বাঁধিব তোমায় বিরহ ডোরে পর্ব-০৬

0
507

#বাঁধিব_তোমায়_বিরহ_ডোরে
#পর্ব_০৬
#রিয়া_জান্নাত

পরপর সাতদিন হয়ে গেলো কিন্তু জুনায়েদ ইনিয়ার খোঁজ পেলো না। এই শহরের প্রায় প্রত্যেক জায়গাতে ইনিয়ার খোঁজ করেও জুনায়েদ ইনিয়াকে পেলো না। পুলিশকে জানাইছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কিন্তু পুলিশ ও খুজে পায়নি ইনিয়াকে। তাই জুনায়েদ আজকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো। জুনায়েদ পুলিশ স্টেশনে আসলো। এসআই আরিয়ানকে এসে জিজ্ঞেস করলো আজ সাতটা দিন পেরিয়ে গেলো আমার অসুস্থ স্ত্রীর কোনো খোঁজ মিললো না। আপনারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন? জুনায়েদের এমন কথায় রেগে যায় আরিয়ান। আরিয়ান জুনায়েদকে বলে আমরা সাধ্যের কমতি রেখেনি গত তিনদিন থেকে। তাছাড়া আপনি ত ভূল করেছেন। আপনার স্ত্রী নিখোঁজ হয়েছে আপনি ত সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইনফর্ম করেন নি? এসেছেন চারদিন পর। আমার মনে হচ্ছে এখন আপনার স্ত্রী নিখোঁজ হওয়ার পিছনে আপনার হাত রয়েছে। নাহলে চারদিন পর এসে আমাদের ইনফর্ম করলেন কেনো? আরিয়ানের এমন কথায় জুনায়েদ রেগে যায়। এরপরে আরিয়ানকে বলে বউকে নিখোঁজ করার পিছনে যদি আমার হাত থাকতো, ঘটা করে আপনাদের জানাতে আসতাম না। দিব্যি আনন্দে থাকতাম। আজ সাতটা দিন হয়ে গেলো আমার অসুস্থ বউকে পাচ্ছিনা। আর আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে মিট করতে আসলে আপনি উল্টা পাল্টা মিনিং বের করেন। আপনাকে না বলেছি ইনিয়া শুধু রাগ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে? জুনায়েদের এমন কথায় আরিয়ান বলে শুধু গত তিনদিন থেকে শুনেই যাচ্ছি রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আরে ভাই কিসের জন্য রাগ করছে কারণ টা বলবেন না? জুনায়েদ পুলিশের কথা এড়িয়ে যেয়ে পুলিশের টেবিলে ইনিয়ার একখানা ফটো দেয়। এরপরে পুলিশকে বলে আমার স্ত্রীর ছবি প্রিন্ট করে লাগিয়ে দেন। শহরের প্রত্যেক অলিতে গলিতে আর ছবির নিচে লিখে দেন। ইনি হলো মিসেস ইনিয়া, গত সাতদিন থেকে নিখোঁজ। খোঁজার অনেক চেষ্টা করেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই যদি কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি এনাকে দেখে থাকেন। তাহলে তাকে নিয়ে থানায় হাজির করলে পুরুষ্কার বাবদ তারজন্য ২ লক্ষ্য টাকা প্রদান করানো হবে। জুনায়েদের এমন বুদ্ধি আরিয়ানের পছন্দ হয়ে যায়। তাই আরিয়ান জুনায়েদকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনা। আরিয়ান বলে মিস্টার শেখ আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ইন শা আল্লাহ এইবার কাজ হয়ে যাবে থানায় বসে থেকে। টেনশন করিয়েন না, এই নেন ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খান। জুনায়েদ ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খেয়ে দ্রুত পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসে। আরিয়ান কনস্টেবলদের দায়িত্ব টি বুঝে দেয় সুন্দরমতো। কনস্টেবল ইনিয়ার ছবির পোস্টার ছাপিয়ে শর্তসমূত শহরের প্রত্যেক জায়গাতে লাগাতে থাকে।

জুনায়েদ বাড়িতে ফিরে নিমুর কাছে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত চায়। বাইরে প্রচন্ড গরম। রোদ উঠেছে খুব, চৈত্র মাসের খা খা রোদ জুনায়েদের শরীরে ঘাম ছুটিয়ে ফেলছে। রুমের মধ্য এসির হাওয়া লাগছিলো না জুনায়েদের শরীরে। জুনায়েদ রেগে যেয়ে নিমুকে জিজ্ঞেস করে এই তুমি এসি বন্ধ করেছো ক্যান?

“ নিমু জুনায়েদের হাতে শরবত দিয়ে বলে, আম্মুর এসিতে কষ্ট হচ্ছিলো তাই বন্ধ করে রেখেছি। ”
“ জুনায়েদ রেগে যেয়ে বলে এসি চালু করো। আর তোমার আম্মু আসছে প্রায় সপ্তাহখানেক হলো এখনো যাওয়ার নাম নাই কেনো? আগে তো এইবাড়ির ভাত খাবেনা বলে কতকিছু বলতো? আমি নাকি ছোটলোক এখন এই ছোটলোকের বাড়িতে থাকতে লজ্জা করেনা? ”
“ কি বলছো এগুলা, আগেতো তুমি আফার জামাই ছিলে, তাই মা এসব হিংসায় ভাবতো। এখনতো তুমি আমার জামাই জুনায়েদ। এখন এসব বলবে ক্যান? আম্মু ঘুমাচ্ছে কথাগুলো আস্তেধীরে বলো, মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলে এগুলা শুনলে কষ্ট পাবে। ”
“তো পাক না তোর মা কষ্ট? তোর মায়ের জানা উচিত অন্যকে অপমান করলে সেই অপমান নিজের গায়ে একদিন প্রতিশোধ রুপে লাগে। ”

“ নিমু কথা ঘোড়ানোর জন্য এসি অন করে দেয়। এরপরে জুনায়েদকে বলে তুমি ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নাও। আর কাপড়গুলি বাথরুমে রাখিও নাহলে তিলা ধরে নষ্ট হবে সাদা শার্ট। ”
“ জুনায়েদ ঠান্ডা শরবতে মুখে দিয়ে ওয়াক থু করে ফেলে দেয়। এরপরে নিমুকে বলে এটা কি বানিয়েছিস? এক গ্লাস শরবত ও ঠিকমতো বানাতে পারিস না? লবন কই শরবতে? চিনির পরিমাণ এতো ক্যানো? ”
“ নিমু বলে আমিতো চেক করে এনেছিলাম জুনায়েদ। সবইতো ঠিক ছিলো? ”

জুনায়েদ নিমুর এমন কথায় রেগে যেয়ে পুরো শরবতের পানি নিমুর মুখে ছিটিয়ে দেয়। এরপরে নিমুকে বলে, তুই জানিস না আমি মুখে মুখে তর্ক পছন্দ করিনা? এরপরেও তুই মুখে মুখে তর্ক করিস। বিয়ের আগেতো মর্ডান মর্ডান ড্রেস পড়ে ছেলেদের নজর কাড়তি। সংসারের কাজ কিছুই শেখায় নাই তোর মা? আমাকে বিয়ে করেছিস সংসারের কাজ ভালোমতে শিখেক নাহলে তোর জীবন জাহান্নাম করে দিব আমি।
“ নিমু জুনায়েদকে বলে জাহান্নামের আর বাকি রাখছো কই? গত পাচদিন থেকে তোমার কোনোকিছু ভালো লাগেনা আমার। কথায় কথায় তুই তোকারি, জিনিস ছুড়ে ছুঁড়ে গায়ে হাত তুলো। কখনো ভেবেছিলাম নিমুর এইদিন আসবে। যেই নিমু ছেলেদের হর্ণি করে দিত। সেই নিমুর দশা এখন গৃহবধূ। ”
” আবার কথা বলছিস? সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি আরেক গ্লাস শরবত দ্রুত বানিয়ে আনবি? ”

নিমু জুনায়েদের হাতে থাকা গ্লাসটা নিয়ে চলে যেতে লাগে। তখনি জুনায়েদ বলে এই শুন নিমু তোর মা দেখছি আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার নাম গন্ধ নাই। শশুড় মশায় প্যারালাইজড, তোর বাবাকে আর কতদিন মানুষ দেখবে? তোর বাবাকেও আনার ব্যবস্থা কর। নাহলে খুব দ্রুত বাবা হারা হয়ে যাবি। নিমু এতোসব ক্যাচালের মধ্যে বাবার কথা এভাবে ভাবেই নি। এখন নিমুর রাগ হচ্ছে তার মায়ের উপর। নিমু হনহন করে চলে যায়। জুনায়েদ একটা মুচকি হাসি দিয়ে উপরে চলে আসে। আর মনেমনে বলে তোদের মা মেয়ের জীবন জাহান্নাম করবে এই জুনায়েদ। সবকিছুর রিপিট হয় তোদের বুঝাবে হারে হারে। ইনিয়ার ছবিখানা বের করে বলে সুইটহার্ট মিস করছি। আমি শিউর আমাদের বাবু চলে এসেছে তোমার কোলে। এতো নিষ্ঠুর হইয়ো না প্রাণপাখি চলে আসো না বাবুকে নিয়ে। বাড়িতে কোন সার্কাস হচ্ছে একটু দেখে যাও না।

____

হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়েছে ইনিয়া আজ দুদিন হলো। এখন অনেকটা সুস্থ ফিল করছে ইনিয়া। ইশমামের বাড়িতে এসে অবাক হয়ে গেছিলো ইনিয়া। কারণ ইনিয়া সেই সংসার ত্যাগ করে চলে এসেছে? ইশমামের সংসার টা ঠিক সেভাবেই সাজানো গোছানো। কোনো ঝামেলা নাই। ইনিয়ার খুব কষ্ট হয়েছিলো প্রিয়ার অকালমৃত্যুতে। ইনিয়া সবকিছু ইশমামের মুখে শুনে অবিরত চোখের পানি ফেলছে। একদিকে স্ত্রী হারানোর বেদনা অন্যদিকে তাকে নতুন জীবন দেওয়া। একজন পুরুষ বলেই এতো নিঠুর মনের হতে পারছে। ইশমামের জায়গায় ইনিয়া নিজেকে কল্পনা করলে ইনিয়া নিজেকে বিগ জিরো দিত। কারণ নিজের প্রিয় জিনিসকে হারিয়ে ইনিয়া কখনো অন্যকে নতুন জীবন দিতে পারবো না। ইনিয়া নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছে লাইফে এরকম বন্ধুর দেখা পেয়ে। কিন্তু ইশমামের মুখের দিকে ইনিয়া দৃষ্টি ফেলতে পারেনা। কারণ লোকটার মুখে হাসি নাই, চোখ সবসময় লাল। এসব কষ্ট ইনিয়া কোনোভাবেই দেখতে পারছেনা।

রাহা কান্না করতেছে। ইনিয়া সম্পূর্ণ রুপে ভাবনার জগতে বিলীন হয়ে গেছে। রাহার কান্না ইনিয়ার কান অব্দি আসছে। রাহার কান্নার শব্দ শুনে ছুটে আসে ইশমাম। এসে দেখে মা সামনে অথচ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছেনা। ইনিয়ার এমন গা ছাড়া ছাড়া ভাব দেখে ইশমাম কিছুটা কষ্ট পায়। মনেমনে আন্দাজ করে নাড়ির টান নেই বলে রাহার কান্নার ভাজ পেয়েও তাকে আদর করে এখনো কোলে নেয়নি।

ইশমাম গলা খাকাড়ি দিয়ে রুমে প্রবেশ করে। ইশমামের খাকাড়িতে ইনিয়া ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে আসে। রাহার কান্নার আওয়াজ কানে পড়ে। রাহাকে দ্রুত কোলে তুলে নেয়। এরপরে রাহাকে বলে কাঁদছো ক্যান মা? এইতো কিছুক্ষণ আগেই পেটভরে দুধ দিলাম তোমাকে? এরই মধ্যে তোমার ঘুম হয়ে গেছে। এতো দুষ্টু কেনো তুমি? আম্মুকে একটুও স্বস্তি দেওনা। পঁচা মেয়ে মানুষ আম্মুকে এতো জ্বালায়।

ইশমাম ইনিয়াকে বলে কিছু মনে করবেন না ইনিয়া। আসলে রাহার কান্নার ভাজ পেয়ে হুট করে নক না করে আপনার রুমে ঢুকে পড়েছি। ক্ষমা করবেন, ভেবেছিলাম আপনি হয়তো রাহার কাছে নেই। এরজন্য রাহা কাঁদতেছে । তাই তড়িঘড়ি করে মেয়ের কাছে এসেছিলাম।

“ এভাবে বলবেন না? এটাতো আপনার বাড়ি। তাহলে আমাকে এসব বলে কুন্ঠিতবোধ করবেন না। আপনার কাছে আমি ও আমার মেয়ে চির ঋণি। জানিনা এই ঋণের মূল্য পরিশোধ করবো কিভাবে? ”
“ এভাবে ভাববেন না। মনে মনে ইশমাম বলে আমিও যে আপনার কাছে চিরঋণি। আমার মেয়ে যে আপনার মতো মা পাবে কখনো কল্পনাই করিনি। আমি যে অপরাধ করে ফেলেছি এখনো আপনাকে সত্যিটা না জানিয়ে। যেদিন সত্যিটা জানবেন, সেদিন কি এভাবে ভাববেন আমাকে নিয়ে? ”

ইনিয়া ইশমামকে বলে কি দেখছেন এভাবে। দয়া করে একটুও বাইরে যান। বাবুর ক্ষুধা লেগেছে।
“ হ্যা! হ্যা! যাচ্ছি। এই কথা শেষ করেই ইশমাম দ্রুত বাইরে চলে যায়। ”

“ ইনিয়ার রাহাকে দুধ দিয়ে বলে, তোমার বাবা থাকলে ঠিক এভাবেই তোমার খোঁজ নিতো মামুনি। কিন্তু তোমার বাবা পঁচা মামুনি। আমি চাইনা সেই পঁচা লোকের সঙ্গে তোমার পরিচয় হোক। এতদিন হয়ে গেলো তবুও সেই লোক তোমাকে আমাকে খোঁজার চেষ্টা করলো না। হয়তো সেই লোক নতুন সংসার নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত আছে যে, তোমাকে আর আমাকে মনেই পড়ছেনা। খাও মা দুধ খাও। ”

#চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে