#বাজিমাত-৩ (অন্তিম পর্ব)
Tahrim Muntahana
সকাল টা শুরু হলো অন্যরকম ভাবে। ঘুম থেকে উঠেই নাদিয়া বিস্ময়ে হতবাক হয়ে থম মেরে রইলো। আহিশ তার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে। ব্যাপারখানা তার হজম হয়নি। হওয়ার কথাও না। কাল রাতে একটু পরিবর্তন তাও মানা যেত, আজ এতটা পরিবর্তন সে মানতে পারছে না।সন্দেহও ঠিক হচ্ছে। নাদিয়া কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহিশ মুচকি হাসলো। বললো,
-“অবাক হওয়ার কিছু নেই। আহিশ দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়! কিছুটা হয়তো বেঁকে গিয়েছিল। তবে তা ঠিক হয়ে গেছে!”
অবাকতা কেটে গেলেও সন্দেহ কমে নি। নাদিয়া ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসে। মুখে দানা দেয় নি! কিছুটা নেড়েচেড়ে বলে,
-“বিষ মেশান নি তো আবার?”
-“তোমার তা মনে হয়?”
-*না হওয়ার কিছু নেই! আপনার মতো পাগল রা সব করতে পারে!”
-“আমি পাগল?”
-“না উন্মাদ!”
রেগে যায় আহিশ। মানুষের ভালো করতে নেই! আহিশ কে রাগতে দেখে মিটিমিটি হাসে নাদিয়া। উপর দিকে দৃষ্টি রেখে বলে উঠে,
-“তুমি সাক্ষী সতিন! আমি যদি আজ মরে যাই প্লিজ এই উন্মাদ টাকে বাঁচিয়ে রেখ না। তোমার আর আমার কবরের মাঝখানে এটাকেও মাটি দিবে। তারপর দুজন মিলে ইচ্ছে মতো থাপ্রা’বো!”
বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আসে। এই ড্রামা কুইনের ড্রামা আবার শুরু হলো। মাঝখানে থেমে ছিল সেই ঢের ছিল। এখন জীবন শেষ করে দিবে! রাগে আহিশ বের হয়ে যায় ঘর থেকে। নাদিয়া মুচকি হেসে খেতে শুরু করে। খাওয়া শেষ করে নতুন এক শাড়ি পরে নেয়। নতুন বউ, পাঁচ মুখে পাঁচ কথা হবে। এমনিই তার দোষের শেষ নেই। তারপর হঠাৎ করেই মিহির ফটোফ্রেমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিড়বিড় করে বলে,
-“তুমি রাগ করো না সতিন, এই পৃথিবীতে একা থাকার মতো যন্ত্রণা আর কিছু নেই! তুমি তার ভালোবাসা, আমি দায়িত্ব! কত অমিল দুজনের!”
মেয়েটার চোখ হয়তো ছলছল করছে। ঘন চোখের পলক ফেলে জলটুকু মিলিয়ে দিতে চায় । ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আহিশ। নাদিয়ার দিকে একটি লকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-“বিয়েতে দিতে হয়, এটি তোমার জন্য!”
নাদিয়া হাতে তুলে নেয়। ছুঁয়ে দেখে। বুকের ভেতর এক দলা বিষাদ কুন্ডলি পাকিয়ে নাচানাচি করছিল। এই একটু খানি প্রাপ্তি তে সেগুলো কোথায় চলে গেল কে জানে? রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ যেমন ঝলমল করে, নাদিয়ার মুখশ্রী টাও আনন্দে ঝলমল করছিল। অতি আনন্দে আকস্মিক সে আবদার করে বসে,
-“পড়িয়ে দিন না, আহি সাহেব!”
আহিশ কিছুক্ষণ সেই ঝলমলে মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আরেক পলক মিহির ছবিটির দিকে। দোটানায় সে হাবুডুবু খায়। মলিন হয়ে আসতে চায় নাদিয়ার মুখশ্রী। হুট করেই আহিশ বদলে যায়। পকেট থেকে সেইম একটি লকেট বের করে মিহির গলার কাছে ঘাম দিয়ে লকেট টি আটকে দেয়। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে অপলক। যেন ছবির মানুষ টি সশরীরে উপস্থিত! সে প্রাণভরে দেখে নিচ্ছে। নিশ্চুপে স্বামীর প্রেম দেখে যায় নাদিয়া। বলার থাকলেও সে বলতে পারে না। কন্ঠনালি ভেদ করে শব্দমালা আসে না। আহিশ ফের নাদিয়ার হাত থেকে লকেট টা নিয়ে নাদিয়ার গলায় পড়িয়ে দেয়। মিহির মতো হয়তো তাকিয়ে দেখে না। তবে ছোট্ট করে বলে,
-“এখন হয়তো দায়িত্বের ভারে করছি, তবে হয়তো কোনো একদিন মায়া জন্মাবে। ভালোবাসাও সৃষ্টি হবে মনে। পবিত্র সম্পর্ক তো অবহেলায় ফেলে রাখা যায় না। সে পর্যন্ত নাহয় একটু কষ্ট করো! আমাকে একটু সময় দিতে হবে! ভালোবাসা হঠাৎ করেই হয়ে যায় না!”
মেয়েটা এই মুহুর্তে এত বেশী চায় নি তো! শুধু মাত্র চেয়েছিল স্বামীর হাতে তার দেওয়া প্রথম উপহারটা গলায় তুলতে! কিন্তু এই মানুষটি যে তাকে এত বেশী দিবে সে জানতো? ইচ্ছে করেই আহিশের বুকে মুখ লুকায় নাদিয়া। ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে। আহিশ জড়িয়ে না নিলেও সরিয়ে দেওয়ার উদ্যত হয় না! মেয়েটা যতক্ষণ থাকতে চায়, সে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। দায়িত্ব গুলো যে খুব জটিল, গুরুত্বপূর্ণ! এড়িয়ে যাওয়া যায় না! মন মতো কেঁদে নিয়ে সরে আসে নাদিয়া। চোখের জল মুছে বলে,
-“তবে বাজিমাত হবে কি করে?”
-“তুমি কি চাইছো হোক?”
-“খেলা টা মন্দ ছিল না!”
-“সংসার খেলার বিষয় নয়!”
-“কে বুঝালো?”
-“আম্মা!”
-“শাশুড়ি ঘেঁটে দিল!”
-“এভাবে চললেও শেষ বাজিমাত কিন্তু আমিই দিবো!”
-“কিভাবে?”
-“দেখতেই পাবে!”
আহিশ মিটিমিটি হেসে চলে যায়। নাদিয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠে। এ সুখ যেন ধরে না! ধরা ছোঁয়ার বাহিরের সুখটা তার এত কাছে! এখন শুধু হাতের মুঠোয় আসা বাকী! নাদিয়া ফের মিহির সাথে কথা বলতে চায়,
-“আর যাই বলো সতিন, তুমি খুব ভাগ্যবতী।কেউ তোমাকে এতটা ভালোবাসে তুমি দেখতে পাচ্ছো? আমার না মাঝে মাঝে মনে হয়, কেন এমন হলো? তোমাদের সংসার টা দীর্ঘ হতে পারতো! ওই উন্মাদ টা দীর্ঘ বছর হাসিখুশি থাকতো তোমাকে নিয়ে। আমি নাহয় দুঃখের অনলে পুড়তাম! ভেসে ভেসে ছুটে বেড়াতাম মিথ্যে হাসি নিয়ে। খুব একটা ক্ষতি হতো না। ভালোবাসা তো ভালো থাকতো! স্বার্থপরের মতো চলে গেলে!”
অতঃপর দীর্ঘশ্বাস। মিলিয়ে যায় শূণ্যে। অনুভূতি রা বুকমাঝারে কিলবিল করে। এ অপেক্ষা টা যে দীর্ঘ। কবে যে একটু খানি জায়গা হবে! চাপা শ্বাস ফেলে নাদিয়া ঘর ছাড়ে। রান্না ঘরে যাওয়া প্রয়োজন। শাশুড়ি একা কি করছে কে জানে! অন্যদিকে সালেহা বেগম রান্না করছিলেন। ইতিমধ্যে এই রান্নার মাঝেই তিনবার স্বামীর খেদমত করেছেন। একবার চা, আরেকবার পানি, তো আরেকবার চা! লোকটা একটু পর পর অযহত ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। এবার ডাকলে হ্যস্তন্যস্ত একটা করেই ছাড়বে। বিড়বিড় করে এসবই বলছিলেন সালেহা বেগম। এরমধ্যেই ড্রয়িং রুম থেকে রমিজদা’র গলার আওয়াজ,
-“সালু, ও সালু, পানি নিয়ে আয়! তেষ্টায় বুকটা ফাইট্টা যাবো মনে হয়।”
হাতে থাকা খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসেন সালেহা বেগম। গিয়েই এক বারি বসান কাঁধে। রমিজ’দা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ান। দাঁতে দাঁত চেপে সালেহা বেগম বলেন,
-“বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরেছে? আরেকবার শুধু এমন ঢং করো, খাওয়া বন্ধ করে দিবো আজ। ফাযলামি শুরু করেছে। আমি ওখানে আগুনে পুড়ে রান্না করছি, আর সে আমোদে খিলখিল করে হাসছে। আরেকবার ডাকলে তোমার মাথা যদি না ফাটিয়েছি আমার নামও সালেহা না!”
কালো কুচকুচে চেহারায় ভিতু ছাপ। রমিজদা মিনমিনে কন্ঠে বলেন,
-“তুই তো সালু, সালেহা নাম….!”
সম্পূর্ণ বলতে পারেন না বাক্যটা। চোখ লাল করে তাকান সালেহা বেগম। গর্জে বলে উঠেন,
-“তোমাকে আমি সাবধান করছি রমিজদা, অতিরিক্ত কথা বললে কিন্তু আজ সারাদিন মুখটা পর্যন্ত দেখতে পারবে না!”
রমিজদা চুপ হয়ে যান। সালেহা বেগম সেভাবেই গজগজ করতে করতে রান্না ঘরে চলে যান। সোফায় বসে রমিজদা বিড়বিড় করে বলেন,
-“হাইরে ভালোবাসা, মাইয়া মানুষ আসলেই দরদ বুঝে না!”
শব্দ করে হেসে উঠে নাদিয়া। সিঁড়ি তে দাঁড়িয়ে শশুড়-শাশুড়ির কান্ড দেখছিল। এবার শশুড়ের কথায় না হেসে পারলো না। হাসির আওয়াজে থতমত খেয়ে যান রমিজদা। নাদিয়া কে দেখে সামান্য লজ্জাও পান। নাদিয়া আর লজ্জা দিতে সেখানে দাঁড়ায় না। রান্না ঘরে গিয়ে দেখে সালেহা বেগম মিটিমিটি হাসছেন। নাদিয়ার কি যে ভালো লাগলো ব্যাপারটা। শশুড় শাশুড়ির প্রেম সম্পর্কে পূর্বেই জেনেছে সে। নতুন নয়, সেই বিয়ের পর থেকেই চোখে হারান রমিজদা! এসব নিত্যদিনের কাজ ছিল। মাস কয়েক যদিও গুমোট ভাব ছিল, নিশ্চুপ ছিল। ছেলের জীবনে কারোর আগমনে তারাও যেন যৌবন ফিরে পেয়েছে। যুবক-যুবতীর মতো ভালোবাসায় ভাসছে। নাদিয়া শাশুড়ির থেকে খুন্তিটা নিয়ে বলে,
-“আম্মা যাও তো আব্বার কাছে! পানি চেয়েছে। তোমার আর এখানে আসতে হবে না। বাকিটা আমি করে নিতে পারবো। আমার সংসার এখন আমাকে বুঝতে দাও! যাও!”
সালেহা বেগম মুচকি হেসে নাদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। পানি নিয়ে ফিরে যান স্বামীর কাছে। নাদিয়া নিজের সংসারের কাজ গুলো যত্ন নিয়ে করতে থাকে। কি যে সুখ এই কাজে! আপন আপন লাগে!
****
যত্নে যত্নে সংসারে নাদিয়ার কেটে গেল দু দুটো মাস! রোজ সকালে আহিশের সাথে কিছুক্ষণ ঝগড়া করা, শশুড়-শাশুড়ির প্রেমময় ঝগড়া দেখা,রান্না করে যত্ন নিয়ে সবাই কে খাওয়ানো, শশুড়-শাশুড়ি ঠিক মতো ঔষধ খাচ্ছে কিনা দেখে রাখা, আহিশের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সবসময় হাতের কাছে রাখা, রোজ রাতে আহিশের ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষা করা, ফিরলে খেতে দেওয়া, কখনো কখনো আহিশের অফিসের কাজে হেল্প করা, মাথা টিপে দেওয়া, কখনো বা ব্যথায় নীল হওয়া বুকে মাথা রেখে সান্ত্বনা দেওয়া, ভেঙে যাওয়া মানুষটাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখানো; এই করে করেই দুটো মাস নাদিয়ার চলে গেল স্বপ্নের মতো। মানুষ টা এখনো ভালো না বাসতে পারলেও নাদিয়ার কোনো অযত্ন করে না। বরং কোনটা করলে নাদিয়া সবচেয়ে বেশী খুশি হবে সেটাই করার চেষ্টা করে। এই যে ব্যথায় নীল হওয়া বুকে যখন মেয়েটা মাথা রাখে আহিশ ভুলবশত ‘মিহি’ নামটা উচ্চারণ করে ফেলে; সে বুঝতে পারে মেয়েটার মনে তখন ঝড় বয়ে যায়, মেয়েটা ভেঙেচুরে যায়; কিন্তু মেয়েটাকে কাছে টেনে নিতে পারে না। শুধুমাত্র দু হাত বাড়িয়ে একটু জড়িয়ে নেওয়া ছাড়া! আহিশ এগোতে চায় সামনে, কিন্তু পারে না। কোথাও একটা বাঁধা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে! সে চাইলেও ভালোবাসতে পারছে না! নাদিয়ার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিল আহিশ। মলিন মুখটাই অসুখের হাতছানি। তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগছে মেয়েটা। বিছানার সাথে শরীর টা যেন মিশে যাবে। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক দহন টের পায় আহিশ। সারাক্ষণ বাড়ি মাতিয়ে রাখা মেয়েটার এমন করুণ অবস্থা তাকেও যে যন্ত্রণা দিচ্ছে সে জানে। এই তিনটে রাত সে নির্ঘুম কাটিয়ে নাদিয়ার যত্ন নিয়েছে। শুধু মাত্র দায়িত্বের জন্য? মন থেকে সায় পায় না আহিশ। শুধুমাত্র দায়িত্বের ভারে কেউ এতটা করবে? এইযে ক্ষণে ক্ষণে তার মন বিষিয়ে উঠছে, সে চাইছে মেয়েটি চোখ খুলে তার দিকে তাকাক, একটু হাসুক, আহি সাহেব বলে ডাকুক; সবই কি দায়িত্বের ভারে? আহিশ বুঝে, সে এই পাগল মেয়ের মায়ায় পড়ে গেছে। হয়তো কিছুদিন যেতে যেতে ভালোও বেসে ফেলবে! ক্ষতি তো হবে না! জীবন আর কত থেমে থাকবে? আহিশ উবু হয়ে নাদিয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। পরক্ষণেই মিহির ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,
-“তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা প্রেমপিয়াসী; এ জীবনে তোমাকে ভোলা সম্ভব নয়! সম্ভব নয় এই মেয়েটিকে আর বঞ্চিত করা। সবাই প্রথম ভুলে দ্বিতীয় শুরু করে। আমি নাহয় প্রথম কে বুকে ধারণ করেই দ্বিতীয় কে জায়গা দিবো! আমার বুকের বিশালতায় কারোর কষ্ট হবে না!”
তারপর নিশ্চুপতা! সে রাত সেভাবেই কেটে গেল! নতুন ভোরের সূচনার সাথে আহিশের জীবন টাও নতুন এক রূপ পেল। চোখ খুলেছে নাদিয়া। পিটপিট করে চোখ খুলে শিহরে আহিশ কে দেখে হাসে সে। হাত বাড়িয়ে আহিশের গালে হাত রেখে ডাকে,
-“আহি সাহেব!”
নিদ্রার রেশ কেটে যায় আহিশের। চোখ খুলে নাদিয়া কে দেখে মুখ ঝলমল করে উঠে। তবে আবেগ টাকে সে আটকে রাখে। নাদিয়া কে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে ঘরটা গুছিয়ে নেয়। জ্বর কমেছে, দুর্বলতা রয়েছে। বেশ ক’দিন সময় লাগবে ঠিক হতে। নাদিয়া কে বিছানায় আধশোয়া করে বসিয়ে দিয়ে সে নিচে চলে যায়। সালেহা বেগম রান্না ঘরেই ছিলেন। আহিশ এসেই মাকে জড়িয়ে ধরে,
-“নাদিয়ার জ্বর কমেছে আম্মা। ওর খাবার টা দাও!”
সালেহা বেগম হেসে ছেলের কপালে চুমু খান। দুজনের খাবার বেড়ে দিয়ে বলেন,
-“নিজেও খেয়ে নিবে! আর যাওয়ার সময় তোমার আব্বা কে চা টা দিয়ে যাবে।”
-“আম্মা, আব্বার চা আমি নিতে পারবো না। তোমার হাত ছাড়া উনি চা নিবেও না। অযহত আমি নিজের মুড নষ্ট করতে পারবো না!”
আহিশ চা টা রেখেই দ্রুত উপরে চলে যায়। সালেহা বেগম রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলেন। খানিক লজ্জাও পান। চা নিয়ে যান স্বামীর কাছে। বুড়ো হয়ে গেছে, তবুও ভালোবাসা নিত্য নতুন বাড়ছে যেন।
আহিশ নাদিয়া কে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেয়। তারপর অনেক টা সময় দুজনে গল্প করে। গল্পের এক পর্যায়ে আহিশ নাদিয়ার হাত ধরে বলে,
-“আমি ভাবছি, জীবন টা নতুন করে শুরু করবো!”
চোখ বড় বড় হয়ে আসে নাদিয়ার। মৃদু চিৎকার করে বলে ,
-“নতুন করে মানে? আপনি কি আবার বিয়ে করতে চাইছেন নাকি? সতিন আমাকে ঠাঁই দিয়েছে বলে আমি কিন্তু আর কাউকে ঠাঁই দিবো না আহি সাহেব!”
এত সুন্দর মুড টার বারোটা বাজিয়ে নাদিয়া খিলখিল করে হাসছে। আহিশের মন চাচ্ছে গলা চেপে ধরে হাসিটা বন্ধ করতে। অনেকটা সময় হাসার পর নাদিয়া বললো,
-“মায়ায় পড়ে গেছেন আহি সাহেব?”
-“নারীজাত বড্ড ফাযিল, পুরুষের ঘুম নষ্ট না করে শান্তি নেই তাদের!”
-“আপনি বলছেন তাহলে সতিনের পর কেউ আপনার ঘুম নষ্ট করতে পেরেছে?”
-“তিতা হলেও সত্যি, হ্যাঁ পেরেছে!”
-“আপনার অনুভূতি কেমন আহি সাহেব!”
-“অনুভূতি জঘন্য! কাছে পেতে মন চায়!”
-“বড্ড ফাযিল কথা! দূরে যান!”
আহিশ দূরে সরে যায়। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় মিহির ছবির সামনে। নাদিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়। সে বলেছে বলেই দূরে যেতে হবে? কই কাছে আসতে বললে তো আসে না! আহিশ কিছুক্ষণ ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কথা বলে। পরক্ষণেই ঘাড় বাড়িয়ে ছবিতে ঠোঁট ছোঁয়ায়। নাদিয়া বসে বসে দেখে সব। কেন জানি এই কাজ গুলো তাকে কষ্ট দেয় না। বরং আনন্দ দেয়। মৃত একজন কে যে ভালোবেসে এভাবে নিজের মনের মাঝে আগলে রাখতে পারে; সে লোক তাকে ভালোবাসলে কতটা আগলে রাখবে? এই কথা ভেবেই নাদিয়ার আনন্দে মরে যেতে ইচ্ছে করে। সুখের সাগরে ভাসতে থাকে সে। সেই ভাসতে থাকাটা আরো আনন্দদায়ক করতে আহিশ এসে জাপটে ধরে নাদিয়াকে। নাদিয়া কিছুক্ষণের জন্য স্তব্দ হয়ে যায়। পরক্ষণেই যখন বুঝতে পারে সে স্বপ্ন দেখছে না তখন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আহিশ কে। কাঁদে, মন মতো কেঁদে নেয়। আনন্দের অশ্রু ঝরে। হেসে বলে,
-“শেষ বাজিমাত কিন্তু আমিই দিলাম আহি সাহেব!”
আহিশ শুধু মুচকি হাসে। সে হাসির মাঝে কিছু একটা রয়েছে। নাদিয়া ধরতে পারে না, তবে নিশ্চুপ থাকে! সময়টা সে কথা বলে নষ্ট করতে চায় না। এ যেন পরম সুখের! থাক না কিছু কথা নিশ্চুপে!
****
আইসক্রিমের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আহিশ। সাথেই নাদিয়া। সাত মাসের ভরা পেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। তার নাকি আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করেছে। এ সময় নানান কিছু খেতে ইচ্ছে করে, তাই আহিশ না করেনি। সকল প্রকার আবদার মেটানোর চেষ্টা করে সে।নাদিয়া সবে মাত্র আইসক্রিমে ঠোঁট ছুঁয়েছে তখনই পাশের স্কুল থেকে ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলো। এক ঝাঁক ছেলে মেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। নাদিয়া অসহায় চোখে তাকালো আহিশের দিকে। দম ফাটানো হাসি পেলেও খুব কষ্টে হাসিটা আটকে রাখলো আহিশ। হেসে মরতে চায় না সে। গুনে গুনে পাঁচটা ছেলেমেয়ে দৌড়ে এসে ঘিরে ধরলো নাদিয়া কে। তিনটে মেয়ে, দুটো ছেলে। নাদিয়া আহিশের জীবন থেকে কেটে গেছে দশটি বছর। সময় পেরিয়ে গেলেও ভালোবাসাটা যেন জীবন্ত। দশ বছরে ঘর আলো করে পাঁচ টি সন্তান এসেছে। আবার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নাদিয়া। এই ছোট ছোট বিচ্ছুদের সামলাতে নাজেহাল অবস্থা নাদিয়ার। ছেলে মেয়ে রা এসেই বায়না ধরলো আইসক্রিম খাবে। আহিশ কিনে দিল। বললো,
মা কে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসো, হসপিটাল যেতে হবে!
নাদিয়া তাদের ধরতেও পারলো না, পূর্বেই ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল পাঁচ জন। রাস্তায় অবশ্য গাড়ি নেই তেমন। তবুও মায়ের মন। চিৎকার করে ডাকলেও বাচ্চা রা নিজেদের মতো হইচই করছে। আহিশ সেসব দেখে হাসলো। হাসিটা অনেকটা সময় দীর্ঘ ছিল। পেছন থেকে নাদিয়া কে ডেকে বললো,
-“বলেছিলাম না, শেষ বাজিমাত টা আমিই দিবো? নাও সামলাও, পাঁচ টাকে। আরেকটা তো আসছে! পরের বছর আবার আসবে!”
নাদিয়া চোখ গরম করে তাকিয়ে কিছু বলবে পূর্বেই বাচ্চারা ডাকতে শুরু করলো। নাদিয়া না পেরে বাপ, ব্যাটা, ব্যাটি সাতজন কেই বকতে শুরু করলো আপন মনে। আহিশ হেসে মানিব্যাগ বের করলো টাকা দিতে। টাকা দিয়ে মানিব্যাগ টা পকেটে রাখার পূর্বেই চোখ পড়লো ছবি দুটোর দিকে। একটা ছবি নাদিয়ার , আরেকটি মিহির। মেয়েটা নেই সাড়ে দশ বছর, তবুও তার নিকট রয়ে গেছে। মানিব্যাগে, ঘরে, বুকে সর্বত্রই রয়ে গেছে। আমৃত্যু থাকবে! অত্যন্ত যত্নে গড়া নাদিয়ার সংসারে এই মেয়েটাও গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য! যাকে তার বাবা-মা ডাকে বড় বউমা বলে, যাকে বাচ্চা রা ডাকে বড়মা বলে! যাকে আহিশ ডাকে প্রেমপিয়াসী বলে, যাকে নাদিয়া ডাকে সতিন বলে; সে কিভাবে নেই? সে তো আছে সর্বত্র, সবকিছু জুড়ে। মানিব্যাগ পকেটে রেখে আহিশ এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। গাড়িতে উঠে বসতেই ছুটতে শুরু করে গাড়ি। নতুন সদস্য কেমন আছে দেখতে যেতে হবে! তার সংসার এভাবেই পরিপূর্ণ! হুট করেই পরিপূর্ণ, আবার হুট করেই অপূর্ণ! পূর্ণতা, অপূর্ণতা নিয়ে তারা বেশ আছে! জীবন থেমে থাকে না, চলতেই থাকবে! মানুষ সামাজিক জীব! একা বাস করা কঠিন! ভালোবাসা রা এভাবেই ভালো থাকুক, পূর্ণতা-অপূর্ণতা নিয়ে!
সমাপ্ত