বাস্তবতা
পর্ব- ০২(অন্তিম পর্ব)
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
ও কল না দিলেও আমি কল দিতাম। খুঁজ খবর নিতাম। কি খেয়েছে? কি করতেছে? শরীর ভালো কি না? কখন ঘুমোবে? এসব, শুধু এসব বিষয়েই ওর সাথে আমার কথা হতো। মাঝে মাঝে একটু আধটু বেশী কথা হতো। যখন বেশী কথা হতো তখন কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যেতাম এই ভেবে যদি চিরতরে হারিয়ে যায় আমাদের বন্ধুত্ব। মনের কথাগুলো তাই অব্যক্ত হয়েই রয়ে গেল আমার মনের গহীনে।
অতিবাহিত হয়ে যায় আরো ১টি বছর। আমি তখনো সোহেলকে আমার অব্যক্ত কথাটা জানাতে পারিনি। সোহেলও আমায় ভালোবাসার ব্যাপারে কিছু বলতো না। কিন্তু মুখে না বললেও সোহেল ওর কর্মকান্ড দ্বারা ও আমায় অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিত।
সেবার প্রচন্ড জ্বরে সোহেল যখন শয্যাশায়ী, তখন আমি ছুটে গিয়েছিলাম ওর কাছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি জন্মায় ওর। চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। দোকান থেকে রেজার এনে সেভ করে দিলাম। নেইলকাটার দিয়ে নখ কেটে দিলাম। গরম পানি গোসল, পরনের ওড়না দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া। সব, সব করে দিলাম। ওর অসুস্থতায় আমি যেন ওর কাছে চলে গেলাম। একেই বলে হয়তো ভালোবাসার গভীরতা। ও সুস্থ হয়ে উঠল।
কিন্তু আমি আমার মনের কথাটা ওকে জানাতে পারলাম না।
“হৃদয় যতই ব্যথিত হোক, কর্মচক্র আপন গতিতে চলিতে থাকে।”
আমাদেরও দিন চলতে থাকল। আমি বোধ হয় আর পারলাম’ই না ওকে মনের না বলা কথাটা বলতে! গুমড়ে কেঁদে উঠলাম।
দিনটি ছিল শুক্রবার। ২০১৪সালের উক্ত দিনে সকাল ১০টায় আমি তাকে ডাকলাম। ও আসলে আমি আমার কথাটা জানালাম সাদামাটা ভাবে। হয়তো তখন তার কাছে আমার হৃদয়ের সবটুকু অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারিনি। আমি চাইনি সে আমার না বলা ভালোবাসা হোক। জানি, যখন কেউ কাউকে বেশি ভালোবাসে তখন সে তাকে দুরে ঠেলে দেয়। যে দুরে ঠেলে দেয়, তাকে আরো বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। কারন মানুষ কষ্ট পেতে ভালোবাসে। মনে হয় আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
সোহেল আমার যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। একটানা ৩মাস ওর সাথে আমার কথা হয়নি। ৩মাস পর একবিকেলে সোহেল আমায় কল করে। ও আমাকে একটা কথা বলতে চায়। তাই ওর বাসায় যেতে বলে। একটা বছর ধরে যে কথাটা শুনার জন্য চাতকের মতো অধির আগ্রহে বসে ছিলাম আজ তার’ই অবসান ঘটতে চলেছে। আজ আমার সোহেল নিজ থেকে আমায় ডেকেছে। এতদিনে সেই বহুল প্রত্যাশিত শব্দ ‘ভালোবাসি’ কথাটা শুনতে পারব।
এ যে কি আনন্দের ছিল তা বলে বুঝানো যাবে না। আমি ছুঁটে গেলাম সোহেলের কাছে। সোহেল তখন রুমে বসে ছিল। আমাকে দেখে ও কেমন যেন ঘামছিল। বুঝতে পারলাম জীবনের প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি তো তাই ওর এরকম অবস্থা হচ্ছে। ওকে বললাম, বলো কি বলবে? ও দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বন্ধ করে দেয় দরজাটা। আমার খুশিতে উজ্জল মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। ওর দৃষ্টি’টা কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল। অন্যান্য দিনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আমার বুকের ভেতরটা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে। সোহেল একটু একটু করে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে চুপসে গেলাম কিন্তু থেমে গেলাম না। এক পা দু’পা করে আমিও পিছু হটতে লাগলাম। আচমকা সোহেল আমার সর্বাঙ্গের আঁচল ধরে টান মারে। বুকটা ধুরু ধুরু করে কাঁপছিল। কাপা গলায় সোহেলকে প্রশ্ন করলাম- কি করছ? সোহেল কোনো কথা না বলে আমার দিকে হিংস্র বাঘের মতো এগুতো থাকে। একটা সময় বিছানায় ফেলে ও আমার উপর ঝাপিয়ে পরে। আমি দু’হাত দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছি ওর মুঠু থেকে মুক্ত করতে। কান্না করে করে বলতেছি-
” না, সোহেল! তুমি এটা করতে পারো না। তুমি এটা কখনো করতে পারো না। তুমি আমাকে ভালোবাসো। তাই তুমি এটা করতে পারো না। সোহেল তবুও কোনো কথার জবাব দিচ্ছে না। এক পর্যায়ে বলে উঠলাম,
আমার পিরিয়ড হয়েছে। আমায় আজকের মত ছেড়ে দাও।”
সোহেল আচমকা আমায় ছেড়ে দিল। হাফ ছেড়ে বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। আসবার কালে সোহেলকে শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমায় বিশ্বাস করাটা কি আমার অপরাধ ছিল? ও ভয়ার্ত হাসি দিয়ে বলেছিল সেদিন, বিশ্বাস নয়। স্বপ্ন। তোর স্বপ্ন দেখা অপরাধ ছিল। তোর মত কালো, কুৎসিত একটা মেয়ে যাকে নিয়ে কিনা বিছানায় শুইতে গেলেও রুচিতে বাঁধবে, সেই মেয়ে কি না স্বপ্ন দেখে আমায় নিয়ে। আরে তোর মত হাজারো মেয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমার এক রাত্রের সঙ্গী হওয়ার জন্য, বেড পার্টনার হওয়ার জন্য। আর সেখানে কি না আমি তোকে ভালোবাসব???
ঐ তুই কি ভেবেছিস? তোকে আমি ভালোবাসার কথা বলব????
হা, হা, হা, হা, হা, হা….
হাসালি….
যা, এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যা।
সেদিন দু’চোখের নোনাজল সঙ্গী করে বের হয়ে এসেছিলাম সোহেলের ওখান থেকে। এরপর কতবার যে মরার জন্য পা বাড়িয়েছিলাম তার কোনো হিসেব নেই। আবার ফিরেও এসেছি অসহায় মায়ের কথা চিন্তা করে। যাকে কিনা রোজ রাত্রে কাঁদতে দেখেছি আমার জন্য। আমার মত একটা কালো মেয়ের জন্য। পৃথিবীর কারো কাছে আমার মূল্য না থাকলেও আমার মায়ের কাছে ছিল। তাইতো প্রচন্ড জ্বরে যখন আমি বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম তখন আমার জনমদুখিনী মা ছুটে আসে আমার কাছে, আমাকে দেখতে। এই কয়দিনে অনেক শুকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মা আমায় বুকে নিয়ে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে। আমার নাকে, মুখে, কপালে চুমুর পর চুমু দিতে থাকে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখি আমার মা আমার মাথার পাশে বসে ঝিমুচ্ছে। আমায় চোখ মেলতে দেখে ওনি আমার দিকে জল ছলছল চোখে তাকান। খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। প্রশ্ন করলাম মাকে,
” মা! আমি কালো বলেই কি তুমি আমার নাম শিমুল রেখেছিলে? সেই শিমুল যে শিমুলের কোনো মূল্য নেই। যে রাস্তায় পথিকের পদতলে পিষ্ট হয়।”
কথাগুলো বলে মায়ের দিকে তাঁকালাম। লক্ষ্য করলাম আমার মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছে। কালো মেয়ের মায়েরা বুঝি এভাবেই কাঁদে, এভাবেই দুঃখগুলো ঢেকে রাখে আঁচলের অন্তঃরালে…..
সমাপ্ত…..
[লেখিকার কথা:- নাহ! গল্প ওখানেই শেষ হয়নি। শিমুলের জীবনে আসে আমার কাজিন রুবেল। রুবেল ভাইয়া শিমুলকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে। রুবেল ভাইয়া কাতার থাকে। পরিবারের সম্মতিক্রমে আগামী শুক্রবার দিন ওদের বিয়ে হবে ফোনে। রুবেল ভাইয়া ৩মাস পর দেশে আসবে।
শিমুল জানে না এরপর কি হবে? রুবেলও শিমুলকে ব্যবহার করবে? নাকি স্বাভাবিক জীবন দিবে]