বাসাবদল
লেখা : শানজানা আলম
এই নিয়ে গত আড়াই বছরে তিনবার বাসা ভাড়া বাড়ালো আরিফের বাড়িওয়ালা । ছোট্ট দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট, বারান্দায় কিচেনের ব্যবস্থা করা, এক চিলতে বাথরুম, এই বাসা ভাড়া এখন এগার হাজার টাকা, আরিফ একা একা চিন্তা করে।
দারোয়ান নেই, অথচ সিকিউরিটি চার্য ধরেছে পাচশ টাকা! ময়লা দিয়ে আসতে হয় নিচে গিয়ে, মাস শেষে তাকেও বখশিশ দিতে হয়।
অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই শহরে এটাই নিয়ম।
-কি করবে কিছু ভাবছো, সুমি এসে চায়ের মগটা দিল।
আরিফ মগটা হাতে নিতে নিতে বললো,হু, ভাবছি বাসা পাল্টে করে ফেলবো।একটু বড় বাসা নিবো। বাবু হাঁটতে শিখছে, এক রুম থেকে অন্য রুমে হেটে বেড়াবে।
সুমি বললো, বড় বাসা নিলে তো খরচ অনেক বেড়ে যাবে। সামলানো যাবে?
আরিফ উত্তর দিলো, দেখি কি করা যায়।তুমি কাল রেডি হয়ে থেকো, অফিস থেকে ফিরে বাসা দেখতে যাবো।
সুমি জানে, এই খরচের উপর আর একশ টাকা খরচও আরিফের জন্য কষ্ট।
শুধু ত্রিশ টাকা বাঁচবে বলে, এখান থেকে পনের মিনিট হেঁটে গিয়ে আরিফ অফিসের বাস ধরে।
পরদিন অফিস থেকে ফিরে সুমিকে নিয়ে বাসা খুঁজতে বের হয় আরিফ।
ওরা থাকে জনতা হাউজিং আট নম্বর রোডে।
এই বাসাটা যখন নেয়া হয়েছিল, তখন ওদের নতুন সংসার। আরিফের বেতন ছিল টেনেটুনে বিশ হাজারের মতো। তখন দুজন মানুষ, বাসা ভাড়া সব সহ সাড়ে আট হাজার ছিল। কোন সমস্যা হয়নি। এরপরে বছর ঘুরতেই বাড়িওয়ালা বললো, ভাড়া বাড়াতে হবে। ভাড়া হলো সাড়ে নয় হাজার। একে একে তিন দফায় এখন ভাড়া প্রায় সাড়ে এগারো হাজার। আরিফ ভেবেছে, এখন বেতন বেড়েছে কিছুটা, সুমির অনলাইন বুটিক টুকটাক ভালো চলছে, একটা দুই বেড, ড্রয়িং ডাইনিং সহ বাসা নিতে পারলে ভালো হয়। তাছাড়া বাবুই হাটতে শিখছে, ও টুকটুক করে ঘর জুড়ে হেঁটে বেড়াবে।
অফিস থেকে ফেরার পথে আরিফ বাসা ভাড়ার নোটিশ লাগানো দেখে এসেছে তিন নম্বর রোডের একটা ওয়ালে। সেখান থেকে বেছে নিয়ে একটা বাসায় যায় ওরা। বাসাটা তিন বেডের, ড্রয়িং ডাইনিং স্পেস আলাদা। একটা রুম সম্পুর্ন আলাদা, সাবলেট দিয়ে দেওয়া যাবে সহজেই। কিন্তু ভাড়া চাইলো বিশ হাজার টাকা। তার উপর মোজাইক ফ্লোর, ওয়াশরুমের ফিটিংস গুলো অতোটা ভাল নয়।
পরে জানাবে জানিয়ে ওরা চলে আসে। আরো কিছু বাড়ি ভাড়ার টুলেট বিজ্ঞাপন মুঠোফোনে ছবি তুলে নিয়ে আসে।
এবার ফোন করা শুরু করে। আগেই বাসা ভাড়ার মাত্রাটা শুনে নেয়। ওদের চাহিদা মতো তেমন বাসা আর পাওয়া যায় না।
আরিফ অফিস থেকে ফিরে বাসা খুঁজতে বের হয়। কোন বাসা পছন্দ হলে ভাড়া বেশি হয়, ভাড়া মিললে পছন্দ হয় না। এরমধ্যে আরিফ একদিন মনসুরাবাদে ঘুরে আসে। ওখানে বাসা আছে, কিন্তু একটু ভিতরের দিকে।
অবশেষে একটা বিজ্ঞাপন পছন্দ হয়। নতুন বিল্ডিং। লিফট সহ অন্যান্য সুবিধা আছে কিন্তু সার্ভিস চার্য নেই। সুমিকে নিয়ে বাসাটা দেখতে যায় আরিফ। ওদের জন্য চমৎকার, দুইরুম, ড্রয়িং ডাইনিং আলাদা, চমৎকার খোলা বারান্দা, ছয় তলায়। শেষর দিকে বলে বারান্দায় দাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ভাড়াটাও লাগালের মধ্যেই। কিন্তু এ বাসায় গ্যাসের লাইন নেই, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে হবে৷ আরিফের সাহস হয় না। সুমি আর বাবুই এর জন্য ভয় লাগে। ইদানিং প্রায়ই গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যায়।
ফেরার পথে আর একটা বাসায় ঢোকে। সে বাসার বাড়িওয়ালাকে সুমির পছন্দ হয় না, মনে হয় সে খ্যাচ খ্যাচ করবে! আরিফ খুব বিরক্ত হয়, এটা কোন অজুহাত, অবশ্য সে বাসার সিড়ি কমপ্লিট হয়নি। বাবুই কখনও যদি নেমে যায়!
একদিন যায়, দুদিন যায়, সুবিধামতো বাসা আর পাওয়া যায় না।
এদিকে বাসা ছেড়ে দেবে বলার পর বাড়িওয়ালা ঝামেলা শুরু করেছে। পানি ছাড়বে না সময়মতো, বললেও গা করে না।
ময়লা দিয়ে আসতে দেরী হয়েছে বলে একদিন কথা শুনিয়ে দিলো।
রোজ একটা না একটা অভিযোগ থাকবেই।
আরিফ হাঁপিয়ে উঠছে।
ঢাকা শহরে সবচেয়ে কষ্টে থাকে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ, এরা নিম্নবিত্তও হতে পারেনা, মধ্যবিত্তও হতে পারেনা।
আরিফ রোজ অফিস থেকে ফিরে খোজাখুজি করে, বাজেট আর পছন্দ মেলানে কষ্টকর।
শেষমেশ একটা বাসার সন্ধান পাওয়া গেল একদিন। বাসাটা মেইন রোড থেকে একটু পিছনের দিকে, তবুও ভাল যে সব কিছু মোটামোটি মিলে গেল। খুশি মনে সেদিন বাসায় ফিরলো আরিফ।
আজ বাড়িওয়ালাকে সে জানিয়ে দিয়ে আসবে, সামনের মাসেই বাসা ছেড়ে দেবে ওরা।
বাসাবদল
লেখা : শানজানা আলম
(ধারাবাহিক নয়, টুকরো গল্প)