#বাজিমাত -১
Tahrim Muntahana
-“তোর বর মানসিক প্রতিবন্ধী নাদিয়া, বদ্ধ পাগল! তুই বিয়েটা করিস না, পালিয়ে যা! জীবন শেষ না করতে চাইলে শিগগির পালা।”
এইতো একটু আগে মেয়েটি সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের বিয়ের আমেজ উপভোগ করতে নাচ করছিল। কখনো গানের সাথে গলা মেলাচ্ছিল। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আনন্দ টা পুরো দমে উপভোগ করতে চেয়েছিল। শেষ মুহূর্তে এসে হুট করে এমন একটি কথা শুনে নাদিয়ার মনে হলো আকাশ ভেঙে পড়লো তার উপর। একজন পাগলের সাথে তার বাবা তাকে বিয়ে দিচ্ছে? তাকে না জানিয়ে? বাবা কে বিশ্বাস করে সব ছেড়ে দিয়ে সে ভুল করেছে? তার উচিত ছিল সারাজীবন যার সাথে থাকবে তার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া। প্রশ্ন করে,
-“তুই জেনে বলছিস? নাকি হুজুগে?”
নাদিয়ার বন্ধু ইমন রেগে যায়। মাথা তার এমনিই গরম ছিল, বরের বাড়ির কিছুজনের কথা শুনে তার বুঝতে বাকি নেই কৌশলে তারা ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। এখন নাদিয়ার এমন প্রশ্নে তার কষিয়ে এক থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করলো। তবে ভেতরের রাগ টা সে দেখালো না। শান্ত কন্ঠে বললো,
-“আমাকে তোর বিশ্বাস হয় না? আমি মিথ্যে বলছি? আচ্ছা চল, তুই নিজেই শুনবি!”
ইমনের এই শান্ত থাকা টা হয়তো নাদিয়ার ভালো লাগে না। সে আকস্মিক বোকাদের মতো জিজ্ঞেস করে ফেলে,
-“বরের নাম কি?”
এবার ইমন বিস্মিত হয়ে যায়! আপনা আপনি মাথায় হাত চলে যায় তার। ছেলে টার স্বভাবই হলো কথায় কথায় রাগ করা, নাকের ডগায় রাগ বসে থাকে। কনের এমন কথায় সে যেন রাগ করতেও ভুলে গেল। চাপা তেজ নিয়ে বললো,
-“তুই বিয়ে করছিস, বরের নাম জানিস না? আর ইউ ক্রেজি?”
-“আহা বল না!”
জোরে জোরে দম নেয় ইমন। নিজেকে ধাতস্থ করতে চায়। সফল ও হয় সে। ধীর কন্ঠে জবাব দেয়,
-“তুই মন থেকে এ বিয়েতে রাজী হয়েছিলি?”
-“সেটা তোর জানার কথা ইনো!”
-“ইনো ডাকবি না, আমার নাম ইমন!”
-“আমি ইনোই ডাকবো! এখন বল পাগল টার নাম কি?”
-“আহিশ!”
বুকে হাত চেপে বসে পড়ে নাদিয়া। চোখ তার কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। আকস্মিক শকড টা এত বেশী ছিল, সারাদিনের ধকল, একটু আগের আকস্মিক উত্তেজনা; নার্ভ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সে ঢুলে পড়ে সোফায়! তাল সামলাতে না পেরে ইমন ধরার আগেই গড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে। একটু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল ইমনের মস্তিষ্ক ধরতে পারলো না। সে মাথায় হাত রেখে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। কবুল বলার মুহুর্ত চলে এসেছে, নাদিয়ার মা মেয়ে কে দেখতে আসেন। এসেই এভাবে ফ্লোরে মেয়ে কে পড়ে থাকে দেখতে তিনি চিৎকার করে উঠেন। এর পরেই হইহই করে উঠে পুরো বিয়ে বাড়ি। নানান জনের নানান কথা! পাত্র পক্ষের মাঝে চিন্তারা ঘুরা ফেরা করছে। অনিমেষ মির্জা মেয়ের শিহরে বসে আছেন। গুনগুনিয়ে কান্না করছেন লতা বেগম। নাদিয়ার জ্ঞান ফেরে, পিটপিট করে চোখ খুলে নিজের ঘরে এত এত মানুষ দেখে ভড়কে যায়। পরক্ষণেই সবকিছু মনে হতেই হে হে করে হাসতে চায়। এমন বোকা তো সে না! হুট করেই চমক টা নিতে পারে নি। ফিসফিস করে অনিমেষ মির্জা কে বলে,
-“বিয়ে হয়ে গেছে বাবা?”
মেয়ের পর পর এমন অদ্ভুত কান্ডে অনিমেষ মির্জা চিন্তায় পড়ে যান। কনে অজ্ঞান থাকলে বিয়ে হবে কি করে? তিনিও চাপা সুরে বলেন,
-“তুমি কি বিয়ের খুশিতে পাগল হয়ে গেছ? অজ্ঞান হয়ে গেলে, এখন আমার এমন অদ্ভুত কথা বলছো! কি হয়েছে?”
-“তার আগে তুমি বলো, পাত্র আহিশ? ওই পাগল টা আমার বর হবে? আর ইউ ক্রেজি বাবা? কয়েক দিন আগে না ওর বউ মরলো, এখনি বিয়ে করতে চলে এসেছে ডেং ডেং করে? পুরুষ মানুষ এমন কেন?”
অনিমেষ মির্জার চোখ ছোট ছোট হয়ে আসে। তিনি কপট রেগে বলেন,
-“নাটক করো না নাদু, তোমার মন যে খুশিতে বাকবাকুম করছে আমি ঢের বুঝতে পারছি। নাটক বাদে সাজগোজ ঠিক করে বাহিরে এসো।”
নাদিয়া ভড়কে গিয়ে হাসার চেষ্টা করে। নাটক করে লাভ কি ধরেই ফেলেছে। মাথার উড়না টা ঠিকঠাক করে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে,
-“আমি তৈরি বাবা! চলো!”
বাবা-মেয়ের ফিসফিস করে কথা বলা, পরক্ষণেই হাসি খুশি কনে কে দেখে পুরো বিষয়টাই সবার মাথার উপর দিয়ে গেল। প্রশ্ন করার মতো পরিস্থিতি রাখলেন না অনিমেষ মির্জা! সকল কে নিয়ে বাহিরে চলে গেলেন। শুধু রয়ে গেল ইমন, নাদিয়া। নাদিয়ার এমন সিদ্ধান্ত শুনে ইমন শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-“তুই কি আসলেই ওই পাগল টাকে বিয়ে করবি?”
-“অবশ্যই!”
-“মানে কি নাদু? পাগল একজনের সাথে সংসার করা সম্ভব?”
-“সম্ভব!”
-“হেঁয়ালি করছিস কেন?”
-“তুই পাগল পাগল করছিস কেন? উনার একটা নাম রয়েছে!”
-“আশ্চর্য!”
-“আজব!”
-“মজা করবি না নাদু। মেজাজ কিন্তু এমনিই গরম।”
-“মাথায় বরফ দে!”
-“আমি সিরিয়াস নাদু!”
-“ব্যথা উঠলে হসপিটাল যা, পেট কেটে ব্যথা কমিয়ে দিবে!”
-“হোয়াট?”
-“ওয়েট!”
নাদিয়ার এমন খামখেয়ালি মজায় ইমন বেচারা দিশেহারা। সে রাগ করবে না শান্ত থাকবে; বুঝে উঠতে পারছে না। নাদিয়া আয়নার সামনে গিয়ে ভালো করে লিপস্টিক লাগিয়ে আবার ফিরে আসে ইমনের সামনে। বলে,
-“চল!”
-“কোথায়? পালাবি? চল, চল!”
ইমনের এক্সাইটমেন্টে নাদিয়া কপট রেগে মাথায় গাট্টা মারলো। ফের হেসে বললো,
-“তোর সাথে আমি পালাবো? লোকে বলবে বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে নাদিয়া মির্জা পালিয়ে গেছে। তোর বাপ তোরে লাথি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করবে, আমার বাপ আমারে ছাদের রেলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখবে। সরি দাঁড় করিয়ে রাখবে।”
হতাশ ইমন এবার মাথা ধরে শুয়ে পড়ে বিছানায়। নাদিয়া ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইমনের পেটের উপর টিস্যু পেপারের বক্স রেখে উদাস কন্ঠে বলে,
-“একটু সহ্য কর দোস্ত, বেশী সিরিয়াস হয়নি। আমার বিয়েটা হয়ে যাক তারপর হসপিটাল যাবো।”
নাদিয়া কথাটি বলেই ছুট লাগিয়েছে, লতা বেগম বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়েকে আসতে দেখেই তিনি কিছু মেয়েদের ডেকে আনেন। তারাই নাদিয়া কে নিয়ে বরের পাশে বসিয়ে দেয়। আড়চোখে একপলক আহিশের দিকে তাকায় নাদিয়া। মাথা নত করে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে আছে ছেলেটি। কাছ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় প্রচন্ড রেগে আছে। নাদিয়া ফিক করে হাসতে গিয়েও হাসে না। গলা খাঁকারি দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয় আহিশের কান বরাবর। ফিসফিস করে বলে,
-“প্ল্যান ফ্লপ মি. আহিশ! ইশশ, ভারী কষ্ট হচ্ছে আমার!”
আহিশ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় নাদিয়ার পানে। নাদিয়ার হাসিমাখা মুখ দেখে তার রাগ দ্বিগুণ বাড়ে। হিসহিসিয়ে বলে,
-“তোমার জীবনের চরম ভুল করলে। জেনে বুঝে জীবন নষ্ট করছো!”
-“আমি জানতাম না, আপনার সাথে বিয়ে হচ্ছে!”
-“নাটক করো না নাদিয়া! তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি!”
-“বাহ! এত বেশী চিনেন? কখনো ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়নি?”
আহিশের শরীর মৃদু কাঁপছে। মনে হচ্ছে চোখ দ্বারাই ধ্বংস করে দিবে নাদিয়াকে। নাদিয়া আহিশের রাগ বাড়তে দিতে চায় না। নরম কন্ঠে বলে,
-“আমি সত্যিই জানতাম না, বাবা আপনার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। ইমন যখন বললো একজন পাগলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে তখন আমার খটকা লেগেছিল। বাবা জেনে বুঝে এমন কাজ কখনোই করবে না। পরে যখন ইমনের কাছে বরের নাম শুনলাম তখনই সবটা পরিষ্কার হলো। আপনি ইচ্ছে করে ইমনের সামনে নিজেকে পাগল সাজিয়েছেন। যাতে আমি পালিয়ে যাই, সব দোষ আমার হয়, কেচ্ছা আমাকে নিয়ে রটে; আপনি সবার কাছে সাধু, ভোলাভালা পুরুষ টি হয়ে থাকুন। কিন্তু তা কি করে হয় বলুন? নাদিয়া মির্জা কখনোই নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করে না! বরং সে দেখে নিজের চোখ, কান, নাক, গাল, ঠোঁট সব ঠিক রেখে কিভাবে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা যায়! এই যেমন এখন বাজিমাত করলাম!”
কথা শেষ করেই নাদিয়া ফর চেঁচিয়ে বলে,
-“কাজি কোথায়? কতক্ষণ বসে থাকবো?”
আহিশ কে প্রতিত্তর করতে দেয় না। কথায় কথা বাড়বে, কখন না পাগল টা নিজের গম্ভীর ফর্মে ফিরে এসে বিয়ে লন্ডভন্ড করে তাকে দুটো ঠাস ঠাস করে চড় মেরে বিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আগে বিয়েটা হোক, তখন চাই থাকুক না থাকুক তার যায় আসবে না। মেয়ের আচরণে লজ্জায় পড়ে যান অনিমেষ মির্জা। এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
-“বাড়াবাড়ি করছো কেন নাদু?”
-“আরে বাবা, বুঝো না তুমি? আমার পাশে কে বসে আছে দেখতেছ না? পাবনা ফেরত পাগল নাকি, যদি কামড়ে দেয়? তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়াতে বলো, আমি এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচি!”
অনিমেষ মির্জা একবার আহিশের রাগী মুখশ্রীর দিকে তাকান, আরেকবার মেয়ের ভীতু মুখশ্রীর দিকে। পরক্ষণেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরে কাজী কে আসতে বলেন সামনে। কাজী আসে, বিয়ে পড়ানো শুরু করে। আহিশ কাঠ হয়ে বসে থাকে! তার স্মৃতি গহ্বরে এখনো তাজা হয়ে আছে দুই বছরের সেই দিন টি! তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। তার জীবনে সুশ্রী এক রমনীর প্রবেশের দিন। কাউকে না জানিয়ে হুট করে মেয়ে টাকে বিয়ে করে নিয়েছিল! সবাই কে যখন জানালো, গড়িমসি করলেও রাজী হয়েছেন। এরপর চোখের পলকে কীভাবে সুখের সংসারের দু’বছর কেটে গেল, আবার তার জীবনে নেমে এলো অন্ধকার, হারিয়ে গেল সুখ, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, একা জীবন, পাগলপ্রায় অবস্থা; জীবনের এই সময়টুকু তার নিকট রূপকথা মনে হয়। মনে হয় চোখ খুললেই সব মিথ্যা হয়ে যাবে, পাশে ঘুমিয়ে থাকা মিহা কে দেখবে! নাহ, তা হয় না! প্রতিদিন এসব ভেবে ঘুমিয়ে গেলেও সকাল তার স্বপ্ন ভাঙে না। আরো অন্ধকারে ঠেলে দেয়। সেই অন্ধকার জীবন থেকেই তাকে বের করতে তার বাবা-মা দ্বিতীয় বার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিহার চলে যাওয়ার ছয়মাস পর। রাজী না হওয়ায় সালেহা বেগম যখন মরার কথা বললেন, তাকে খু’নী উপাধি দিলেন; আবেগের বশে তখন স্বীকার হলেও প্ল্যান ছিল অন্যরকম। ভয়ে তার বাবা-মা তাকে মেয়ের ব্যাপারে কিছুই বলে নি। আজ যখন গাড়ি অনিমেষ মির্জার বাড়িতে ঢুকলো তখন তার নিকট সবকিছু পরিষ্কার হলো। এরা সবাই এক জোট হয়ে তার থেকে তার মিহাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। অনিমেষ মির্জা ও রমিজ … পরস্পর বন্ধু। সুখ দুঃখের ভাগীদার। শেষ চেষ্টা আহিশ করেছিল। বন্ধুদের হাতে পায়ে ধরে রাজি করিয়েছিল। ওরাই ইমন কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, ‘ছেলে পাগল, বদ্ধ উন্মাদ, ছয় মাস আগে পাবনা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে, মেয়ে মানুষ দেখলেই কামড়াতে যায়’! কিন্তু কাজ হলো না। নাদিয়া সব বানচাল করে দিল। আহিশ দাঁত কিড়মিড় করে কবুল বলে দেয়। দেরী করে না নাদিয়া। ঝটপট কবুল বলে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। বুকে হাত চেপে ধরে নিঃশ্বাস নিয়ে তাকালো আহিশের দিকে। ছেলেটির চোখ মুখে রাগ নেই, কোন রকম প্রতিক্রিয়া নেই, শান্ত-নিগুঢ় আহিশ কে দেখে নাদিয়ার বুকের ভেতর মুচড় দিয়ে উঠলো। মনের ভেতর কি চলছে একটু হলেও টের পেল যেন। আহিশ হুট করেই বাঁকা হেসে তাকালো নাদিয়ার দিকে। হিসহিসিয়ে বললো,
-“বাজিমাত কাকে বলে দেখবে নাদিয়া! টের পাবে! অন্যায়ের শাস্তি তুমি পাবে! জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!”
উঠে দাঁড়ালো আহিশ। একপলক বাবা-মা’র দিকে তাকিয়ে হনহন করে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। চোখের কার্ণিশে জলের ধারা টের পেল নাদিয়া। বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। অজানা ভয়, ব্যথায় রোমাঞ্চিত হচ্ছে সে। চোখের জল মুছে নিজেই ফিসফিস করে বলে,
-“চলুক না বাজিমাতের খেলা! দেখি কার জয় হয়!”
চলবে।