#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৫)
দরজার কাছে পুরুষ কণ্ঠ পেয়ে চমকে উঠে কোমল। দৌড়ে দরজা ভিজিয়ে দিয়ে দমটা আটকে রাখল। যেন নিশ্বাস ফেললেই তার প্রাণপাখি উড়ে যাবে।
দরজার পাশে নীরব অপেক্ষার সময় গুণছিল নিবিড়। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারও বলল,
” চুপ করে থাকবেন না। কিছু একটা বলুন। আপনার জন্য ভবিষ্যৎ বাজি রেখে ছুটে এসেছি। ”
কোমল নিশ্বাস ছেড়ে দরজা থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়াল। ওড়না খামচে ধরে একধ্যানে তাকিয়ে রইল বন্ধ দরজার কপাটে। যেন কোনো দৈবশক্তির মাধ্যমে নিবিড়কে দেখতে পাচ্ছে!
নিবিড়ের ধৈর্য্যশক্তি লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। সময় দেখছে ঘনঘন। ব্যর্থতার এক আবছা ছায়া স্পষ্ট হতে চাচ্ছে কৈশোরের মুখটায়। সে দরজায় মৃদু আঘাত করল। কিছু একটা বলতে চেয়েও পারল না। কোমলের মা ধমকে বললেন,
” এই ছেলে, সর আমার মেয়ের রুমের সামনে থেকে। কোমল তো বলেছেই এখন কথা বলবে না। তাও ঝামেলা পাকাচ্ছিস! ”
এবার স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” তুমিও চুপ করে দেখছ সব? মেয়ের কথা না শুনে এর কথা শুনছ কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না! ”
রাবেয়া খাতুনের কণ্ঠে একাধারে রাগ, বিস্ময়। স্বামীর এহেন আচরণ মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই। আরও কিছু কড়া কথা শুনাতে ব্যস্ত হলেন। সেই সুযোগে কোমলের দরজার পাল্লা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল নিবিড়। সবাইকে বিস্ময়ের সাগরে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে দিল। তার এই দুঃসাহসিক কর্মে কোমল চমকে গেল, ভীত হলো। চড়কিবেগে পেছন ঘুরল। দ্রুত ওড়না দিয়ে আবৃত করল নিজেকে।
” এই অপরিচিত আমিটার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন একসময়। পরিচয় হওয়ার পর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আর আজ যখন জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি তখন দূর করে দিচ্ছেন? ”
কোমলের মায়া হলো। নরম মনটা কৃত্রিম শক্ত শেঁকল ভেঙে দিল। কথা বলার জন্য অস্থির করে তুলল। উত্তর দিতে গিয়ে দেখল তার ঠোঁট কাঁপছে, কণ্ঠস্বরে আওয়াজ নেই। জড়তা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বাঙ্গে।
নিবিড় উত্তরের আশায় থাকতে থাকতে নজর গিয়ে পড়ল কোমলের চুলে। রেশম কালো চুলগুলো পিঠ ছড়িয়ে আছে। ওড়নার প্রশস্ত অংশ সম্পূর্ণ ঢাকতে পারেনি। নিচদিক থেকে কয়েক ইঞ্চি এলোমেলো হয়ে কোমড় ছুঁয়ে আছে আদুরে ভাবে। তার দৃষ্টি মুগ্ধতায় রূপ নিতে পলক ফেলল। বলল,
” চুল বেঁধে নিন। ”
নিবিড়ের কণ্ঠে অনুরোধ নাকি আদেশ বুঝা গেল না। তবুও কোমল চুল বেঁধে নিল দ্রুত। জড়তা কেটে গেল নিমেষেই। গলার অবশতা ভেঙে বলল,
” তুমি অভদ্র আচরণ করছ। এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। ”
কোমলের কণ্ঠস্বর নিবিড়ের অস্থিরতা বাড়িয়ে দিল কয়েকগুণ। পাগলামি ছড়িয়ে পড়ল অঙ্গভঙ্গিতে। দ্রুত বলল,
” আপনি পাত্রের সামনে বসছেন, অপমানিত হচ্ছেন। এটাও আমার পছন্দ হচ্ছে না। ”
” ওটা অপমান নয়, সত্য কথা। ”
” সত্য কথা শান্তভাবেও বলা যায়, ভাঙচুর করতে হয় না। গালিগালাজ করতে হয় না। ”
” ওদের মিথ্যা বলা হয়েছিল তাই রাগ হয়েছে। ”
” কী মিথ্যা? ”
কোমল উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। একটু দম টেনে জিজ্ঞেস করল,
” এসব তুমি জানলে কী করে? ”
কোমলের মতো নিবিড়ও উত্তর চেপে গেল। একটু থেমে বলল,
” এত খারাপ ব্যবহার করার পরও তাদের পক্ষে কথা বলছেন। আপনার মধ্যে কি বিন্দু পরিমাণ রাগ নেই? ”
” কারও পক্ষে না, সত্য ও যুক্তির কথা বলছি। রাগ ছাড়া মানুষ হয় না। আমি মানুষ। তাই আমারও রাগ আছে। তুমি বুঝতে পারছ না? ”
নিবিড় ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে গেল। কোমল উল্টো ঘুরে থাকায় মুখের অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে না। গলার স্বর তেজালো নয়। উচ্চ নয়। সবসময়ের মতো শান্ত ও ধীর। তাহলে রাগটা প্রকাশ পাচ্ছে কিভাবে? নিবিড় বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর বলল,
” রাগ করেছেন বলেই কথা বলতে চাননি? ”
কোমল নিরুত্তর রইল। নিবিড় পুনরায় বলল,
” অভদ্র আচরণ তো মাত্র করলাম। তাহলে পূর্বে রাগ করার কারণ কী? ”
কোমল আগের মতোই নিরুত্তর থাকলে নিবিড় নীরব থাকল। একটুক্ষণ ভেবে বলল,
” পরীক্ষা না দিয়ে এখানে এসেছি বলে? ”
এ পর্যায়ে মুখ খুলল কোমল। পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কেন এসেছ? ”
নিবিড় বিনাদ্বিধায় বলল,
” আপনাকে বিয়ে করতে। ”
কোমল আরও একবার চমকাল। বিস্ময়াপন্ন হলো। স্তব্ধ হয়ে কাটিয়ে দিল কয়েক মুহূর্ত। বহুকষ্টে উচ্চারণ করল,
” অসম্ভব! এমনটা কখনই হতে পারে না। ”
” কেন হতে পারে না? ”
” আমি তোমার থেকে অনেকটা বড়, এটা কি ভুলে গেছ? ”
” বড় হলে কি বিয়ে করা যায় না? ”
কোমল কী উত্তর দিবে ভেবে পেল না। মাথার ভেতরটা ফাঁকা বোধ হলো। একহাত কপালে ঠেকালে নিবিড় বলল,
” আপনার কি মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে? ”
নিবিড়ের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ কোমলের চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিল। কঠিন স্বরে বলল,
” তুমি আমার রুম থেকে বের হবে। এখনই। ”
নিবিড় বের হওয়ার বদলে দরজায় ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। আরাম আসনে পা ভাঁজ করে বলল,
” আংকেল বলেছে, আপনাকে রাজি করাতে পারলে আমাদের বিয়ে হবে। রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাচ্ছি না। দুঃখিত কোমল। ”
নিবিড়ের কণ্ঠে নিজের নাম শুনে কেঁপে উঠল। ভয়টা সাপের মতো প্যাচিয়ে ধরল আপাদমস্তক! নিশ্বাস নিতে বাঁধা পাচ্ছে বারবার। কথা বলতে কষ্ট হলেও বলল,
” তোমাকে ঢাকা পাঠিয়েছিলাম জ্ঞানার্জন করার জন্য। সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ার জন্য। তার বদলে কিনা বাবা-মায়ের সম্মান নষ্ট করতে চাচ্ছ। আমাকে অপদস্ত করছ! ”
” আমি কারও সম্মান নষ্ট করছি না, অপদস্ত করছি না। নিজের চাওয়া পূরণ করার জন্য কৌশল অবলম্বন করছি মাত্র। ”
” তোমার চাওয়া তো ছিল, এমবিবিএস ডাক্তার হওয়া। ”
” ওটা আমার নয় বাবা-মায়ের চাওয়া। আপনার চাওয়া। ”
নিবিড়ের কাটা কাটা উত্তর কোমলকে হারিয়ে দিচ্ছে যেন। একটুক্ষণ চুপ থেকে নরম স্বরে বলল,
” অবুঝের মতো আচরণ করছ কেন, নিবিড়? বুঝার চেষ্টা করো। বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সটাও গুরুত্বপূর্ণ। ”
” আমার তো এমনটা মনে হয় না। ”
” তার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হতে হয়। ”
” কোন ব্যাপারে প্রাপ্তবয়স্ক চাচ্ছেন? ”
” তুমি কিন্তু আমাকে লজ্জায় ফেলছ। ”
নিবিড় চুপ হয়ে গেল। কোমলও। দুজনের নীরবতার জন্যই হয়তো বাইরের শোরগোল ভেতরে প্রবেশ করল। রাবেয়া খাতুনের চিৎকার-চেঁচামেচি, দরজায় থাপড়ানোর জোরাল শব্দে বিরক্ত হলো নিবিড়। খানিকটা উঁচুস্বরে বলল,
” যদি খারাপ কিছু করার চিন্তা-ভাবনা থাকত তাহলে কি বাবা-মাকে সাথে নিয়ে আসতাম? বিয়ের প্রস্তাব দিতাম? আন্টি শান্ত হোন। কোমল রাজি হলেই আমি দোর খুলে দেব। ”
রাবেয়া খাতুন শান্ত হওয়ার বদলে রেগে গেলেন। রাগ ঝাড়তে লাগলেন আনিস মোল্লার উপর। নিবিড় সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে আনল কোমলের দিকে। মেয়েটা তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলল,
” আলো নিভিয়ে খাটে বসুন। আমি চাইলেও অন্ধকার ভেদ করে আপনাকে দেখতে পারব না। ”
কোমল সত্যি আলো নিভিয়ে দিল। খাটের কিনারে বসল নিঃশব্দে। নিবিড় মৃদু হাসল। চুপচাপ কিছু সময় পার করে সহসা বলল,
” সকাল দশটায় আমার পরীক্ষা। সাড়ে নয়টায় হলে পৌঁছাতে হবে। ”
কথাটা কোমলের উদ্দেশ্যে হলেও তার দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিবিড় আবার বলল,
” আপনি বোধ হয় চাচ্ছেন, আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি। ”
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিবিড় বসা থেকে শুয়ে পড়ল। কোমল বুঝতে পেরে বলল,
” তোমার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করিনি। ”
কোমলের কণ্ঠে আর্দ্রতা, ব্যথা। নিবিড় শোয়া থেকে উঠে আবারও বসল,
” আপনি কি খুব কষ্ট পাচ্ছেন? ”
কোমল মিনতি করে বলল,
” ফিরে যাও। ”
বিপরীতে নীরব রইল নিবিড়। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর বলল,
” আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না বলে আমার খুব খারাপ লাগছে। বিশ্বাস করুন, জোর করে বিয়ে করার কোনো উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। ”
” তাহলে করছ কেন? ”
” ভয় হচ্ছে। ”
” কিসের ভয়? ”
” আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে যদি দেরি করে ফেলি? ফিরে এসে আপনাকে না পাই? ”
নিবিড়ের সাথে কোমলের আলাপ হয়েছে মাত্র একবার। সেটাও ঘটনাচক্রে। সেসময় তো বিয়ে বিষয়ক কোনো কথা হয়নি। প্রেমে পড়ার মতো কোনো কারণও তৈরি হয়নি। তাহলে এমন পাগলামির কারণ কী? বিয়ের জন্য এত মরিয়া হচ্ছে কেন?
চলবে
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৬)
নিবিড়ের সাথে কোমলের আলাপ হয়েছে মাত্র একবার। সেটাও ঘটনাচক্রে। সেসময় তো বিয়ে বিষয়ক কোনো কথা হয়নি। প্রেমে পড়ার মতো কোনো কারণও তৈরি হয়নি। তাহলে এমন পাগলামির কারণ কী? বিয়ের জন্য এত মরিয়া হচ্ছে কেন?
কোমল ভাবনার অতলে ডুবতে ডুবতে উদাস হয়। খেয়াল হারায়। সেই উদাসতা ভাঙে ঘড়ির টিকটিক শব্দে। সময় বয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট ও ক্ষীণ শব্দটা নতুন ভাবনার উৎপত্তি করে। মস্তিষ্কে শক্তি জোগায়। শব্দ জমায়। মনে পড়ে, নিবিড়ের পরীক্ষার কথা। ভবিষ্যতের কথা। জেদে পড়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। এমন বোকামো কি নিবিড়কে মানায়? প্রশ্নটা মনের মধ্যে জেগে উঠার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে যায় কোমল। সামান্য হাসে। আপনমনে বিড়বিড় করে, ‘ মানায়। ওর বয়সটাই তো জেদের। একরোখা আর বেপরোয়া হওয়ার। ‘
কোমল আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজের মনকে শান্ত করল। চিন্তা-ভাবনাকে স্থির করল। সমস্যা থেকে বেরুতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখা সব থেকে জরুরি। এতে বুদ্ধি খুলে দ্রুত। সঠিক সমাধান পাওয়া যায়। কয়েক মুহূর্ত ঠাণ্ডা মেজাজে কাটিয়ে দেওয়ার পর একটা সিদ্ধান্তে আসল কোমল। নিবিড়ের চাওয়া থেকে টলানো অসম্ভব প্রায়। এতক্ষণ চেষ্টা করতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়েছে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে একটু প্রশ্রয় দেওয়া শ্রেয় হবে। কোমল তাই করল। নীরবতা ভেঙে বলল,
” তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি। ”
নিবিড় সেকেন্ডের চেয়েও কম সময়ে বলল,
” সত্যি আপনি রাজি? ”
নিবিড়ের কণ্ঠে বিস্ময়, অবিশ্বাস। কোমল একটু সময় নিয়ে বলল,
” কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। যদি তুমি শর্ত মানো তবেই বিয়ে হবে। ”
আনন্দে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল নিবিড়। কোনোরূপ ভাবনায় না গিয়েই বলল,
” আমি সব শর্তে রাজি। ”
” এত অধৈর্য্য ভালো নয়, নিবিড়। সাবধান হতে শেখ। সতর্ক হও। বুদ্ধিমানদের মতো আচরণ করো। ”
নিবিড় থতমত খেল। এখানে বুদ্ধিমানের কাজ কী বুঝতে পারছে না। কোন ব্যাপারে সতর্ক হবে? প্রশ্নটা কোমলকে না করলেও সে উত্তর দিল,
” কেউ যখন শর্ত দিচ্ছে তখন শর্তগুলো জানা উচিত। খুব ভালো করে বুঝা উচিত। এবং সিদ্ধান্তে যাওয়ার পূর্বে বিবেচনা করা উচিত। ”
নিবিড় বুঝতে পারলেও খুব একটা আগ্রহ পেল না। তার মনে হলো, কোমলের রাজি হওয়ার পেছনে হাজারটা শর্ত জুড়ে দিলেও তার কোনো যায়-আসে না। সেই শর্তে যদি তাকে মৃত্যুর সাথে লড়তে হয়, লড়বে। আগুনে ঝাপ দিতে হয়, দিবে। এই মনে হওয়ার বিরল অনুভূতিটুকু প্রকাশ করল না নিবিড়। কোমলকে খুশি করার জন্যই বলল,
” বলুন, আপনার কী কী শর্ত। ”
কোমলও সময়ব্যয় না করে নিজের শর্তগুলো তুলে ধরল,
” প্রথমত, আমাদের বিয়েটা আইনি নিয়মে হবে না। ধর্মীয়ভাবে হবে। সাক্ষী থাকবে শুধু তোমার আর আমার পরিবার। এই দুই পরিবার ব্যতীত আর কেউ এই বিয়ে সম্পর্কে জানবে না। ”
” কেন? ”
” দ্বিতীয় শর্তের জন্য। ”
নিবিড় অনাগ্রহ ভাবটা কাটিয়ে ভীষণ আগ্রহী হয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
” দ্বিতীয় শর্ত কী? ”
” এখান থেকে যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ হবে না। বিয়ের ব্যাপারটা মাথা থেকে মুছে ফেলতে হবে একদম। আমাকে নিয়ে কোনোরূপ ভাবনায় মশগুল হতে পারবে না। কারও মাধ্যমে আমার খোঁজখবরও নিতে পারবে না। সহজ করে বলতে গেলে কোমলকে ভুলে যেতে হবে পুরোপুরিভাবে। ”
” এটা কী করে সম্ভব? ”
” আমি শর্ত দিচ্ছি শুধু। সম্ভব করার উপায় না। সেটা তোমার দায়িত্বে। ”
এক মুহূর্তের জন্য বিমুঢ় হলো নিবিড়। মাথার ভেতরটা ঝিম ধরেছে যেন। চারপাশের হাব-ভাব কিছুই টের পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বিশাল আগ্নেয়গিরিতে পতিত হয়েছে সে। যার উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে তার সকল আনন্দ, আহ্লাদ।
” তুমি কি শর্ত মানতে রাজি? ”
কোমলের প্রশ্নে নিবিড়ের বিমূঢ়তা কাটল। একটু সময় নিয়ে বলল,
” সময়সীমা বলুন। ”
” বুঝিনি। ”
” শর্ত পালনের সময়সীমা। কোমলকে কতদিন ভুলে থাকতে হবে? ”
” সেটাও তোমার উপর নির্ভর করছে। ”
” কীরকম? ”
” কাল তোমার ভর্তি পরীক্ষা না? যদি টিকে যাও। মেডিকেলে চান্স পাও। তাহলে এমবিবিএসের কোর্স শেষ হওয়া পর্যন্ত শর্ত প্রযোজ্য হবে। ”
” আর যদি চান্স না পাই, তাহলে ওখানেই শেষ? ”
” হ্যাঁ, বুঝে গিয়েছ দেখি। ”
” একটু বুঝেছি, পুরোপুরি না। এর শাস্তি কী হবে? ”
” তালাক। ”
” তালাক! ”
নিবিড়ের কণ্ঠে আরও একবার বিস্ময়, অবিশ্বাস খেলে গেল। কোমল শান্ত গলায় বলল,
” হ্যাঁ। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে ডাক্তার হবে। তার জোরেই আজ তুমি আমার রুমে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছ। তাহলে সেই জোর যদি না থাকে, কথার খেলাফ হয়, তোমার পাগলামিকে প্রশ্রয় কেন দেব? ”
নিবিড় পাথরের মতো শক্ত হয়ে রইল। কিছু বলার মতো শব্দ, শক্তি কিছুই পেল না। কোমল বোধ হয় ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারল। নরম হয়ে বলল,
” কষ্ট পেও না। আরেকটু বড় হও, দুনিয়াকে চিনো। তখন বুঝতে পারবে, আমি তোমার ভালো চেয়েছি। ”
কোমলের সান্ত্বনাকে গ্রহণ করল না নিবিড়। উৎসাহ নিয়ে বলল,
” যদি টিকে যাই, আপনার সব শর্ত মেনে এমবিবিএস কোর্সও শেষ করি সফলভাবে। তাহলে কোমলকে আমি মনে করতে পারব তো? ”
কোমল সাথে সাথে উত্তর দিল না। একটু সময় পর বলল,
” না। ”
” কেন? ”
” তখন আরেকটি শর্ত যোগ হবে। ”
” আবার শর্ত? ”
কোমল হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। নিবিড়ই অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” নতুন শর্ত কী হবে? ”
” আমার পর্দা সরে যাবে। ”
পর্দা সরে গেলে কোমলকে দেখতে পারবে নিবিড়। এতে তার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হয়নি। সে বুঝে গেছে এর মধ্যেও অন্যকিছু আছে, যা তার জন্য খুশি নয়। নিবিড় সন্দেহ থেকেই প্রশ্ন করল,
” পর্দা সরে গেলে কী হবে? ”
” তোমার কিশোরকালের বোকামিকে দেখতে পারবে। খারাপ পছন্দকে দেখতে পারবে। আবেগ তোমাকে কতটা জেদি করে তুলেছিল তা পরিমাপ করতে পারবে। ”
” তারজন্য এত অপেক্ষার কী আছে? এখনই সরিয়ে ফেলুন। আমার বোকামি, খারাপ পছন্দ দেখি। ”
” না, এখন দেখতে পারবে না। ”
” কেন? ”
” কারণ তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হওনি। ”
কোমল আর কথা বাড়াতে চাইল না। তাই আবার বলল,
” পর্দা সরে যাওয়ার পর যদি তোমার সিদ্ধান্ত একই থাকে তাহলে তালাক হবে না। ”
নিবিড়ের হারিয়ে যাওয়া আনন্দটা আবার ফিরে এলো। আনন্দিত গলায় বলল,
” কোমলকে সারাজীবন মনে করতে পারব? আমার পাশে পাব? ”
কোমল উত্তর দিল না। কেমন যেন দ্বিধা আর অস্বস্থিতে পড়ে গেল। খানিকটা লজ্জাও ছুঁয়ে গেল মুখটায়। এই বিব্রত অবস্থা কাটাতে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল,
” তোমার উচিত ক্ষমা চাওয়া। ”
নিবিড় যেন আকাশ থেকে পড়ল এমনভাবে জিজ্ঞেস করল,
” ক্ষমা! কিসের ক্ষমা? ”
কোমল বুঝিয়ে দিল,
” এই সময় আন্টি-আংকেলের ঘুমানোর কথা। তা না করে তারা আমার বাসায়। নিশ্চয় নিজ ইচ্ছায় আসেনি। তুমি জোর করেছ, খারাপ ব্যবহার করেছ। এতে তারা কষ্ট পেয়েছে। বাধ্য হয়েছে এখানে আসতে। এজন্য তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। এতে তারা খুশি হবেন। ”
নিবিড় ঘাড় নেড়ে বলল,
” চাইব। ”
” ঠিক একই কারণে, আমার বাবা-মায়ের কাছেও চাইবে। ”
” আচ্ছা। ”
” দাঁড়িয়ে না থেকে তাই ক্ষমা চাইতে যাও। ততক্ষণে বাবার সাথে আমি কথা বলব। ”
নিবিড় দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে বলল,
” সবার থেকে বেশি কষ্ট দিয়েছি আপনাকে। জোর করে রুমে ঢুকে অনেক বড় অন্যায় করেছি। সেই হিসেবে তো প্রথম ক্ষমাটা আপনার কাছেই চাওয়া উচিত। কিভাবে চাইব বলুন। ”
নিবিড় যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এতেই সে সন্তুষ্ট। তবুও বলল,
” এই পৃথিবীতে এমন কিছু দুর্লভ জিনিস আছে যা জোর করে পাওয়া সম্ভব নয়। আমি চাই, তুমি সেই জিনিসগুলোর ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করো এবং এমন অন্যায় জেদ থেকে নিজেকে বিরত রাখো।
” তাহলেই আমি মাফ পাব? ”
” হ্যাঁ। ”
________________
দুই পরিবারকে সাক্ষী রেখে নিবিড় আর কোমলের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। রাবেয়া খাতুন স্বামীকে আড়ালে টেনে নিয়ে বললেন,
” এই ছেলের মধ্যে এমন কী দেখলে যে এত সহজেই মেয়ের জামাই হিসেবে মানলে? ”
” কিছু তো দেখেছি। কিন্তু আজ নয়, কয়েক বছর আগে। ”
” কী দেখেছ? ”
স্ত্রীর কৌতূহলে আনিস মোল্লা মৃদু হাসলেন। বললেন,
” আজ নয়, অন্যদিন বলব। মেয়ের জামাই চলে যাবে এখনই। কিছু দোয়ার ব্যবস্থা করি। ”
আনিস মোল্লা ব্যস্ত হয়ে কোথাও একটা চলে গেলেন। রাবেয়া খাতুন তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে উদাস হলেন।
_______________
বিয়ে সম্পন্ন হতেই তড়িঘড়িতে বেরিয়ে গিয়েছিল নিবিড়। কয়েক মিনিট পর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো। কোমলের পাশে একটি কাঠের বাক্স রেখে বলল,
” আপনি চান, আমি কোমলকে ভুলে যাই। কিন্তু আমি চাই না, কোমল নিবিড়কে ভুলে যাক। তাই এটা আপনাকে উপহার হিসেবে দিয়ে গেলাম। ”
” উপহার? ”
” হ্যাঁ। আপনার কাছে হয়তো নিবিড় থাকবে না। কিন্তু তার মন থাকবে। আর আমি চাই, আপনি সেই মনটাকে জানুন। জানতে জানতে যদি ভালো লেগে যায় তাহলে আপনার মনে তাকে জায়গা দিবেন। ”
নিবিড়ের প্রেমময় কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারল না কোমল। ছোট্ট বাক্সের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী আছে এটার ভেতর? ”
” আমার ভালোবাসা। ”
চলবে