#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৩)
নিবিড়ের আজগুবি চিঠির সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রথমদিকে কোমলের হাসি পেত। মজার মনে হতো। দুষ্টুমি ভেবে আশকারা দিলেও একসময় বাড়াবাড়ি ঠেকল। অর্থ ও সময়ের অপচয় বোধ হলো। গুরুত্বহীন ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা। অযৌক্তিত চাওয়া, আবদার। নিবিড়ের চিঠির ঝড় থামাতে প্রথমবারের মতো নিমন্ত্রণ পাঠাল।
নিবিড় নিমন্ত্রণ পেয়ে মোল্লাবাড়িতে পদধূলি ফেলল সাঝবেলায়। মূল দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকল নির্দ্বিধায়। কোমলের রুমে ঢোকার আগে একবারটি অন্য কারও সাথে দর্শন আলাপ সারতে চাচ্ছিল। সেই সুযোগ হলো না। কারও দেখা পেল না। ধরে নিল, আনিস মোল্লা মসজিদে আছেন। রাবেয়া খাতুন জায়নামাজে মোনাজাতে। কুলসুম নাহার সেজদাহতে। আর কোমল? কোমল কী করছে এটা নিজ চোখে দেখার জন্য উশখুশ করতে লাগল। সেও যদি নামাজে থাকে তাহলে চুপটি করে পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চমকে দিবে। এমন মনোবাসনা নিয়ে কোমলের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল নিবিড়। সাথে সাথে আশাহত হলো। কোমলের নামাজ শেষ। বিছানায় বসে সুঁই-সুতো দিয়ে কিছু একটা করছে। সে চাইলেও লুকিয়ে পেছনে যেতে পারবে না। ভেতরে ঢুকলেই দেখে ফেলবে। চমকে দেওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আদুরে স্বরে ডাকল,
” কোমলমতি? ”
কোমল চকিতে তাকাল সামনে। সচকিত গলায় সুধাল,
” চলে এসেছ? ”
নিবিড় উত্তর দিল না। ভেতরে ঢুকে কোমলের সেলাই করা জামাটির উপরে মাথা রাখল। পা’দুটি খাটে তুলে টান টান হয়ে শুয়ে বলল,
” এখন মনে হচ্ছে, সত্যি এসেছি। ”
” দেখে তো সুস্থই মনে হচ্ছে। তারমানে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো চলছে। রান্নাও ভালো হচ্ছে। তারপরও এত অভিযোগ? ”
নিবিড় চোখ বন্ধ করে ছিল। কোমলের কথায় চোখ মেলে দেখল, সে সুঁই-সুতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার হাত থেকে সেগুলো কেড়ে নিয়ে বলল,
” আপনার চোখদুটো যেটুকু দেখতে পাচ্ছে, শুধু সেইটুকু সুস্থ। বাকি সব অসুস্থ। ”
কোমল ঠোঁট টিপে হাসলে নিবিড় বলল,
” বিশ্বাস না হলে আমার হৃৎস্পন্দন, নাড়ি স্পন্দন পরীক্ষা করুন। ”
কোমল পরীক্ষা করার সময় পেল না। কোথাও থেকে অনড়া ছুটে এলো। ‘ বুবু ‘ বলে ডেকেই কণ্ঠটা নিভে গেল। পদ কম্পন থেমে গেল। নিবিড় বিরক্ত চোখে অনড়ার দিকে তাকিয়ে থাকলে কোমল ফিসফিস গলায় বলল,
” সরো। ও দেখছে। ”
নিবিড় সরল না। অনড়ার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল। কোমল পড়ল ভীষণ অস্বস্থিতে। অপ্রস্তুত হেসে অনড়াকে বলল,
” মায়ের রুমে গিয়ে বস, আমি আসছি। ”
অনড়া মাথানিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কোমল অসন্তুষ্ট হয়ে বলল,
” এটা কী ঠিক হলো? ”
” কোনটা? ”
” অনুর সামনে আমাকে লজ্জায় ফেললে। ”
” আমি ফেলিনি। ও ফেলেছে। কারও রুমে ঢোকার আগে যে অনুমতি নিতে হয়, সে কি জানে না? ”
কোমল তর্কে জড়াতে চাচ্ছে না। অনড়া কেন এসেছে জানা প্রয়োজন। হাতে বই-খাতা ছিল না। তারমানে পড়তে আসেনি। অন্য কারণে এসেছে। কোনো সমস্যায় পড়েনি তো? কোমল দু্র্ভাবনায় পড়ে নিবিড়কে বলল,
” তুমি হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলাও। আমি আসছি। ”
” আরেকটু থাকি এভাবে। ”
” অনড়া আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ”
” করুক। আপনার কাছে আসার জন্য একমাসের দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় ছিলাম আমি। আর সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে না? ”
কোমল কী বলবে খুঁজে পেল না। অস্থিরমনে দরজার দিকে চেয়ে থাকলে নিবিড় পুনরায় বলল,
” বলুন তো, আমার মুখে কয়টা তিল? বলতে পারলে যেতে দেব। ”
কোমল নিরীক্ষকের মতো নিবিড়ের মুখটায় চোখ বুলাল। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
” একটাও পাচ্ছি না। ”
কোমলের ব্যর্থ চোখজোড়ায় চেয়ে নিবিড় বলল,
” আমার মুখে কোনো তিল নেই। ”
” তাহলে খুঁজালে কেন? ”
” আমি চাচ্ছিলাম এই শান্ত চোখদুটি আমাকে দেখুক। তাহলে আমার অশান্ত মন শান্ত হবে! তবেই না এতদূর আসা সার্থক হবে। আপনার ছুটি মিলবে। ”
কোমল দৃষ্টি সরিয়ে নিলে নিবিড় উঠে বসল। অনুমতি পেয়ে জোর কদমে বাইরে বেরিয়ে এসে ধাক্কা খেল হৃদয়ে। অনড়া মায়ের রুমে যায়নি। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তার ভেজা গালদুটো হাতের আঁজলায় নিল কোমল। ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন? ”
অনড়া উত্তর দিতে পারল না। অশ্রুর প্লাবন বেড়ে চলল শুধু। হেঁচকি উঠে গেলে কোমল আদুরে গলায় বলল,
” বুবুকে বলবি না? ”
অনড়া নিশ্বাস টেনে কান্না বিগলিত গলায় বলল,
” ব্যথা করছে। ”
” কোথায়? ”
” খুঁজে পাচ্ছি না, বুবু। ”
” তাহলে পিরিয়ডের ব্যথা। আমার সাথে আয়। গরম পানি করে দিচ্ছি। ”
অনড়া বুবুর সাথে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে যেতে যেতে আপনমনে বলল, ‘ পিরিয়ডের ব্যথা না, বুবু। হৃদয় ভাঙার ব্যথা। স্বপ্নে যে মানুষটা রোজ আমায় বিয়ে করত, সেই মানুষটা তোমায় বাস্তবে ভালোবাসছে, আদর করছে। আমি কী করে সইব বলো? ‘
_____________
” এই তোমার লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা ভাত, ডিমের সাথে কাঁচামরিচ ভাজা, মাংস দিয়ে মসুর ডাল, শুঁটকি দিয়ে কাঁচকলার তরকারি। ”
নিবিড় বোকা চোখে তাকিয়ে সুধাল,
” আপনি মজা নিচ্ছেন? ”
কোমল মুচকি হেসে বলল,
” মজা নিব কেন? তোমার চাওয়া পূরণ করছি। রোজ রোজ তো সম্ভব না, তাই একবেলায় তোমাকে খুশি করতে চাচ্ছি। ”
নিবিড়ের মুখ কালো হলো। চোখ নামিয়ে বলল,
” ইচ্ছে করে উল্টো বুঝছেন। আসল চাওয়াটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। ”
ভাতের থালায় ডিম ভাজা তুলে দিয়ে কোমল বলল,
” কাকা বলেছিলেন, তোমার খেয়াল রাখতে। আমি সেটাই করছি। ”
” না বললে রাখতেন না? ”
নিবিড়ের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
” কাকিমার খেয়াল রাখার দায়িত্ব কিন্তু তোমার উপর। আমি চাই সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করো। এসব আবেগি চিন্তা-ভাবনাকে দূরে রাখ। পাগলামি বন্ধ করে ভবিষ্যৎ চিন্তায় মগ্ন হও। ”
নিবিড় চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে গেল। কোমল বুঝতে পারল সে মনখারাপ করেছে। তবুও পেছন পেছন গেল না। মায়ের সাথে রান্নাঘরে সময় কাটাল অনেক্ষণ। তাকে রুমে দিয়ে বাড়ির সব আলো নিভিয়ে অতঃপর অগ্রসর হলো নিজ রুমের দিকে। নিবিড়কে একপাশ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে রুমের আলোটাও নিভিয়ে ফেলল। চুপচাপ অন্যপাশে শুতেই নিবিড় বলল,
” আমি কি খুব বিরক্ত করছি? ”
” না, অল্প। ”
” শাস্তি পাওয়ার মতো? ”
” তুমি শাস্তি চাও? ”
” আপনি দিলে, চাই। ”
কোমল মৃদু হাসল। নিবিড়ের চুলে আঙুল ডুবিয়ে বলল,
” আসো, ঘুম পাড়িয়ে দিই। ”
ঘুমের আমন্ত্রণ পেয়ে নিবিড়ের মনখারাপ দূর হয়ে গেল নিমিষেই। বালিশ ছেড়ে এসে স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
” আপনি যেমন বলবেন, আমি তেমনভাবেই চলব। শুধু এই নিমন্ত্রণটা বন্ধ করবেন না। ”
” আচ্ছা। ”
একটুক্ষণ চুপ থেকে নিবিড় সুধাল,
” আপনি খুশি? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে একটা চুমু খাই? ”
” আচ্ছা। ”
অনুমতি পেয়েও চুমু খেতে ইচ্ছে হলো না নিবিড়ের। বেশ কয়েকটি মুহূর্ত নীরব কাটিয়ে উঠে বসল। কোমল ভাবল, বাইরে যাবে হয়তো মূত্র নির্গমনের জন্য। কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ঠাঁই বসে রইল তখন প্রশ্ন করল,
” ঘুম আসছে না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” অশান্তি লাগছে। ”
কোমল উঠে বসল। নিবিড়ের কাঁধে হাত রাখতেই বলল,
” আমার অর্থ-বিত্ত নেই, আপনার পছন্দসই ব্যক্তিত্ত্ব নেই, দেখতেও আহামরি কিছু না। সেজন্যই আপনার মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারছি না, তাই না? ”
” হঠাৎ এমন কথা কেন? ”
” বিয়েটাও হয়েছে আমার জোরাজুরিতে। সেজন্য মানিয়ে নিতে এত সমস্যা হচ্ছে আপনার। ”
” কোথায় সমস্যা হলো? আমি এমন কিছু বলেছি? ”
” হচ্ছে, নাহলে এখনও আমার বাবা-মাকে কাকা-কাকিমা বলে সম্বোধন করেন? ”
কোমলের হঠাৎ করে যেন হুঁশ হলো। বিয়ের পরে যে তারা কাকা-কাকিমা থেকে শ্বশুর-শাশুড়ি হয়েছে এ কথাটি সে ভুলেই গিয়েছিল। কী অদ্ভুত! অন্য কেউ মনে করিয়েও দেয়নি। কোমলের ভারি অনুতাপ হলো। বলল,
” তুমি যেমনটা ভাবছ তেমন নয়, আমি তোমাকে নিয়ে এত চিন্তিত ছিলাম যে অন্যকিছুতে মনোযোগ দিতে পারিনি। তাই ভুল করে কাকা-কাকিমা সম্বোধন করেছি। ”
নিবিড় আচমকা পেছন ঘুরল। অন্ধকারে কোমলের চোখে চোখ রেখে বলল,
” তারমনে আপনি বিয়েটা মন থেকে মেনে নিয়েছেন? ”
“হ্যাঁ। ”
” আমাকে ভালোবাসেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন বাসেন? ”
” বুঝিনি। ”
” ঐ যে বললাম না? আমার অর্থ নেই, কঠোর ব্যক্তিত্ব নেই, দেখতেও খুব ভালো নই। তাহলে কী দেখে ভালোবাসলেন? ”
কোমল চুপ থাকলে নিবিড় অধৈর্য হয়ে বলল,
” বলুন না। ”
” কেউ সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে, কেউ শরীরের, কেউ মনের, কেউ’বা ব্যক্তিত্বের, মায়ার অথবা গুণের। আমি নাহয় এই সব কিছুকে ছাপিয়ে তোমার ভালোবাসার প্রেমে পড়লাম! ”
কোমলের মুগ্ধ বুলিতে বিস্ময়াভিভূত হলো নিবিড়। কয়েক মুহূ্র্তের জন্য বাকহারা থেকে বলল,
” তাহলে ঐ অনুমতি দিন। ”
” কোন অনুমতি? ”
” যে অনুমতি চাইলে দুজনেই ভীষণ লজ্জা পাব। ”
কোমল একটুক্ষণ চুপ থেকে বুঝার চেষ্টা করল। তারপর বলল,
” আজ থেকে আমার কোনো ব্যাপারে তোমার অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন নেই। ”
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ। ”
নিবিড় অতি খুশিতে কোমলকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও থেমে গেল। অসহিষ্ণু গলায় বলল,
” আমি অনুমতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, বিবি। ওটা ছাড়া হচ্ছে না। ”
কোমল হেসে ফেলল। সহাস্যে বলল,
” অনুমতি দেওয়া হলো। ”
চলবে
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৪)
” মাথায় হাত দিচ্ছেন কেন, ঘুম চলে আসছে তো! ”
চুম্বনের উষ্মতা ছড়ানোর এক ফাঁকে কথাটা বলল নিবিড়। কণ্ঠে মৃদু বিরক্ত, অনুযোগ। কোমল থতমত খেয়ে হাত সরিয়ে নিল। নিবিড় সেই হাত টেনে এনে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
” কষ্ট পেয়েছেন? আপনি চুলে হাত রাখলে আমার ঘুম চলে আসে। অভ্যাস হয়ে গেছে। সেজন্য ভুল করে বলে ফেলেছি! ”
কোমল নীরব চেয়ে থাকল নিবিড়ের মুখটায়। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হলো দৃষ্টি জোড়া। মনে মনে বলল, ‘ তুমি ভেতরে যেমন, বাইরেও তেমন। এই গুণটায় আমাকে খুব টানে। বাধ্য করে তোমার সকল চাওয়া পূরণ করতে। আবদার রাখতে। ‘ সামনাসামনি বলল,
” আমি কষ্ট পাইনি। ”
নিবিড়ের অপরাধবোধ দূর হলো। চোখের চাহনিতে মাদকতা ফিরে এলো। চিত্তচাঞ্চল্য শরীরের মধ্যে বয়তে শুরু করতেই ঠোঁটের নরম স্পর্শ রাখল কোমলের গ্রীবাদেশে। দুনিয়া ভুলে পুনরায় স্ত্রীর নরম দেহ গাঁথুনিতে ডুবে যাচ্ছিল। সহসা কোমল দু’হাতে নিবিড়ের মুখ চেপে ধরে বলল,
” তোমাকে একটা চুমু খাই? ”
নিবিড় প্রবল উৎসাহে ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল,
” এখানে খান। ”
কোমল মৃদু হাসল। ঠোঁটের বদলে কপালে চুমু খেল পরম আদরে। স্বামীর মাথা বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল,
” আমরা যদি সম্বোধন পাল্টাপাল্টি করি কেমন হবে? ”
” কীরকম? ”
” তোমার ‘ আপনি ‘ ডাকটা আমাকে দিবে। আমার ‘ তুমি ‘ ডাকটা তোমাকে দেব। ”
” ইচ্ছে হচ্ছে? ”
” হ্যাঁ, খুব। এতে বয়সের পার্থক্যটাও ভুলে থাকা যাবে। ”
” আমি ভুলতে চাই না। ”
” কেন? ”
” আপনার প্রতি সম্মানটা আজীবন ধরে রাখতে চাই। ”
” সম্বোধন বদলে গেলে সম্মান কমে যাবে? ”
” একদমই না। ”
” তাহলে আপত্তি কিসের? ”
” ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। ”
কোমল চুপ হয়ে গেলে নিবিড় বলল,
” অন্য সবকিছুর মতো ‘ আপনি ‘ ডাকেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি। তবে, আপনার ইচ্ছেটাকে সম্মান করে আমি চেষ্টা করব। ”
কথাটা বলতে বলতে কোমলের পেট আবৃত করল নিবিড়। সেখানে মাথা রাখল। কোমলের হাত চুলের উপর রেখে বলল,
” ঘুমাব। ”
” এখন? ”
” হ্যাঁ। ”
কোমল ভয় পেয়ে গেল। ভেবে বসল, নিবিড় রাগ করেছে। রাগ ভাঙানোর জন্য ব্যস্ত হলে নিবিড় বলল,
” শরীরি ভালোবাসার চেয়ে মনের ভালোবাসা অনেক দামি। যেটা আমি মাত্র অনুভব করেছি। আমি আজ অনেক খুশি, অনেক। খোদার নিকট আকুল আবেদন, এই ভালোবাসা কখনও না ফুরাক। ”
_____________
ঢাকায় ফিরে যাওয়ার আগে মায়ের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এলো নিবিড়। কোমল তখন কাপড় স্ত্রী করছিল। নিবিড় বিছানায় বসে সঙ্গীনির কাজের ভঙ্গি দেখছিল চুপচাপ। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
” আপনি শাড়ি পরেননি কখনও? ”
” বিয়েরদিন পরেছিলাম। মনে নেই? ”
নিবিড় যেন সত্যিই ভুলে গিয়েছিল। খানিকটা আফসোস প্রকাশ করে বলল,
” আগে পরেননি? ”
” না। ”
” কেন? ”
” ইচ্ছে করেনি কখনও। ”
” এখনও ইচ্ছে করে না? ”
” না। ”
সযত্নে ভাঁজ করা কাপড়খানা নিবিড়ের পাশে রাখল কোমল। বলল,
” গোসল করে এসো। আমি খাবার বাড়ছি। ”
” আমি সবার সাথে খাব না। ”
” সে কী! কেন? ”
” আপনার সাথে ভাগাভাগি করতে পারি না। খেয়ে তৃপ্তি পাই না। ”
কোমল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলে নিবিড় দৃষ্টি নামিয়ে বলল,
” খাবার এখানে নিয়ে আসুন। আপনার ভাগ না দিলেন, আমারটা নিবেন। ”
” এটা কি ভালো দেখাবে? বাবা কী মনে করবেন? তিনি বাসায় না থাকলে অন্য ব্যাপার ছিল। ”
” তাহলে দুইবার খাই? ”
কোমল ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
” তুমি খেতে পারলে আমার অসুবিধা নেই। ”
_______________
নিবিড় চলে যাওয়ার দুইদিন পর অনড়া পড়তে আসল। তার কিছুদিন পর পরীক্ষা। প্রস্তুতি ভালো করার জন্য আগে থেকে খাতা-কলমে পরীক্ষা নিবে কোমল। সেই আয়োজনের জন্যই প্রশ্ন তৈরি করেছে। ঘড়িতে চোখ রেখে বাঁধা সময় দিয়ে লেখা শুরু করতে বলল। ঘণ্টার কাঁটা একঘর ছেড়ে অন্য ঘরে যেতে কোমলের কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিমায় বলল,
” তুই এখন বড় হয়েছিস, না অনু? ”
অনড়ার মনেযোগ ক্ষুণ্ণ হলো। খাতা থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল,
” তোমরা যদি বলো, তাহলে হয়েছি। ”
” বড় হলে অন্যদের রুমে ঢুকতে হলে অনুমতি নিতে হয়, জানিস এটা? ”
অনড়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়লে কোমল বলল,
” জানি। ”
” তাহলে সেদিন অনুমতি ছাড়া আমার রুমে ঢুকলি কেন? ”
” সবসময় তো অনুমতি ছাড়াই ঢুকি। ”
” এখন থেকে ঢুকবি না। ”
অনড়া উত্তরে কিছু বলল না। লেখায় মনোযোগ দিতে গিয়ে বুঝল, চোখে ঝাপসা দেখছে। নিশ্বাস আটকে আছে। গলার ভেতর কান্নার দলা পাকিয়ে আছে। সেই দলা বের করতে পারছে না বিধায় ভীষণ ব্যথা করছে। এই অসহ্য ব্যথা মস্তিষ্ক অবশ করে দিল। বুঝতে পারল না, খাতায় একের পর এক ভুল উত্তর লিখছে। খাতায় অসংখ্য কাটাকাটি করতে করতে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ যে আমার বুবুর ভালোবাসা কেড়ে নেয়, সে আমার ভালো স্বপ্ন হতে পারে না। সে শুধু দুঃস্বপ্ন। ‘
বাঁধা সময় শেষ হলে খাতা জমা নিল কোমল। প্রথমে খুব ভালো নাম্বার পেলেও শেষের দিকে ভুলের পর ভুল হওয়ায়ই লাল কালিতে শূণ্য দিচ্ছিল। অনড়ার মনের রাগ অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠল। খাতা টেনে নিয়ে বলল,
” এখানে শূণ্য দিলে কেন? ”
” ভুল লিখেছিস। ”
” কী করে জানলে, ভুল লিখেছি? তুমি তো কখনও কলেজে যাওনি, ক্লাস করোনি, পরীক্ষা দেওনি। ”
কোমলকে কিছু বলার সুযোগ দিল না অনড়া। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে যেন। পাগলের মতো লাল কালির কলমটাও ছিনিয়ে নিল। শূণ্যের জায়গায় সর্বোচ্চ নাম্বার বসিয়ে বলল,
” সব ঠিক লিখেছি। আমি জানি, সব ঠিক। কারণ, আমি কলেজে যাই, ক্লাস করি, নোট লিখি। ”
অনড়া বই-খাতা নিয়ে উঠে পড়ল। বাইরে বেরুতে বেরুতে বলল,
” আমি আসলেই বোকা। নাহলে এমন মানুষের কাছে পড়তে আসি? যে কিনা কলেজের গেইটটা পর্যন্ত চোখে দেখেনি! ”
________________
অনড়া সেই যে রাগ দেখিয়ে চলে গেল, আর আসেনি কোমলের কাছে। কোমলের মন উতলা হয়ে উঠল দিনে দিনে। বাবাকে দিয়ে কয়েকবার ডাক পাঠাল। তবুও এলো না। একসময় বাধ্য হয়ে সে নিজেই সশরীরে হাজির হলো অনড়াদের বাড়িতে। অনড়া তখন চৌকাঠে বসেছিল গালে হাত দিয়ে। কোমলকে দেখে ছুটে যায় বাড়ির ভেতরে। দরজা আটকে দেয় সশব্দে। কোমল বাইরে থেকে ডাকাডাকি করে বলল,
” শূণ্য দিয়েছি বলে এত রাগ করে কেউ? আচ্ছা যা, আমার কাছে পড়তে হবে না তোর। এমনি আসিস। গল্প করব, তেতুল খাব। ”
অনড়া বাইরে বেরুল না। কোনোরূপ সাড়াশব্দও করল না। অনেকটা সময় অপেক্ষা করে দুঃখীমনে ফিরে আসে কোমল।
_______________
সেমিস্টার ফি দেওয়ার পর যৎসামান্য টাকা ছিল নিবিড়ের কাছে। সেই টাকা খরচ না করে রেখে দিয়েছিল মানিব্যাগের এককোণে। অপেক্ষায় ছিল কোমলের দ্বিতীয় নিমন্ত্রণের। ঠিক করেছিল, এবার খালি হাতে যাবে না সে। কিছু একটা নিয়ে যাবে। বিয়ের পর কোমলকে কিছু কিনে দিতে পারেনি সে। এবার দিবে।
ছটফটময় অপেক্ষার অবসান ঘটল। নিমন্ত্রণ এলো। কোমলের জন্য উপহার কিনতে গিয়ে পড়ল বিপাকে। এত অল্প টাকায় কী কিনবে ভেবে পেল না। শাড়ি কেনার কথা চিন্তায় আসলে মনে পড়ল কোমলের শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয় না। অনিচ্ছার জিনিস দেওয়া ঠিক হবে না। তাই অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে এক মুঠো কাচের চুড়ি, পাথরের দুল আর কাজল নিল। গ্রামের পথ পার হতে হতে নাম না কিছু ভিন্ন রঙের ফুল কুড়িয়ে নিল।
এবারও সাঝবেলাতেই মোল্লাবাড়িতে পৌঁছাল নিবিড়। সদর দরজায় পা রাখতে রাবেয়া খাতুনের সাথে দেখা হলো। কুশল বিনিময় শেষে কোমলের সাথে দেখা করতে গিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হলো। সবিস্ময়ে সুধাল,
” আপনি তো বলেছিলেন, শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয় না। ”
” আজ হলো। ”
নিবিড় উপহারগুলো কোমলের হাতে দিয়ে বলল,
” এগুলো আপনার জন্য। ”
কোমল খুশিমনে সেগুলো নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিবিড় ভাবল, তার সামনে এগুলো পরতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই মায়ের রুমে গেছে পরতে। অনেকটা সময় পেরিয়ে কোমল যখন রুমে এলো। নিবিড় অবাক হয়ে দেখল, তার ভাবনা ভুল। কোমল সেগুলো কিছুই পরেনি। সে সন্দেহি গলায় সুধাল,
” আপনার পছন্দ হয়নি? ”
” হয়েছে। ”
” তাহলে পরেননি কেন? ”
” পরে, খুলে ফেলেছি। ”
” কেন? ”
কোমল মনখারাপের সুরে বলল,
” কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল! ”
নিবিড় ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থেকে হালকা হাসল। বলল,
” আপনি নিশ্চয় আগে পরেননি এগুলো। তাই এমন মনে হচ্ছে। ”
কোমল বোকা চোখে তাকালে নিবিড় বলল,
” নিয়ে আসুন তো। আমি দেখি, কেমন অদ্ভুত দেখায়। ”
কোমল ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে গেল সেগুলো আনতে।
______________
কোমলকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর অনুতাপে পুড়ছিল অনড়া। নিজেকে ঘরে বেঁধে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। কোনোকিছুতেই মন বসাতে পারছিল না। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে অসুখে ভুগল কয়েকদিন। অসুখ সারতেই বুবুর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। একা যেতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল। তাই সন্ধ্যার দিকে নানি বাড়ি ফিরলে তাকে নিয়ে হাঁটা ধরে কোমলদের বাড়ি। রাবেয়া খাতুনের সাথে জমিলা বেগমের বাক্যালাপ শুরু হলে অনড়া সংকোচে এগিয়ে যায় কোমলের রুমের দ্বারে। দরজা চাপানো ছিল। সে দরজা মেলে ভেতরে ঢুকবে তখনই মনে পড়ল, বুবু বলেছিল, অনুমতি চেয়ে ভেতরে ঢুকতে। অনড়া সেই আদেশানুসার করতে গিয়ে নজর পড়ল রুমের ভেতর। ছোট ছোট চোখদুটো দেখল, নিবিড়ের যত্ন করে চুড়ি পরানো, কানে দুল পরানো। পরিশেষে চুল আঁচড়ে দিয়ে ফুল গুঁজে দেওয়া। দেখতে দেখতে অনড়ার নাভিশ্বাস উঠে গেল। মুখ ফিরিয়ে দৌড়া লাগাল ফেরার পথে।
________________
অনড়া এবাড়ি এসেছিল অথচ কোমলের সাথে দেখা করেনি। কথাটা যত মনে পড়ছে ততই মনখারাপ হচ্ছে কোমলের। নিবিড় না থাকলে সে হয়তো এখনই আরেকবার ছুটে যেত অনড়ার কাছে। আগেরবারের মতো চুপচাপ ফিরে আসত না। কান ধরে খুব বকত।
” আপনি কিন্তু অনেক শুকিয়ে গেছেন। খাওয়া-দাওয়া করছেন না ঠিকমতো? ”
নিবিড়ের কণ্ঠে কোমল তটস্থ হলো। প্রকৃস্থ হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে বলল,
” কোথায় শুকালাম? ”
” এখন কি শরীরে চিহ্ন এঁকে দেখাতে হবে? ”
কোমল নিরুত্তর থাকলে নিবিড় বলল,
” ঘুমাচ্ছেন না ঠিকমতো। চোখের নিচে কালি পড়েছে। চুলের যত্ন করছেন না একদম। ”
কোমল এবারও নিরুত্তর থাকলে নিবিড় গালে হাত রাখল। কোমল স্বরে সুধাল,
” কী হয়েছে আপনার? ”
কোমল পূর্বের মতো নিরুত্তর থাকলে নিবিড় বলল,
” আমার কথা খুব মনে পড়ছিল? ”
কোমল উপরনিচ মাথা নেড়ে মুখ লুকিয়ে ফেলল নিবিড়ের বুকে। নিবিড় সবিস্ময়ে বলল,
” আপনিও লজ্জা পান! ”
_______________
নিবিড় ও কোমলের জীবনে আরও বেশ কয়েকটি নিমন্ত্রণপত্র জমা হওয়ার পর সেই বিকেলের দেখা মিলল। যে বিকালে বিধ্বস্ত অবস্থায় ঢাকা আসে কোমল। নিবিড় ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে দেখে রাঁধুনির বদলে দরজা খুলে দিয়েছে তার জীবন সঙ্গীনি। সেই প্রথম স্ত্রীর শান্ত চোখদুটি তার মনকে শান্ত না করে অশান্ত করে দিল। ভয় পায়িয়ে দিল। অকল্যাণজনিত হাজার দুশ্চিন্তা এক মুহূর্তে দখল করে নিল মন ও মস্তিষ্ক। সে ভয়ে ভয়ে শুধু জিজ্ঞেস করল পারল,
” কী হয়েছে, কোমল? ”
চলবে