#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩১)
কোমল সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। হঠাৎ শাশুড়ি মায়ের চেঁচামেচি কানে আসে। সে চুলার আঁচ কমিয়ে সেদিকে ছুটল। দরজার নিকট পৌঁছাতেই শুনল,
” অন্যের বাচ্চারে পালবি ক্যান? সমস্যা তো তোর না। তোর বউয়ের। দরকার হইলে আরেকটা বিয়া করবি। ”
” মা! ”
নিবিড়ের ‘ মা ‘ সম্বোধনটা ভূমিকম্প সৃষ্টি করে ছাড়ল যেন! কোমল তাল হারিয়ে ফেলল ভয়ে। ভার শূণ্য হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, খপ করে দরজার পাশটা আকড়ে ধরল। দূর থেকে বুঝতে পারল নিবিড়ের পুরো শরীরের কম্পন। আপন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। ভয়ানক কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তার পূর্বেই মা ও ছেলের মধ্যখানে এসে দাঁড়াল। স্বামীর বিধ্বস্ত মুখটায় দৃষ্টি পড়তে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো উত্তপ্ত চোখদুটির চাহনি। নিবিড় ভীষণ রুক্ষ স্বরে আদেশ করল,
” মায়ের সাথে জরুরি কথা বলছি। যাও, এখান থেকে। ”
কোমল দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। দুর্বল কণ্ঠে বলল,
” আমাকে নিয়ে-ই তো কথা হচ্ছে। ”
নিবিড় পূর্বের চেয়েও শক্ত স্বরে বলল,
” কোমল, আমি তোমাকে যেতে বলছি। ”
কোমল নড়ল না। চোখ তুলে তাকাল স্বামীর রক্তিম মুখটায়। ঠাণ্ডা গলায় বলল,
” এই মুখটা আমার অচেনা লাগছে। কণ্ঠটাও! ”
নিবিড়ের শক্তভাবটা কেটে গেল মুহূর্তেই। মায়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। তারপরেই স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” তাহলে আমি-ই চলে যাচ্ছি। ”
সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেল নিবিড়। নাস্তা খেল না, গোসল করল না, পোশাক বদলাল না। যেমন ছিল তেমনভাবেই নিজের কর্মস্থলে চলে গেল।
____________
হাসপাতালে ভিড় করা রোগীর মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছিল নিবিড়। ঠিক করেছিল, দুপুরে বাসায় খেতে যাবে না। এতে যদি তার মা বুঝতে পারে কত বড় অন্যায় কথা বলেছে। বুকের ভেতরে ঘা’টা ঠিক কতটা গভীরে পৌঁছেছে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলো না। দুপুর হওয়ার পূর্বেই হাসপাতাল ছেড়ে দিল সে। আচমকা মনে পড়েছে, কোমল তাদের কথপোকথন শুনে ফেলেছে। তারপর থেকে পলকে পলকে ধরা পড়েছে কোমলের বুকের কাঁপন! কিছু শুনেনি, কিছুই হয়নি এমন ভান ধরার কঠিন কৌশল। যে কথাটা কাছে বসিয়ে, আদর করে বুঝিয়ে বলার সাহসও করতে পারেনি। সেই কথাটা শুনতে পেল এমন ভয়ঙ্করভাবে। নিবিড় কী করে সামলাবে? সামলিয়ে উঠতে পারবে তো? এমন অবস্থায় স্ত্রীকে ফেলে চলে আসায় নিজের উপর রাগ হলো তার। চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো। হয়তো প্রকৃত বোকার পরিচয় পাওয়া যায় মাত্রাতিরিক্ত রাগেই।
নিবিড় বাড়ি পৌঁছে দেখল, কোমল রান্নার আয়োজন করছে। তাকে দেখে জিজ্ঞেস বলল,
” রাগ পড়েছে? ”
কোমলের চালচলন স্বাভাবিকের মধ্যেও অস্বাভাবিক ঠেকল তার নিকট। নীরব চেয়ে তার হস্ত কাজ দেখছিল। সহসা হাত কেটে ফেলল কোমল। নিবিড় ছুটে গিয়ে আঙুল চেপে ধরল। বটি সরিয়ে ফেলল দূরে। শাসনের ভঙ্গিতে বলল,
” একটু চুপচাপ বসে থাকতে পার না? সারাক্ষণই কাজে লেগে থাকতে হয়? ”
কোমলকে টেনে রুমে নিয়ে আসল। চেপে ধরে থাকায় রক্ত তেমন বের হতে পারেনি। তুলোতে ওষুধ লাগিয়ে পরিষ্কার করছিল সাবধানে। কোমল উদাস স্বরে বলল,
” আমি তো তোমাদের মতো ছুটতে পারি না! তাই সবসময়ে কাজে থাকতে হয়। নাহয় সময়ের সাথে পেরে উঠব কী করে? ”
নিবিড় থেমে গেল। অজান্তে চোখ গিয়ে পড়ল কোমলের পায়ে। স্ত্রীর শারীরিক ত্রুটির কথা তো সে ভুলেই গেছিল। এতদিন বাদে মনে করিয়ে দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাচ্ছে সে?
” এই সামান্য কাটার জন্য ব্যান্ডেজ করতে হবে নাকি? ছাড়, রান্নাটা বসিয়ে দিই। নাহলে রান্না শেষ হতে দেরি হয়ে যাবে। ”
কোমল উঠে চলে যেতে চাইল। নিবিড় দিল না। পেছন থেকে ঝাপটে ধরে বলল,
” এমন করে চললে তো পাথর হয়ে যাবেন একদিন! একটু কাঁদুন। আমায় চোখ মুছিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিন। ”
স্বামীর প্রশ্রয় পেয়েও দুর্বল হলো না কোমল। শুকনো স্বরে বলল,
” এ তো দুঃখ নয়, শাস্তি। তাহলে কাঁদব কেন? ”
কোমলকে নিজের দিকে ঘুরাল ঝটিতে। দুই-গালে হাত রেখে মুখ উঁচু করে সুধাল,
” কিসের শাস্তি? ”
” পাপের। ”
” পাপ! ”
নিবিড়ের কণ্ঠ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ছে যেন! কোমল জোর দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। আল্লাহর দানকে আমি মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম না? তার শাস্তি দিয়েছেন তিনি। বাচ্চাকে মৃত জন্ম দিলাম। চিরদিনের মতো বন্ধ্যাও হলাম। ”
” কী সব উল্টা-পাল্টা বলছেন! ”
” উল্টা-পাল্টা না। ঠিকই বলেছি। এই কঠিন শাস্তির মধ্যে শোকর এইটুকু যে, তিনি আমাকে পাপমুক্ত করে মৃত্যু দিবেন। ”
শেষ কথাটা একদমই সহ্য করতে পারল না নিবিড়। তাই ধমকের সুরে বলল
” কোমল! চুপ করুন৷ ”
কোমল চুপ করল না৷ বলে গেল,
” আমার কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে, আমার পাপের শাস্তি তোমাদেরও ভোগ করতে হচ্ছে। ”
বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল তার।
______________
মৃত বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পরও নিজেকে খুব দ্রুত সামলে নিয়েছিল কোমল। এবার আর পারছে না। কোনো কিছুতেই প্রাণের ছোঁয়া আনতে পারছে না। স্বামী, সংসার সবকিছুতে বিরক্ত অনুভব করছে। শরীর, মন, মস্তিষ্ক একাধারে ক্লান্ত, অবসন্ন। শ্রান্ত হয়ে আসে চোখের পাতা। প্রকৃতি নিয়ম পালনে আসে তীব্র অনীহা, নিরুদ্যম।
” তোমার বোন হোস্টেলের সিটের জন্য আবেদন করেছিল না? পেয়েছে? ”
স্বামীর হঠাৎ প্রশ্নে একটু চমকাল। বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে চেয়েছিল একমনে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বলল,
” না। ”
” তাহলে ক্লাস করছে কিভাবে? ”
কোমল দৃষ্টি গভীর করল। নিবিড় কখনও অনড়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। প্রসঙ্গ আসলে দায়সারাভাবে আলোচনায় অংশ নেয়। আজ নিজ থেকে তার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে, ব্যাপার কী? কোমল সন্দেহমোচন করতে বলল,
” না। কেন? ”
নিবিড় ইতস্তত করে বলল,
” আমাদের এখান থেকে ঢাকা ভার্সিটি খুব দূরে নয়। যতদিন সিট না পাচ্ছে ততদিন এখানে থেকে ক্লাস করুক। এতে ক্লাসগুলো মিস হবে না। আর বোনকে পেয়ে তোমার মনও ভালো থাকবে। ”
কোমল গ্রিল ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো স্বামীর নিকট। মুখটার দিকে চেয়ে থেকে বলল,
” দিন-রাত শুধু আমাকে নিয়েই ভাব, তাই না? ”
নিবিড় নিরুত্তর থাকলে সে আবার বলল,
” অনেক শুকিয়ে গেছ। ”
” বিবিরা বেখেয়াল হলে স্বামীরা শুকিয়েই যায়। ”
” আমি বেখেয়াল? ”
” তা নয়তো কী? আমি যে এশারের নামাজ পড়তে যায়নি সেটা খেয়াল করেছ? ”
কোমলের যেন হঠাৎ মনে পড়েছে। এমন ভাব করে বলল,
” তাই তো। যাওনি কেন? ”
নিবিড় উত্তর দিল না। চুপ হয়ে রাতের আকাশের দিকে চেয়ে থাকল। কোমলও একই প্রশ্ন দু’বার করল না। উত্তরের অপেক্ষাও করল না। প্রায় মিনিটখানিক চুপচাপ থেকে স্বামীর কাঁধে মাথা রাখল আলতো করে। বুকের একপাশ খামচে ধরে বলল,
” রাগ করেছ? ”
” না, কষ্ট পাচ্ছি। ”
” কেন? ”
” আপনার সেই মিষ্টি শাসনগুলো আর পাচ্ছি না তাই। ”
কোমলের হাতের খামচি আরও গভীর হলো। কাঁধে ঠোঁট ছুয়িয়ে ঘনিষ্ঠ গাঢ় করে বলল,
” আর কষ্ট দেব না। ”
_____________
অনড়ার ব্যাগপত্র রাখা হলো কুলসুম নাহারের কক্ষে। আজ থেকে এখানেই থাকবে সে। প্রথমে আসতে চাচ্ছিল না। কোমলের পীড়াপীড়িতে আসতে হলো।
” মেয়েটা কে গো? গায়ের রঙটা একদম পাকা। ”
মুনের দাদির এমন মন্তব্যে মৃদু হাসলেন কুলসুম নাহার। তিনি প্রায় বিকেলেই গল্প করতে আসেন। গল্প চলাকালীন সময়ে হালকা নাস্তা দিয়ে যায় কোমল। আজ অনড়াকে দিয়ে পাঠানোতে তার নজরে পড়ল।
” আমাদের গ্রামের-ই মেয়ে। বউমা ছোট বোনের মতো দেখে। ”
” তাই নাকি? বিয়ে-শাদি হয়েছে? ”
” না। এখনও পড়তাছে। ”
দাদি চায়ে চুমুক দিতে দিতে দুই বোনের খুনসুটি শুনলেন। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার অনড়া এ রুমে ছুটে এসে বেরিয়েও গেল। চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বললেন,
” মেয়েটা খুব চঞ্চল। এমন চঞ্চল মেয়েরা কাজে-কর্মে পটু হয়। আমার আরেকটা ছেলে থাকলে বউ করে নিতাম। আপনারও তো নেই, না? ”
” না। ”
” ওহ। ”
দাদি এমনভাবে ‘ ওহ ‘ শব্দটা উচ্চারণ করলেন যেন ছেলে না থাকা বিরাট আফসোসের ব্যাপার। একসময় বলেই ফেললেন,
” গ্রামের মেয়েই যদি হয়, তাহলে একে বউ না করে ঐ মেয়েকে করলেন কেন? মানছি, সাংসারিক কাজে হাত পাকা। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে দেখলে কিন্তু আপনার ছেলের সাথে একদম মানায় না। ”
কুলসুম নাহারের মুখের নম্র হাসিটুকু বিলীন হয়ে গেল। বিরস গলায় বলল,
” ছেলে যখন বিয়া করছে তখন অনড়া খুব ছোট ছিল। ”
” ছেলের বয়স তো খুব বেশি মনে হয় না। অল্প বয়সে বিয়ে করিয়েছেন নাকি? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
কুলসুম নাহার উত্তর দিতে পারলেন না। প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন। মাগরিবের আযান পড়তে গল্পের আসর শেষ করলেন দুজন।
_______________
ছেলের ভয়ে বাচ্চা বিষয়ক কোনো কথাবার্তা তুলেননি কুলসুম নাহার। কিন্তু চুপ করে থাকবেন কতদিন? কোমলের বন্ধ্যাত্বের কথাটা জানার পর থেকে ঘরটা যেন বেশিই ফাঁকা লাগে। ঘুমের ঘরে প্রায় স্বপ্নে দেখেন তার একটি ফুটফুটে নাতি হয়েছে। পুরো ঘর দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সেই স্বপ্ন কি স্বপ্নই থেকে যাবে?
” আম্মা, ডেকেছেন? ”
রাতের খাবার শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তখনই কোমলের আগমন ঘটল। তিনি শোয়া উঠে বসে বললেন,
” বসো। জরুরি কথা আছে। ”
কোমল বসল। তিনি একটু সময় নিয়ে বললেন,
” পোলা তো আমারে দেখতে পারে না। আমার কথা সহ্য হয় না। তাই তোমার লগেই কথা কই। ”
” এভাবে বলছেন কেন? ও আপনাকে খুব ভালো…”
” থাক, এসব কথা। আসল কথা হুনো। ”
” আচ্ছা। ”
কুলসুম নাহার নিজ ভাষায় খুব সুন্দর করে বুঝাতে লাগলেন, বাচ্চা ছাড়া একটা সংসার কখনই পূর্ণতা পায় না। তাছাড়া বংশ এগিয়ে নেওয়ারও একটা ব্যাপার আছে। তার তো এই একটি-ই ছেলে। প্রদীপ ধরাতে হলে তাকেই ধরাতে হবে। বিকল্প পথ নেই। কোমল যত শুনছিল তত কুঁকড়ে যাচ্ছিল। বুকের ভেতরের তোলপাড়টা সামলাতে ঠোঁট কামড়ে থাকল। সবশেষে দ্বিতীয় বিয়ের কথাও তুললেন। সাথে এটাও বললেন,
” আমি জানি, তুমি কইলেই নিবিড় রাজি হইব। তাই এই দায়িত্ব তোমার উপর দিলাম। প্রথমে হইত রাগ দেখাইব ভয় করবা না। নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকবা, বুঝছ? ”
কোমল মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারল না৷ মাথা কিঞ্চিত নাড়তেই তিনি বললেন,
” পুরুষ মানুষ ধইরা রাখা এত সহজ না। সামনাসামনি যতই কউক, তার বাচ্চা লাগব না, শরীর লাগব না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠিকই চাইব। শরীরও খুঁজব। তখন পায়ে ধইরাও ফিরাইতে পারবা না। ঘাড় ধাক্কা দিয়া সংসার থেকে বাইর কইরা দিব। আমি চাই না তোমার সাথে এমন হোক। তাই আগে-ভাগে বিয়ার কথা বলতাছি। আমি যতদিন বাঁইচা থাকমু ততদিন তুমি আমার লগেই থাকবা। এইডা আমার প্রতিজ্ঞা। ”
কোমল নীঃশব্দে শাশুড়ির রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আপন কক্ষে ফেরত এসেই দাঁড়াল আয়নার সামনে। নিজেকে খুঁটে খুঁটে দেখতে গিয়ে নিবিড়ের প্রতিবিম্বটায় নজর আটকাল। গভীর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে বুঝল শাশুড়ি ঠিকই বলেছে। নিবিড়ের শরীর তো মাত্র উদ্বেলিত হচ্ছে। আর তার সমাপ্তি ঘটছে।
” আয়নায় কী এমন দেখছেন শুনি? তখন থেকে দেখছি, একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। ”
কোমল পেছন না ঘুরে বলল,
” তোমাকে। ”
নিবিড় খাট থেকে নেমে এলো দ্রুত। কোমলের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
” সত্যি আমাকে দেখছিলেন? ”
” হ্যাঁ ”
” অবিশ্বাস্য। ”
” কেন? ”
” আপনি আমাকে দেখবেন, এমন সৌভাগ্য আমার নেই। ”
কোমল স্বামীর দিকে ঘুরল। কী যেন একটা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল। ব্যাপারটা নিবিড়ের দৃষ্টি এড়াল না। জিজ্ঞেস করল,
” কিছু বলবে? ”
কোমল উত্তর দিল না। বারান্দার দিকে হেঁটে গেল। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। তার দিকে চেয়ে বলল,
” আজ মনে হয় পূর্ণিমা। আমায় গয়না পরাবে না? ”
চলবে
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩২)
নিবিড় বাসায় ফিরে দেখল, মুন তার পড়ার টেবিলের উপরে বসে আছে। গুছিয়ে রাখা বই উল্টে-পাল্টে রেখেছে, খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে উড়াচ্ছে। সে ভেতরে ঢুকে ধমকে উঠল,
” এই মেয়ে কী করেছ এসব? ”
মুন ভয়ে কেঁপে উঠল। কান থেকে কলমটা পড়ে গেল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে নিবিড় আগের স্বরে বলল,
” বাঁদর মেয়ে। নামো বলছি। ”
মুন নামার সময় পেল না। নিবিড় দুই হাতে উঁচু করে বিছানায় ফেলল তাকে। বইয়ের স্তুপের ভেতর থেকে পুতুলটা তার কোলে ঢিল মেরে বলল,
” বাসায় যাও। ”
মুন আর চুপচাপ থাকতে পারল না। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। তার কান্নার শব্দ পেয়ে কোমল ছুটে এলো। নিবিড়ের দিকে এক পলক চেয়ে মুনকে কোলে তুলে নিল। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কাঁদছে কেন? ব্যথা পেয়েছে নাকি? ”
নিবিড় সেই উত্তর দিল না। বিরক্তে চোখ-মুখ বিকৃত করে বলল,
” তুমি থাকতে রুমের অবস্থা এমন হয় কী করে? ”
কোমল চট করে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে বলল,
” বাচ্চা মেয়ে…”
কথা শেষ করতে দিল না নিবিড়। দ্রুত বলল,
” যার বাচ্চা তার ঘর নষ্ট করুক। আমার ঘর কেন? বাসায় দিয়ে আসো। এসব উটকো ঝামেলা ভালো লাগে না। ”
কথাটা বলেই ঘামে ভেজা শার্টটা খুলে ফেলল। তোয়ালে নিয়ে গোসলখানায় ঢুকতে গিয়ে থামল। স্ত্রীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল,
” এমন করে চেয়ে আছ কেন? আমার কথা বুঝতে পারনি? ”
কোমল নিরুত্তর থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মুনকে তার বাসায় দিয়ে এসে সরবত বানাল। নিবিড় বের হলে খেতে দিবে তাই সরবত নিয়ে আসল রুমে। তার ফেলে রাখা ময়লা শার্টটা তুলতে গিয়ে দেখল পকেট ভারী। সেখানে হাত দিতে কতগুলো চকলেট পেল। এগুলো মুনের পছন্দের চকলেট। ভালোবেসে চকলেট এনে ধমকে উঠল কেন বুঝতে পারছে না। এর আগে এরকম করেনি কখনও। হাসপাতালে কোনো সমস্যা হলো নাকি! কোমল চিন্তায় ডুবে যেতে নিবিড় বেরিয়ে এলো। কোমলের হাতে চকলেট দেখে বলল,
” তুমি চকলেট খাও না? ”
কোমল মৃদু চমকাল। স্বামীর দিকে চেয়ে বলল,
” হ্যাঁ, ছোটবেলা খুব পছন্দ করতাম। ”
” বড়বেলায়ও পছন্দ হবে। খেয়ে দেখ। ”
” এগলো আমার জন্য এনেছ? ”
কোমলের কণ্ঠে হালকা বিস্ময়, সন্দেহ। নিবিড় টি-শার্ট গায়ে দিতে দিতে বলল,
” আর কার জন্য আনব? মা এসব খায় না। ”
” আমি ভাবলাম মুন….”
” ক্ষুধা লেগেছ। খাবার বাড়ো। আমি মাকে ডেকে আনছি। ”
নিবিড় দ্রুতপদে মায়ের রুমের দিকে চলে গেল। অনড়া রুমে আছে বিধায় সরাসরি ভেতরে ঢুকল না। দরজায় মৃদু আঘাত করে বলল,
” মা, খেতে আসো। ”
_____________
রাতের খাবার শেষ করে কী একটা দরকারে বাইরে গেল নিবিড়। কোমল রান্নাঘরের গোছগাছ শেষ করে রুমে ঢুকল। বিছানা ঝাড় দিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে ঘড়ি দেখল। প্রায় আধঘণ্টা হতে চলল, অথচ নিবিড়ের ফেরার গন্ধ নেই। সে আরও টুকটাক কাজ সেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দূরের রাস্তাটিতে চোখ রাখতে অবাক হলো। নিবিড় মুনকে কাঁধে নিয়ে বাসায় ফিরছে। তার হাতভর্তি চকলেট আর আইসক্রিম। দৃশ্যটি খুবই সুন্দর, মিষ্টি। আদুরে আর স্নেহময়। কোমলের চিত্ত পুলকিত হলো। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি উঁকি দিল। তারা যতক্ষণ না দৃষ্টির আড়ালে গেল ততক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। তারও বেশ কয়েক মিনিট পর রুমে ঢুকল নিবিড়। কোমল মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করল,
” বাইরের কাজ শেষ হলো? ”
” হ্যাঁ। ”
” মন ভালো হয়েছে? ”
নিবিড় স্ত্রীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। একটু অন্যদিকে সরে গেল আড়ষ্টভাবে। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল,
” আমার মন খারাপ ছিল নাকি? ”
” হ্যাঁ, সেজন্যই তো মুনকে বকাবকি করলে। ”
” বকার কাজ করলে বকব না? ”
নিবিড়ের কণ্ঠে উত্তাপ ফিরে এলো। কোমলের দিকে ঘুরে বলল,
” মুনকে নয়, তোমাকে বকা উচিত। মাথায় তো তুমি চড়িয়েছ। তোমার আদরে বদমাশ হয়েছে। ”
বিছানায় বসে কোমলের হাত ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” বাচ্চা মানে ঝামেলা, বিশৃঙ্খলা। আর আমার এসব একদম ভালো লাগে না। বুঝছ? ”
কোমল চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল। যেন, নিবিড় কোনো অবাস্তব, অদ্ভুত ধরনের কথা বলেছে!
” আমার শুধু আপনাকে ভালো লাগে। আপনার ভালোবাসাকে ভালো লাগে। ”
কথা দুটো বলতে বলতে কোমলকে বসাল উরুর ডানপাশে। অভিমানি সুরে বলল,
” অনেকদিন হলো, আমাকে ভালোবাসেন না! আমার হিসেবকে ভেঙে দিন তো। ”
___________
নিবিড়কে নাস্তা দিয়ে একটা কাজে রুমে এসেছিল কোমল। হঠাৎ দেখল মোবাইলটা বাজছে। হাতে তুলে নিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হলো। দুলাল ভাই কল করেছে। মানুষটার খোঁজ পাওয়া গেছে তাহলে! সে মোবাইল হাতে ছুটে গেল স্বামীর কাছে। মোবাইল বাড়িয়ে বলল,
” দেখ, দুলাল ভাই কল করেছে। ”
নিবিড়ের মধ্যে তেমন উত্তেজনা দেখা গেল না। কলটা ধরার আগ্রহও না। প্লেটের পাশে রেখে বলল,
” আরেকটা রুটি দেও। ভাজিটা মজা হয়েছে। ”
কোমল রুটি তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কল ধরলে না যে? রাগ করেছ? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” হাসপাতালে গিয়ে কথা বলে নিব। ”
” তোমাদের দেখা হয়েছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” কবে? কোথায়? ”
” পরশু। হাসপাতালে। ”
” আমাকে তো বলোনি। ”
” খেয়াল ছিল না। ”
নিবিড় পানি খেয়ে নাস্তা শেষ করল। উঠতে ধরলে কোমল আবার প্রশ্ন করল,
” তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিল? কিন্তু উনি জানলেন কিভাবে, তুমি ঐ হাসপাতালে আছ? ”
” জানতেন না। আসার পর দেখেছে। ”
কোমল আরও একটি প্রশ্ন করার জন্য নিবিড়ের পেছন পেছন আসছিল। নিবিড় আচমকা থেমে যাওয়াই ধাক্কা খেল। কোমল লজ্জায় অবনত হলে নিবিড় নিজ থেকে বলল,
” উনার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই…”
” খুব বড় অসুখ নাকি? ভর্তি হতে হয়েছে? ”
” সেরকমই। ”
নিবিড়ের হাতে মানিব্যাগ দিয়ে অনুরোধের সুরে বলল,
” দুপুরে খেতে এসে আমাকে নিয়ে যাবে? ”
” কোথায়? ”
” তোমার হাসপাতালে। দুলাল ভাইয়ের বউকে দেখে আসব। ”
” কেন? তাকে দেখতে হবে কেন? ”
” কী আশ্চর্য! কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যেতে হয় না? ”
নিবিড় জবাব দিল না। চুপচাপ জুতা পড়ায় মনোযোগ দিল। কোমল পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। যাওয়ার পূর্বে বলে গেল,
” তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে না। সময় বুঝে আমি দাওয়াত দিয়ে আনব। ”
কোমল মন খারাপের সুরে বলল,
” আচ্ছা। ”
____________
নিবিড় দুপুরে খেতে এসে দেখল, কোমলের মনখারাপ কাটেনি। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,
” বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না কিন্তু। দেখা করেই চলে আসবে, রাজি? ”
কোমলের মনখারাপ ছুটে গেল। দারুন উৎসাহের সাথে তৈরি হয়ে নিবিড়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।
_____________
দুলালের একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। মূলত এই কারণেই স্ত্রীকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। বাচ্চার বয়স আজ তিনদিন। কোমল আলতো করে কোলে নিয়ে বুকের কাছটায় চেপে সরে এলো নিবিড়ের দিকে। ফিসফিসে বলল,
” তুমি তো বলেছিলে, অসুস্থ। সেজন্য শুধু ফলমূল এনেছি। বাচ্চার জন্য কিছু আনা দরকার ছিল না? খালি হাতে মুখ দেখলাম! ”
নিবিড় না শোনার ভান করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। দুলাল ভাই দূর থেকে বললেন,
” পরশুদিন থেকে বলছি, আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। রাজিই হচ্ছিল না। অথচ ও ঠিক জানে, আপনাকে দেখার কতটা ইচ্ছে ছিল আমার। ”
কোমল নিকাবের আড়ালে বিনয়ী হাসল। স্বামীর দিকে আরেকটু ঘেষে বলল,
” কোলে নিয়েছ? ”
নিবিড় উত্তর দেওয়ার পূর্বে দুলাল ভাই আহ্লাদী হয়ে বললেন,
” হ্যাঁ। সিজারের সময় ও ভেতরে ছিল। প্রথম কোলে তো ও-ই নিল। তারপর থেকে অবসর পেলেই দৌড়ে আসছে। কোলে নিচ্ছে, আদর করছে। ”
দুলাল আরও কিছু বলতে চাইলে নিবিড় বাঁধা দিয়ে বলল,
” একটু পর আমি ব্যস্ত হয়ে যাব। চলুন, আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি। ”
” মাত্রই তো এলো। তুলির সাথে থাকুক না কিছু সময়। তোর ছুটি হলে একসাথে যাবি। ”
নিবিড় এক ঝলক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চলে গেল। কোমল সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারল না। শুধু মনে হলো, নিবিড় হঠাৎ করে অদ্ভূত আচরণ করছে।
কিছু সময় পেরুতে তুলি সাথে ভাব হয়ে গেল কোমলের। মেয়েলি গল্পে মশগুল হতে দুলাল ভাই ডাকলেন,
” একটু এদিকে আসবেন? একটা জরুরি কথা ছিল। ”
কোমল সংকোচে পড়ে গেল। পুরুষদের সাথে আলাদাভাবে কথা বলায় অভ্যস্ত নয় সে। যদিও কালো বোরকায় নিজেকে আবৃত করে রেখেছে তবুও অস্বস্থি বোধ করল। আড়ষ্টভাবে দুলালকে অনুসরণ করল। একটু কোণার দিকে গিয়েই তিনি বললেন,
” এটা রাখ। ”
কোমল হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিয়ে দেখল একটা স্বর্ণের চিকন চেইন। সে বিস্মিত বদনে বোকা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে তিনি বললেন,
” নিবিড় আমার মেয়েকে পরিয়ে দিয়েছিল এটা। ”
” তাহলে ফেরত দিচ্ছেন কেন? পছন্দ হয়নি? ”
দুলাল ব্যস্ত হয়ে বলল,
” পছন্দ হবে না কেন? খুব পছন্দ হয়েছে। ”
” তাহলে ফেরত দিচ্ছেন কেন? ”
” এত দামি উপহার দেওয়ার সামর্থ্য হয়নি ওর। যেদিন হবে সেদিন গ্রহণ করব। আমি নিশ্চিত কারও কাছ থেকে ধার করে কিনেছে। ”
” ও ঠিক শোধ করে দিবে। নিশ্চয় খুব ভালোবেসে এনেছে। ফেরত দিলে কষ্ট পাবে। ”
” রাখতে বললে, আমি কষ্ট পাব। আমার মন ভাবছে, ও আমার ঋণ শোধ করতে চাচ্ছে। ”
কোমল কী বলবে খুঁজে পেল না। দুলালের জোরাজুরিতে চেইনটা নিতে হলো তাকে। ভীষণ চিন্তিত স্বরে বলল,
” যদি রাগ করে? ”
” আপনি বুঝিয়ে বললে, রাগ করবে না। আপনার সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি, তা থেকে বুঝেছি, আপনার কথা নিবিড় ফেলতে পারে না। আপনাকে খুব মানে, সম্মান করে। ”
_____________
কোমল হাসপাতাল থেকে ফিরল আকাশ মাপের মনখারাপ নিয়ে। সারা রাস্তায় শুধু এটাই উপলব্ধি করল, নিবিড়ের অদ্ভুত আচরণ করার কারণ, বাচ্চাদের প্রতি যে তার একটা দুর্বলতা আছে এটি কোমলকে বুঝাতে চায় না। অভিনয় করতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ফেলছে।
” দুলাল ভাইয়ের মেয়েটা এত পাজি! সেকেন্ডে সেকেন্ডে প্রস্রাব করে, মিনিটে মিনিটে পায়খানা করে। আমি তো ভেবেই পায় না তিনি সহ্য করছেন কিভাবে? ”
কোমল নীরব শ্রোতা হয়ে বোরকা খুলল। হাত-মুখে পানি দিয়ে ক্লান্তভাব দূর করল। কী একটা দরকারে আলমারি খুলতেই নজরে এলো বাচ্চাদের নানান জিনিস। যেগুলো তার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কিনে এনেছিল নিবিড়। মুহূর্তেই অতীতে ফিরে গেল কোমল। মনে পড়ল, নিবিড়ের সেই পাগালামি, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, শাশুড়ির সেলাই করা কাঁথা, মায়ের যত্নমাখা আদর, বাবার লজ্জিত মুখ।
কোমল ফুঁপিয়ে উঠল। নাভিশ্বাস উঠল। নিবিড়ের থেকে লুকিয়ে পড়ার জন্য বারান্দায় ছুটল।
” জানতাম, এমনটা হবে। এজন্যই নিয়ে যেতে চাইনি। ”
কোমলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” এই যে নিজেকে দোষী ভেবে এত কষ্ট পাচ্ছেন, এটা অন্যায়। প্রকৃত দোষী হলাম আমি। আমার জেদের জন্য যদি সেদিন আমাকে বিয়ে না করতেন তাহলে হয়তো আপনার জীবনটা অন্যরকম হতো। হাসি, খুশি, আনন্দে ভরপুর থাকত। ”
নিবিড় একটু উদাস হলো। দম টেনে আবার বলতে শুরু করল,
” আপনার বাবা নিশ্চয় সেরা পুরুষটিকে আপনার জন্য খুঁজে আনতেন। যে খুব যত্নবান হতো। হতো প্রাপ্তবয়স্ত, প্রাপ্তমনস্ক। সাংসারিক ব্যাপারে যার অগাদ জ্ঞান। আপনার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়ার সামর্থ্য থাকত। আপনাকে খুব আগলে রাখত। বিপদের কোনো আঁচ আসত না। আপনি সুরক্ষিত থাকতেন। তাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করতেন না। নিঃসংকোচে নিজের সমস্যা, প্রয়োজন বলতে পারতেন। ফলে, এত বড় বিপদটা সামনে আসতই না কখনই। ”
কোমল কথার মধ্যে স্বামীর দিকে তাকালে সে বলল,
” আমি ভুল বলছি না কিছু। কারণ, এই সমস্যাটা আপনার জন্মগত বা বিবাহ পূর্বে ছিল না৷ প্রেগন্যান্সির পর তৈরি হয়েছে। যেটা আমার বেখেয়ালের কারণে এমন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এর পুরো দায় আমার। আমি দোষী। আপনার উচিত নিজে কষ্ট না পেয়ে আমাকে শাস্তি দেওয়া। ”
” তুমি শাস্তি চাও? ”
” অবশ্যই। বলেন, আমাকে কী করতে হবে। ”
কোমল সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল নিবিড়ের দিকে। স্পষ্ট ও দৃঢ় স্বরে বলল,
” দ্বিতীয় বিয়ে করো। ”
” কোমল! ”
নিবিড়ের কণ্ঠ থেকে নামটা বেরুল এত অস্পষ্ট ও দুর্বলভাবে যেন, তার ভেতরটায় অসংখ্য ক্ষত, যন্ত্রণায় জর্জরিত। একটু আঘাতে প্রাণ হারাবে! কোমল তার একহাত নিজের মুঠোয় নিল। ভীষণ কাতর স্বরে মিনতি করল,
” আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেও। দোষী যেই হোক না, শাস্তি সবাই পাচ্ছে। এর থেকে মুক্ত করতে পার একমাত্র তুমি। ”
নিবিড় হাত ছাড়িয়ে নিল। হীম গলায় বলল,
” আমি জানতাম আপনি খুব জ্ঞানী, সুবিবেচক। আজ বুঝলাম আমার জানাতে ভুল আছে। ”
কথাটা বলে সে চলে যেতে নিলে কোমল পেছন থেকে বলল,
” দুলাল ভাই বলেছিল, আপনি আমার সব কথা মানেন। ”
নিবিড় থেমে বলল,
” ভুল বলেনি তো। ”
” তাহলে এটা মানছ বা কেন? ”
কোমল ছুটে এলো নিবিড়ের সামনে। আকুতি করে বলল,
” মেনে নেও এটা তোমার শাস্তি। ”
” এটা আমার না, আপনার শাস্তি। আর আমি আপনাকে শাস্তি দিতে চাই না। ”
নিবিড় কোমলকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে, সে দ্রুত বলল,
” আমার একটা চাওয়া জমা পড়েছিল। ”
” আমি অসামর্থ্য, অক্ষম। যদি সম্ভব হয় মাফ করে দিবেন। ”
” করব না। ”
” আমার দুর্ভাগ্য। ”
” তোমাকে বিয়ে করতে হবে। এরজন্য আমায় যতদূর যেতে হয়, যাব। ”
কোমল রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনল,
” তোমাকে জেদে মানায় না। ভুল করছ। ”
কোমল সেই কথার পাত্তা দিল না। সোজা গিয়ে ঢুকল শাশুড়ির রুমে। অনড়ার টেবিলে বসে পড়ছিল একমনে। তাকে উপেক্ষা করে বলল,
” আম্মা, মেয়ে দেখেন। আপনার ছেলেকে মানানোর দায়িত্ব আপনার। ”
কুলসুম নাহার আনন্দে কেঁদে ফেললেন। কোমলের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন,
” মেয়ে তো আমাদের ঘরেই আছে। ”
” কে? ”
” অনড়া। বয়স, চেহারা, গুণে সবকিছুতেই আমার ছেলের সাথে মানায়। ”
অনড়া ঝড়ের গতিতে পেছনে ঘুরল। অবোধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বুবুর দিকে। কোমল কয়েক মুহূর্তের জন্য বোধশক্তি হারিয়েছে যেন! অনুভূতিহীন চোখজোড়া একস্থির হয়ে থাকল অনড়ার দিকে। কয়েকটি মুহূর্ত এমনভাবে কাটিয়ে আচমকা অনড়ার হাত ধরে বলল,
” রাজি হয়ে যা, বোন। আমি কথা দিচ্ছি, তোর অধিকারে আমি বাঁধা হব না কখনও। ”
_______________
সেই রাত থেকে একই সাথে মনব্রত ও অনশন রক্ষা করে চলল কোমল। নিবিড় কিছুতেই তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারল না। রাগ ভাঙাতে পারল না। ধৈর্য্য হারিয়ে নিজেও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিল। ঘর ত্যাগ করল। দুলাল ভাইয়ের বাসায় দুদিন কাটাতে না কাটাতে খারাপ সংবাদ এলো কানে। কোমল জ্ঞান হারিয়ে হাসাপাতলে ভর্তি। নানান যন্ত্রাংশের সাথে আইসিউতে সময় কাটাতে কাটাচ্ছে। তবুও অন্ন তো দূর, পানিও পান করানো গেল না। ডাক্তাররা বাধ্য হয়ে নল দিয়ে তরল ঢুকাতে লাগল শরীরে। স্যালাইন চলল দিবা-রাত্রি। কোমলের এই মৃত্যুর সাথে সন্ধিভাব মেনে নিতে পারছিল না নিবিড়। দুর্বল হতে বাধ্য হলো। স্ত্রীর হাত ধরে বলল,
” আমি তোমার ইচ্ছে পূরণ করব। কিন্তু দুটো শর্ত আছে আমার। ”
কোমলের তখন কথা বলার শক্তি নেই। চোখের ইশারায় শর্তগুলো জানতে চাইলে সে বলল,
” প্রথম শর্ত, আমার সংসারের চাবি তোমার হাতে থাকবে। যত ঝড় আসুক না কেন, এই চাবি অন্য কারো হাতে হস্তান্তর করতে পারবে না। দ্বিতীয় শর্ত, আমাকে শেষ করে দেওয়ার মতো এমন জেদ ধরতে পারবে না কখনও। এটাই প্রথম ও শেষ। ”
কোমল চোখের পলক ফেলে বুঝাল সে রাজি।
চলবে