিতা টিউশনটা এগিয়ে তিনটায় নিয়ে এসেছিলো। পড়ানো শেষ করে সাড়ে চারটায় বের হতে পারলেও বাসায় আসতে সময় লেগেছে ওর। ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বিশ বাজতেই ওয়াহিদ ফোন কলে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে।

নিজেকে তাড়া দেয় অপরাজিতা। চোখেমুখে পানি দিয়ে, দ্রুত তৈরী হওয়ার চেষ্টা করে। ডেনিম ওয়াইড লেগ জিন্সের সাথে বটল গ্রীন ফ্লেয়ারড টপসে নিজেকে সাজায়। ফ্লোরাল ওরনা গলায় পেঁচিয়ে, এলো চুলে লুজ পনিটেইল করে। ডাইনিংরুমে বেসিনের সামনে থাকা আয়নায় একবার উঁকি দেয়। কিছু একটা মিসিং মনে হতেই বারগান্ডি রেড লিপস্টিক ঠোঁটে ছোঁয়ায়। এবার ঠিক লাগছে কি না সেই ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন, ব্যাগ, চাবি নিয়ে দরজা লক করে বের হয়।

ওয়াহিদ দাঁড়িয়েছিলো বাসার সামনের রোডে গলির মুখে। অপরাজিতাকে দেখে নিঃসংকোচে স্বীকার করে, “ইউ আর সিস্পলি বিউটিফুল!” ওয়াহিদের সরল স্বীকারোক্তি, চোখের উন্মাদনায় অপরাজিতা লাজুক হাসে। সমস্ত তনু-মনে অদ্ভুত ভালোলাগা হুটোপুটি খায়। নিজের মধ্যে এক ঝাঁক প্রজাপতির অস্তিত্ব খুঁজে পায়। মনে হয় ইংরেজিতে বলা ‘বাটারফ্লাইস ইন স্টোমাক’ কথাটা একবিন্দুও মিথ্যে নয়!

ওরা যাচ্ছে খিলগাঁও তালতলায়। ধানমন্ডি থেকে রিকশায় ওখান পর্যন্ত যাওয়াটা বেশ সময়ের ব্যাপার। তবে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো মূল উদ্দেশ্য হলে এই সময়টা বেশ উপভোগ্য। রিকশায় বসে ওরা পুরোটা সময় গল্প করলো। ইন্ডিয়ায় দু’সপ্তাহ কেমন ছিলো সেটা ওয়াহিদ চমৎকার গুছিয়ে বললো। অপরাজিতা কে সঙ্গে করে আবার যেতে চায় সেটাও অকপটে বলে ফেললো। অপরাজিতা বললো দু-তিন দিন আগে মাঝরাতে ঝুম বৃষ্টির কথা। ও আর মুনিরা মিলে তখনই কেমন খিচুড়ি রান্না করে খেয়েছে সেই গল্প করলো হাসিমুখে। ওয়াহিদ তখন জানালো ওর মনের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছে। সে অপরাজিতা কে সঙ্গে নিয়ে হুড খোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভিজতে চায় কোনো এক সন্ধ্যেয়। সেটা শুনে অপরাজিতা খুব হাসলো। হাসির তোরে ভেসেই প্রশ্ন করলো কেনো সন্ধ্যেয়? কেনো বিকেলে বা দুপুরে না? ওয়াহিদ তখন খুব সিরিয়াস হয়ে বললো, “এজ অ্যা পারসন আই অ্যাম ভেরি পজেসিভ! আর তোমাকে নিয়ে ঠিক কতটা পজেসিভ সেটা তুমি আন্দাজও করতে পারবে না।” অপরাজিতা এই কথাতেও হাসলো। মজা করে জানতে চাইলো, “শুধু পজেসিভ? একটুও জেলাস না?” ওয়াহিদ খুব ভাব নিয়ে বললো, “উহু। জেলাসি আমার কখনোই হয়না কোনো ব্যাপারে।” অপরাজিতা তখন ওকে শিহাব ভাইকে কেন্দ্র করে ঘটা কাহিনী শোনালো। সবটা শুনে ওয়াহিদ চোখমুখ কুঁচকে বললো, “প্রেমে পড়ে ছেলেরা মোটামুটি গাধা টাইপ কাজকর্ম করে ফেলে। রিপা পাগল-ছাগল ডেকে ভুল করেনি।” অপরাজিতা অবাক হয়ে গেলো ওর রিয়াকশনে। ও ভেবেছিলো ওয়াহিদ জেলাস হবে! এমন উদ্ভট একজনকে বাবা কোথায় পেলো!

তালতলায় এসে ওরা আগে তালতলার বিখ্যাত কফিশপের হট ক্যাপোচিনো কফি খেলো। এরপর তালতলা মার্কেটের মাঝখানে বসা ফুটপাথের ছোট ছোট দোকান ঘুরে অপরাজিতা নোজপিন, কাঁচের চুরি কিনলো। মার্কেটের পেছনে থাকা ভেলপুরির স্টল থেকে দুজনে ভাগাভাগি করে ভেলপুরি খেলো। আরেকটু সামনে এগিয়ে ঘুরে ঘুরে বাসায় পরার জন্য আরাম আরাম টাইপ টি-শার্ট কিনতে চাইলে ওয়াহিদ পছন্দ করে দিলো। মার্কেট থেকে বেরিয়ে ওখানেই এক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেলো। ওয়াহিদের ফুচকা অতটা পছন্দ না। ও এক পিস টেস্ট করলো কেবল।

এরপর হেঁটে হেঁটে তালতলার মেইন রেস্টুরেন্টের এরিয়াতে এসে, এতো এতো রেস্টুরেন্ট দেখে কোথায় বসবে সেটা নিয়ে কনফিউশানে পরে গেলো। সি থ্রু রেস্টুরেন্ট গুলোর জানলায় দেখলো কোনোটাই তেমন খালি না। সবখানেই মানুষের এতো আনাগোনা দেখে ওরা কিছুক্ষণ হাঁটলো। শেষে পাস্তা খাবে ঠিক করে একটা রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসলো। অপরাজিতার স্পাইসি নাগা পাস্তার বিপরীতে ওয়াহিদের সুইট পাস্তা বাস্তার কম্বিনেশনে ওয়েটার কী অবাক হলো একটুখানি? কী জানি!

খাওয়া শেষে ধানমন্ডি ফিরতে এবার ওয়াহিদ সিএনজি ঠিক করলো। একটা গাড়ি থাকলে এখন কতো ভালো হতো সেটা ভেবে একটু মন খারাপ হলো ওর। সেটা লক্ষ্য করে অপরাজিতা অবাক হলো। জানতে চাইলো কি হয়েছে। ওয়াহিদ বলবে কি না বুঝতে পারছিলো না। তারপর মনে হলো অপরাজিতার নিজের যুদ্ধটা এখনও বাকি। সেখানে ওর কেনো গাড়ি নেই, বা ওর গাড়ি কেনার প্ল্যানিং নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। ও কথা ঘুরিয়ে বললো, “তোমাকে ড্রপ করার সময় হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।” অপরাজিতার বিশ্বাস হলো না সেটা। তবে সিএনজিতে বসে আর কথা বাড়ালো না। পুরো রাস্তা দু’জনেরই কাটলো নিঃশব্দে।

ধানমন্ডি এসে পৌঁছাতে দশটা চল্লিশের মতো বাজলো। অপরাজিতার মনে অলরেডি প্রশ্ন জমে ছিলো। একটু আগে আরো প্রশ্ন যোগ হয়েছে সেখানে। এতোসব প্রশ্ন নিয়ে ও কোনোভাবেই বাসায় যেয়ে শান্তি পাবে না। কিন্তু এই মুহূর্তটাও কথা বলার জন্য পারফেক্ট না। তার উপর গেইট বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। নিজেকে সামলে নেয়। কয়েক মুহূর্ত ভেবে আগামীকাল দেখা করতে পারবে কি না জিজ্ঞেস করে ওয়াহিদকে। ওয়াহিদ রাজি হয় সানন্দে। অপরাজিতার সঙ্গে দেখা করতে ওর কোনো না নেই।

***

অনেক ভেবেচিন্তে অপরাজিতা ঠিক করেছে ওয়াহিদকে বাসায় আসতে বলবে। রেস্টুরেন্টে বসে এতো সব কঠিন প্রশ্ন করা যায় না। একচুয়েলি হয়ে উঠে না। গতকাল দেখা করতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ও ভেবেছিলো সুযোগ করে কথাগুলো জিজ্ঞেস করতে পারবে। কিন্তু এতো মানুষ, হৈচৈয়ের ভীড়ে সম্ভব হয়নি। আজকেও সেরকম কিছু যেনো না হয় তাই ওর এই ডিসিশন। মুনিরা সকালে বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যের আগে ফিরবে না। তারপরও অপরাজিতা ওকে বিষয়টা জানিয়েছে। মুনিরা খুশি মনে বলেছে তার কোনো প্রবলেম নেই। বরং ওরা যেনো আরাম করে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করে! হাহ! যদি মুনিরা জানতো কি সব জটিল সমীকরণ নিয়ে অপরাজিতা দিন পার করছে তবে এই উইশ নিশ্চয়ই করতো না। অপরাজিতা আরেকটা কাজ করেছে। বাড়িওয়ালাকেও ব্যাপারটা জানিয়েছে। এই বাসাটায় ফ্যামিলি থাকে দুই/একটা ফ্ল্যাটে। বাকি সবটাতেই স্টুডেন্ট অথবা কর্মজীবী মেয়েরা থকে। সেখানে হুট করে ওয়াহিদকে নিয়ে আসাটা দৃষ্টিকটু। কোনোরকম কনফিউশান চায় না অপরাজিতা। তাই আগেই সতর্ক হয়েছে।

সকাল থেকে ভেবেচিন্তে করা এতোকিছুর মধ্যে ওয়াহিদকে জানাতেই সবচয়ে দেরি হয়েছে। এগোরাটার দিকে যখন ফোনে জানালো ও বেশ অবাক হয়েছিলো। কীভাবে, কেনো, কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে হাজারটা প্রশ্ন করছিলো। অপরাজিতা তখন বলেছে সব প্রশ্নের উত্তর বাসায় এলেই পাবে। ওয়াহিদ মেনে নিয়েছে। স্বভাবসুলভ হাসিতে জিজ্ঞেস করেছে, “আমার জন্য স্পেশাল কী রান্না করবেন, ম্যাডাম?” এরপরে অপরাজিতার খেয়াল হয়েছে দুপুরে শুধু গুরুগম্ভীর আলোচনা করলেই হবে না লাঞ্চও করতে হবে! সেই থেকে এখন অব্দি ও রান্নাঘরেই। রান্নাটা মোটামুটি কাজ চালানোর মতো ভালোই জানে ও। কিন্তু প্রথমবার ওয়াহিদকে রান্না করে খাওয়ানোটা এক্সট্রা টেনশন দিচ্ছে ওকে। যদিও ভাত, ডাল, মুরগী ভুনা, মাছ ভাজার মতো সহজ রান্নাই করেছে। তারপরও চিন্তা হচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছে ঝাল বেশি হয়ে গেলো! আবার কখনো মনে হচ্ছে আইটেম কম হয়ে গেলো! এদিকে দেড়টা বাজে, ওয়াহিদের আসতেও দেরি নেই। জলদি শাওয়ার নিয়ে ফেলা দরকার। নিজেকে প্রেজেন্টেবলও তো লাগতে হবে। সকাল থেকে করা এতোসব কাজে অপরাজিতার মনে প্রশ্ন জেগেছে সংসার কী এভাবেই শুরু হয়? এক’পা-দু’পা করে?

ওয়াহিদ এলো একটু দেরি করে। মিষ্টি, চকলেটস, আইসক্রিমসহ আরো দু’টো ব্যাগে রাজ্যের জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে। অপরাজিতাকে হেসে বললো, “তুমি দাওয়াত দিয়েছো। খালি হাতে আসি কী করে!” ওর কথায় অপরাজিতা কেবল মাথা নাড়লো। এমন আধপাগলা মানুষ বাবা কোথায় পেলো!

খেতে বসে ওয়াহিদ খেলো আরাম করে। সময় নিয়ে। অপরাজিতা যতটা ভয় পাচ্ছিলো তেমন কিছুই হলো না। ওয়াহিদের চেহারায় পরিতৃপ্ত ভাবটা ক্লিয়ারলি বুঝিয়ে দিলো এই মানুষটাকে তুষ্ট করা সহজ। খাওয়া শেষে ওয়াহিদ বারান্দায় গিয়ে বসলো। অপরাজিতা টেবিল গোছগাছে ব্যস্ত তখন।

বারান্দায় বসে ওয়াহিদ দূরের আকাশে নিজের মন খারাপটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। অপরাজিতা হঠাৎ কেনো বাসায় আসতে বললো সেটা সঠিক না জানলেও আন্দাজ করা যায়। ওয়াহিদের কাছে অপরাজিতার প্রশ্নের জবাব আছে। কিন্তু ও নিজে যে ভুলটা করেছে সেটার কোনো উত্তর নেই। আজকে এই বাসায় না এলে ও কখনোই হয়তো বুঝতো না ওর ভুলগুলো কত বিশাল। দু’টো বেডরুমের এই বাসায় দরজা খুলতেই মাঝখানের ডাইনিং স্পেস চোখে পরে। বেডরুমের সাইজ ছোট হলেও অপরাজিতা নিজের মতো সাজিয়েছে। রান্নাঘরটা একজন মানুষের একা কাজ করার জন্য ঠিকঠাক। বড়সড় এই বারান্দায় বসে সহজেই মন খারাপগুলোকে ছুটি দেয়া যায়। কিন্তু সারাজীবন আরাম-আয়েশে, বাবার অতি ভালোবাসায়, আম্মুর আদরে-আহ্লাদে বড় হওয়া অপরাজিতার জন্য এগুলো কোনোকিছুই ঠিক নয়। ওয়াহিদের এর আগে পর্যন্ত মনে হতো ও ভুল করেছে। হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে অপরাজিতাকে কষ্ট দেওয়ার মতো ভুল করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্যায় করেছে। যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছে, যাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়েছে সেই মেয়েটা কী চায় ও ভাবেনি। একবারও জানার চেষ্টা করেনি। সেদিন বিয়ের গল্পটা ওর জন্য যতটাই আনন্দের ছিলো, অপরাজিতার জন্য ততটাই কষ্টের-হতাশার ছিলো। এই সত্যটা ও আগে টের পায়নি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ অপরাজিতার পাওনা ছিলো। ও যদি অপরাজিতায় মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করতে পাগল হতে পারে অপরাজিতারও ওয়াহিদে মুগ্ধ হয়ে হ্যাঁ বলার অধিকার আছে। অথচ ও এটা কী করলো?

অপরাজিতা বাড়ি ছেড়েছে জানার পর ও বিস্মিত হয়েছে। বিয়ের আসরে বুঝেছিলো, প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলা মেয়েটা, এই বিয়েতে হ্যাপী না। কিন্তু তাই বলে বাড়ি ছাড়বে ওটা ভাবেনি। তারপরও অপরাজিতার বাবা যখন বললো ওর সাথে দেখা করতে তখন ও ভীষণ খুশি হয়েছে। অভিমানীনির অভিমান ভেঙে ফেলতে পারবে সেই বিশ্বাসে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সময় লাগলেও, দেয়াল তুলে দিয়ে নিজের অনুভুতি লুকিয়ে রাখলেও, অপরাজিতা ওর ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছে। কিন্তু অপরাজিতার মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে ওর কারণে সেটার সামনে ও কীভাবে দাঁড়াবে?

আইসক্রিম খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে টুলে বসে থাকা অন্যমনস্ক ওয়াহিদ কে দেখে অপরাজিতা থমকে গেলো। গতরাতের মতো অস্থির অনুভব করলো। আলতো স্পর্শে ওয়াহিদের কাঁধে হাত রাখলে ও ফিরে তাকিয়ে মলিন হাসলো। সে হাসিতে ওয়াহিদকে এতো অসহায় দেখালো, অপরাজিতার মনে হলো কিছুই ঠিক নেই। কি করবে বোঝার আগেই ওয়াহিদ ওকে চট করে জড়িয়ে ধরলো। প্রথমবারের জড়িয়ে ধরার অনুভতি অনেক ম্যাজিকাল হতে পারতো। কিন্তু অপরাজিতার ঠেকলো বিষাদময়। এতো কিসের বিষাদ ওয়াহিদের? নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, ওয়াহিদকে টেনে ওর রুমে নিয়ে আসে অপরাজিতা। ফ্লোরিং করা বিছানায় বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও ওর পাশেই বসে। ওয়াহিদকে সময় দেয় খানিকক্ষণ। এতো অসহায়, ক্লান্ত কেনো লাগবে সদা প্রাণবন্ত এই মানুষটাকে?

“অপরা, তোমার সাথে আমি খুবই অন্যায় করেছি। কিন্তু একটু আগে পর্যন্ত সেটা বুঝিনি।”, নিজ থেকে বলতে শুরু করা ওয়াহিদের কথায় অপরাজিতা খেই হারায়। কথার অর্থ উদ্ধার করতে না পেরে প্রশ্ন করে, “কিসের অন্যায়? কি হয়েছে ওয়াহিদ? আপনি এতো ডিস্টার্বড কি নিয়ে? গত রাতেও খেয়াল করেছি।”

অপরাজিতার হাত আঁকড়ে ধরে ওয়াহিদ নিচু স্বরে বলে, “গত রাতে তোমাকে ড্রপ করার সময় আমার খুব আফসোস হচ্ছিলো। কেনো আমার একটা গাড়ি নেই? গাড়ি কেনার জন্য আমি টাকা সেইভ করছি। সামনের বছর হয়তো কিনে ফেলবো। গতরাতে এটা নিয়ে একটু আপসেট ছিলাম। কিন্তু এটা আমার মন খারাপের কারণ না। ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। বুঝিয়ে বলতে পারছি না।”

অপরাজিতা আদতেই কিছু বুঝতে পারছে না। ওর দু’চোখের বিস্ময় জানান দিলো সেটা। ওয়াহিদ স্মিত হাসে। প্রশ্ন করে, “আগামী দু’বছরেও বিয়ের প্ল্যানিং নেই, বলেছিলাম তোমাকে। মনে আছে?” মাথা নেড়ে অপরাজিতা সায় দিতেই নিচুস্বরে বলতে শুরু করে ওয়াহিদ, “আমি আরো গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। গাড়ি কেনাটা সেই গুছিয়ে নেয়ার মধ্যেই পরে। নিজের ইনকামে গাড়ি কিনবো, পুরো ফ্ল্যাট সাজাবো তারপর বিয়ে, এটাই আমার প্ল্যান ছিলো। এই কারণেই বিয়ে নিয়ে আব্বুর কথায় গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু অপরা, তোমাকে দেখার পর সমস্ত প্ল্যানিং যেনো আমি ভুলে গেছি। বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলাম। বিয়ে করে ফেললাম। হুটহাট ডিসিশন আমি ইউজুয়ালি নিই না। অথচ তোমার ক্ষেত্রে এটাই করেছি। তোমাকে আমার পছন্দ। কিন্তু তুমি আমাকে পছন্দ করবে কি না সেটা চিন্তাই করিনি। তোমাকে সেদিন হুট করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললাম। তুমি রাজি হলে। কিন্তু কেনো হলে? মন থেকে কি আদোও রাজি হলে? সেটাও চিন্তা করিনি। তোমাকে ভালোবাসি, বিয়ে করলে তোমাকে পাবো এর বাইরে কিছুই ভাবিনি। তুমি আমার হুটহাট করা কাজের জন্য বাড়ি ছাড়লে, আমি তোমার অভিমান ভাঙাতে চলে এলাম। অথচ বুঝলামই না এই সকল ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু আমি। তোমার বাবার কাছে আমি বেস্ট চয়েজ হতে পারি। কিন্তু সেই বেস্ট চয়েজকে তুমি গ্রহণ করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত তোমার। আমি, আমরা তোমাকে সেই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলাম। তোমার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আজকে এইখানে না আসলে আমি কখনোই ব্যাপারগুলো বুঝতাম না। শুধু বাবার সাথে অভিমান বলেই একটা মেয়ে সম্পূর্ন নতুন একটা জীবন বেছে নিবে? নাহ তো। তোমার অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ বলেই তুমি আজকে এখানে। তুমি আমাকে পছন্দ করেছো। কিন্তু দেয়াল ভাঙছো না। আমি ভাবলাম বাবার প্রতি অভিমান না মিটলে এই দেয়াল ভাঙবে না। অথচ বুঝলামই না অভিমানের দেয়াল বাবার সঙ্গে হলেও তোমার অস্তিত্বের লড়াইটা আমার সঙ্গে!”

এতোদিন ধরে লুকিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস সশব্দে ছাড়ে অপরাজিতা। নিচু কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠে, “ঠিক তাই ওয়াহিদ। আপনার বোঝায় কোনো ভুল নেই। গত তিন মাস ধরে আমি আপনাকে একটু একটু করে জেনেছি, দেখেছি, প্রেমে পড়েছি, ভালোবেসেছি। কিন্তু আপনার ভলোবাসায় সাড়া দেয়া নিজের সাথে অন্যায় করা। আবার না দেওয়াও অন্যায় করা। এই নিদারুন মানসিক সংঘাতে আমি ক্লান্ত। আপনি আমাকে ভালোবাসলেন, আমাকে চাইলেন অথচ তাড়াহুড়ো করলেন। আপনার ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ হয়েছি। বিয়ের আগেও যদি সামনে এসে দাঁড়াতেন, কথা বলতেন তবে কী মুগ্ধ হতাম না? বাবার চোখেমুখের প্রবল আকুতি আমাকে বিয়েতে হ্যাঁ বলিয়েছে। আপনার ব্যক্তিত্ব, সর্বোপরি আপনিতে মুগ্ধ হয়ে, আপনাকে ভালোবেসেছি, ভবিষ্যৎে সংসারও করবো। কিন্তু ওয়াহিদ, আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারার অধিকার আছে। এটা আপনারা ভুলে গেলেন কেনো? আপনি বাবার কাছে বেস্ট চয়েজ। আমার কাছেও বেস্ট চয়েজ কি না সেটা ভাবার সুযোগটাই আমি পাইনি। বিয়ের পরে জানলাম, ইয়েস মানুষটা আমার জন্য পারফেক্ট। বিয়ের আগে কী জানতে পারতাম না? আপনার প্রতি প্রগাঢ় যে অনুভূতি আমার হয় সেটা যতটা আনন্দের ততটাই আবার নিজের অস্তিত্ব সংকটে হেরে যাওয়ার মতো কষ্টের। হুট করে বিয়ের প্রস্তাব আপনারা দিলেও আমার বাবা সেটায় রাজি হয়েছে। এখানে আপনার দোষ নেই। এটা বাবার সাথে আমার বোঝাপড়া। বাবার জন্য মন পুড়লেও একারণেই ফিরে যেতে পারিনি। মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে জীবন কাটানো আম্মু আমাকে শেখায় নি। তাই আপনাকে ভালোবাসলেও এই দেয়াল ভাঙুক চাইনি। ভালোবাসার থেকেও ভালোথাকা জরুরি।”

অপরাজিতা থেমে যোগ করে, “মনের মধ্যে এত জটিলতা নিয়ে সংসার করা যায় না ওয়াহিদ। আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলতে চাইনি। বিয়ের দিনের দমবন্ধকরা অনুভূতিটা আপনার জন্য এতো অন্যরকম মায়াময় সেটা ভেবে হাজারবার কষ্ট পেতে চাইনি। আপনাকে ভালোবাসলেও কষ্ট হচ্ছে। ভালো না বাসলেও যন্ত্রণা হচ্ছে। মানুষ হিসেবে আপনি যদি আরেকটু খারাপ হতেন তবে বোধহয় এই দ্বিধা-দ্বন্দে আমি জড়িয়ে পড়তাম না। আপনি ভালো বলেই বাবার প্রতি অভিমানটা হালকা হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি বাবা আমার জন্য বেস্ট মানুষ টাকে পেয়েছে বলেই হুটহাট বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি বুঝেছি আপনাকে ভালোবাসি সেটা স্বীকার করলেই মানিয়ে নিয়ে জীবন পার করা হবে না। বরং আপনি যে ভীষণ ভালোবাসতে জানেন, সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে জীবন কাটানো হবে। ভালোবেসে ভালো থাকাটাও জরুরি, ওয়াহিদ। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।”

ওয়াহিদের চোখেমুখে খেলা করা বিভিন্ন অনুভুতির ছটায় অপরাজিতা মিষ্টি করে হাসে। বলে, “বাবাকে জানাবেন, আমার আর সময় লাগবে না। তিনি যেনো জলদি আসেন।”

———————————————————————————–

চলবে

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

শেষ পর্ব (সমাপ্তাংশ)

অনেক কাঙ্খিত মানুষটাকে পেয়ে যাওয়ার আনন্দ কতটা তীব্র হতে পারে সেটা ওয়াহিদ ভাষায় বর্ণনা করতে পারবে না কখনও। তবে আজ দু’দিন ধরে সব কিছুতে ভীষণ সুখ সুখ অনুভব হয় তার। অপরাজিতাও ভালোবাসে ওকে, এই ব্যাপারটাই যেনো ম্যাজিকাল। সেদিন অপরাজিতার কথায় কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলো ও। মন বলছিলো অপরাজিতা হারিয়ে যাবে এবং সেটা ওর-ই দোষে। কিন্তু অপরাজিতা নিজের মনের দ্বন্দ্বে যেমন জিতে গেছে তেমনি জিতিয়ে দিয়েছে ওয়াহিদকেও। মনের জটিলতা মিলিয়ে দিয়ে চমৎকার করে আগলে নিয়েছে ওকে।

ওয়াহিদ, অপরাজিতার মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে ওর বাবার কাছে। আনাম সাহেব মেয়ের কথা জেনে কোনো রিয়াকশন দেননি। শান্ত থেকেছেন। তবুও ওয়াহিদ জানে কী প্রচন্ড আকুলতায় তিনি এই ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন। মেয়েকে সময় দিতে হবে, এই উপলব্ধি তার ছিলো বলেই শত অস্থিরতায়ও নিজেকে শক্ত খোলসে আটকে রেখেছিলেন। আনাম হাসনাত! অপরাজিতার বাবা! কি প্রবল আত্মবিশ্বাসে মেয়ের ফিরে আসার অপেক্ষা করেছেন!

***

টিউশন শেষে অপরাজিতা বাসায় ফিরছিলো। সারাদিনের ক্লান্তিটাকে সরিয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাত্রই সন্ধ্যে নেমে আসা শহরটাকে ভীষণ আদুরে ঠেকছিলো ওর। মনের মধ্যে থাকা অনেকদিনের অস্থিরতা বিদায় নিয়ে আশ্চর্য এক শীতলতা তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। অভিমানের প্রগাঢ় অনুভূতি ম্লান হয়ে, ঘরে ফেরার প্রখর অনুভতি হয়ে ধরা দিয়েছে। বাবার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত দুচোখ মেলে প্রতিটা মুহূর্ত পার করছে।

কিন্তু অপরাজিতা জানে না বাবা চলে এসেছেন। ক্রিসেন্ট রোডের বাসায় ওর প্রিয় হাওয়াই মিঠাই নিয়ে অপেক্ষা করছেন সেই কোন বিকেল থেকে।

***

আনাম সাহেব বসে আছেন অপরাজিতাদের বারান্দায়। তিনি যখন এলেন মুনিরা নামের মেয়েটা দরজা খুলেছিলো। অপরাজিতার বাবা শুনে ভেতরে এনে অপরাজিতার রুমে বসিয়েছে। ব্যস্ত হয়ে অপরাজিতাকে ফোন করতে গেলে তিনি নিষেধ করেছেন। বলেছেন অপেক্ষা করবেন। অপরাজিতা তার সময় মতোই আসুক। মুনিরা তাকে চা বানিয়ে দিয়েছে। চা খাওয়ার ফাঁকে মুনিরার সঙ্গে কথায় কথায় জানলেন নতুন এক অপরাজিতাকে।

যখন শুনলেন অপরাজিতা প্রায়ই নিশ্চুপ হয়ে বারান্দায় বসে থাকে, উঠে গিয়ে ওখানে বসলেন তখন। গোধূলির আলোমাখা আকাশে তাকিয়ে মেয়ের লুকানো হাজারো দীর্ঘশ্বাস যেনো অনুভব করতে পারলেন। মেয়েকে ঠিক কতটা কষ্ট দিয়েছেন মনে হতেই অপরাধবোধে, অনুশোচনায় আবারও জর্জরিত হলেন।

অপরাধবোধ, অনুশোচনায় দিশেহারা বাবাকে মুক্তি দিতে, অপরাজিতা বাসায় আসলো সন্ধ্যে পার করে। দরজার বাইরে রাখা বাবার জুতো চিনতে তার ভুল হয়নি একটুও। মনের আনন্দ চোখেমুখে খেলা করলো ওর। অভিমানটাও যেনো মুচকি হাসলো। ঝাপসা চোখে বেল বাজিয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটালো। মুনিরা দরজা খুলে, বাবার আসা থেকে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার সবটাই বললো। মুখ ফুটে কিছুই বলতে না পেরে শান্ত ভঙ্গিতে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো অপরাজিতা, যেখানে মন ভালো করার পসরা সাজিয়ে বসে আছে ওর জীবনের জাদুর মানুষটি।

মেয়ে এসেছে, তার ঠিক পেছনেই বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে টের পেয়েছেন আনাম হাসনাত। কিন্তু ঘুরে তাকাতে পারছেন না। চোখ ভিজে আসছে। মেয়ের দিকে ঘুরে তাকানো এতো কঠিন কবে হলো? কেনোই বা হলো?

অপরাজিতা বাবাকে বুঝে ফেললো চট করে। মৃদু হেসে শুধালো, “কফি খাবে, বাবা?” আনাম সাহেব জবাব দিলেন না, বলা ভালো দিতে পারলেন না। অশ্রুজলে তার কন্ঠ বুজে এসেছে। অপরাজিতা অবশ্য বাবার হ্যাঁ-না বলার অপেক্ষা করলো না। নিজের মতো কফি বানাতে চলে গেলো। তার নিজেরও কান্না পাচ্ছে। বাবা মানুষটার সঙ্গে তার কোনোকালেই লুকোছাপা ছিলো না। দাদী চলে যাওয়ার পরেও বাবাকে সে মন খরাপ করতে দেখেছে, গুমরে কাঁদতে দেখেছে। সেসব দিনে অপটু অপরাজিতা বাবাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজকের কান্নায় ও শামিল হবে না। আজকের কান্নায় বাবার নিজের ভেতরে থাকা অপরাধবোধ মুছে যাক। ওর জাদুর মানুষটা আবারও মাথা উঁচিয়ে ওর সামনে দাঁড়াক।

***

মুনিরা, অপরাজিতার ব্যাপারে অতো ডিটেইলস জানে না। তবে আজকে ওর বাবার আগমনে এতোটুকু বুঝেছে এই মুহুর্তে বাসায় না থাকাটাই ভালো হবে। অপরাজিতা যখন কফি করতে গেলো তখনই মুনিরা, একটু আসছি বলে বেরিয়ে গেছে। কফিও এতক্ষণে হয়ে গেছে। বড় একটা দম নিয়ে অপরাজিতা বাবাকে ডাকে। এবারে উঠে, ডাইনিংয়ে আসেন আনাম সাহেব। বদলে যাওয়া অপরাজিতাকে দেখেন। মেয়েটা এতো শুকিয়ে গেলো কিভাবে! মেয়েকে নিয়ে বাসায় যাওয়ার পর ইরা যে তার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করবে সেটায় কোনো সন্দেহ নেই।

অপরাজিতা চেয়ার টেনে বাবাকে বসতে দিয়ে নিজেও বসে। কফি খেতে খেতে বাবাকে ভালো করে দেখে। সেদিন ওয়াহিদের ফেইসবুক স্টোরিতে দেখা আর সামনে থেকে দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। রেগ্যুুলার মেহেদী দেওয়া বাবার চুলে বোধহয় মেহেদী দেওয়া হয়নি অনেকদিন। সাদা চুল দেখা যাচ্ছে। আম্মু নিজে সবসময় মেহেদী দিয়ে দিয়েছে। বাবা-আম্মুর আসলেই কী কিছু হলো? ওর চলে আসাটা আম্মু-বাবার সম্পর্কেও কী এফেক্ট করলো? শিট! দেরি না করে অপরাজিতা প্রশ্ন করে, “আম্মু কেমন আছে, বাবা?” আনাম সাহেব মুখ খুলেন এবার। জবাব দেন, “নিশ্চয়ই ভালো আছে! দেখলে তেমনই লাগে।” বাবার গলায় ঝরে পরা অনুযোগ টের পায় অপরাজিতা। ও চলে আসায় আম্মু কি কথা না বলে বাবাকে পানিশমেন্ট দিচ্ছে? এই ভাবনায় হাসি পায় ওর। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দও হয়। দারুণ এক উপলব্ধিতে মন জুড়ে প্রশান্তি বয়ে যায়। জগতের সবার কাছে পরিচিত কঠিন ব্যক্তিত্বের আনাম হাসনাত, স্ত্রী-মেয়ের কাছে নিতান্তই সাধারণ একজন মানুষ। যার সাথে চাইলেই স্ত্রী রাগ করে কথা বলা বন্ধ রাখতে পারে। মেয়ে অভিমান করে বাড়ি ছাড়তে পারে।

অপরাজিতাকে চুপ দেখে আনাম সাহেবের অস্বস্তি হয় খুব। শান্ত অপরাজিতাকে কখনোই দেখেননি তিনি। সারাক্ষণ চঞ্চলতায় মাতিয়ে রাখা মেয়েটার সাথে কোনো মিলই যেনো নেই। মেয়েটা কী সত্যিই বড় হয়ে গেলো? এতো তাড়াতাড়ি বড় না হলেই কী চলতো না? তিনি গলায় কুন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করেন, “আমার নেয়া ভুল ডিসিশনে তুই কি খুব বড় হয়ে গেলি, অপরা?” বাবার প্রশ্নে অপরাজিতা সময় নিয়ে উত্তর দিলো, “বড় আগেই হয়েছিলাম বাবা। কিন্তু তোমরা ছিলে বলে ‘বড় হয়েছি’ এই বোধটুকুর প্রয়োজন ছিলো না। তোমাদের ছেড়ে এসে, একা বাঁচার চেষ্টায় অস্তিত্ব সংকটে যখন উঠেপড়ে লেগেছি তখন বুঝলাম আমি বড় হয়ে গেছি। বারান্দায় যে মানি প্ল্যান্ট গাছটা দেখেছো ওটার সাথে আমার খুব একটা পার্থক্য নেই বাবা। যখন অবলম্বন হিসেবে গ্রিল ছিলো, গাছটা গ্রিল বেয়েই শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে। গ্রিল থেকে নামিয়ে দিয়ে যখন এমনি ফেলে রাখলাম, গাছটা বাতাসে দুলতে দুলতে নিচের দিকে নেমে গেছে। নতুন করে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। এতটুকু বড় হওয়াতে, কষ্ট হলেও আমি আনন্দ খুঁজে পেয়েছি।” আনাম সাহেব মেয়ের উত্তরে মুগ্ধ হলেন। অপরাজিতা বুঝলো সেটাও। নিজ থেকেই আবার বলে উঠলো, “তোমার নেয়া ডিসিশনের মধ্যে কোনটাকে ভুল বলছো? আমার জন্য ওয়াহিদকে পছন্দ করেছো, সেটা? আমাকে না জানিয়ে সেদিন ওনাদের আসতে বলেছো, ওটা? নাকি হঠাৎ আকদের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার সিদ্ধান্তটা? কোনটা ভুল, বাবা?”

মেয়ের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে আনাম সাহেব মুচকি হাসলেন। চকিতে একবার অপরাজিতাকে দেখলেন। ওর চোখেমুখের অঘোষিত কৌতূহল যেনো জানান দিলো বাবার কথা শুনতে সে ঠিক কতটা উদগ্রীব। কৌতূহল, প্রশ্ন ফুরিয়ে দিয়ে আনাম সাহেবও এক্সপ্লেইন করলেন তার নেয়া একেকটা সিদ্ধান্তের পেছনের গল্প!

শুরুটা করলেন ওয়াহিদকে প্রথম দেখা থেকে। একে একে বলে গেলেন, কেনো ছেলেটাকে তার ভালো লাগলো। ছেলেটার কোন কোন কোয়ালিটি তাকে মুগ্ধ করলো। মেয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়েকে পর করে দেওয়া নয়, বরং ছেলে পাওয়ার যে ইচ্ছে সেটা ঠিক কীভাবে ওয়াহিদ পূরণ করতে পারলো। দারুন আলাপচারিতায় ওয়াহিদ কীভাবে অপরাজিতায় মুগ্ধ হয়ে ওকে চাইলো, সবটাই মেয়েকে বললেন। অপরাজিতা শুনলো বিভোর হয়ে। যে ওয়াহিদে ওর বাবা মুগ্ধ হয়েছে, সেই ওয়াহিদে ও নিজেও মুগ্ধ হয়েছে। একজন সেইম মানুষকে ঘিরে বাবা-মেয়ের মুগ্ধতার গল্প যদি একই হয় তবে বলা যায় সেই মানুষটা সত্যিই স্পেশাল। আনাম সাহেব কেনো ওয়াহিদকে পছন্দ করেছিলেন সেটা বিগত দিন গুলোতেই অপরাজিতা বুঝতে পেরেছিলো। তবুও বাবার মুখে শুনে ও নতুন করে রিয়েলাইজ করলো বাবা ঠিক কতটা যাচাই-বাছাইয়ের পর ভেবেচিন্তে ওয়াহিদকে ওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে দিলেন। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়। সেই প্রশ্নটা অপরাজিতা করলো বাবাকে, “ওয়াহিদকে তুমি আমার জন্য পছন্দ করেছো। কিন্তু কেনো করলে, সেটা আমিও এখন জানি, বুঝি। উনি আমার জন্য বেস্ট চয়েজ, তা-ও মানি। কিন্তু বাবা, আমাকে জানালে না কেনো? সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে তুমি, আম্মুই শিখিয়েছো। অথচ এই এতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় দিলে কেনো? তোমার পছন্দের ওপর কি তোমার বিশ্বাস ছিলো না? নাকি তোমার পছন্দকে আমি অপছন্দ করতে পারি সেটা ভেবেছিলে? কোনটা?”

আনাম সাহেব মৌন রইলেন। চোখের কোনে আবারও জলেরা ভীড় জমালে অপরাজিতা পরম মমতায় সেটা মুছে দিলো। বাবার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। আনাম সাহেব যেনো এই মমত্ববোধে শক্তি পেলেন। অস্ফুটস্বরে বলতে শুরু করেন, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, অপরা। তোকে অবিশ্বাস করিনি। নিজের পছন্দেও বিশ্বাস ছিলো। তুই এই দুনিয়াতে আসার আগে পর্যন্ত আমি বুঝিনি বাবা হওয়াটা কতটা ম্যাজিকাল হতে পারে। তুই এনআইসিও থেকে যেদিন তোর আম্মুর কাছে আসলি সেদিন থেকে কী ভীষণ মায়ায় তুই আমাদের জড়িয়ে ফেললি। সেই তোকে ছেড়ে একদিন এই দুনিয়া থেকে আমাকে চলে যেতে হবে। তোর দাদী-দাদা চলে গিয়েও আমি তোকে নিয়ে, তোর আম্মুকে নিয়ে বাঁচতে পারছি। তোকেও আমাদের ছাড়া বাঁচতে হবে। এমন নয় যে আমরা না থাকলে তোর জীবন থেমে থাকবে। তুইও কাউকে সঙ্গী হিসেবে পাবি, জীবন ঠিক কেটে যাবে। কিন্তু তোর জীবনসঙ্গী যদি অতোটা ভালো না হয়? তোকে যদি আগলে না রাখে? আমি চিন্তায় অস্থির হলাম। তোর আম্মু আমার অস্থিরতায় হাসলো। বললো কিছুদিন গেলে এইসব পাগলামি চিন্তাভাবনা আমার কেটে যাবে। কিন্তু দিন যতো গেলো, যতো তোর বিয়ের প্রস্তাব আসলো আমি ততোটা দিশেহারা হলাম। অনেক অপেক্ষার পর ওয়াহিদ এলো। আমার স্বস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। বিয়ে দিয়ে দিলেই তো তুই চলে যাবি। আমার মেয়ে আমার বাড়ি ছেড়ে নতুন ঠিকানায় চলে যাবে। বাড়ির লনে আর শিউলি কুড়াবে না। ভ্যানিলা আইসক্রিম কেনো আনতে ভুলে গেলাম সেই রাগে গাল ফুলাবে না। হাওয়াই মিঠাইয়ের বায়না করবে না। মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দিবো আমি? যে মেয়েকে ঘিরে আমি, ইরা -আমরা জীবন সাজালাম সেই মেয়েকে ছাড়া আমাদের দিনগুলো কিভাবে পার হবে? তুই ছাড়া আমাদের আছেই বা কে? এই হারানোর ভয়ে আমি স্থির হতে পারছিলাম না। ওয়াহিদদের আসতে বলতে মন চাইলো না। তবুও একদিন ডাকলাম। শর্ত রাখলাম তুই জানবি না। তোকে রয়েসয়ে বলার ছুতোয়, আরো ক’টা দিন আমাদের কাছেই রেখে দিতে চাইলাম। ওরা এলো। তোকে ওদের পছন্দ হলো। ওরা প্রস্তাব দিতেই নিদারুণ অস্থিরতায়, হারানোর ভয় আমাকে জেঁকে ধরলো। আমি না-ই বলতে যাচ্ছিলাম। তোর বড় ফুপি আমার মন পড়ে ফেললো। শক্ত কন্ঠে বললো আমার মনের এই অমূলক ভয় ঝেরে না ফেললে কোনোদিনই তোকে বিয়ে দিতে পারবো না। যত ভালো ছেলেই হোক আমি এগোতে পারবো না। মনের অমূলক ভয় ঝেরে ফেলার চেষ্টায় আমি সাহস করে রাজি হয়ে গেলাম। মেয়ের জন্য পছন্দ করা বেস্ট চয়েজটা মেয়েও পছন্দ করবে সেই বিশ্বাসে, আমি সাহস দেখিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। বারবার মনে হলো আজকে যদি ওরা চলে যায়, যেই সাহসটা আমি করতে পারছি সেটা আর পারবো না। মেয়ে অন্যের ঘরে যাবে, এই কঠিন সিদ্ধান্ত বারবার নেয়ার মতো মানসিক শক্তি আমার ছিলো না। চিরকাল ধরে চলে আসা নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়ে আমি সেদিন রাজি হয়ে গেলাম।”

বাবার কথার এ পর্যায়ে হাপুসনয়নে কেঁদে চলা অপরাজিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বলে চললেন, “তোর সিদ্ধান্ত তুই-ই নিবি সবসময়। সেটাই তোকে শিখিয়েছি অথচ সেদিন নিজের কথাই কেবল ভেবেছি। তুই ভেবেচিন্তে জানাবি এই সময়টা তোকে দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। তোর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তোর হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। স্যরি, মা।”

হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু খারাপ বাবা একটাও নেই। অপরাজিতার বাবা সেই বাবাদেরই একজন। জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘কোটা ফ্যাক্টরির’ একটা সংলাপের বাংলা করলে দাঁড়ায়, মা-বাবার সিদ্ধান্ত হয়তো ভুল হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য কখনো ভুল হতে পারে না। আনাম সাহেবের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো, তবে অমন হঠাৎ নেয়া সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য খুব কি ভুল ছিলো?

অপরাজিতা বাড়ি ফিরেছিলো সেদিনই। আম্মু ওকে দেখে শুরুতে খুব রাগ দেখিয়েছে। এতো ফোনকল, মেসেজ কিছুতেই মেয়ের মন গলেনি অথচ বাবা যেতেই চলে এসেছে -এই নিয়ে খানিকক্ষণ কপট অভিযোগও করেছে। অপরাজিতা হাসিমুখে সব বকা শুনেছে। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী মেয়ে হয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলে ভাব করতে বলেছে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণে মিশে গিয়ে অনেকগুলো দিন পরে আরাম করে ঘুমিয়েছে।

***

আজকে অপরাজিতা-ওয়াহিদের রিসেপশন। দুমাস ধরে চলা আয়োজনের আজকে শেষদিন।

আকদ হয়ে যাওয়ার পরে আবার নতুন করে এনগেজমেন্ট, বিয়ে পড়ানোতে রাজি ছিলো না অপরাজিতা। কিন্তু ওয়াহিদের ‘বিয়ে জীবনে একবারই করছি!’ যুক্তির সামনে তার আপত্তি ধোপে টেকেনি। বহু আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, গায়ে হলুদের দু’টো প্রোগ্রাম আর ওয়েডিং রিসেপশন, এই তিনে, অপরাজিতা-ওয়াহিদের নতুন পথ চলার শুরু হবে। বিয়ে নিয়ে কারো উৎসাহ-ই কম না। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে ইরা, মেঝ ছেলের বিয়েতে জোহরা -কারোই আনন্দের শেষ নেই। রোজ তারা দুজনে ফোনে কথা বলছেন, এটা-সেটা ঠিক করছেন। ছেলে-মেয়েকে একসাথে কি দারুন মানাবে সেই সুখস্বপ্নে বিভোর হচ্ছেন। তাদের এতোসব প্ল্যানিংয়ে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় বোধহয় ছিলো ওয়েডিং প্ল্যানার টিম। তবুও কোনো কিছু থেমে থাকে নি। বিয়ের শপিং থেকে শুরু করে ওয়াহিদ-অপরাজিতার নতুন ফ্ল্যাট সাজানো সবটাতেই তারা দারুন কাজ দেখিয়েছে। অপরাজিতার মনে হয় এই টিম ছিলো বলেই রিসেপশন পর্যন্ত ও আসতে পেরেছে। বিয়ে ওর। কিন্তু সবার এতো আগ্রহ, এতো এতো মতামত। এরটা শুনলে ও মন খারাপ করে। ওরটা বাদ দিলে এ নতুন আরেকটা বলে। এতোসব আইডিয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে, অপরাজিতা তখন মা-শাশুড়ি আর ওয়েডিং প্ল্যানার শম্পাকে সঙ্গে নিয়ে বসেছে। ক্লিয়ারলি জানিয়েছে, দু’টো হলুদের একটায় হলুদ হলে অন্যটায় সবুজ রং থাকতে হবে। শাড়ি-লেহেঙ্গা যাই হোক তার কোনো সমস্যা নেই। আর রিসেপশনে তার পড়নে গাঢ় লাল রঙ থাকতেই হবে। শাড়ি হতে পারে তবে লেহেঙ্গা বেটার অপশন। ডিজাইন নিয়ে তার কিছু বলার নেই। মায়েরা সবাইকে নিয়ে যেয়ে কিনুক। যেখান থেকে ইচ্ছে কিনুক। জুয়েলারি নিয়েও সেইম। সাজসজ্জায়ও মেকআপ আর্টিস্টের ইচ্ছেই ফাইনাল, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হয়। এরপরে ওকে আর কেউ তেমন বিরক্ত করেনি।

ওয়াহিদ যখন শুনলো রিসেপশনে অপরাজিতা গাঢ় লাল পরবে, তখন ওর মনে হলো ইন্ডিয়া থেকে আনা লাল রঙা সিল্কের কাঞ্জিভরম শাড়িটাই তো অপরাজিতা পরতে পারে। কিন্তু রিসেপশনের শপিং নিয়ে মা-শাশুড়িসহ সকলের এতো এক্সাইটমেন্ট দেখে সেই কথা শেষ পর্যন্ত আর বলেনি। আবার ওর পজেসিভ সত্ত্বাও অপরাজিতা এই শাড়ি কেবল ওর জন্য পরুক সেই চিন্তায় সায় দিয়েছে! শেষে ওর কেনা শাড়িগুলো অপরাজিতাকে পাঠিয়ে দিয়েছে ওয়েডিং গিফট হিসেবে। প্রত্যেকটা শাড়ির সঙ্গে আলাদা করে চিরকুট এঁটে দিয়েছে। অপরাজিতা শাড়ি দেখে যতটা খুশি হয়েছে চিরকুট পড়ে ততটাই লজ্জায় রাঙা হয়েছে। কী ভেবে, কোন শাড়ি কেনা হয়েছে সেটা লিখে পাঠালে অনুভূতিরা অমন লাল রঙ ধারণ করে ছোটাছুটি তো করবেই!

সিলভার-পিংক কম্বিনেশনের কাঞ্জিভরম শাড়িটায় শুধু অপরাজিতাকেই মানাবে, ওয়াহিদের জোর দিয়ে লেখা এটুকু কথায় কী ছিলো কে জানে! অনেকবছর আগে, ছোট্ট অপরাজিতার মনে গেড়ে বসা ‘গোলাপি বেগম’ এইবার বোধহয় ধুয়েমুছে যাবেই। ওই ঘটনার পরপর আম্মু-বাবা চেষ্টা করেছিলো ওকে বুঝাতে। কিন্তু ছোট্ট অপরাজিতার কান্নাকাটিতে হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। বড় হওয়ার পরও জোর করেনি। নিজেরাও এভোয়েড করেছে। ওয়াহিদ এই ঘটনা জানে না। তাই কিনে ফেলতে পেরেছে। অপরাজিতা একসময়ের অতি প্রিয় রঙটাকে আবার ধারণ করলে বাবা-আম্মুও নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে।

বিয়ের শপিংয়ে যখন সবাই ব্যস্ত অপরাজিতা আর ওয়াহিদ নিজেরা মিলে ফ্ল্যাট সাজানোর এটা-সেটা কিনেছে। ওখানেই এক দোকানের কুশন কভার দেখে ওর বেশ পছন্দ হলো। কিনে ফেলতে গিয়ে মনের খেয়ালে বলে ফেললো, আমাদের রুমের সোফার কুশনে এটা খুব মানাবে। বলতেই খেয়াল হলো ওয়াহিদের রুমটা কখনো ওর নিজের হবে কি না সেই শংকা কাটিয়ে দিয়ে, ওয়াহিদ ওকে আস্ত একটা সংসার উপহার দিয়েছে।

গায়ে হলুদের দু’টো প্রোগ্রামেই একটা ঘরোয়া আমেজ ছিলো। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের বাইরে কাউকেই দাওয়াত করা হয়নি। দু’হাত জুড়ে মেহেদী রাঙানো, হাসিতে মুখরিত অপরাজিতাকে দেখে ওয়াহিদের রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের মতো বলতে ইচ্ছে করেছে, “আমি পাইলাম,’আমি ইহাকে পাইলাম।’ কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে।”

সকলের মিলিত হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাসে, বিদায়ের সুরটাও কোথাও একটায় অপরাজিতাকে বারবার কাঁদিয়েছে। মায়া-মমতার চিরচেনা মানুষগুলোকে ছেড়ে, নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন স্বপ্ন চোখে নিয়ে চলে যাওয়াটা যতটা মন খারাপের ততটাই আবার আনন্দের। পাওয়ার আনন্দ-হারানোর বেদনা, সমানতালে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। আদুরে মেয়ে থেকে নবপরিণীতা হওয়ার এই উপাখ্যান, সকল অপরাজিতাদেরই তো এক!

সন্ধ্যের রিসেপশনে, হাজারো অতিথিদের শুভকামনায় অপরাজিতা-ওয়াহিদের বিবাহিত জীবনের শুরুটা হলো মহাসমারোহে। আত্মজার বিদায়ে সিক্ত হলেন অপরাজিতার আম্মু। জীবনের কঠিন নিস্তব্ধ সময়টায় অপরাজিতার মা হয়েছিলেন তিনি। অনিবার্য এই বিচ্ছেদে অপরাজিতা খুব ভালো থাকুক, এই কামনায় মেয়েকে জড়িয়ে রাখলেন শেষ পর্যন্ত।

বাবা নামের জাদুর মানুষটা চোখে কান্না, মুখে চমৎকার হাসি নিয়ে অপরাজিতাকে তুলে দিলেন, ওর জীবনে ভালোবাসা হয়ে আসা জাদুর মানুষটার কাছে। নতুন স্বপ্ন, গোছালো-অগোছালো ইচ্ছে, হুটহাট রাগ-অভিমান নিয়ে শুরু হলো ওদের নতুন অধ্যায়।

***
ওয়াহিদদের বাসায় টুকটাক বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে, অপরাজিতাকে নতুন সাজানো ফ্ল্যাটের বেডরুমে কিছুখন আগে রেখে গিয়েছে ওয়াহিদের বোন-ভাবী-কাজিনরা। সকলে চলে যেতেই- সারাদিনের ক্লান্তি, সাজগোজ ধুয়েমুছে অপরাজিতা সময় নিয়ে গোসল সারলো। ওয়াহিদ বাসায় আসেনি তখনও। সেই সুযোগে অপরাজিতা লাল রঙা সিল্কের কাঞ্জিভরম শাড়ীটা পরে ফেললো। খোলা চুলে, গাঢ় লাল লিপস্টিকে নিজেকে ওয়াহিদের মনমতো সাজিয়ে তুললো। বিয়ের উপহার হিসেবে ওয়াহিদের প্রিয় ব্র্যান্ডের ঘড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকলো।

ওয়াহিদ এলো রেড ভেলভেট কেক নিয়ে। নতুন জীবনের শুরুটা মিষ্টিমুখে হোক! পারফেক্ট এন্ড ডীপ লাভের প্রতিনিধিত্ব করা টিউলিপ ফুল উপহার দিলো, ওর একান্তই ব্যক্তিগত মেয়েটাকে। পূর্ণতার নোনাজলে ভাসিয়ে অপরাজিতার অনামিকায় সবশেষে পরিয়ে দিলো রেডিয়েন্ট কাট ডায়মন্ড রিং। ওর গভীর চাহনিতে মাদকতার ছড়াছড়ি। লুকিয়ে, আঁড়চোখে তাকানোর দিনের সমাপ্তি টেনে, ওয়াহিদ স্পষ্ট মুগ্ধতা নিয়ে নবপরিণীতাকে দেখে। আকুলতায় ডুবে প্রশ্ন করে, “আমি যদি অনেক করে তোমার হই, তবে কি অনেক করে তোমাকে পাবো, অপরা?” ভালোলাগার আবেশে, ঘোরের মধ্যে হারিয়ে অপরাজিতা মাথা দোলালো কেবল।

ঠিক এইভাবে অপরাজিতার একটা ভালোবাসার গল্প হলো। সবখানে এতো মানুষের ভীড়ে, একটা নিজের মানুষ হলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী হলো। রাতজাগার সঙ্গী হলো। অনেকখানি মায়ায় জড়ানোর প্রিয় মানুষ হলো।

——————————————————————————

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে