বিবি পর্ব-১৩+১৪

0
600

#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৩)

নিবিড়কে কী বলে ডাকবে বুঝতে পারছে না অনড়া। দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে তাকিয়ে থাকল নিবিড়ের দিকে। সে কিছুক্ষণ রোদের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। পাল্লা মেলে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তে! অনড়ার পলক পড়ল। দুঃখী বদনে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকল উদাসভাবে। চোখ ভর্তি ব্যথার পানি ও লাঠি নিয়ে হাজির হলো মোল্লাবাড়ি। কোমলের রুমে ঢুকে বলল,
” বুবু, ভালোবাসার মানুষরা মারলেও আনন্দ লাগে? ”

কোমল বোরকার শেষ সেলাইটি দিচ্ছিল সযত্নে। অনড়ার উপস্থিতি টের পায়নি। হঠাৎ কণ্ঠ পেয়ে খানিক চমকাল। মেশিনের চাকা থামিয়ে চোখ তুলে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে ভ্রূ-দ্বয় কুঁচকে এলো। সংশয় নিয়ে বলল,
” মার দিয়েছিস নাকি খেয়েছিস? ”

অনড়া গাল থেকে বাম হাত নামিয়ে বলল,
” খেয়েছি। ”

কোমল মেশিন ছেড়ে উঠে এলো। অনড়ার গালে লালচে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” নানি মারল আবার? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

অনড়া বলতে গিয়েও জিভ সামলে নিল। নিবিড়ের দেওয়া লাঠিটা বুকে চেপে ধরে সুধাল,
” শাসনতো সেই করে যে ভালোবাসে। তাই না, বুবু? ”
” হ্যাঁ। ”
” তারমানে তিনিও আমাকে ভালোবাসেন। ”

অনড়ার কণ্ঠে মুক্ত পাখির মতো উচ্ছ্বাস। চোখের তারায় বর্ষার রামধনুর মতো রঙিন আনন্দ। কোমল জিজ্ঞেস করল,
” তিনিটা কে? ”

অনড়া খুশি নিয়ে নৃত্যভঙ্গিতে ডানে-বামে দুলে বলল,
” আমার স্বপ্নে আসা বর। ”

কোমল বিস্মিত হলো। পরক্ষণেই স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে গেল সেলাই মেশিনের কাছে। টুলে বসে, মেশিনের চাকা ঘুরিয়ে বলল,
” কোথাও যাস না। এখানে বস। একটা সেলাই বাকি। ”

অনড়া প্রেম মোহ থেকে বেরিয়ে এলো চট করে। নিবিড়ের ঘোর কাটিয়ে বলল,
” কিসের সেলাই? ”
” এখনই দেখতে পাবি। দুটো মিনিট অপেক্ষা কর। ”

অপেক্ষা করার ধৈর্য্য হলো না অনড়ার। মেশিনের কাছে ছুটে গেল। কালো রঙের কাপড়টা ছুঁয়ে দেখে বলল,
” নতুন জামা? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” নতুন বোরকা। ”

কথায় কথায় সেলাই শেষ করে ফেলল কোমল। দাঁত দিয়ে সুতো কেটে বোরকা আলাদা করল। অনড়াকে সামনে দাঁড় করিয়ে লম্বা মেপে নিল। ঠিকঠাক মনে হতেই গলায় গলিয়ে দিয়ে বলল,
” এই হলো তোর বড় হওয়াকে ঢাকা। ”

অনড়া পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে কোমল মৃদু হাসল। বলল,
” বরের বউ হতে হলে বড় হতে হবে। বাচ্চাদের মতো দৌড়াদৌড়ি করলে চলবে না। গাছে উঠা যাবে না। বড়দের সাথে বেয়াদবি করা যাবে না৷ নম্র ও ভদ্র হয়ে থাকতে হবে। ”

কোমলের মধ্যে নিবিড়ের ছায়া দেখতে পেল যেন! মুগ্ধ চাহনি রাখল কোমলের মুখটায়। সেকেন্ড কয়েক পর ঠোঁট নেড়ে বলল,
” তাহলে আমার বিয়ে হবে? সংসার হবে? বাচ্চা-কাচ্চা হবে? ”

অনড়ার এমন প্রশ্নে হতভম্ব হলো কোমল। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলল। অনড়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,
” হবে। সব হবে। ”

অনড়া খুব খুশি হলো। চৌকিতে রাখা লাঠিটা আবারও বুকে জড়িয়ে বলল,
” এই আজ থেকে আমার বড় হওয়া শুরু। ”

_______________

নিবিড় গ্রামে আসার পর ঐবাড়িতে যাওয়া হচ্ছে না কোমলের। কুলসুম নাহারও এবাড়িতে আসছে না। মতিন মিয়ার খোঁজ-খবর এনে দিচ্ছে মোহন কাকা। কোমল অবশ্য মাকে দিয়ে রান্না করা খাবার পাঠায় মাঝেমধ্যে। মা না আসা পর্যন্ত একটা চাপা ভয় বসে থাকে বুকের মধ্যখানে। মনে হয়, নিবিড় খাবার ফিরিয়ে দিবে। তার এই মনে হওয়া ভুল প্রমাণিত হয় প্রতিবার। সবসময়ের মতো আজও রাবেয়া খাতুন খালি হাতে ফিরে এসে বললেন,
” আজকেও বাটি দিল না। এটা কেমন অভদ্রতা? আমি কি যেচে বাটি চাইতে যাব? বাসায় আর একটিও বাটি নেই। এতজনের খাবার কি প্লেটে নেওয়া যায়? ”

প্রত্যুত্তরে নীরব থাকল কোমল। মা বিরক্ত ঝেড়ে ফিরে গেলে বই তুলে নিল। কয়েক পাতা পড়ে মনে হলো, বাবাকে বলতে হবে বাজার থেকে কিছু বাটি আনিয়ে রাখতে। হাতের বইটি বইয়ের তাকে রাখতে গিয়ে সেই কাঠের বাক্সটি চোখে পড়ল। মনে পড়ল, অনেকদিন বাক্সটি খোলা হয় না। নিবিড়ের শব্দে আঁকা কোমলকে পড়া হয় না। ভাবতে ভাবতেই একটা আবছা মোহে ডুবে গেল সে। ভুলে গেল বই রাখতে আসার কারণ। আকুলতা ছড়িয়ে পড়ল মনের ভেতরটায়। উশখুশ ভাব নিয়ে বাক্স তুলে নিল দুইহাতে। ঢাকনা খুলতেই ভোরের হাওয়ার মতো পুলকিত হলো মন ও শরীর। বৈচিত্র্য সব জিনিস নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একটি কানের দুল পেল। রাতের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল যেন! দুলটা হাতে নিতেই অস্পষ্ট শব্দে উচ্চারণ করল, ‘ এটা তো আমার হারিয়ে যাওয়া দুল! ‘ কোমল চেনা সত্ত্বেও দুলটি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখছিল। উল্টো করতেই একটি কাগজের টুকরো পেল। সুতো দিয়ে খুব কায়দা করে নিপুণতার সাথে গোল করে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। কোমল সেই কাগজ খুলল আলতো টান দিয়ে। ভাঁজ খুলতেই ছোট্ট কাগজটি অনেকটাই বড় দেখাল। তারমধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা ছোট করেই শব্দ বুনা। কোমল আলোর সামনে গিয়ে চোখ সরু করে পড়তে লাগল,
” পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠতে আমার জন্য প্রাইভেট ঠিক করল, মা। আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম তখন। কেননা, সেই বয়সে অভাব সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান হয়েছে আমার। নিজ সংসারের দারিদ্র্য সম্পর্কে অবগতও আমি। সেই অবস্থায় মাস্টারের কাছে আলাদা করে পড়া মানে অতিরিক্ত কিছু টাকা খরচ করা। শুরুর দিকে আমি পড়তে চাইতাম না। মা বুঝাতেন, জোর করে নিজেই দিয়ে আসতেন স্যারের বাসায়। আমাকে অবাক করে দিয়ে মাসের শুরুতেই প্রাইভেটের বেতন পরিশোধ করতেন মা। আমার পড়তে না চাওয়া ভাবটা কেটে গেল। মায়ের জোর করা বন্ধ হলো। নিজেই দৌড়ে পড়তে যেতে শুরু করলাম। এমন করে বছর পেরিয়ে গেল। ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভালো করলাম। সপ্তম শ্রেণিতে রোল নাম্বার হলো দুই। আমি বেশ উৎসাহিত হলাম। মনে মনে জেদ ধরলাম অষ্টম শ্রেণিতে রোল করব এক। সে চিন্তা নিয়ে খুব মনোযোগে পড়ছিলাম। সেই পড়ার মধ্যে একদিন দেখলাম বাবা খুব রাগ করেছেন। মাকে চড়া গলায় বকছেন। আমি পড়া রেখে বকার কারণ জানতে গেলাম। কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি। দূর থেকেই শুনলাম, মা কোমলের কানের দুল চুরি করেছে। এ অন্যায় বাবা মানতে পারছেন না। মা বুঝাতে চাচ্ছেন আমার লেখাপড়ার খরচের জন্য এমনটা করেছে। তবুও বাবা মানলেন না। সেই ঝগড়ার সূত্র ধরেই জানতে পারলাম, মায়ের করা এটিই প্রথম চুরি নয়। আগেও নাকি নানান জিনিস চুরি করে বিক্রি করেছে। সেই টাকা আমার পড়ালেখা ও সংসারের খরচে ব্যয় করেছে। বাবার রাগ কমার বদলে বেড়ে গেল। আর আমার চোখে অশ্রু জমল। মায়ের এই কাজটি আমার একটুও পছন্দ হলো না। ভেবে নিলাম প্রাইভেট পড়ব না আর। তার আগে কোমলের দুল ফেরত দিতে হবে। সেই রাতে মায়ের শাড়ির আঁচলের গিঁট থেকে দুলজোড়া সরিয়ে ফেললাম। ভোর হতেই ছুটলাম কোমলের কাছে। ইচ্ছে ছিল কোমলের হাতে দুল তুলে দিয়ে মায়ের হয়ে ক্ষমা চাইব। সেই সিদ্ধান্ত বদলে গেল কোমলের রুমের জানালায় উঁকি মারতেই। সিজদাহতে মাথা ঠেকানো কালো আবরণের কিশোরী মেয়েটিকে দেখেই আমার কী যেন হলো! ছুটন্ত ট্রেনগাড়ির মতো ঝিকঝিক শব্দ তুলে কিছু একটা ছুটতে থাকল হৃদয়ের রেললাইনটিতে। আমি বিভোর হলাম, তার স্পর্শ করা দুলজোড়া শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলাম। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, ঐ দুলদুটিতে আমার প্রাণ ভরে রেখেছে কেউ। হাত ছাড়া হলেই আমি মারা যাব। নিজ হাতে প্রাণ হারানোর সাহস পেলাম না। তাই দুলজোড়ার একটি তার কলমদানিতে রেখে অন্যটি নিয়ে ফিরে এলাম। এতে আমি বেঁচে গেলাম ঠিক কিন্তু অদ্ভুত এক অসুখ বাঁধিয়ে বসলাম। পরবর্তীতে সেই অসুখের নাম দিয়েছিলাম, সুখপোকা। যে পোকা কামড়ালে ব্যথা হয় কিন্তু চোখে পানি আসে না। অবিনশ্বর সুখী মানুষ বোধ করায়। ”

চিঠি ফুরিয়ে আসলেও এর রেশ লেগে থাকল কোমলের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ উদাস সময় কাটাতেই হৃদয়ে হুঁল ফোটার মতো একটা ব্যথা অনুভূত হলো। যেটাকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ সে। চিঠি গুছিয়ে রেখে ছুটে গেল পড়ার টেবিলটায়। কলমদানি উল্টে কানের দুল খুঁজতে লাগল। না পেয়ে হতাশ হলো। মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কলমদানিতে কোনো দুল পেয়েছিল নাকি। তিনি না জানাতেই কোমলের মনখারাপ হলো। নিবিড় মিথ্যে বলেছে এটা মানতে পারছে না যেন।

________________
মতিন মিয়া অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে খেতে পারছেন, হাঁটা-চলা করতে পারছেন। কাজে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন। সেই সময় নিবিড় জানাল, ভোরের বাসে ঢাকা ফিরবে সে। এতদিন এখানে থাকায় পড়াশোনায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। বাবা-মা দুজন সম্মতি দিলেও নিবিড় শান্তি পেল না। কোমলের সাথে দেখা করবে না বলেই গ্রামে আসেনি সে। এসেই যখন পড়েছে, তাহলে একবারটি দেখা করলে ক্ষতি কী? নাহয় আরও একবার শর্ত ভেঙে শাস্তি বাড়িয়ে নিবে। বিকেলের শেষ আলোতে মোল্লাবাড়ির দিকে অগ্রসর হলো সে। দাওয়াতে দেখা হলো আনিস মোল্লার সাথে। কিছুক্ষণ কথা-বার্তা চলল দুজনের মধ্যে। ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথাও জানাল নিবিড়। সেই ফাঁকে বার বার বাড়ির ভেতরটা দেখছিল। এতটা সময় কাটিয়েও একটি বারের জন্য কোমলের পদধ্বনি শুনতে পেল না। সেই প্রথম কোমলকে কোমলমতি নয়, নিষ্ঠুর বলে সম্বোধন করল। আনিস মোল্লার থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলেও নিজ বাড়িতে গেল না। বেড়া ডেঙিয়ে কোমলের রুমের জানালার দিকটাতে এলো। নিবিড় চাইলেই খোলা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে কোমলকে দেখতে পারে। কিন্তু সে এ কাজ করবে না। সকল শর্ত ভাঙলেও এই একটি শর্ত ভাঙবে না সে। কোমলের ইচ্ছেতেই মুখদর্শন করবে বলে স্থির করেছে। সন্ধ্যার আধো আলোতে একটি ইটের টুকরো খুঁজে নিল। জানালার পাশের তেতুল গাছটায় চেয়ে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ সেদিন আমার সাথে কথা না বলে পালিয়ে গিয়েছ, কণ্ঠস্বর শুনলে কি পাপ হবে আমার? তাহলে সেই পাপ করেই ঢাকা ফিরব। ‘ বলতে বলতে ঢিল মারল গাছে। সঙ্গে সঙ্গে একটি মিষ্টি শাসন শুনতে পেল,
” এই ভরসন্ধ্যায় গাছে উঠেছিস, অনু? নেমে আয় বলছি, নাহলে কিন্তু বুবু আর কথা বলবে না। ”

_________________
বড় হওয়ার শিক্ষা গ্রহণের মধ্যেই কলেজে ভর্তি করানো হলো অনড়াকে। বুবুর চোখের আড়াল হলেই সেই শিক্ষা ভুলে যায় রোজ। বেরিয়ে আসে দুষ্টুবুদ্ধি আর গ্রাস করে অপরিমেয় চপলতা। কোমলের দেওয়া বোরকা পরে কলেজে যাওয়ার পথে মুরগির পেছনে ছুটলে পেছন থেকে ডাক দিলেন কুলসুম নাহার। অনড়া দাঁড়ালে তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
” এই চিঠিডা ডাকবাক্সে ফালাইয়া দিস। ”

অনড়া চিঠি নিল। দুষ্টু হেসে বলল,
” না, নদীতে ফেলব। ”

কুলসুম নাহার রেগে যান। আবার ভয়ও পান। চিঠি ফিরিয়ে নিতে গেলে অনড়া পেছনে লুকিয়ে ফেলে ঝটিতে। দূরে সরে গিয়ে চিৎকার করে বলল,
” কেঁদে-কেটে লাভ নেই, বুবুর কাকিমা। আমাকে দিয়ে কাজ করানোর শাস্তি এটা। ”

কথাটা বলে আরও দূরে সরে কলেজের পথে হাঁটা ধরে অনড়া। দুষ্টুমি করলেও চিঠিটা নদীতে ফেলল না সে। ডাকবাক্সে ফেলতে গিয়ে একবার উপরের লেখাগুলো পড়ল। সেখানে নিবিড়ের নাম দেখে এক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হলো। বিয়ে না করে যে মানুষটি হারিয়ে গেল সেই মানুষটির ঠিকানা লিখে মুখস্থ করল। খাতায়ও লিখে নিল ভুলে যাওয়ার ভয়ে।

চলবে

#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৪)

মায়ের চিঠির সাথে আরও একটি চিঠি পেল নিবিড়। মায়ের নাম দেখে সেটা আলাদা করে রেখে অন্যটা নিয়ে বসে আছে পড়ার টেবিলে। খামের মুখ খোলার আগে উল্টে-পাল্টে দেখল কিছুক্ষণ। তারপরেই আবার সন্দেহ দৃষ্টি পড়ল প্রেরকের জায়গায়। যেখানে সুন্দর করে লেখা হয়েছে, ‘ বউ ‘

প্রথম দফায় কোমলের মুখটা মনে পড়লেও পর মুহূর্তে হারিয়ে গেল। যে মেয়েটা ভুল করেও নিবিড়ের সাথে একটিবার কথা বলে না, ঘাড় ফিরিয়ে দেখে না। উপরন্তু শক্ত কিছু শর্ত দিয়ে বছরের পর বছর তাকে আটকে রেখেছে দূর শহরে। সে কিনা চিঠি লিখবে? তাও আবার বউয়ের পরিচয়ে? অসম্ভব! নিবিড় চিঠিটা দূরে ছুঁড়ে মারল। সেইসময় দুলাল রুমে ঢুকল অন্যমনস্কতায়। চোখের দৃষ্টিতে ক্লান্তি, কপালের ভাঁজে দুশ্চিন্তা, হাঁটা-চলায় অসাবধানতা।

নিবিড় চেয়ার ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন, দুলাল ভাই? কোনো সমস্যা? ”

দুলাল ঘামে ভেজা শার্ট-প্যান্ট নিয়ে বসলেন বিছানায়। মোজা পরা পা-দুটো উপরে তুলে বললেন,
” তুলির বাবা-মা বিয়ের কথাটা জেনে গেছে। ঝামেলা করছে খুব। মনে হয়, আমাদের আলাদা করিয়েই ছাড়বে! ”

দুলালের কণ্ঠে ভয়, অসহায়ত্ব। নিবিড় চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো। দুলালের কাছটায় বসে ভীষণ সুন্দর করে বলল,
” শরীর আলাদা করলে শরীরী টান ছুটে যায়, মনের না। আর ভালোবাসা তো মন থেকেই সৃষ্টি। চিন্তা করবেন না, দুলাল ভাই। আপনাদের মধ্যে যদি সত্যিকারের ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে যত বাঁধাই আসুক, বিপদ আসুক, ঝড় আসুক, সবকিছু সামলে নিবে সে। কারণ, পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অস্ত্র হলো ভালোবাসা। ”

দুলালের ক্লান্ত চোখদুটোতে বিস্ময় খেলে গেল মুহূ্র্তেই। চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকলেন কয়েক সেকেন্ড। সবিস্ময়ে বললেন,
” তুই দেখি পন্ডিতদের মতো কথা বলছিস! পড়াশুনা ছেড়ে ভালোবাসা নিয়ে গবেষণা চলছে নাকি খুব? ”

নিবিড় লজ্জা পেল খুব। দুলালের থেকে সরে আসতে চাইল চট করে, পারল না। তিনি হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
” এসব নিশ্চয় দুলকন্যার প্রভাব? নাম-ধাম বলবি নাকি সারাজীবন দুলকন্যা বলেই ডাকব? ”

নিবিড় লাজুক স্বরে বলল,
” বলব। ”
” কবে? ”
” খুব শীঘ্রই। ”

অন্য সময় হলে আরও কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করতেন দুলাল। কিন্তু আজ তার মন ভালো নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছেন। তাই নিবিড়ের হাত ছেড়ে দিলেন। মুক্তি পেয়ে সে পূর্বের চেয়ারে বসল। পড়ার জন্য বই টেনে নিতে গিয়ে খেয়াল করল না, হাওয়ার তোড়ে পাতলা খামটি উড়ে গিয়ে পড়ল পুরোনো বইয়ের ঢাকনা খোলা বাক্সে।

_______________

সন্ধ্যার মায়াবী অন্ধকার ঠেলে মোল্লাবাড়িতে হাজির হয়েছেন মতিন মিয়া। কাঁচুমাচুভঙ্গিতে আরজি জানালেন, কোমলের সাথে দেখা করতে চান। জরুরি কথা বলবেন।

এমন জরুরি তলবে বেশ ঘাবড়ে যায় কোমল। মতিন মিয়াকে নিজ রুমে বসার ব্যবস্থা করে। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন তিনি নীরব রইলেন তখন কোমল বলল,
” আপনার শরীর ভালো তো, কাকা? ”

মতিন মিয়া দুর্বল চাহনি রাখলেন কোমলের মুখটায়। সে বোরকা পরা না থাকলেও ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনেছে। ঘোমটার একপাশের কাপড় মুখের উপর চেপে ধরায় চোখ ও নাক ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। মতিন মিয়া এভাবে তাকিয়ে থাকায় কোমলের জড়তা বাড়ল। অস্থির মনে বলল,
” আপনি বসুন, আমি পানি নিয়ে আসি। ”
” না, কোথাও যাইও না। ”

মতিন মিয়া কথাটা এমনভাবে বললেন যে, কোমল থেমে যেতে বাধ্য হলো। মায়াভর্তি চোখ দুটোতে চেয়ে মতিন মিয়া ম্লান হাসলেন। দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে বললেন,
” তোমার কাকিমারে যখন বিয়া করি তখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ। ঘরের কাম পারত না কিছুই। আমারে দেখলেই ডরাইত। সেই ডর ভাইংগা ভাব করার জন্য কত কী যে করতে হইছে! মাটিতে দাগ কাইটা কুতকুত খেলাইছি, রাত-বিরাতে আম কুড়াইতে গেছি, দুই গেরাম হাঁইটা মেলা ঘুরাইছি, আঙুলের আগা কাইটা বন্ধু পাতাইছি। তারপর একটু একটু করে চুলা ধরানো শিখাইছি, রান্না শিখাইছি, থালা-বাসন মাজা শিখাইছি। সংসার করা শিখতে শিখতে নিবিড় পেটে আইল। সংসারে সদস্য বাড়াইতে পৃথিবীতে চোখ মেইলা তাকাইল আমার পোলা। ”

এইটুকু বলে থামলেন মতিন মিয়া। এমনভাবে চেয়ে আছেন যেন তার সামনেই সবটা ঘটছে। চোখের তারায় এক ঝলক আনন্দ ঝলমলিয়ে হারিয়ে গেল। অশ্রু জমতে শুরু করলে তিনি ধরা গলায় বললেন,
” যে নিজের সংসার গুছাইতে জানত না সেই এখন টাকার লোভে অন্য সংসারে গোছগাছ করে, রান্ধে-বাড়ে, থালাবাটি ঢলে। অভাব মানুষকে এক নিমিষেই বদলাইয়া দেয়। তাই না রে, মা? কিন্তু এই বদলটা আমি কখনই চাই নাই। প্রথম যেদিন কুলসুম রে তোমাগো বাড়িতে দিয়া গেছি সেদিন আমি কিছু খাই নাই। খাবার দেখলেই আমার দম বন্ধ হইয়া আইত, মইরা যাইতে ইচ্ছা হইত। কিন্তু আমি মরি নাই। পোলার মুখের দিকে তাকাইয়া স্বপন দেখছি শুধু। ও বড় হইব, টাকা রোজগার করব, মায়েরে কাজ থেইকা ছুটাইব, ভালো খাওয়াইব, পরাইব। আরও কত কী!

কোমল অধৈর্য হয়ে বলল,
” এভাবে বলছেন কেন, কাকা? কী হয়েছে? আমাকে বলুন। আমার চিন্তা হচ্ছে। ”

মতিন মিয়া আবেগ সামলালেন। কোমলের দিকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” এখানে এক লাখ টাকা আছে৷ নিবিড়ের পড়ার খরচ। তুমি একটু হিসেব কইরা প্রতি মাসে পাঠাইও। ”

কোমল যারপরনাই বিস্মিত হলো। কোনো এক বিপদের আভাস পাচ্ছে যেন৷ দ্রুত বলল,
” আমি পাঠাব কেন? আপনার ছেলে, আপনার টাকা। আপনি পাঠাবেন। ”

মতিন মিয়া চুপ হয়ে গেলেন হঠাৎ। দৃষ্টি হারিয়ে গেল শূন্যে। অনেকটা সময় নীরব থেকে বললেন,
” আমি মূর্খ মানুষ, হিসাব বুঝি না। এগুলা তুমি’ই রাখ। ”

কোমল নিল না। এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল,
” আমার মনে হচ্ছে, আপনি অসুস্থ। একটু বিশ্রাম নিন। আমরা পরে কথা বলব। ”
” এত কথা কইতাছ ক্যান? রাখতে কইছি, রাখ। ”

প্রায় ধমকেই উঠলেন মতিন মিয়া। কোমল ভয়ে সামান্য কেঁপে উঠল। হঠাৎ রাগের কারণ খুঁজার চেষ্টা করছিল। তন্মধ্যেই মতিন মিয়া দাঁড়িয়ে পড়লেন। আগের মতো ধমকেই বললেন,
” এখনও দাঁড়াইয়া আছ? নিতে কইছি না? ”

কোমল কাঁপা হাতে প্যাকেটটা নিলে মতিন মিয়া আগের মতো খাটের কোণায় বসলেন। একটুক্ষণ চুপ থেকে সহসা বললেন,
” আমি ভিটা-বাড়ি বেইচা দিছি। ”

কোমল বিস্ফারিত চোখে চাইলে মতিন মিয়া আবার বললেন,
” তোমার কাকি জানে আমি বাড়ি বন্ধক রাখছি। বন্ধকই রাখছিলাম, কিন্তু টাকা পরিশোধ করতে পারি নাই। তার মধ্যে নিবিড়ের টাকা লাগব আরও। কই থেইকা দিমু? তাই বেইচা দিছি একবারে। শোধ করার ঝামেলাও থাকল না। ঠিক করছি না, মা? ”

কোমলকে যেন বোবায় পেয়েছে। কোনো কথা বলতে পারছে না। বহুকষ্টে ঘাড় ডানে-বামে নাড়লে মতিন মিয়া ম্লান হেসে বললেন,
” গরীবদের স্বপ্ন দেখতে হয় ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া, জাইগা না, বুঝলা মা? ”

কোমল সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কার কাছে বেচছেন? ”
” পাশের গেরামের চেয়ারম্যানের কাছে। ”
” কাউকে না জানিয়ে এমনটা কেন করলেন? অন্তত আমাকে তো বলতে পারতেন? ”
” ক্যান? যৌতুক দিতা? আমি গরীব হইতে পারি কিন্তু লোভী না। বুঝছ? ”

কোমল এবার ঘাড় নেড়েও উত্তর দিতে পারল না। মতিন মিয়ার চোখ ছলছল হলো। সেই চোখে ভারী স্বরে বললেন,
” নিবিড়রে কইও, মায়েরে দেইখা রাখতে। ”

কোমল কিছু একটা বলার জন্য ছটফট করছিল। মতিন মিয়া থামিয়ে দিলেন। উঠে বেরিয়ে যেতে গিয়ে পেছন ফিরে বললেন,
” শ্বশুর যদি ছেলের বউয়ের মুখ দেখে, তাইলে কি পাপ হইব? ”
” না। ”
” তাইলে মুখ থেইকা কাপড়টা একটু সরাও, তোমারে এক নজর দেইখা যাই। ”

মতিন মিয়ার আদেশ অমান্য করতে পারল না। আড়ষ্টতায় মুখের কাপড় সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল। মতিন মিয়া দু-চোখ মেলে ছেলের বউয়ের মুখ দেখলেন। পকেট হাতড়ে একশ টাকার নোট বের করে কোমলের হাতে দিয়ে বললেন,
” আমার ছেলেটারে দেইখা রাইখ। ওর ভবিষ্যৎ তোমার হাতে। ”

মতিন মিয়া রাস্তায় নামা পর্যন্ত পিছু পিছু হেঁটে এলো কোমল। তার কিছুই ঠিক লাগছে না। অশান্ত হয়ে পড়েছে মন। চিন্তা-ভাবনা করেও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। একবার ভাবল, বাবার সাথে কথা বলবে, আরেকবার ভাবল, নিবিড়ের সাথে কথা বলবে। এই দোটানায় ভুগতে ভুগতে রাত হয়ে গেল। সারারাত অস্থিরচিত্তে ছটফট করল বিছানায়৷ সকালে ঘুম ভাঙলে বাবার কাছে ছুটে গেল। তিনি বাসায় নেই, নামাজ পড়তে গেছেন। কোমল বাবার রুমে অপেক্ষা করার জন্য বসল। তখনই চোখে পড়ল মোবাইলটা। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে ফিরে এলো নিজের রুমে। মতিন মিয়ার অসুস্থতার খবর দেওয়ার পর নাম্বারটা তার কাছে রয়ে গিয়েছিল। সেটাই খুঁজে বের করল। নাম্বার তুলতে গিয়ে দেখল, নিজের নাম। কাগজটার একদম উপরে গাঢ় কালিতে লেখা। তার নিচেই বেশ কিছু সংখ্যা। সম্ভবত কিছু একটার হিসাব তোলা। কোমল কাগজের এপিঠ-ওপিঠ ভালো করে পড়েই বুঝে গেল, নিবিড়ের ধারণা, তার পড়াশুনার সব খরচ চালানো হচ্ছে মোল্লাবাড়ি থেকে। কোমল হতাশ হলো, ভেঙে গেল আরও একটু। নিবিড়ের বাবা যে, তাদের থেকে বেতন ব্যতীত এক টাকারও বাড়তি না নিয়ে ভিটে-বাড়ি বেচে তার পড়াশুনার খরচ চালাচ্ছে এটা তার জানানো উচিত। আর এখনই। একমাত্র সেই পারবে, এই সমস্যার সমাধান দিতে। কোমলও চায়, নিবিড় ডাক্তার হোক। কিন্তু বাবা-মায়ের শেষ সম্বলটুকুর বিনিময়ে না।

কোমল মোবাইলে নাম্বার তুলে কল দিল। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো। সে কথা বলার সময় পেল না, তার আগেই আনিস মোল্লা বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বললেন,
” কোমল? কোথায় রে, মা? জলদি আয়, ঐ বাড়ি যেতে হবে। নিবিড়ের বাবা নাকি ঘুমের মধ্যে মারা গেছে! ”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে