#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৯)
” আপনার স্ত্রীর অবস্থা খুবই খারাপ। ও’টি’তে নিতে হবে। ”
নিবিড় চেয়ার থেকে সামান্য উঁচু হয়ে টেবিলের দিকে ঝুঁকল। হাতজোড় করে ভীষণ অসহায় গলায় বলল,
” আমার স্ত্রীকে সুস্থ করে দিন। তার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। ”
টেবিলের উল্টোপাশে বসা মহিলা ডাক্তার তাকে সান্ত্বনা দিলেন,
” শান্ত হোন। এখনই ভেঙে পড়লে চলবে না। আরও অনেক কিছু বলার আছে আমার। ”
নিবিড়ের মুখ রক্তশূণ্য হলো। নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে যেন! পলকহীন চেয়ে থাকে শূণ্য দৃষ্টিতে। ডাক্তার একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
” শুনেছি, আপনি মেডিকেলের স্টুডেন্ট? ”
” জি, লাস্ট সেমিস্টারে আছি। ”
” তাহলে তো প্লাসেন্টা প্রিভিয়া পোস্টপেরিওর সম্পর্কে শুনেছ তাই না? ”
নিবিড়ের স্থিরভাব ছুটে গেল। শিরা-উপশিরার শীতল রক্ত কণিকা হঠাৎ করেই উত্তপ্তে রূপ নিল। স্রোতের গতি হলো সুনামির মতো তীব্র। টেবিল থেকে হাত সরিয়ে নিতেই মস্তিষ্কে চাপ পড়ল। ‘ সাধারণত গর্ভাবস্থায় বাচ্চা জরায়ুর মধ্যে থাকে সামনে আর গর্ভফুল পেছনে। কিন্তু এই গর্ভফুল যদি সামনে চলে আসে এবং বাচ্চা পেছনে চলে যায় তখন তাকে প্লাসেন্ট প্রিভিয়া বলে। এই সমস্যার প্রধান কারণ রক্তক্ষরণ। গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণের তিন ভাগের এক ভাগই হয় প্লাসেন্টার জন্য। এই রক্তক্ষরণের নির্দিষ্ট কারণ বিজ্ঞানিরা এখনও বের করতে পারেনি। কিছু সাধারণ কারণ ধারণা দিয়েছে। তার মধ্যে হতে পারে, ইতিমধ্যে অনেকগুলো বাচ্চা নিয়েছে কিংবা মায়ের বয়স পঁয়ত্রিশ অথবা পূর্বে সিজার বা জরায়ুর অপারেশন করেছে। এমনকি ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাওয়া বা করার কারণেও হতে পারে। ‘ কোমল এসবরের একটিতেও নেই তাহলে কি ওর গর্ভফুল বড় বা পাতলার কারণে হয়েছে? নিবিড়ের ভাবনা এলোমেলো হয়। মস্তিষ্ক অকেজো বলে ঘোষনা দিতে সে প্রশ্ন করল,
” কোমল কোন স্টেজে আছে? ”
” টোটাল সেন্ট্রাল। ”
নিবিড় চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। যেন কী একটা ঘটিয়ে ফেলবে! হাত-পা অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে। প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার চারটি ধাপ। তার মধ্যে প্রথম দুটিতে তেমন ভয়ের কিছু থাকে না। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সাবধানে থাকলে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সুযোগ নিবিড়ের হয়নি। এই প্রথম কোমলের উপর ভীষণ রাগ হলো তার। এটি তো একদিনে হয়নি। বেশ সময় নিয়েছে। রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রতিনিয়ত। কোমল কি একদিনেও লক্ষ করেনি? নাকি ইচ্ছে করে জানায়নি সে চিন্তা করবে বলে? সবসময় অন্যের ভালো নিয়ে চিন্তা করার ফল আজ ভোগ করতে হচ্ছে। কোমলের প্রসব বেদনা শুরু না হলে একটা আশা থাকত। শতকরা নব্বই ভাগ প্লাসেন্টা বা ফুল উপরে উঠতে শুরু করে। ফলে সমস্যাও কেটে যায়। কিন্তু কোমলের দুর্ভাগ্য! তার প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেছে। এত আগে বাচ্চা প্রসব করলে বাচ্চাটি হয় অপরিপক্ক। অটিস্টিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আইসিউতে রাখা লাগে। অন্যদিকে মায়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করা মুশকিল হয়ে যায়। দরুন জরায়ু কেটে ফেলতে হয়।
” আমি শুধু কোমলের সুস্থতা চাই। সেজন্য যদি জরায়ু কাটার প্রয়োজন হয়। কেটে ফেলুন। ”
নিবিড়ের কণ্ঠস্বর শক্ত ও দৃঢ়। ডাক্তার বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। একটু আগেও যে ছেলেটি নরম মাটির মতো দলে-মলে যাচ্ছিল সেই ছেলে এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এত দ্রুত! যেখানে তার জানা, জরায়ু কেটে ফেললে তার স্ত্রী আর কোনোদিনও সন্তান সম্ভাবনা হতে পারবে না।
_____________
কয়েকদিন পর অনড়ার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। বুবুর সাথে রাগ ভেঙেছে বহু আগে। মোল্লাবাড়িতে নতুন অতিথির আগমন ঘটতে চলেছে, কথাটি শোনামাত্র ছুটে এসেছিল বুবুর নিকট। দর্শন পাওয়া মাত্র বুবুকে জড়িয়ে ধরে মাফ চেয়েছে। কয়েকবার তো কানে ধরে উঠবসও করেছে। নিজের গালে চড় মেরেছে। কোমল শুধু হেসেছিল। তারপর থেকে স্থগিত থাকা পাঠ্য অভ্যাস নতুন করে শুরু হয়েছে। সেই অভ্যাসের সাথে আরেকটি অভ্যাসও হয়েছিল অনড়ার। পড়ার ফাঁকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে বুবুর পেটের দিকে তাকিয়ে থাকা। দিন যত এগুচ্ছিল সেই দৃষ্টি শুধু প্রগাঢ় হচ্ছিল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো, এখানে আরেকটা প্রাণ আছে। যে কিনা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। মাঝে মাঝে তো জিজ্ঞেস করেই বসত, ‘ বাবুর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় না? এখানে তো আলো-বাতাস কিছু নেই। একা থাকতে ভয় করে না? ‘ এরমধ্যে বেশ কয়েকবার নিবিড়ের দেখাও পেয়েছিল সে। সেই দেখাগুলো বুকের ভেতর ব্যথা সৃষ্টি করলেও পূর্বের মতো অশ্রুতে পরিণত হয় না। ভাবে, নিবিড় হলো বুবুর সুখ। আর বুবুর সুখে তো সেও সুখী।
কলেজ থেকে ফিরে বুবুর কাছে পড়তে এসেছিল অনড়া। এসেই জানতে পারে কোমলকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সে বই-পুস্তক ফেলে তাৎক্ষণিক ছুটে হাসপাতালের উদ্দেশ্য। প্রথমে দেখা হয় আনিস মোল্লার সাথে। তিনি জানান, কোমলকে ওটি’ থেকে বের করলেও জ্ঞান ফিরেনি।
_____________
কোমলের জ্ঞান ফিরল ভোরের দিকে। চোখ মেলে আশপাশে তাকিতে নজর আটকাল নিবিড়ের দিকে। সে নামাজে নিমগ্ন। এই সুন্দর দৃশ্যটি কোমলের নিষ্প্রভ মুখটিতে প্রভা ছড়ায়। চিত্ত পুলকিত হয়। শুষ্ক ঠোঁটে হাসির টান পড়ে।
নিবিড় সালাম ফিরাতে গিয়ে দেখে কোমল উঠে বসার চেষ্টা করছে। সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে আসে। কোমলের কাঁধ ধরে আলতো করে। কোমল ক্লান্ত স্বরে দ্রুত বলার চেষ্টা করল,
” নামাজ ছাড়লে কেন? ”
” নফল পড়ছিলাম। ”
কথাটা শেষ করে কোমলের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল নিবিড়। কোমল অতিদ্রুত বলল,
” ছেড় না আমাকে। ”
নিবিড় ছাড়ল না। আরও ঘেষে বসল স্ত্রীর নিকট। বিস্ময় চোখে তাকালে সে বলল,
” নিশ্চয় আমার জন্য খারাপ সংবাদ আছে, তাই না? ”
” কী করে বুঝলেন? ”
” সেজন্যই নফল নামাজ পড়ছিলে। ”
নিবিড় একটুক্ষণ চুপ থাকল। স্ত্রীর দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকতে থাকতে চোখে অশ্রু কণারা ভিড় জমিয়েছে। সেই দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে কোমল বলল,
” আমাকে দুর্বল করে দিও না। ”
” এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারীটি আমার স্ত্রী। যাকে আল্লাহ দু’হাত ভরে ধৈর্য কঠিন মনোবল দান করেছেন। যা পরিমেয়! অফুরন্ত! সেই দানের জন্যই তাকে কোনো বিপদ টলাতে পারে না। দুঃখ স্পর্শ করতে পারে না। যার কাছে সুখ মানেই অপরের হাসি। ”
কোমলকে একহাতে জড়িয়ে ধরল নিবিড়। আর্দ্র কণ্ঠে বলল,
” সন্তানের মৃত্যু সংবাদ দেওয়ার সময় আমার ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। এ কি আমার দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য? ”
” কোনোভাবে বাঁচানো গেল না? ”
” সেই চেষ্টার সুযোগ পায়নি ডাক্তার। ”
” কেন? ”
” আমাদের প্রথম সন্তান মৃত অবস্থায় জন্ম নিয়েছে। ”
_____________
একটি জীবনাবসান শুধু মোল্লাবাড়ি নয় গোটা গ্রামটাকেই যেন শোকে পরিণত করল! প্রতিদিন কেউ না কেউ এসে দেখা করে যায় কোমলের সাথে। জীবনধারায় এলো আমূল পরিবর্তন। সবকিছু এলোমেলো, বিশৃঙ্খলা। বাধ্য হয়ে কোমলকেই হাল ধরতে হলো। এক সন্ধ্যায় বাবাকে বলল,
” মতি কাকাকে বাজারে পাঠাও, বাবা। তোমার জামাই ঢাকায় ফিরবে। একটু ভালো-মন্দ রেঁধে সঙ্গে করে দিব। ”
নিবিড় শ্বশুরের রুমেই ছিল। বিস্ময়াপন্ন হয়ে বলল,
” এ কথা তো আমি বলিনি! ”
কোমল একটু এগিয়ে বলল,
” আমি বলছি। যাও তৈরি হও, রাতেই বাস ধরবে। ”
নিবিড় খাট থেকে নেমে এলো। কোমলের বাহু চেপে ধরে বলল,
” পাগলামি করো না। সময় হলে আমি ঠিকই যাব। রুমে চলো। ”
কোমল হাত সরিয়ে দিল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
” আমি এই সময়টাকে ভুলতে চাই। দয়া করে, আর অমত করো না। ”
স্ত্রীকে খুশি করতে নিবিড় বাধ্য হলো ঢাকা যেতে। সময়ের সাথে সাথে সংসারটাতেও প্রাণ ফিরিয়ে আনল কোমল। ভেতরে একটা চাপা দুঃখ নিয়েই সবাই হাসতে শুরু করল।
_______________
এমবিবিএস কোর্স শেষ করে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য বেসরকারি একটি হাসপাতালে নিয়োগ পেয়েছে নিবিড়। অনাহারি ট্রেনিংসহ একটি নির্দিষ্ট অংকের বেতনও পাবে।
প্রথম বেতন হাতে পেয়েই গ্রামে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল তার মন। কোমলের জন্য একটি শাড়ি কিনতে গিয়ে তিনটে কিনে ফেলল। সাথে টুকটাক আরও কিছু কিনে তবেই স্ত্রীর সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। তার হাতে দুটো শপিং ব্যাগ দিয়ে বলল,
” আমার দুই মায়ের জন্য। দিয়ে এসো।
কোমলের চোখ-মুখ ঝলমল করে ওঠল। ব্যাগদুটো স্বামীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
” আমি দেব কেন? তুমি এনেছ, তুমি দিবে। ”
” আমার লজ্জা করছে। ভয়ও লাগছে। ”
” কেন? ”
” মা যদি বকে? মার দেয়? ”
” মেরেছিল নাকি কখনও? ”
” হ্যাঁ, ছোটবেলায়। ”
” নিশ্চয় স্কুলের বেতনের টাকা মেরেছিলে, সেজন্য রাগ করেছিল। এখন তো নিজের উপার্জন থেকে নিয়েছ। খুব খুশি হবেন। ”
নিবিড়কে রুমে রেখে মা ও শাশুড়িকে ডেকে আনল। নিবিড় ভয়ে ভয়ে দুজনের হাতে শাড়ি দুটো তুলে দিল। সে অবাক হয়ে দেখল, তার মা বকা দেওয়ার বদলে কাঁদছে।
রাতে ঘুমানোর সময় কোমল জানাল, অনড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলেছিল। পরশুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার তারিখ পড়েছে। কাল নিবিড়ের সঙ্গে তারাও যাবে। তার ওখানে থেকে অনড়া পরীক্ষা দিবে।
চলবে
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩০)
অনড়া বুবুর সাথে দুই রাত ঢাকা থাকল। নিবিড় থাকল বন্ধুর বাসায়। এতে যেন তিনজনই স্বস্থি পেল। সে রাত দুটি বড্ড কষ্টে কেটেছে অনড়ার। ঘুম হয়নি একদম। প্রথম রাত চুপচাপ চোখ বুঝে থাকলেও দ্বিতীয় রাতে পারল না। পিলপিল পায়ে পুরো রুমের জিনিসপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। সবশেষে টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টানল সাবধানে। সেখানটায় বসতেই পুরো শরীর কেঁপে উঠল তার। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। লুকিয়ে রাখা সেই পুরোনো অনুভূতিটা তাজা রক্তের মতো ছলকে উঠল যেন! মুহূর্তেই সবকিছু আপনবোধ হতে লাগল। কর্তৃত্বের কঠোর টান অনুভব করতে থাকে। সাজিয়ে রাখা একটা বই টেনে বুকের মধ্যে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে আবেশে। বেসামাল হয়। বই মুখের সামনে এনে চুমু খাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই বুবুর কণ্ঠ শুনল,
” অনু? অন্ধকারে কী করছিস? ”
অনড়া চমকে কেঁপে ওঠে। হাত থেকে বই পড়ে যায় অসাবধানতায়। সভয়ে থেমে থেমে বলল,
” ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম একটু পড়তে বসি। ”
কোমল উঠে আলো জ্বালায়। অনড়ার কাছে এসে মাথায় হাত বুলায় পরম স্নেহে। মৃদু হেসে বলল,
” খুব চিন্তা হচ্ছে, না? ”
অনড়া হাসার চেষ্টা করে বলল,
” একটু। ”
কোমলের হাত মাথা থেকে গালে চলে গেল। ঠোঁটের হাসি চওড়া করে বলল,
” চিন্তা করিস না। আমার মন বলছে, তুই পাশ করবি। খুব ভালো নাম্বার পেয়ে মেধাতালিকায় একটা ভালো স্থানে জায়গা করে নিবি। ”
বুবুর কোমর জড়িয়ে ধরল অনড়া। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মনে মনে নিজেকে খুব বকল। যুদ্ধ করল। বুকের পাশটায় খামচে ধরে বিড়বিড় করল, ‘ সে শুধু বুবুর। শুধুই বুবুর। ‘
_____________
নিবিড়ের আনা আম থেকে দুটো সুন্দর করে কাটল কোমল। দুই বাটিতে সাজিয়ে একটা শাশুড়িকে দিয়ে আরেকটা নিবিড়ের জন্য নিয়ে এসেছে। নিবিড় কাঁটা চামচ হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বাবাকে দিয়েছ? ”
” না। ”
” দিয়ে এসো, যাও। ”
কোমল চলে যেতে নিলে পিছু ডাকল। এক টুকরো আম তার মুখের সামনে ধরে বলল,
” আপনার ভাগেরটা তো খেয়ে যান। ”
” রেখে দেও, এসে খাচ্ছি। ”
নিবিড় সে কথা শুনল না। জোর করে স্ত্রীর মুখে আম ঢুকিয়ে দিল। সেই আমের স্বাদ জিহ্বা স্পর্শ করতে আশ্চর্য হয়ে বলল,
” এটা তো খেতে একদম আমাদের বাগানের আমের মতো! ”
” তোমাদের বাগানেরই। ”
একটু জোর দিয়ে কথাটা বলে আম খাওয়ায় মনোযোগ দিল সে। ততক্ষণে কোমল ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়ল। আমের বাগানটি আর তাদের নেই। বিক্রি হয়ে গেছে অনেক আগে। তাহলে নিবিড় আম আনল কী করে? তার ভাবনার সুতো কাটল স্বামীর কণ্ঠস্বরে,
” এই মুহূর্তে শ্বশুরের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। তাই তার প্রিয় জিনিস খায়িয়ে খুশি করতে চাচ্ছি। ”
কোমল বিচলিত হলে নিবিড় পুনরায় বলল,
” এত বড় বিষয়টি গোপন করা উচিত হয়নি। ”
কোমলের মাথা নিচু হয়ে গেল। অপরাধির মতো মুখ করে ফেললে নিবিড় বলল,
” ব্যাপারটি আমাকে কষ্ট দিয়েছে। এজন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে। ”
” আচ্ছা। ”
” আগে, বাবাকে আম দিয়ে আসুন। তারপর শাস্তি দিচ্ছি। ”
কোমল নীরব চালে বেরিয়ে গেল। বাবাকে আম দিয়ে ফেরত আসল দ্রুত। নিবিড় গম্ভীর স্বরে সুধাল,
” আপনি কি শাস্তি নিতে প্রস্তুত? ”
কোমল অবনত অবস্থায় মৃদু স্বরে উত্তর দিল,
” হ্যাঁ। ”
” গতবার যে শাড়িটা এনেছিলাম ওটা পরে আসুন। ”
কোমলের মাথা উঁচু হয়ে গেল আপনাআপনি। নিবিড় বোকা হেসে বলল,
” আপনাকে সাজাতে আমার খুব ভালো লাগে। ”
কোমল দ্বিধান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” মাফ করে দিয়েছ? ”
” একটু করেছি। সাজাতে সাজাতে বাকিটা করব। ”
কোমল শাড়ি পরে। তার পিঠ ঢাকা রেশম কালো চুলে চিরুনি ডুবিয়ে নিবিড় বলল,
” মাকে বাড়ির ব্যাপারে এখন কিছু বলার দরকার নেই। ”
” আচ্ছা। ”
চুলে বেনি পাকানোর বদলে কোমলকে কাছে টেনে বলল,
” অনেক দূরে থাকা হয়েছে। এবার সব গুছিয়ে তৈরি হোন। এখন থেকে রোজ রাতে আমার কাছে সাজতে বসতে হবে। ”
কোমল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে পুনরায় বলল,
” আমার দায়িত্ব ছিল, বাসা ঠিক করা। করেছি। এবার তোমরা সাজানোর দায়িত্ব গ্রহণ করো। ”
কোমল পুরোপুরি ঘুরে বসল। চিন্তিত স্বরে বলল,
” এখনই? মাত্র তো গ্রাজুয়েশন শুরু করেছ। শেষ হোক, তারপর যাই। এত তাড়াহুড়ো করার কী আছে? ”
” পাঁচ বছর অপেক্ষা করার পরও বলছেন, তাড়াহুড়ো করছি? ”
কোমল শান্তস্বরে বুঝাতে চাইল। নিবিড় বুঝ নেওয়ার জন্য একদমই রাজি নয়। স্ত্রীর কোলের উপর মাথা রাখল। পা ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
” আমি কিছু শুনতে চাই না। হয় আমার সাথে একেবারে ঢাকা যাবেন, নাহয় আমি আপনার সাথে এখানে থেকে যাব। ”
নিবিড় গোঁ ধরে শুয়ে থাকলে কোমল বলল,
” অবুঝের মতো কথা-বার্তা! ”
” হ্যাঁ, আমি অবুঝ। আর অবুঝ বলেই একা একা থাকতে ভয় পাচ্ছি। ভয় কাটানোর জন্য বুঝের প্রয়োজন। আর সেই বুঝটা তো আপনি। আমার প্রিয় মানুষ। আমার একমাত্র বিবি। ”
কোমলকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ দিল না নিবিড়। নিজ জেদে অটল থেকে বলল,
” আপনি কথা দিয়েছিলেন, আমি যখন চাইব তখন মাকে বুঝাবেন। সেখানে থাকতে রাজি করাবেন। এবার কথা রাখুন। ”
_____________
ছেলে ঢাকায় নিয়ে যেতে চায়, কথাটা শুনে প্রথমে রেগে গেলেও পর মুহূর্তে রাজি হলেন কুলসুম নাহার। এভাবে ছেলের শ্বশুরবাড়িতে থাকার চেয়ে ঢাকা থাকা ঢের ভালো। সম্মানে ঘা লাগবে না অন্তত। যদিও মোল্লাবাড়িতে বেশ আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়েছেন তিনি। কটু কথা শুনেননি কখনও। কাউকে মুখ কালো করতে দেখেননি ভুলেও। তবুও, আত্মসম্মান বলতে কিছু একটা তো আছে!
নতুন বাসায় দুটো রুম, একটা ডাইনিং, রান্নাঘর আর গোসলখানা। কোমলরা যে রুমে থাকবে সে রুমে একটা ছোট্ট বারান্দাও আছে। এখান থেকে চাঁদ দেখা যায়। নিবিড় বলেছে, পূর্ণিমা রাতে সেই চাঁদের জোসনা চুরি করে গয়না গড়িয়ে রাখবে। কোমল যখন রাগ করবে, অভিমানে গাল ফুলাবে তখন সেই গয়না দিয়ে সাজাবে। এতে নাকি তার রাগ পড়ে যাবে, মান ভেঙে যাবে। অথচ সে বুঝতেই পারল না, এই মানুষটার উপর কখনও রাগ হয় না কোমলের। যেটুকু দেখানোর চেষ্টা করে সেটা অভিনয়। তার পাগলামিগুলোকে সীমার মধ্যে আটকে রাখার জন্য জোর করে অভিনয়টুকু করতে হয়।
_______________
কোমলদের ফ্ল্যাটের মুখোমুখি আরেকটি ফ্ল্যাট আছে। সেখানে একটি বাচ্চা মেয়ে থাকে। বয়স বোধ করি পাঁচ কী ছয় হবে। মা-বাবা দুজনেই চাকরীজীবী। দাদা নেই। দাদির সাথে সারাদিন বাসায় থাকে। এক ঘটনাচক্রে সেই মেয়েটির সাথে আলাপ হয় কোমলের। জানতে পারে তার নাম মুন।
মুন মেয়েটি খুব চঞ্চল। এরমধ্যেই কোমলের সাথে ভাব করে ফেলেছে। দিনের বেশিরভাগ সময় সে কোমলের সাথে গল্প করে। গল্পের ফাঁকে নানান আবদারও করে। সেইসকল আবদার পূরণ করতে বেশ লাগে কোমলের। তেমনি এক আবদার পূরণ করতে রান্নাঘরে ঢুকতে হয় তাকে। ঝটপট নুডলস রেঁধে তাকে খাওয়ানোর ফাঁকে নানান প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল রসিয়ে রসিয়ে।
কুলসুম নাহার দূর থেকে অবলোকন করছিল তাদের। হঠাৎ বলে ফেললেন,
” আদর-ভালোবাসা সব কি অন্যের বাচ্চারেই দিয়া দিবা? নিজেরটার লাইগা কিছু থুইও। ”
কোমল অপ্রস্তুত হলো কিছুটা। মুনকে কোল থেকে নামিয়ে বলল,
” কিছু লাগবে, আম্মা? ”
কুলসুম নাহার উত্তর দিলেন না। মুনের পাশে বসলেন। গাল টেনে বললেন,
” তোমার দাদি খুঁজতাছে। যাও, দেখা কইরা আহো। ”
মুন একছুটে বেরিয়ে গেলে তিনি বললেন,
” প্রথম বাচ্চা মরা হইলে পরের বাচ্চা তাড়াতাড়ি নেওন লাগে, বুঝছ? নইলে সমস্যা হয়। তোমার তো এক বছর হইতে চলল। এইবার চিন্তা-ভাবনা করো। নিবিড়ের লগে কথা কও। আমি নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চাই। ”
____________
রাতে নিজ থেকেই স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠ হলো কোমল। তার এক ফাঁকেই শাশুড়ি বলে দেওয়ার কথাটা তুলল। নিবিড় পাথরের মতো জমে গেল যেন! স্ত্রীকে ছেড়ে উঠে বসল। কোমল চাইলেও যে আর কখনো মা হতে পারবে না এ কথাটা বলা হয়নি। নিবিড়ের সাহস-ই হয়নি কখনও। অথচ এটা জানানো খুব দরকার। নিবিড় ভেতরে ভেতরে শক্ত হতে গিয়েও ভেঙে পড়ল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,
” হঠাৎ বাচ্চার প্রসঙ্গ আসল যে? ”
” আম্মা বলছিল যে…”
” আম্মা বলেছে? ”
বাক্য শেষ করার পূর্বেই নিবিড় এমনভাবে প্রশ্নটা করল যে কোমল ভয় পেয়ে গেল। আমতা আমতা শুরু করলে নিবিড় বলল,
” রাত হয়েছে৷ আসুন, ঘুমাই। ”
____________
কোমল সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। হঠাৎ শাশুড়ি মায়ের চেঁচামেচি কানে আসে। সে চুলার আঁচ কমিয়ে সেদিকে ছুটল। দরজার নিকট পৌঁছাতেই শুনল,
” অন্যের বাচ্চারে পালবি ক্যান? সমস্যা তো তোর না। তোর বউয়ের। দরকার হইলে আরেকটা বিয়া করবি। ”
চলবে