#বাজিমাত-২
Tahrim Muntahana
রাত বেশ গভীর। আহিশ আর বাড়ি ফেরে নি। এর জন্য যে নাদিয়া চিন্তিত এমন নয়। সে নিজের মতো ঘুমিয়ে গেছে। সত্যিই ঘুমিয়েছে কিনা জানা নেই। ঘুমের মতো নির্জীব হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, বালিশ আঁকড়ে। মেয়েটা থম মেরে গিয়েছিল প্রথম এসে এই ঘরে! আজ থেকে এই ঘরটা তার, এই ঘরের মানুষ টাও তার সে যেন স্বপ্ন দেখছিল! যাকে তিনটে বছর ধরে ভালোবাসে, যার সুখের জন্য বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল দুটো বছর, বুঝতে দেয় নি বুকের দহন, জানতে দেয় নি ব্যথার কারণ, হুট করে বদলে যাওয়ার ব্যাখ্যা; সে মানুষ টা এখন তার। অনিমেষ মির্জা যখন ধমকে বললেন, বিয়ে ঠিক করেছেন এবার কোনো ঝামেলা করলে খুব খারাপ হবে! নাদিয়া মেনে নিয়েছিল। বাবা-মা’র আর কি দোষ? তারা কেন কষ্ট পাবে? তাদের তো শখ আহ্লাদ রয়েছে। রাজী হয়েছিল বিয়েতে! কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নাকি রহমত সে জানে না; তিন বছরের ভালোবাসা অবশেষে তার হলো। পিটপিট করে চোখ খুলে নাদিয়া। চোখ বুজে থাকা যায় না, হাঁসফাঁস লাগে। উঠে পড়ে সে। আবছা আলো-অন্ধকার ঘরে দেয়ালে টাঙ্গানো বৃহৎ বড় ছবিটা অমায়িক লাগছে। দুই বেশী করা মেয়েটি একগাল হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে কি মায়া! নাদিয়ার বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠলো। সে কি ঠকালো এই মেয়েকে? হয়তো ঠকালো! কিন্তু তারই বা কি করার আছে? সে তো মেনে নিয়ে দূরে ছিল! দূরে ছিল ভালোবাসা হারানোর ব্যথা থেকে। হয়তো আগে জানলে বিয়েটাও ভেঙে দিত! কষ্ট হতো, তবুও যে তার না তাকে সে চায় না। শেষ মুহূর্তে জেনে পরিস্থিতি বিগড়ে গিয়েছিল। বিয়ে না হলে সমাজে সে মুখ দেখাতে পারতো না! এতদিন বিয়ে করেনি বলে কটু কথা বলেছে, এবার বিয়ে ভেঙে গেলে অপয়া, অলক্ষী এসব তাকে সারাজীবন শুনে যেতে হতো। কিঞ্চিৎ লোভ ও হয়তো জন্মেছিল। নাদিয়া আর ভাবতে চায় না। ছবি থেকে চোখ সরিয়ে সে বারান্দায় চলে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। বাগানের সাথে এটাচ করা কবরস্থানে একটি ছেলে শুয়ে আছে। বিয়ের শেরওয়ানী তে ধুলো, ধুলো গাঁয়ে- মুখে। নাদিয়া টের পায়, মানুষ টাকে চিনে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেমে যায় নিচে। বিয়ের শাড়ি সেও খুলেনি। ইচ্ছে করেই, কেন জানি ভালো লাগছিল। নাদিয়া আকস্মিক গিয়ে কবরের অন্যপাশে শুয়ে পড়ে। আহিশ কারো উপস্থিতি টের পায়, চোখ খুলে না। চোখ বুজেই প্রশ্ন করে,
-“কেন এসেছো?”
-“চোখ বুজে যাকে অনুভব করা যায়, সে খুব আপন মানুষ আহি সাহেব!”
-“জীবন নাটক সিনেমা নয় নাদিয়া! এ বাড়িতে কেউ এই সময়ে এখানে আসবে না। আজ তুমি এসেছো, হিসেব করে অঙ্ক মেলানো কঠিন নয়!”
চাপা শ্বাস ফেলে নাদিয়া। মৃদু হেসে বললো,
-“আজ আমাদের বাসর রাত আহি সাহেব! আর আপনি এখানে শুয়ে আছেন?”
-“তোমার আকাঙ্ক্ষা খুব উচ্চ! যারা প্রয়োজনের তুলনায় উচ্চ আকাঙ্ক্ষা করে তাদের মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে সময় লাগে না!”
-” ‘আশায় বাঁচে চাষা’ প্রবাদ টা বিশ্বাস করেন তো?”
-“বিশ্বাস তো আমি এটাও করেছিলাম শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমার প্রেমপ্রিয়াসী আমার সাথে থাকবে!”
-“একটু আগে আপনিই বললেন জীবন নাটক সিনেমা নয়, এখন আবার নাটকের মতো ডায়লগ দিচ্ছেন আহি সাহেব! ব্যাপারটা এক মুখে দু’কথা হলো না?”
-“সবটাই আবেগ! আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন!”
-“তবে বিবেক কেন নয়? বিবেক যে আবেগ কে নিয়ন্ত্রন করতে পারে!”
-“বিবেক যে তোমাকে আমার পাশে দেখায়, কিন্তু মস্তিষ্ক মানতে চায় না! আবেগ নিয়ে আমি ঢের ভালো আছি, এই যে সংসার করছি আমরা। আমি, আমার প্রেমপিয়াসী! তুমি এখানে, আমার প্রেমপিয়াসী কষ্ট পাচ্ছে, জানো?”
-“ভুল কথা আহি সাহেব! আপনার মস্তিষ্কে জং ধরেছে! জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এবং কি সবকিছু উপর ওয়ালা প্রদত্ত। আর সব দোয়া দ্বারা, নেক কাজ দ্বারা বদলানো যেতে পারলেও জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে বদলানো যায় না। আপনার ভাগ্যে দুটো বিয়ে লেখা ছিল, কিন্তু এই নয় যে আপনি ভালোবাসা হারিয়েছেন, আপনার মনে সে সবসময় থাকবে। না আমি তার জায়গা টা নিতে চাই। আমি চাই আপনার মনে আমার জন্যও একটুখানি জায়গা থাকুক। অর্ধাঙ্গিনী আমি আপনার, আপনার সঙ্গী! হয়তো আপনার ইচ্ছেই বিয়েটা হয়ে নি। কিন্তু হয়েছে তো! আপনি তো বাবা হোন নি, জানেন না বাবাদের মনের অবস্থা। নিজের সন্তান কে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যেতে দেখতে কোনো বাবাই চান না। মায়ের দরদ বুঝতে পারছেন না, প্রতিনিয়ত নির্ঘুম সন্তান কে দেখে কোনো মা’ই ঘুমাতে পারে না। আপনি খুব দায়িত্বজ্ঞানহীন সন্তান আহি সাহেব! বাবা-মা’র মূল্য বুঝেন না। শুধু মাত্র বিয়োগান্ত স্ত্রীর জন্য নিজেকে তো শেষ করছেন, সাথে সাথে আরো দুটো প্রাণ কে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর স্বাদ উপভোগ করাচ্ছেন।”
জোরে দম নেয় নাদিয়া। আহিশ নিশ্চুপ। শূণ্যে দৃষ্টি রেখে নাদিয়া ফের বলে,
-“মানুষ সামাজিক জীব, একা কখনোই বাস করতে পারে না। আপনি এখন যুবক, আপনি মনে করবেন আপনার আর কাউকে লাগবে না। কিন্তু একসময় আপনি চরম একাকীত্বে ভুগবেন, বৃদ্ধ বয়সে আফসোস করবেন, বাঁচার ইচ্ছে মরে যাবে। আহি সাহেব, কেউ কারোর জন্য মরে না। এই যে আগে ভাবতেন মিহা না থাকলে আপনি মরে যাবেন। অথচ আপনি কিন্তু বেঁচে আছেন। বাঁচার মতো বেঁচে নেই ঠিক! কিন্তু যত সময় গড়াবে, আপনার মস্তিষ্ক ও মনে দুটোতেই স্তর পড়বে, আগের মতো আর মনে পড়বে না। তাই বলে ভালোবাসেন না এমন না। এটাই জাগতিক নিয়ম আহি সাহেব! আমরা সেভাবেই বেঁচে আছি!”
তারপর নিরবতা! অদূরের ওই ঝোঁপঝাড় থেকে নিশাচরের শব্দ ভেসে আসছে, কোথাও একটা বেওয়ারিশ কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। নাদিয়ার ভয় লাগছে না, এই গভীর আলো অন্ধকারে কবরের পাশে শুয়ে থাকতে ভয় করছে না। পাশে যে তার ভালোবাসা রয়েছে। সময়টা তখন তিনটের কাছাকাছি। শোয়া থেকে দাঁড়িয়ে আহিশ গাঁয়ের ধুলো ঝেড়ে নেয়। নাদিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলে,
-“উঠো!”
-“উহম হাম!”
-“কেন?”
-“তুলুন!”
-“বাড়াবাড়ি করো না!”
-“একটু করবো!”
-“যথেষ্ট বড় তুমি, বাচ্চা দের আচরণ মানায় না। মানুষ এক মুহুর্তে অভ্যাস বদলাতে পারে না।”
আহিশের কাটকাট জবাব। নাদিয়া একাই উঠে। ধুলো ঝেড়ে হাঁটতে থাকে ধীরগতিতে। পেছনে আহিশ আসছে। মনের ভেতর হুট করেই এক আনন্দ এসে ঢুকে গেল, সে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে হেসে উঠলো নাদিয়া। আহিশ এবার তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-“ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী নয় আমি! অযহত হাসা পাগলের লক্ষণ!”
হাসি থামায় নাদিয়া। দাঁড়িয়ে পড়ে। আহিশের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দেয়,
-“আমি তো সেই তিন বছর থেকে পাগল, একজনের ভালোবাসায় পাগল!”
-“ভুলো নি দিন গুলো!”
-“ভুলার কথাও না!”
-“উচিত ছিল!”
-“প্রেম উচিত-অনুচিত বুঝে না। যদিও আমি বুঝতে দেরী করেছি, সাহস হয়নি আপনাকে বলার। যখন বলার সাহস করলাম তখন আপনি অন্যকারোর মায়ায় আটকে গেছেন। আমি আপনার অনুভূতি কে সমর্থন করেছিলাম, আপনার সুখের জন্য সরে এসেছি। নাহলে বাবা, আংকেল কে রাজি করিয়ে আপনাকে হাসিল করা কঠিন ছিল না!”
-“আমার থেকে বেটার কাউকে পেতে! ”
-“ভালোবাসা তো ভালোবাসায়! তবে আমি খেলতে ভালোবাসি! বাজিমাতের খেলায় নেমেছি যে। তবে আহি সাহেব আপনি কি জানেন, পরপর দুবার আমি আপনাকে মাত দিলাম?”
-“কিভাবে?”
-“বিয়েটা হলো, তারপর এই যে এখন আপনি আমার সাথে ভেতরে যাচ্ছেন। চিন্তা নেই, এভাবেই ধীরে ধীরে আপনাকে বাজিমাত কাকে বলে শেখাবো! আপনার মনে জায়গা করেও নিবো!”
ঘরে ঢুকে পড়েছে দুজন। নাদিয়া আর কথা বাড়ায় না, ধুলোয় তার শরীর চুলকাতে শুরু করেছে। ওয়াশ রুমে চলে যায় কাপড় নিয়ে। আহিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভাবতে থাকে। অনেকক্ষণ ভাবে, অনেকক্ষণ মনের সাথে বুঝাবুঝি হয়। একসময় ফিক করে হেসে দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-“নারী ছলনাময়ী! ছলনা করে কেউ চলে যায়, ছলনা করে কেউ আসে! নারী ছলনা করেই ভালোবাসে, কাছে ডাকে!”
ততক্ষণে নাদিয়া বেরিয়ে আসে। আহিশ কে হাসতে দেখে চোখ গোল গোল হয়ে যায় তার। বুকে হাত চেপে বিছানায় বসে পড়ে। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
-“আহি সাহেব, আপনি হাসছেন? এটা আপনি? সত্যি আপনি? দীর্ঘ ছয়টা মাস পর আপনার ওই মুখে হাসি! আহি সাহেব আপনার মাঝে আমার সতিনের আত্মা ভর করে নি তো?”
চোখ ছোট ছোট হয়ে যায় আহিশের।ধমকে উঠে,
-“হোয়াট? সতিন?”
-“হ্যাঁ, সতিন ই তো! এই শুনেন, সতিন কখনো আপন হয় না। তাই তাকে নাম ধরে হোক আপু করে হোক ডাকতে পারবো না। সতিন ই বেটার। এখন একটু ওয়াশরুম থেকে মানুষ হয়ে আসুন।”
-“আমি মানুষ নয়?”
-“বর্তমানে আবর্জনা ছাড়া কিছুই লাগছে না!”
-“তুমি বেশী কথা বলছো না?”
-“আপনি জানেন আমি ছোট থেকেই বেশী কথা বলি! মাঝখানে সেটা হারিয়ে গিয়েছিল, এখন ফেরত আসছে!”
আহিশ আর কিছুই বলে না। রাগ ও হয় তার। কেন যে এই মেয়ের সত্য কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে গেল, আর নিজেকে অপরাধী ভাবতে গেল! নাহলে এই মেয়ের এসব বকবক সহ্য করা লাগতো? ওয়াশ রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে গেল সে। গম্ভীর মুখে পেছনে ঘুরে নাদিয়া কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“শেষ বাজিমাত টা আমিই দিবো!”
চলবে…?