বিয়েকথন পর্ব-০১

0
779

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

১ম পর্ব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কবি সুফিয়া কামাল হল। ২০৬ নাম্বার রুমের কোণার বেডটায় গতদিন উঠেছে অপরাজিতা। ইংরেজিতে অনার্স করা অপরাজিতার হলে থাকার আদতে কোনো প্রয়োজন নেই। মিরপুরে ওর বাবার বিশাল বাড়িটি দেখে যে কেউ নির্দ্বিধায় সেকথা বলবে। তবুও অপরাজিতা যখন সন্ধ্যেনাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে রিপা কে ফোন করেছিলো, রিপা তখন কী ভেবে ওকে হলে ওর রুমে উঠতে বলেছে।

হলে এসে অপরাজিতার আরো মন খারাপ হয়েছে। রুমে আটজনের সিট। আটজনই তাদের বই-খাতা নিয়ে রীতিমতো সংসার পেতেছে বলা যায়। সেখানে ও অনাহূত অতিথির মতো। যদিও ওরা ওকে সাদরেই গ্রহণ করেছে, তারপরও অপরাজিতার অস্বস্তি কাটেনি। সিনিয়র তোরাপু বললো, “হুটহাট কতো মেয়ে এমন এসে উঠে। শুধু হল লাইফটা কেমন দেখতেও বন্ধুরা আসে। আবার চলেও যায়৷ তুই কিচ্ছু ভাবিস না অপরা। যতদিন ইচ্ছে থাক। আমরা কত আনন্দ করি, স্ট্রাগল করি- দেখে যা।” তোরাপু বাংলা সাহিত্যে পড়ে বলেই বুঝি সুন্দর করে কথা বলতে জানে। কী চমৎকার করে ওর অস্বস্তিটা কাটিয়ে দিলো। অপরাজিতার আরও একটা ব্যাপার ভালো লাগছে। কেউ জানতে চায়নি ও কেনো হলে এসে উঠেছে। রিপাও জানতে চায়নি। নিজের মতো বানিয়ে বলেছে, “অপরাজিতা ক’টা দিন থাকবে। সামনেই আমাদের মিডটার্ম এক্সাম। একসাথে পড়ালেখা করবো।”

গতরাতে অপরাজিতাকে বেড ছেড়ে দিয়ে রিপা ফ্লোরে শুয়েছে। বলেছে, “আজকে বেড তোর। পরদিন আমার। শাফল করে থাকি, ওকে?” অপরাজিতা কিচ্ছু বলতে পারেনি। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে রিপাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজিতা চেনা মুখ। ডিবেট করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা মেয়েটাকে সিনিয়র-জুনিয়র সকলের পছন্দ। সুন্দরি, মিষ্টভাষী অপরাজিতার বন্ধু সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এতো এতো বন্ধু থাকতেও কে আসল শুভাকাঙ্ক্ষী সেটা বেশ বোঝে ও। তাই অমন ঝামেলার মাঝে সবার আগে মফস্বল থেকে আসা রিপাকেই ফোন দিয়েছে ও। সবটা দিয়ে আগলে রাখতে জানার বিশেষ গুন আছে এই মেয়েটার। একবার ফোন করতেই কিচ্ছু না ভেবে বললো চলে আয়। এমন করে আর কেউ কী বলতো!

***

অনেকক্ষণ ধরে এটা-সেটা ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইলেও আর পারছে না অপরাজিতা। রুমে এই মুহুর্তে কেউ নেই। সকলেই ক্লাসে নয়তো লাইব্রেরিতে গিয়েছে। ওর ইচ্ছে করছে না বলে, রিপা কিছু বলেনি। একাই চলে গেছে ক্লাসে। তারপরেই দরজা আটকে রিপার বেডে এসে শোয় অপরাজিতা। খোলা জানলায় দূরের আকাশ দেখে। আনমনে ভেসে উঠে একটা চেহারা। যার সাথে গতদিন বিকেলে বিয়ে হয়েছে অপরাজিতার!

বাবা-আম্মুর একমাত্র মেয়ে অপরাজিতা। আদরে- আহ্লাদে বড় হয়েছে ও। যখন যা চেয়েছে তখনই সেটা পেয়েছে। তবে ওর চাওয়া-পাওয়া সবসময়ই ছিলো সীমিত। আম্মুর থেকে শিখেছে প্রয়োজনের কোনো কিছুই ভালো নয়। তাই বাবার টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির বড় ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও, অপরাজিতা জীবন কাটিয়েছে সাধারণ মেয়ের মতোই। সরকারি স্কুল-কলেজে পড়েছে। নিজের মেধায় চান্স পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিউশন করিয়েছে। বাবা শুরুতে একটু গাঁইগুই করলেও পরে খুশি হয়েছে। তবে প্রতিমাসে ওর অ্যাকাউন্টে ঠিকই টাকা দিয়েছে। বলেছে, “তুই টিউশন করা, মা। আমি তো বাঁধা দিচ্ছি না। তেমনি তোর হাতখরচ দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। আমাকেও বাঁধা দিস না।” হাসিমুখেই মেনে নিয়েছে অপরাজিতা। টিউশনের টাকায় বাবা কে তার প্রিয় ব্র্যান্ডের শার্ট কিনে দিয়েছে কখনো। কখনোবা আম্মুকে কিনে দিয়েছে তার প্রিয় জামদানি। বন্ধুদের সাথে ট্যুরেও গিয়েছে কখনোসখনো। সবে মিলে ওর জীবনটা সুন্দর কাটছিলো। দীর্ঘশ্বাসের কোনো গল্প ওর নেই।

আসলেই কী নেই? মাঝেমধ্যেই অপরাজিতার মনে হয়েছে, আমার কেনো একটা ভালোবাসার গল্প নেই? কেনো পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার কেউ নেই? কেনো রাতজাগার একটা সঙ্গী নেই? কেনো একটুখানি মায়ায় জড়ানোর কেউ নেই? ওর জীবনে ভালোবাসা আসেনি। মুগ্ধচোখে তাকিয়েছে অনেকে কিন্তু হাত বাড়িয়ে দেয়নি। যারা দিয়েছে তাদের চোখে অপরাজিতা ভালোবাসা খুঁজে পায়নি। তবু অপেক্ষা করেছে। প্রিয় কারো ওর জীবনে আগমনের অপেক্ষা করেছে। কিন্তু গতকাল সব অপেক্ষা ফুরিয়েছে। অচেনা-অজানা একজনের সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে ওর আপত্তি কোনোকালেই ছিলো না। কিন্তু তাই বলে হুট করে কাউকে বিয়ে করে ফেলতে যে আপত্তি হবে না, তা নয়।

ঘটনার সূত্রপাত গতকাল সকালে। এগারোটা নাগাদ। আর্লি মর্নিং ক্লাসের পরপর ওর একটা টিউশন ছিলো। সেটা শেষে ওর নীলক্ষেত যাবার কথা। কিছু নোট ফটোকপি করতে দিয়ে এসেছিল মামুন মামার কাছে। তার আগেই আম্মু ফোনে বাসায় ফিরতে বললো। গেস্ট আসবে। ওর নাকি থাকতে হবে। অতশত না ভেবে ও টিউশন ক্যানসেল করে বাসায় ফিরলো। গিয়ে দেখে বিশাল আয়োজন হচ্ছে। বড়ফুপি এসেছে, ছেলের বউ আয়না ভাবীকে নিয়ে। ছোটফুপি বিকেলের মাঝে এসে পরবে তার ছানা-পোনাদের নিয়ে। ওর একমাত্র মামা এসেছে মামীকে নিয়ে। মামাতো বোন শীলাপু আসছে হাসব্যান্ড নিয়ে। বড়খালা আসবে কি না শিওর বলেনি। তবে খালাতো বোন, শর্মীপু আসবেই। বড়জোর দুপুর হতে পারে। ছোট চাচ্চু তো আরেক কাঠি এগিয়ে। এসেই কিচেনে ঢুকে খোঁজ নেয়া শুরু। নামী রেস্তোরাঁর দামী শেফ কি না! ছোট চাচী হাসি হাসি মুখে এর-ওর সাথে গল্প করছে। তাদের জমজ ছেলেরা বাসাজুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সবাইকে দেখে চমকে যাবার কথা থাকলেও অপরাজিতা একটুও চমকায়নি। ওদের বাসায় মাসে এক-দুবার এমন হুটহাট গেট টুগেদার কমন চিত্র। ও বরং সবাইকে দেখে হাজারটা কথা বলেছে। শর্মীপুকে ফোন দিয়ে জলদি আসতে বলেছে। সেগুনবাগিচা থেকে আসতে এতখন লাগে নাকি! আম্মু যখন একসময় গোসল করে ফ্রেশ হতে তাড়া দিলো, ও তখন নিতান্তই অনিচ্ছায় শাওয়ারে গেলো। আয়নাভাবী শাড়ি পরেছে দেখে ও নিজে থেকেই একটা নীল জামদানী পরলো শাওয়ার শেষে। তখনও কী জানতো এটাই ওর বিয়ের শাড়ি হবে?

অপরাজিতা শাড়ি পরে বেরিয়ে দেখলো শীলাপু, তার হাজব্যান্ড তামিম ভাইয়াকে নিয়ে এসে পরেছে। ওদের সাতমাসের বাচ্চাকে নিয়ে সবার আহ্লাদী আড্ডায় যোগ দিলো ও। এক ফাঁকে পায়ে পায়ে উঠে মায়ের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “দু’টা সিংগাড়া ছাড়া আর কিচ্ছু খাই নাই আম্মু। ইঁদুর রীতিমতো ম্যারাথন দৌড়াচ্ছে আমার পেটে!” আম্মু হেসে জবাব দিলো, “আসল গেস্ট এখনও আসেনি। ওদের রেখেই খেয়ে নিবি?” অপরাজিতা এবারে অবাক হলো। চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলো, “আসল গেস্ট কারা? আমি ভাবলাম আমাদের এজ অ্যাজুয়াল গেট টুগেদার।” এবারও হাসিমুখে আম্মু জানালো, “তোর বাবার বন্ধুরা আসবে কয়েকজন। তাদের জন্যই আজকের গেট টুগেদার।” থেমে যোগ করলেন, “তোর বাবাকে বল একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে ওরা কতদূর এলো।” আম্মুর কথা ঠিকমতো প্রসেস করার আগেই মামা এসে জানালো গেস্টদের গাড়ি নিচে এসে পরেছে। মনের প্রশ্ন মনে আর পেটের খিদে পেটে রেখেই অপরাজিতাও চললো গেস্ট দেখতে।

বিশ-বাইশজন মানুষ একে একে ওদের বাসায় ঢুকে ড্রয়ইংরুমটা পূর্ণ করে ফেললো। অপরাজিতা বিস্মিত হওয়ার সুযোগ পেলো না। তার আগেই পরিচয় পর্ব শুরু হয়ে গেলো। এর সাথে ওর হাই-হ্যালো চললো কতক্ষণ। বাবা অপরাজিতাকে পরিচয় করানোর সময় বললেন, “এই হলো আমার অপরাজিতা মা। ঢাবি তে ইংরেজিতে অনার্স করছে। দ্বিতীয় বর্ষ।” সঙ্গে সঙ্গে অপরাজিতা শুধরে দিয়ে বলেছিল, “দ্বিতীয় না। তৃতীয় বর্ষ, বাবা। সবসময় ভুলে যাও তুমি!” ওর কথায় হাসির রোল পরেছিলো ড্রয়ইংরুম জুড়ে। খানিকটা লজ্জা পেয়ে অপরাজিতা সরে এসেছিলো ওখান থেকে।

***

আড়াইটা নাগাদ টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে ফেলা হলো। অপরাজিতা মা, ফুপি, মামীর হাতে হাতে এগিয়ে দিলো। শর্মীপু এলো সেইসময়, ওর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে। অপরাজিতাকে দেখেই চোখ নাচালো। ইশারায় কী কিছু বোঝাতে চাইছিলো শর্মীপু?

খাবার টেবিলে একসঙ্গে সবার জায়গা হলো না। বারোজন টেবিলে আর বারোজন বসলো ড্রয়ইংরুমে। বাবাকে ছাড়া তার বন্ধু কোনোভাবেই বসবে না। অগত্যা বাবা বসলেন। মামাকেও টানলেন সাথে। খাওয়া শুরু হলো। আম্মু, ফুপি, মামী, চাচ্চু অ্যাপায়ন করলেন। কিন্তু এতো গেস্ট, তামিম ভাইয়াও দাঁড়িয়ে রইলেন না। একফাঁকে আম্মু অপরাজিতাকে ডেকে বললেন, “বাচ্চাগুলোর খাবারে একটু মনিটরিং কর, অপরা। তোর মামী আছে ওখানে, তারপরও। ডাইনিং ছেড়ে নড়তে পারছি না আমি। তোকে দেখে কম্ফোর্টেবলি বলতে পারবে কিছু লাগবে কি না।” মায়ের কথা শুনে অপরাজিতা ড্রয়ইংরুমে চলে গেলো। বাচ্চাগুলোর প্লেটে তুলে তুলে দিলো। গল্প করলো। ওদের এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলো। ওখানে থাকা বড়দের সাথেও টুকটাক কথা বললো। তাদের মধ্যে কাউকে তো পাত্র বলে মনে হয়নি। কারো মুগ্ধ চোখের চাহনি অনুভব করেনি। অথচ ছেলেটা নাকি ওখানেই ছিলো!

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে