#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ
২য় পর্ব
গেস্টরা খেয়ে উঠার পর অপরাজিতারা খেতে বসেছিলো। কিন্তু ততক্ষণে চনমনে খিদেটা মিলিয়ে গেছিলো ওর। দু’পিস কাবাব খেলো কোনোরকমে। আম্মু কত সাধলো, তবুও ইচ্ছে করেনি। শর্মীপুর মেয়েকে নিয়ে চলে গেছিলো উপরে, ওর রুমে৷ খাওয়া শেষে আয়নাভাবী, শীলাপু-শর্মীপু জয়েন করেছিলো ওকে। নিজেদের মাঝে এটা-সেটার গল্প করলো। ছবি তুললো। তারপর এলো সেইক্ষণ।
আসরের আজান পরে যাওয়ার কিছুখনের মধ্যে বাবা-আম্মু ওর ঘরে এলো। পেছনে মামা। ওদের দেখে ভাবী-আপুরা ব্যালকনিতে চলে গিয়ে স্লাইডিং ডোর টেনে দিলো। ঘড়িতে তখন বোধহয় সাড়ে চারটে।
অপরাজিতা অবাক হয়েছিলো ওদের দেখে। ওকে খাটে, নিজের পাশে বসিয়ে যখন বাবা কথা শুরু করলো তখন অবাকের চূড়ান্ত হলো। আজকের গেস্ট মাজহার আংকেল ওর বাবার বন্ধু, ঠিক। কিন্তু ব্যবসার বন্ধু না। অনেক বছর আগে তারা একসঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন। মাজহার উদ্দিনের বাবা সরকারি চাকুরির সুবাদে বদলি হয়ে গেলে, যোগাযোগটা আর হয়ে উঠে নি। অনেকসময় পর গতবছর দেখা হয়েছে, বলা যায় ব্যবসার খাতিরেই। তারপর থেকেই যোগাযোগ হয়েছে প্রতিনিয়ত। মাসখানেক ধরেই মাজহার সাহেব, তার মেঝ ছেলের জন্য বউ খুঁজছেন। অপরাজিতার জন্মদিনে ওকে নিয়ে ফেইসবুক একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ওর বাবা আনাম হাসনাত৷ সেখানেই অপরাজিতার ছবি দেখেন মাজহার সাহেব। মিষ্টিমুখের মেয়েটাকে পছন্দ হতেই, ছেলের জন্য চেয়ে বসলেন। শুরুতে রাজি ছিলেন না অপরাজিতার বাবা। মেয়েকে এখনই বিয়ে দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু মাজহার সাহেবের বারবার আকুতি তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করেছে। অপরাজিতার মাকে বলার পর, তিনি একবার দেখতে আসার ক্ষেত্রে সায় দিয়েছেন৷ তখনই অপরাজিতার খালা, মামা, ফুপু, চাচাদের জানিয়েছেন। ছেলের বাবা সম্পর্কে শুনেই সকলে পজিটিভ ফিডব্যাক দিয়েছেন৷ ছেলের সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছেন। সবদিক বিবেচনা করেই আনাম সাহেব আজকে ওদের আসতে দাওয়াত করেছেন। কিন্তু সেটা আন-অফিশিয়ালি। ওনারা এসে অপরাজিতাকে দেখে যাক। ছেলেও জানুক বাবার পছন্দ করা মেয়েটা কেমন। অপরাজিতাও সবাইকে কম্ফোর্টেবলি দেখুক। ওনারা চলে যাবার পরই ওকে জানানো হবে এই আন-অফিশিয়ালি দেখার কথা। তারপর সিদ্ধান্ত ওর। ভেবেচিন্তে জানাবে। ছেলের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু! একটু বদল এসেছে প্ল্যানিয়ে। মাজহার সাহেবের পরিবারের সবার অপরাজিতাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আনঅফিশিয়াল দেখা-সাক্ষাৎকে ওনারা অফিশিয়াল করতে চাইছেন! সোজা বাংলায় বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে চাইছেন! আজকেই! এখনই!
বাবার কথা শেষেই অপরাজিতার মামা বললেন, “অপরা, ওনারা এতো রিকুয়েষ্ট করলো তাই অনেক ভেবেচিন্তে আমরা তোকে জানালাম। তারমানে কিন্তু এটা না যে তোকে বিয়ে করতেই হবে। এখনই করতে হবে সেটা তো আরো না৷ তোর বাবার এতে খুব একটা সায়ও নেই। ওদেরটা ওরা বলেছে। আমরা করবো সেটাই যেটা তুই চাইবি। তোর ওপর কোনো জোর নেই, মা।” মামার কথা শুনেই অপরাজিতা ফিক করে হেসে ফেললো। তারপরই গম্ভীর হয়ে গেলো। কয়েকমিনিট পর সরাসরি বাবার দিকে তাকিয়ে নরমস্বরে বললো, “তোমার কথায় এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে বাবা, আমি ছাড়া আজকে উপস্থিত সকলেই সবটা জানতো। অথচ, বিয়ের কথা, আন-অফিশিয়ালি দেখতে আসা, পুরোটাই আমিকেন্দ্রিক। আমাকে কেনো বললে না বাবা? এমন তো নয় আমার কোনো পছন্দ আছে। তাহলে আমার কাছে লুকাতে কেনো হলো?”
ওর কথায় কেউ কোনো জবাব দিতে পারলো না। জবাব না পেয়ে, ও আবার বললো, “বাবা, তুমি বললে তুমি রাজি ছিলে না। সবাই পজিটিভ ফিডব্যাক দেওয়াতে তুমি এগিয়েছো। ওদের আসতে বলেছো। কিন্তু বাবা, তুৃমি একজন বিজনেসম্যন। দ্যাট মিনস ভেরি ক্যালকুলেটিভ। তুমি ছেলের সম্পর্কে সব খোঁজ নিয়েছো। তোমার পছন্দ হয়েছে। না হয় তোমার বন্ধু যত যা বলুক তুমি আম্মুকে জানাতে না, বাকী ফ্যামিলিকে জানাতে না। সবাই যতই বলুক তুমি যদি না চাইতে ওরা আজকে কোনোভাবেই এখানে আসতে পারতো না। তারমানে তুমি চেয়েছো, বাবা। ইনফ্যাক্ট, এইযে ওনারা আজকে বিয়ে করাতে চাইছে, এটায় তোমার সম্মতি আছে। মামা যে বললো তোমার সায় নেই, সেটা খুবই ভুল। তোমার সম্মতি আছে বলেই, উই আর হ্যাভিং দিজ কনর্ভাসেশন রাইট নাও! তুমি না চাইলে, ওনারা কি চাইলো সেটা আমি পর্যন্ত এখন কোনোভাবেই আসতো না বাবা।” বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ফের বললো ও, “বাবা। বিব্রত হয়ো না প্লিজ। তুমি যেহেতু চাইছো এই বিয়েটা আমি করি, তারমানে এটাই আমার জন্য বেস্ট। আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা। বিয়েটা আমি করবো।”
অপরাজিতার কথায় রুমজুড়ে যে পিনপতন নীরবতা এসেছিলো সেটা ভাঙলো বড়ফুপির আগমনে। অপরাজিতা মত দিলো কি না সেটা দেখতেই তিনি এসেছিলেন। সবার থমকানো চেহারা দেখে ধরে নিলেন অপরাজিতা না করে দিয়েছে। তবুও তাড়া দিলেন। গেস্টরা অপেক্ষা করছে। তাদের কিছু একটা তো বলতে হবে। মৌনতা ভেঙে অপরাজিতার আম্মু বললেন, “তুই শিওর, অপরা? সবকিছু খুব ফার্স্ট হচ্ছে। আমার ভালো লাগছে না। তুই আরো সময় নে। বিয়ে-ফিয়ে করা লাগবে না।” অপরাজিতা মায়ের কথায় গা করলো না। আগের মতোই বসে রইল। বাবার কথার অপেক্ষা করলো।
অবশেষে আনাম হাসনাত মেয়েকে বললেন, “বিয়ে একটা কমিটমেন্ট, অপরা। আমার মনে হয়েছে এখানে বিয়ের পর তুই আজীবনের একটা সাপোর্ট সিস্টেম পাবি। খুব ভালো থাকবি। রাগ থেকে নয়, ভেবে বল তুই রাজি কি না। যেটাই বলবি আমি মেনে নেব।” বাবার কথার পর অপরাজিতা সময় নিলো না। সঙ্গে সঙ্গে বললো, “আমি রাজি, বাবা। ভেবেই বলছি।”
ওর মত পেয়েই মামা, বড়ফুপি স্বমস্বরে উচ্চারণ করলেন, “আলহামদুলিল্লাহ।” বাবার চোখেমুখে দেখা গেলো তৃপ্তির হাসি। আম্মুর চোখে শংকা। অপরাজিতা সব দেখেও যেনো কিচ্ছু দেখলো না। কেমন ভোঁতা এক অনুভূতি নিয়ে ঠায় বসে রইল।
নতুন আয়োজন করতে হবে। একে একে সবাই বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যালকনি থেকে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো আড়ি পেতে সমস্তটা শুনতে থাকা তিন রমণী! শীলাপু জড়িয়ে ধরলো ওকে। অপরাজিতার বিয়েতে সে কত্ত খুশি সেটাই বারবার করে বললো। শর্মীপু বললো, “মাছ ব্যবসায়ীর বউ তবে হয়েই গেলি, অপরা।” কথাটা খট করে বিধলো অপরাজিতার কানে। মাছ ব্যবসায়ী! শুনেই কেমন জানি গা গুলিয়ে আসতে চাইলো ওর! অথচ বাকীদের কোনো হেলদোল নেই। আয়না ভাবী মিটমিটিয়ে হাসছে কেবল।
***
ছোট ফুপি এলো বিয়ে পরানোর মিনিট দশ আগে। অপরাজিতা তাকে দেখেই হেসে বললো, “আর একটু হলেই আমার বিয়েটা মিস করে ফেলতে!” সকলেই যেনো কিছুটা চমকালো। বিয়েতে রাজি হবার আগে না হোক, পরে অন্তত ছেলের সাথে ও কথা বলতে চাইবে সেটাই সবাই ভেবেছিলো। কিন্তু অপরাজিতা বড়ই নির্লিপ্ত। ওর মায়ের মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। তবে তিনি সেটা ধরতে পারছেন না। তার হাজব্যান্ডকে যেমন বুঝতে পারছেন না, তেমনি মেয়ের মনও পড়তে পারছেন না।
সকলের জল্পনা-কল্পনা, আশংকাকে একপাশে রেখে, পড়ন্ত বিকেলে মাগরিবের আগে আগে অপরাজিতার আকদ হয়ে গেলো। বারো লক্ষ টাকা কাবিনে। কাজীসাহেব যখন কবুল বলতে বললো, একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই ও তিনবার কবুল বলে ফেললো। ছেলের নামটা কী যেনো শুনলো। শাহেদ? খালেদ? একহাত দূরত্বে বসে থাকা ছেলেটার চেহারাও ঠিকমতো খেয়াল করতে পারলো না। সারাটাক্ষণ একটা মাছ মাছ আঁশটে গন্ধে ও কাবু হয়ে রইল!
বিয়ের পর ওদের একসাথে বসিয়ে চটজলদি কিছু ফটোসেশন করা হলো। একফাঁকে শ্বশুরবাড়ির কেউ একজন খেজুর সামনে ধরলো। এত তাড়াতাড়ি খেজুরও ম্যানেজ করে ফেলেছে। নিশ্চয়ই বাবার কাজ। চমৎকার! কেউ কেউ ওর হাতে সালামি গুঁজে দিলো। ওদের একসাথে কী দারুন লাগছে সেটাও বললো। এতসবের ভীড়ে স্ট্যাচুর মতো ও কেবল বসে থাকলো।
মাগরিব আজান পরতেই অপরাজিতাকে অবশেষে রুমে পাঠিয়ে দেয়া হলো। নামাজের পরই গেস্টরা বেরিয়ে পরবেন। এর মাঝে এক কান্ড হলো। ছেলের বড় ভাবী মেহের সুযোগ বুঝে ছোট ফুপিকে বললেন, “ছেলে-মেয়ে দুজন তো বিয়ের আগে কথা বলার সুযোগ পেলো না। চট করেই বিয়েটা হয়ে গেলো। ওদের তো জানাশোনা দরকার। আজকে আমার দেবর নাহয় থাকুক।” ছোটফুপি প্রায় রাজিই হয়ে যাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস সেখানে আয়না ভাবী ছিলো। সে দ্রুত অপরাজিতার মাকে ডেকে আনলো। অপরাজিতার মা আব্দার শুনে কঠিন হলেন। এত তাড়াহুড়ো তার পছন্দ হচ্ছে না। বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে সবকিছু। রাজি না হয়ে বললেন, “বিয়ে যেহেতু হয়েছে ওরা একসাথেই থাকবে। তবে আজকেই সেটার প্রয়োজন নেই। খুব জলদিই হয়তো বিয়ের প্রোগামের দিন-তারিখ ফিক্সড করা হবে। ততদিন ওরা দূর থেকেই চিনুক-জানুক। কিছু মনে কোরো না। তোমার কথা রাখতে পারছি না।” মেহের লজ্জা পেয়ে ফেরত গেলো। হুট করেই বিয়েটা হয়েছে। মেয়েটার নিশ্চয়ই সময় লাগবে। তার দেবর সেটা বুঝলে তো!
গেস্টরা চলে যাবার খবর পেতেই অপরাজিতা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। পরিধান করা শাড়িটা জগদ্দল পাথর ঠেকলো। ভাবতেই আশ্চর্য লাগলো এটা ওর বিয়ের শাড়ি। এভাবেও বিয়ে হতে পারে? নিজের সাথে না ঘটলে ও বুঝতোই না। দেখতে এসে হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়াটাই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?
কী ভেবে ও উঠে পরলো। শাড়ি পালটে একটা সুতির সালোয়ার কামিজ পরলো। প্রয়োজনীয় দু-তিনটে জিনিস, কদিন চলার মতো জামা-প্যান্ট, কামিজ একটা ট্র্যাভেল ব্যাগে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পরলো। বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে ড্রয়ইংরুমে গিয়ে হাজির হলো। ভাই, বোনেদের মাঝে বসে নিচুস্বরে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন আনাম সাহেব। অপরাজিতাকে দেখে মাথা উঁচিয়ে তাকালেন। মেয়ের হাতে ব্যাগ দেখেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো, কিচ্ছু ঠিক নেই।
চলবে।